কয়েকদিন ধরেই অপেক্ষা করছি আমি, পত্রিকা-ব্লগ, সামাজিক সাইট উল্টে – পাল্টে দেখছি, কেউ অন্তত বলুক মনের কথা গুলি। এত সুলেখক আমাদের দেশে, নিশ্চয়ই তাদের মধ্যে কেউ আমার মত করেই ভাবছেন। আর সেই কথা গুলিই আমার চাইতেও সুন্দর করে লিখতে পারবেন তিনি। কিন্তু নাহ, হতাশ হচ্ছি বারবার, অগত্যা নিজেকেই কলম ধরতে হল।
ঠিক এই সময়টাতে, চরম বিভক্তির এই দিনগুলিতে, একটা জায়গায় আমরা সবাই এক, একবাক্যে সবাই স্বীকার করছি “দেশে ঘোর দুর্দিন যাচ্ছে”।
কিন্তু এই এক হওয়াটা কোনভাবেই একাত্মতা প্রকাশ করে না, কারণ যে যে যার মত করে খারাপ সময় কাটাচ্ছে। সরকার খারাপ সময় কাটাচ্ছে প্রতিকুল পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে গিয়ে, বিরোধী দল খারাপ সময় কাটাচ্ছে অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করতে গিয়ে, জনগণ খারাপ সময় কাটাচ্ছে এই দুই পরিস্থিতির শিকার হয়ে। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে পরিস্থিতি মোকাবেলা করবে কে? কে এই দুঃসময় থেকে দেশটাকে বের করে নিয়ে আসবে?
বেশির ভাগ মানুষই রাষ্ট্রের যাবতীয় দায়–দায়িত্ব সরকারের কাঁধে তুলে তাদের দিকেই আঙ্গুল তুলে বলছেন “সরকারকেই এই পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হবে”। অবশ্যই, সরকারের দায়িত্ব এখানে সবচাইতে বেশি। কিন্তু, সত্যটা হচ্ছে, সরকার সফলভাবে সেটা পালন করতে পারছে না।
তাহলে আমরা আমজনতা কি করতে পারি? বসে বসে সরকারের ব্যর্থ প্রচেষ্টার চিত্র দেখব? নাকি সরকার ব্যর্থ এই দাবী তুলে সরকারকে নেমে যেতে বলব? সরকার নেমে গেলেই কি সমস্যার সমাধান হবে?
অনেক সমস্যার মাঝে, খুব রিসেন্ট একটা ঘটনার কথা বলা যাক। গতকাল তিন ব্লগারকে ডিবি-পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছেন। এটা সুস্পষ্ট যে তাদের আটকের পিছনে “ধর্ম ভিত্তিক লেখা” একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। অনেকেই এই গ্রেফতারকে রাজনৈতিক কৌশল ভাবছেন। “আমার ব্লগ” নামক ব্লগের এক্সেস পাওয়া যাচ্ছে না।
ধারনা করা হচ্ছে “আমার ব্লগ” কে ব্লক করা হয়েছে। এই পদক্ষেপ বাক – স্বাধীনতা ও মুক্তচিন্তার পরিপন্থী অভিযোগ করে দেশের ব্লগস্ফিয়ারে হইচই পড়ে গেছে। নিজেদের মধ্যে বিভক্তি থাকলেও ব্লগগুলি একসাথে পরিস্থিতি মোকাবেলার চিন্তা করছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে সরকার বাক – স্বাধীনতার উপরে হস্তখেপ করছে কেন? যুদ্ধপরাধের বিচারের মত কঠিন একটা বিষয়ে জনমত তৈরি করে এই ব্লগাররাই কিন্তু সরকারকে দুঃসময়ে সহায়তা করেছেন। এর প্রতিদান এত নির্মম কেন?
এই উত্তর জানতে হলে, আমাদের একটু পেছনে ফিরতে হবে।
বাংলাদেশের ব্লগের ইতিহাস বেশ ক-বছর হয়েছে। খুব অল্প সময়েই ব্লগ বেশ জোরালো একটা কণ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার মানে এই না যে, যারা ব্লগ লেখেন তারা সবাই শক্তিশালী লেখা লেখেন। ব্লগে যে কেউ যে কোন বিষয়ে লিখতে পারেন। এবং অনেক ব্লগারই ব্লগের প্ল্যাটফর্ম কে নিজের স্বার্থ সিদ্ধির কাজে লাগান।
কোন ব্যক্তি অথবা কোন বিষয় আমার অপছন্দ, লিখে দিলাম দু-কলম, সেটা শেয়ার হতে থাকল, মানুষ জানতে থাকল, আমার পক্ষে মতবাদ তৈরি হতে থাকল, অনেকে আমার বিপক্ষেও কথা বলল, দুটি দল হল। আমার লাভ হল যে, আগে আমি একা ছিলাম, এখন বন্ধু পেলাম, সহযোদ্ধা পেলাম। ভালো কাজ, খারাপ কাজ সব কাজেই সহযোগী চায় সবাই। এবং ব্লগে যারা অনেকদিন ধরে লেখেন তার সবাই কোন না কোন ভাবে একটা দলের অংশ। হতে পারে ব্লগার সেখানে নেতা, আর পাঠকরা তার সমর্থক।
এই স্বাধীন সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন ব্লগে ধর্মীয় মূল্যবোধকে আঘাত করে লেখালেখি হয়ে আসছিল এটা সত্যি। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন, নাস্তিকতা কখনোই ধর্মীয় মূল্যবোধের জন্য আঘাত নয়। একেশ্বরে, বহু ঈশ্বরে এবং ঈশ্বরহীনতায় মানুষের বিশ্বাস থাকতেই পারে, কিন্তু একেশ্বরবাদী যেমন বহু-ঈশ্বরবাদীর বিশ্বাস কে আঘাত করে কথা বললে সেটা ধর্মান্ধতা, তেমনি ঈশ্বরে যার অবিশ্বাস সেও কারো ধর্মবিশ্বাস কে আঘাত করে কথা বললে সেটা ধর্মবিদ্বেষ। এবং দুটোই সমাজে অস্থিরতা, অরাজকতা, হানাহানি তৈরি করে। আজ বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা বেশি বলে, এদের প্রতিক্রিয়া চোখে পড়ে (এবং তাদের প্রতিক্রিয়াশীল বলা হয়), যেদিন অবিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা বেশি হবে, সেদিন তাদের প্রতিক্রিয়া চোখে পড়বে, এবং তখন তাদেরকে প্রতিক্রিয়াশীল বলে মনে হবে।
এই রকম মুখোমুখি অবস্থা কখনোই কাম্য নয়। এর মন্দ দিক বহুমুখী। শাহবাগ আন্দোলনের যারা বিরোধিতা করেছিল, তাদের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার ছিল কতিপয় ব্লগারের ধর্মবিদ্বেষী মনোভাব। সবাই জানত শাহবাগের প্রথম সাড়িতে ব্লগাররা রয়েছেন। সাধারণ ধর্মপ্রান মানুষগুলিকে কিছু ধর্মবিদ্বেষী ব্লগারের লেখা পরিয়ে তাদেরকে শাহবাগের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলা হয়, যার প্রতিফলন আমরা সাময়িক ঘটনা গুলিতে দেখেছি।
অথচ সত্যটা হচ্ছে শাহবাগে ধর্ম বিদ্বেষী ব্লগারের সংখ্যা ছিল অতি নগণ্য। ধর্মবিদ্বেষী ব্লগারদের বেশির ভাগই দেশের বাইরে থাকেন।
শাহবাগ এই পরিস্থিতির শিকার হয়েছে। এখন ব্লগগুলিও এই পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে। এই রকম অবস্থা থেকে অতিসত্তর বের হয়ে আসতে হবে।
নাহলে এর ফল আরও ভয়াবহ হতে পারে। এই অবস্থা মোকাবেলা করবার জন্য একটা ব্লগকে বন্ধ করে দেয়া কখনোই সঠিক পদক্ষেপ হতে পারে না। একমাত্র সচেতনতাই পারে এরকম পরিস্থিতি থেকে মুক্তি দিতে।
যারা ব্লগ লিখছেন, ব্লগ নিয়ন্ত্রণ করছেন, তাদেরকেই দায়িত্ব নিতে হবে। তাদেরকেই নিশ্চিত করতে হবে, যেন নিজের ব্লগপোস্ট অথবা নিজেদের ব্লগ প্ল্যাটফর্ম থেকে ধর্মান্ধ অথবা ধর্মবিদ্বেষী কোন লেখা প্রকাশিত না হয়, কোন ব্যক্তি বা দল যেন কোন লেখা ব্যাবহার করে কাউকে আঘাত বা উস্কানি দিতে না পারে।
এই দায়িত্ব ব্লগারদেরই। সরকারের কাঁধে দায়িত্ব তুলে দেয়া মানে হচ্ছে নিজের কণ্ঠে সরকারের আঙ্গুল তুলে নেয়া, যেখানে সরকার যখন ইচ্ছা কণ্ঠরোধ করে দিতে পারবে। একটা স্বাধীন দেশে এমন কণ্ঠরোধ কখনোই কাম্য নয়। এই কণ্ঠরোধের প্রতিবাদ এবং প্রতিকার চাই ব্লগারদের কাছ থেকেই !!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।