সুখ চাহি নাই মহারাজ—জয়! জয় চেয়েছিনু, জয়ী আমি আজ। ক্ষুদ্র সুখে ভরে নাকো ক্ষত্রিয়ের ক্ষুধা কুরুপতি! দীপ্তজ্বালা অগ্নিঢালা সুধা জয়রস, ঈর্ষাসিন্ধুমন্থনসঞ্জাত,সদ্য করিয়াছি পান—সুখী নহি তাত, অদ্য আমি জয়ী।
শুরু করেছিলাম ব্লগার স্বদেশ হাসনাইনের একটি কবিতার প্রেক্ষিতে কবির দায়বদ্ধতা নিয়ে একটা পর্যালোচনমূলক লেখা লিখে। তারই ধারাবাহিকতায় আজকের এই লেখার সূত্রপাত। স্বনামধন্য লেখক হুমায়ূন আহমেদের সুত্র ধরে দুই কিস্তিতেএই লেখাটির প্রসব।
প্রায় ২১ বছর আগে ১৯৯১ সালের মাঝামাঝি সময়ে তৎকালীন সাপ্তাহিক বিচিত্রায় হুমায়ূন আহমেদের এক সাক্ষাৎকার প্রকাশের সেই কপিটি ঘটনাচক্রে আমার হাতে এলো। দীর্ঘদিন ধরেই হুমায়ূন আহমেদের উত্থান লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। লেখক হিসেবে তিনি ক্রমশঃই নিজের আসন তৈরী করে নিয়েছেন, তাঁর পরিচিতি এখন আকাশচুম্বী, ফলে পত্রিকা সাংবাদিকরা তাঁকে নানা প্রশ্ন করেছেন, কিন্তু কোথাও তিনি মন খুলে সেসব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন বলে মনে হয়নি। এমন সময় বিচিত্রার সাক্ষাৎকারই প্রথম সিরিয়াস কিছু বলে মনে হয়। এই প্রথম হুমায়ূন আহমেদ নিজেকে মেলে ধরার সুযোগ গ্রহণ করেছিলেন।
কারণ সম্ভবতঃ এর আগের সাক্ষাৎগ্রহীতাদের উপর হুমায়ূন আহমেদ আস্থা রাখতে পারেননি। কারন প্রাগুক্ত সাক্ষাৎকারে “নির্মুল” থিওরীতে বিশ্বাসী শাহরিয়ার কবির স্বভাবতঃই যথেষ্ঠ পোক্ত আর অবজেকটিভ অবস্থান নিয়ে হাজির ছিলেন। হূমায়ূন আহমেদকে তিনি কথা বলতে দিয়েছেন, বলিয়েছেন, তা তাঁর পছন্দের কথা না হলেও।
পরবর্তীতে এই সাক্ষাৎকারের প্রক্রিয়ায় পরের মাসের সাপ্তাহিক “খবরের কাগজ”-এ শান্তনু কায়সার এক কড়া সমালোচনা প্রকাশ করেছিলেন।
আমাদের 'কমিউনিস্টদের' স্বভাব হলো যে ঘটনা ব্যাখ্যা করতে পারি না, তাকে হাসিঠাট্টা দিয়ে তুচ্ছজ্ঞান করে তার গায়ে কালি লাগিয়ে দেই।
হুমায়ূন আহমেদের উত্থান সে ধরনের একটা ঘটনার ভিতর দিয়ে ঘটেছিল।
কমিটমেন্ট বা দায়বদ্ধতার কথা বলে সংবেদনশীল লেখক হত্যার যে পরিবেশ আমরা গড়ে রেখেছি, তাকে অতিক্রম করে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন হুমায়ূন আহমেদ। কমিউনিস্টদের তৈরী পরিবেশ, ছাঁচ ও আকাঙ্খার বাইরে উত্থিত হয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ। বলা যায়, এই উত্থান কমিউনিস্টদের হাতছুট ঘটনা। তাই একে ব্যাখ্যা করতে প্রচন্ড বেগ পেতে হয়েছে এবং হচ্ছে তাদের।
তরুণ প্রজন্মকে নিরুৎসাহিত করতেও শুনেছি কমিউনিস্ট বাবা-মা’দের, যেন তারা হুমায়ূন আহমেদ না পড়ে।
এই রচনায় হুমায়ূন আহমেদের প্রতি আমার সহানুভূতি প্রকাশ পেয়েছে। হুমায়ূন আহমেদ বড় মাপের লেখক কি না এটা আমার কাছে মূখ্য প্রশ্ন নয়। যে প্রতিকূল পরিবেশে লড়াই করে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন, সেটার প্রতিই আমার সহানুভূতি। দ্বিতীয় যে কারণে তাঁর প্রতি সহানুভূতি প্রকাশিত হয়েছে তা হলো,তাঁর লেখার সাবজেক্ট মানুষের মন।
কমিটমেন্টের কথা তুলে মন নিয়ে আমরা এ পর্যন্ত কাউকে লিখতে দেইনি। হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন। এর তাৎপর্য গভীর! আমরা এটাকে ধরতে না পেরে লেবেল এঁটে দিয়েছি- তিনি "মধ্যবিত্তের স্বপ্নের সওদাগর"।
তবু হুমায়ূন আহমেদ এই লেখাটির মূল বিষয় নয়। কমিটমেন্টের কথা বলে আমরা কি ভাবে সংবেনশীল লেখকদের উত্থানরহিত পরিবেশ তৈরী করে রেখেছি, তার দিকে দৃষ্টি ফেরানোই এর লক্ষ্য।
এই আচরণ যেমন নিষ্ঠুর, তেমনি অমানবিক। এ ব্যাপারে আমরা সতর্ক থাকলে এতদিনে আরও অনেক হুমায়ূন আহমেদ আমরা পেতাম।
হুমায়ূন আহমেদ বড় মাপের লেখক কি না সেই সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর সময় শেষ হয়ে যায়নি। সে প্রশ্ন তুলে রেখে বড় লেখক তৈরীর পরিবেশ রচনায় দু’কদম এগিয়ে আমরা নিজেদের পুণর্গঠিত করে নিতে কি পারি না?
সংবেদনশীল লেখকদের উপর কমিউনিস্টদের সর্বশেষ আঘাত হেনেছিলেন শান্তনু কায়সার। সংবেদনশীলতার প্রাণ সংহারের ক্ষেত্রে ‘কমিউনিস্টদের’ যোগ্য প্রতিনিধি হিসাবেই তিনি এ কাজ করেছিলেন।
উপন্যাসিক, নাট্টকার হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয়তাকে ব্যাখ্যা করতে অপারগ শান্তনু কায়সার তাই যতবার কালি লাগিয়ে তুচ্ছ করা যায়, সেই উদ্যোগ নিয়ে তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন তৎকালীন সাপ্তাহিক খবরের কাগজে। কমিউনিস্টদের তৈরী ছাঁচের বাইরে উত্থিত এই লেখককে ছাঁচে ঢুকানো অথবা নাকচ করে ফেলা- এর যে কোন একটি অবস্থায় ফেলে দেওয়াই এর লক্ষ্য। ‘কমিউনিস্টদের’ আকাঙ্খিতরূপে কেউ ‘কমিটেড লেখক’ না হলে তার প্রতি শান্তনু কায়সারদের এই আচরণকে প্রাণ সংহারী বললে কম বলা হয়। নিজের বোধ উপলব্ধি আর বিশ্বাসের উপর ভর করে ন্যুনতম সংবেদনশীল একজন লেখক হিসেবে বিকশিত হওয়ার ক্ষেত্রে ‘কমিউনিস্টদের এই সরব উপস্থিতি সবচে’ বড় বাধা হিসেবে কাজ করছে।
কবি সাহিত্যিক লেখক মাত্রই সংবেদনশীল।
সংবেদনশীলতাই তাঁর প্রাণ। জীবনকে বিচিত্র রকমভাবে আর বিভিন্ন দিক থেকে উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে এই সংবেদনশীলতাই লেখকের মৌলিক সত্ত্বা, তার প্রাথমিক গুন। তাঁর মনন ও সৃষ্টিশীল তৎপরতার পূর্বশর্ত। সামাজিক ঘটনাবলী সম্বলিত সংবেদনী তার মন-ক্যামেরা খুঁটিনাটিসহ নিখুঁত ইমেজ তৈরী করে চলে। আন্দোলিত করে তাকে।
বাংলাদেশের লেখকেরা এই মৌলিক সত্ত্বায় পুরোপুরি আস্থা রেখে বেড়ে উঠতে পারেন নি। “আমরা মূলত বাঙালী”- এই বোধ নিজের মধ্যে এবং সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠালাভ করার সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ার কালে ষাটের দশক থেকেই অর্থাৎ জাতীয়তাবোধ অবলম্বন করে আমাদের উন্মেষের কাল থেকেই লেখকদের এই আস্থাহীনতা কমবেশী শুরু হয়। সে সময় থেকেই তাঁদের মনে হয়েছে তাঁদের সংবেদনশীল সত্ত্বা যে উপলব্ধি তাঁদেরকে দিচ্ছে, এটাই আসল বা সব নয়। জীবনকে দেখার বা ব্যাখ্যা করার কোন এক ফর্মুলা বা পদ্ধতি রয়ে গেছে তাঁদের সংবেদনশীলতার শক্তি ও তার কার্যকারীতার বাইরে। 'কমিউনিস্টদের' হাতে যা গড়ে উঠেছে।
সেই পদ্ধতি দিয়ে জীবনকে উপলব্ধি আর এর বিচিত্রতা অনুসন্ধান করতে হবে। বাস্তব জীবনকে লেখক যত বিচিত্র ভাবে দেখছেন, তা তাঁর সংবেদনশীলতায় যে ভাবে ধরা পড়ছে, তাই নয়; এর উপরে নির্ভর করে নয়; বাইরে থেকে ঢুকানো হাতের মতো এক চিন্তা পদ্ধতি দিয়ে জীবনকে ব্যাখ্যা ও উপলব্ধি করার প্রচেষ্টাই যেন বা ভালো লেখক হবার পদ্ধতি। একে আমরা সকলে ‘প্রগতিশীলতা’ ব’লে জেনেছি। ‘প্রগতিশীল’ হওয়ার লোভে লেখকেরা কখন তাঁদের মৌলিক সত্ত্বার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ফেলেছেন, তা আর তাঁদের খেয়ালই পড়ে না।
এটা ভাবা ভুল হবে যে লেখকেরা এরকম আত্মহত্যার পথ নিজেরাই নিজেদের জন্য বেছে নিয়েছেন।
এই পথ অবলম্বনে তাঁরা বাধ্য হয়েছেন। বলা ভালো, যে পরিবেশে তাঁদের লেখক-জন্ম ও বসবাস, ওই পরিবেশের সামাজিক চিন্তা পদ্ধতির মূলধারা প্রবাহিত হয়েছিল ‘কমিউনিস্টদের’ চিন্তা-পদ্ধতির আধিপত্যে। এই আধিপত্য কেবল আধিপত্য হিসেবে কোন দোষের ছিল না। চিন্তার কাজই হলো আধিপত্য বিস্তার করা। তবে ‘কমিউনিস্টদের’ চিন্তা-পদ্ধতি এমন কিছু প্রশ্ন লেখকদের সামনে ছুঁড়ে দিয়েছিল যে এর উত্তর না দিয়ে প্রগতিশীল লেখক হওয়া দূরে থাকুক, লেখক হিসেবে নিজের সামাজিক উপস্থিতির ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত রাখাও কঠিন ছিল।
লেখকেরা উত্তর দিতে পারলে প্রগতিশীল লেখক হতেন আর না দিতে পারলে নিজের লেখক সত্ত্বা প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব ছিল। নাকচ হয়ে যেতেন। ‘কমিউনিস্টদের’ এ প্রশ্নগুলো ছিল এরকমঃ সমাজ ও রাজনীতির প্রতি লেখকের অঙ্গীকার ও দায়বদ্ধতা আছে কি না; কাদের জন্য লেখেন; কেন লেখেন- ইত্যাদি। এসব বিষয় এখনও বহাল আছে। সাধারণভাবে এর উত্তর ইতিবাচকভাবে পেলে ‘কমিউনিস্টরা’ এদের “কমিটেড লেখক” শিরোনামে প্রগতিশীলতার খাতায় তাঁদের নাম লিপিবদ্ধ করার ঘোষনা দেন।
কোন সমাজের বিকাশের স্তরে এধরনের প্রশ্ন করতে শেখা অগ্রসরতার লক্ষণ, সন্দেহ নেই। প্রশ্নগুলো তাই লেখকদের ভাবনায়ও ফেলেছিল। লেখকেরাও নিজেদের এই প্রশ্ন করে সচেতনতার একটা ধাপে নিজেদের উত্তরন ঘটাতে আন্তরিকভাবেই চেয়েছিলেন। কিন্তু সে সব আত্মজিজ্ঞাসা নিজেদের ভিতর ফয়সলা হবার আগেই লেখকেরা এর উত্তর রেডিমেট পেয়ে গেছেন, বা বলা চলে তাঁদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে এক যান্ত্রিক ফর্মুলা আকারে। ইতিহাস, সমাজ, উৎপাদন সম্পর্ক ব্যাখ্যা করার নামে এই ফর্মুলা ‘কমিউনিস্টরা’ লেখকদের হাতে হস্তান্তরিত করেছেন।
এই ফর্মুলা দিয়েই কমিউনিস্টদের নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গী, রণনৈতিক কৌশল তৈরী। এই যান্ত্রিক পদ্ধতি ‘কমিউনিস্টদের’ বিকশিত হওয়ার ক্ষেত্রে যতটা না তাদের সীমাবদ্ধ ক’রে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, তার চেয়েও ঢের বেশী ক্ষতি করেছে লেখক-সাহিত্যিকদের।
সাধারণভাবে এই চিন্তা পদ্ধতি যান্ত্রিক, ইতরোচিত বস্তুবাদী এক চিন্তাপদ্ধতি। স্থান কাল পরিস্থিতি নির্বিশেষে এই ব্যাখ্যা পদ্ধতি মানুষের সমাজবদ্ধ জীবনযাপন থেকে শুরু করে পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কে তার প্রবেশ, উত্তরণ ও তৎজাত সংকট- এইসব কিছুই অবশ্যম্ভাবী ভাবে ঘটেছে বা ঘটবে- এমন ছকবাঁধানো কিছু সামাজিক উৎপাদন প্রণালী (সম্পর্ক) হিসাব সূত্রবদ্ধ করে এবং ব্যাখ্যা করে। আদিতে আদিম সমাজ, তারপর দাস সমাজ, সামন্ত সমাজ, পূঁজিবাদ সমাজ এবং সবশেষে সমাজতন্ত্র- এভাবে এই ব্যাখ্যা নিজেকে সূত্রবদ্ধ করে।
পৃথিবীর সব দেশের ইতিহাসই যে এভাবে ছকবদ্ধভাবে আবর্তিত হচ্ছে- এ ব্যাপারে এদের আর কোনই সন্দেহ নেই! তারা একেবারে সুনিশ্চিত! সমাজ সচেতন বা ‘কমিটেড লেখকদের’ তারা এ ব্যাখ্যা মেনে নিতে বাধ্য করতে পেরেছেন। সেই সাথে লেখকদের কর্তব্যও প্রকারান্তরে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। এইগুলো হলো এইঃ
(১) ছঁকবাধা সমাজ আবর্তনের ব্যাখ্যার ভিতরে সমাজের ঘটনাপ্রবাহকে দেখতে অভ্যস্ত হওয়া, (২) লেখকের রচনার কাঠামোগত দিক যেন এই ধারাবাহিকতাকে নির্দেশ করে, (৩) শেষ বিচারে রচনার উদ্দেশ্য যেন হয় এই ছকবাঁধা সমাজ বিবর্তনের তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করা, (৪) লেখকের কালজয়ী রচনা হবে সেটাই যেটা এই সমাজ বিবর্তনের পূর্বনির্ধারিত যান্ত্রিক বিভাগগুলো অনুসরন ক’রে ইতিহাসবোধকে প্রতিষ্ঠা দেবার জন্য আমাদের পুরানো দিনের ইতিহাস ঘেঁটে তথ্য সংগ্রহ করবে এবং সে অনুযায়ী পাত্র-পাত্রীর মুখ দিয়ে গল্প বলিয়ে সেই ছকবাঁধা ধারাবাহিকতা তুলে ধরবে।
এই বক্তব্যের সবচেয়ে উপযুক্ত এবং প্রতিনিধিত্বমূলক উদাহরণ হলো সম্ভবতঃ মহাশ্বেতা দেবীর লেখা “চোট্টি মুন্ডা ও তার তীর” উপন্যাসটি। পশ্চিমবঙ্গের এই লেখিকা শুধু নিজ দেশে নয়, এদেশেও কমিউনিস্টদের কাছে আদর্শ উপন্যাসিক।
শান্তনু কায়সারও হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে লিখতে যেয়ে উদাহরণ হিসেবে মহাশ্বেতা দেবীকে টেনেছিলেন। “মহাশ্বেতা দেবী আদিবাসীদের মধ্যে বসবাস করেন”- এ কথা খুবই গর্বের সঙ্গে তিনি আমাদের জানিয়েছিলেন। মহাশ্বেতা দেবীদের আদিবাসীদের কাছে যাবার আসল কারণ হলো- এমন অনেক সমাজ সভ্যতা আছে যেখানে আদিতে আদিম সমাজের লক্ষণ ছিল বলে প্রমাণ করা যায় না। সেই সব সমাজকে ফর্মুলায় ফেলে ব্যাখ্যা করা “আদিম সমাজবাদী” তাত্ত্বিকদের জন্য সমস্যা। সেই সমস্যা মোকাবেলায় মহাশ্বেতা দেবী সিদ্ধহস্ত হয়ে এমনভাবে তাঁর উপন্যাস সাজালেন, যেন আদিবাসী সমাজ (সাঁওতাল বা কখনও চা বাগানের জীবন) হয়ে উঠে এর উদাহরণ।
“চোট্টি মুন্ডা ও তার তীর” এর পাত্র-পাত্রী তাই আদিবাসী সমাজ থেকে তার যাত্রা শুরু করে। আর এটা শেষ হয় ১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধীর মিসা আইনের শাসনকালে। মহাশ্বেতা দেবী এই প্রয়োজনেই আদিবাসীদের জীবন গভীরে পর্যবেক্ষণে গিয়েছেন। তাই অন্ততঃ দু’টো কারণে মহাশ্বেতা দেবীর এই উদ্যোগ সমর্থনীয় নয়। প্রথমতঃ কোন আদিবাসী উপজাতীয় সমাজ স্ব-ব্যাখ্যাতেই মূল সমাজ নয়।
সমাজের মূল ধারার পাশাপাশি তবে পিছিয়ে থাকা এবং মূলধারার প্রভাবান্বিত এক সমাজ। এটা কখনই মূল সমাজের পুরানো রূপ বা এর উদাহরণ নয়। দ্বিতীয়তঃ মহাশ্বেতা দেবী আদিবাসীদের কাছে গিয়েছেন একটা পূর্বনির্ধারিত ধারণাকে প্রতিষ্ঠা দেবার প্রয়োজনে। তিনি ‘কমিটেড লেখক’ হিসাবে ‘কমিউনিস্টদের’ ব্যাখ্যাকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়েছেন। এটা কোন উপন্যাসিকের কাজ নয়।
এটা বড়জোড় একটা ভাড়াটে ঐতিহাসিকের কাজ, যিনি ‘কমিউনিস্টদের’ মনগড়া ইতিহাসবোধকে সত্যি বলে প্রতিষ্ঠা দেবার প্রয়োজনে ছকবদ্ধ ধারনায় ইতিহাসের মালমসলার খোঁজে আদিবাসীদের কাছে গিয়েছেন।
কাজেই মহাশ্বেতা দেবীর আদিবাসীদের কাছে যাওয়া মোটেও কোন গৌরবময় ঘটনা বা কোন লেখকের আদর্শ উদাহরণ নয়। সমরেশ মজুমদারের ‘কালবেলা’ থেকে ‘কালপুরুষ’ উপন্যাস দু’টো এই একই আদর্শ থেকে লেখা। এর প্রেক্ষিত নকশাল রাজনীতি আর বুর্জোয়া কংগ্রেস। শুধু ‘কালবেলা’কে ডক্যুমেন্টারী হিসেবে হয়তো মাফ করে দেওয়া যেত, কিন্তু ‘কালপুরুষ’ পর্যন্ত গিয়ে যেভাবে লেখক বস্তিবাসীদের সমাজতন্ত্র অর্থাৎ দারিদ্রের বন্টন করে সমস্যার সমাধান টেনেছেন, তা পেটিবুর্জোয়া সমাজতন্ত্রের এক আদর্শ এবং অনন্য উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
‘কমিউনিস্টদের’ রাজনৈতিক কর্মসূচী, চিন্তা ভাবনাকে পাত্র-পাত্রী সাজিয়ে গল্প ব’লে প্রচারে নিয়ে যাওয়া উপন্যাসিকের কাজ নয়। রাজনৈতিক দলের কর্মসূচী প্রচার আর উপন্যাস লেখা এক কাজ নয়।
যান্ত্রিক ইতরোচিত বস্তুবাদী চিন্তা পদ্ধতির তৈরী ‘কমিটেড লেখকদের’ আদর্শ উদাহরণ পশ্চিমবঙ্গ থেকে দিলেও এটা সমভাবে বাংলাদেশেও প্রযোজ্য এবং বাংলাদেশেও এগুলো আদর্শ উদাহরণ। সেলিনা হোসেনের চা বাগান নিয়ে লেখা উপন্যাস একই প্রবণতার সাক্ষী। সৈয়দ শামসুল হক-এর “বৃষ্টি এবং বিদ্রোহীগণ”, শওকত আলীর “প্রদোষে প্রাকৃতজন” এসবই কাঠামোগতভাবে ‘কমিউনিস্টদের’ সমাজ ইতিহাস, উৎপাদন সম্পর্ক সংক্রান্ত বোধকে প্রতিষ্ঠা দেবার প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখেই লেখা।
‘কমিটেড লেখকদের’ পরিণতি
সার অংশে বললে ‘কমিটেড লেখক’দের মধ্যে আমরা যা লক্ষ্য করি তা হলো- শুরুতে সংবেদনশীলতা ছিল লেখক হিসেবে তার মৌলিক সত্ত্বা। যার গুনে সামাজিক ঘটনাবলীতে তাঁরা পীড়িত হতেন। তাঁর ভিতরে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া হতো। ফলাফলে সেই মনন-প্রক্রিয়া সৃষ্টিশীল প্রকাশে হাজির হতো। অনেক সময় এই প্রকাশ প্রচলিত মত ও বোধের বিরোধী হয়ে যেতে পারে।
তা প্রচলিত মত ও মূল্যবোধের বিরোধী ব’লে লেখক কখনই এই বাস্তবতার দিকে পিঠ ফিরিয়ে থাকতে পারেন না, থাকেনও না। লেখক অবশ্যই তা প্রকাশ করবেন। সমাজের চিন্তা পদ্ধতিতে সমস্যা জটিলতা থাকলে লেখকের অনুভবের সাথে এর অমীমাংসেয় এক বিরোধ থাকবে। এই বিরোধই সামাজিকভাবে আমাদের সকলকে জীবন্ত রাখবে। সমাজে তাগিদ অনুভূত হবে এই বিরোধ মীমাংসার।
অনুভবকে মরমে বিনাশ করলে সমাজের মনন ও সৃষ্টিশীল উদ্যমও বিনষ্ট হয়। আমরা আমাদের সংবেদনশীল লেখনী-অনুভবকে জীবন্ত রাখতে পারিনি। তবু প্রতিকুল সমাজ আর এর চিন্তা-পদ্ধতি এ কাজে আমাদের সহায়তা না করলেও কোন লেখকেরই তাঁর সৎ অনুভবকে উপেক্ষা করা ন্যায্য হতে পারে না। আমাদের লেখনী অনুভব অবশ্যই প্রকাশিত হতে হবে- তা সে যতই বিরোধাত্বক আর প্রতিকুল পরিবেশে বসবাস করুক না কেন। দার্শনিকদের আমরা দেখেছি তাঁদের নতুন চিন্তা সমাজের সাথে প্রবল বিরোধাত্বক হওয়াতে উপন্যাস আকারে তা লিখে রেখে যেতে।
প্রতিকুল সমাজে দার্শনিকেরা তাঁদের কোন নতুন চিন্তা ভাবনাকে হাজির রেখে যাবার প্রয়োজনে অথবা একে সহজ করে উপস্থাপনের সুযোগ নেবার জন্য এরকম উপন্যাস লিখে উপন্যাসিক হবার উদাহরণ বিস্তর পাওয়া যাবে। জ্যাঁ পল সাত্রে, কাফকা বা ভলতেয়ারের “কাদিদ” জাতীয় অনেক উপন্যাসই আমরা রচিত হতে দেখেছি। কিন্তু এখানে উল্টোভাবে উপন্যাসিকরা ভাড়াটে ঐতিহাসিক বা ইতিহাসবেত্তা হয়ে বসে আছেন। উপন্যাসে ইতিহাস নয়, মনগড়া ইতিহাসের ফাঁকফোকর পূরণ ক’রে সে ইতিহাসের পূর্ণ অবয়ব দেওয়া তো কোন লেখক-সাহিত্যিকের কাজই হতে পারে না। অঙ্গীকারবদ্ধতার নামে বাংলাদেশে আমরা তাই হতে দেখেছি।
এভাবেই এক বিশাল লেখক সাহিত্যিক পরিমন্ডল গড়ে উঠেছে ‘কমিউনিস্টদের’ মতাদর্শগত প্রভাবে। এভাবেই বাংলাদেশে এক গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়কাল পার হয়েছে। এই পর্যায়ে কেউই ‘কমিউনিস্টদের’ প্রভাব আর অঙ্গীকারের দাবীর বাইরে লেখক হিসেবে অর্থাৎ সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কেউ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারেন নি। ফলে আমরা এমন সব ‘প্রগতিশীল’ লেখকদের পেয়েছি যারা সংবেদনশীল মননে জীবন বৈচিত্র্য অনুভবের ক্ষমতাকে দমিয়ে রাখতে রাখতে লেখকের মৌলিক সত্ত্বাকেই হারিয়ে বসে আছেন।
একথা এখনও সত্যি ‘কমিটেড লেখক’ হিসেবে তালিকাবদ্ধ না হলে সমাজে লেখক হিসেবে জায়গা করে নেয়ার ক্ষেত্রে সমাজ এখনও প্রতিকুল।
তবে সুখের বিষয় হলো, সচেতনভাবে না হলেও অচেতনে নৈর্ব্যক্তিকতায় বস্তুর পরিবর্তনের স্বভাবগুনে এ পরিস্থিতির বদল ঘটছে। তবু গুরুত্বের দিকটা হলো এই বদল এখনও নিজেকে চিনতে বা চেনাতে শেখেনি।
হুমাযূন আহমেদের প্রবেশ
এমনই এক পরিস্থিতিতে হুমায়ূন আহমেদের উত্থান ঘটেছে। নিজেকে উপন্যাসিক আর নাট্টকার হিসাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করে জনপ্রিয়তার পরিচয় ঝুলিয়ে নিয়ে তিনি হাজির। এই লেখকের উত্থানের কালেও আমরা একইভাবে তাঁর কাছে অঙ্গীকারের প্রশ্ন তুলেছি।
তবে তারও আগে গুরুত্বহীন করার জন্য ‘মধ্যবিত্তের লেখক’, ‘স্বপ্নের ফেরীওয়ালা’ বলে তাঁকে পাশে ফেলে রেখে উপেক্ষা করতে চেয়েছি। কিন্তু বিপদে ফেলে দিয়েছে তাঁর বিপুল জনপ্রিয়তা। আমরা কিছুতেই আর তাঁকে উপেক্ষা করে চলতে পারিনি। আমরা এই জনপ্রিয়তাকে ব্যাখ্যা করতে পারিনি, ফলে কিছুতেই আর তাঁকে উপেক্ষা করে চলতে পারিনি। তাঁর ‘জনপ্রিয়তা’কে ব্যাখ্যা না করতে পারলে এ পরিস্থিতি আবার পুরনো স্থবির মৃতপ্রায় লেখক সাহিত্যিকদের সৃষ্টিহীনতাকে আরও সবলে প্রমাণ করে ছাড়বে।
তাই গত শতাব্দীর নব্বই দশকে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে এক বিরাট আলোচনার ঝড় উঠেছিল। তাঁর ‘অয়োময়’ কে নিয়ে বিতর্ক পরিণত হয়েছিল কেন্দ্রবিন্দুতে। হুমায়ূন আহমেদের উত্থানের কালে একই ভাবে তাঁকেও অঙ্গীকারের প্রশ্ন নিয়ে আমরা বিব্রত করতে গিয়েছি ঠিকই। কিন্তু লক্ষ্যণীয়, হুমায়ূন আহমেদ কখনই তাঁর অগ্রজদের মতো চট করে প্রশ্নের উত্তর দিতে যাননি। এমন কী ‘প্রগতিশীল’ লেখক হিসেবে খেতাব পাবার আগ্রহও আমরা তাঁর মধ্যে দেখিনি।
‘প্রগতিশীল’ হিসাবে আমরা যাঁদের জানি, তাঁদের মতন করে হুমায়ূন আহমদে ‘প্রগতিশীল’ নন।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, তাঁর উপন্যাসগুলো আর প্রথম দু’টো টিভি নাটক মুখোমুখি দাঁড় করাতে চেষ্টা করেছেন সাংবাদিক, সাক্ষাৎকারপ্রার্থী, তখনকার সাপ্তাহিকগুলোর সংস্কৃতি পাতার সমালোচক- সকলে। কিন্তু তিনি কখনই তাঁদেরকে স্পষ্ট স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। উত্তরগুলো এরকম- “দর্শক-পাঠকেরাই যা বিচার করে করবে”, এভাবেই থেকেছে। কখনও বা একেবারেই এড়াতে না পারলে দু’একটা কাটাকাটা মন্তব্যের বেশী কিছু তিনি বলেননি।
যেমন, তাঁর একটা রঙিন টেলিভিশন কেনার শখ ছিল তাই সেই প্রয়োজন মেটাতেই নাকি তিনি নাটক লিখেছেন। এ ভাবেই পাশ কাটিয়ে চলেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। অনেকে ভেবে নিয়েছিলেন এই ‘মধ্যবিত্তের’ লেখককে নিয়ে না ভাবলেও চলবে। এছাড়া এর এসব প্রশ্নের মুখোমুখি হবার সাহসও বোধহয় তাঁর নেই। কিন্তু না, সে ভুল তিনি যখন ভেঙ্গে দিলেন তখন বুঝা গেল এটা ছিল তাঁর উত্তর দেবারই একটা দীর্ঘ প্রস্তুতি।
তিনি উত্তর দিয়েছেন। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, তিনি তাঁর জনপ্রিয়তার মধ্য গগনে উঠে তারপর যখন “অয়োময়” সিরিজ নাটক হিসাবে শেষ হয়েছে, তখনই উত্তর দেবার ভালো সময় হিসাবে তিনি সেটাকে বেছে নিয়েছিলেন।
(পরের কিস্তিতে সমাপ্য)
শেষ কিস্তি এখানে
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।