আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মুভি রিভিউ: ব্লগার লাল দরজার ডকুমেন্টারী - অপরাজেয় বাংলা

স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতীক ভাস্কর্যের কথা বললেইসবার প্রথমে যে দৃশ্যটি ভে্সে উঠে চোখের সামনে তা হলো তিনটি নিশ্চল মূর্তি নিশ্চুপ দাড়িয়ে – ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত এই ভাস্কর্যটির নাম অপরাজেয় বাংলা। এই তিনজন তরুণের দুজন পুরুষ, একজন নারী। পুরুষের একজনের কাধে রাইফেল, লম্বা এই তরুনের পরনে কাছা দেয়া লুঙ্গি, ডান হাতের মুঠোয় একটি গ্রেনেড। তার বামদিকে অপেক্ষাকৃত খর্বকায় আরেক তরুন, তার পরনের জিন্সপ্যান্ট বুঝিয়ে দেয় সে একজন শহুরে, এর রাইফেলটি হাতে ধরা। লম্বা তরুনের ডানপাশে কুচি দিয়ে শাড়িপরিহিতা এক তরুনী, এর কাধে একটি ফার্স্ট এইড বক্স।

একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্র্রতিরোধ, মুক্তি ও সাফল্যের প্রতিকৃতি এই অপরাজেয় বাংলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়েছিল ১৯৭৯ সালের ১৬ই ডিসেম্বর। ৩২ বছর পরে বাংলাদেশীদের যে সংস্কৃতি চেতনার প্রতীক হয়ে উঠা অপরাজেয় বাংলার নির্মান ইতিহাস তুলে ধরেছেন প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা সাইফুল ওয়াদুদ হেলাল তার ‘অপরাজেয় বাংলা’ তথ্যচিত্রে, অপরাজেয় বাংলার নির্মানের সাথে জড়িতদের জবানীতে। সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের প্রধান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, চেতনার উতসবিন্দু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে স্থানে বর্তমানে অপরাজেয় বাংলা দাড়িয়ে আছে সেখানে ছিল আরেকটি ভাস্কর্য যা কোন কারণে ভেঙ্গে ফেলতে হয়েছিল এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তখন আরেকটি ভাস্কর্য নির্মানের উদ্যোগ নেন। সময় ১৯৭৩ সাল। নাট্যাভিনেতা ম. হামিদ তখন ডাকসুর সাংস্কৃতিক সম্পাদক।

অনেক খোজ খবর করে তারা খুজে বের করেন ভাস্কর সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদকে। তিনি তিন মাস সময় নিয়ে তিনফুট উচু একটি রেপ্লিকা মূর্তি তৈরী করেন। এই মূর্তি তৈরীতে মডেল হিসেবে সময় এবং শ্রম দেন অপরাজেয় বাংলার মধ্যমণি কৃষক মুক্তিযোদ্ধারূপে বদরুল আলম বেনু, অপরাজেয় ছাত্রমূর্তি মুক্তিযোদ্ধা ছাত্ররূপে সৈয়দ হামিদ মকসুদ এবং অপরাজেয় নারী মূর্তি মুক্তিযোদ্ধা সেবিকারূপে হাসিনা আহমেদ। সে সময় পত্রিকায় এই ভাস্কর্যটি নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেন সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী – তার প্রবন্ধের নাম অনুসারে ভাস্কর্যটির নাম হয়ে যায় ‘অপরাজেয় বাংলা’। ভাস্কর্যটি যে তিনকোনা বেদীর উপরে স্থাপিত তার নকশা করেন স্থপতি কবি রবিউল হুসাইন।

প্রথম প্রতিকৃতির প্রায় চারগুন আকারের বর্তমান ভাস্কর্য নির্মানের কাজ পান প্রকৌশলী শহীদুল্লাহ এবং তার ফার্ম শহীদুল্লাহ এসোসিয়েটস। নির্মান কাজ শুরু হয় ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি। কিন্তু ১৯৭৫ এর আগস্টে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হলে এর নির্মান কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ভাস্কর্য নির্মানের এ পর্যায়ে নির্মান সহযোগী এবং মডেল বদরুল আলম বেনুর জবানীতে জানা যায়, সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাসভবন এবং কলাভবনের সামনে একটি করে ট্যাংক দন্ডায়মান ছিল। এদের একটির নল তাক করা ছিল অপরাজেয় বাংলার দিকে।

সাধারণ জনতার অংশ হিসেবে বেনু ঘুরতে গিয়েছিলেন সেখানে এবং উর্দুতে কথোপকথনরত সৈন্যদের থেকে ভাস্কর্যটির ভেঙ্গে ফেলার কথা শুনে উদ্বিগ্ন হন। স্বাধীন দেশের সেনাবাহিনীতে কর্মরত সেই সকল সৈন্য সম্ভবত যুদ্ধপূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত ছিলেন এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ভাস্কর্য নির্মান বন্ধ হয়ে গেলেও ভাস্কর্যটি অক্ষত থাকে। তথ্যচিত্রের নির্মাতা পরিচালক-চিত্রগ্রাহক-সম্পাদক সাইফুল ওয়াদুদ হেলাল ২০০৮ সালে তথ্যচিত্রটির চিত্রগ্রহন করেন। অপরাজেয় বাংলা ভাস্কর্য নির্মানের সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গের সাক্ষাতকার এবং কিছু দুর্লভ সাদাকালো ছবির সমন্বয়ে তিনি এর নির্মান ইতিহাস তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন।

সাদাকালো এবং পুরাতন ইমেজ ইফেক্ট দেয়া কিছু চলমান দৃশ্য ৩২ বছর আগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছে। ১৯৭৯ সালে পুনরায় ভাস্কর্য তৈরীর উদ্যোগ নেয়া হয় এবং সে বছরই বাকী কাজ সম্পন্ন করা হয়। ১৯৭৯ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবসে উদ্বোধন করা হয় অপরাজেয় বাংলা, উদ্বোধন করেন যুদ্ধাহত কজন মুক্তিযোদ্ধা। অপরাজেয় বাংলার পাদদেশেই অনুষ্ঠিত হয় এ উপলক্ষ্যে সাংস্কৃতিক উতসব। অপরাজেয় বাংলা তথ্যচিত্রের গুরুত্বপূর্ন অংশ হিসেবে এর নির্মান ইতিহাস বর্ণিত হলেও এর মূল বিষয় ভাস্কর্য নির্মান কাহিনী নয় বরং এর সাথে জড়িত বাংলাদেশীদের সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী সাংস্কৃতিক চেতনা এবং ঐক্য।

১৯৭৩ সালে শুরু হয়ে ১৯৭৯ সালে উদ্বোধনের মাধ্যমে যে অপরাজেয় বাংলার সৃষ্টি তা হুমকীর মুখে পড়েছিল ১৯৭৭ সালের অগাস্টে। ঢাকা জিপিওর সামনে জিরো পয়েন্টে বর্শা নিক্ষেপরত একটি মূর্তি স্থাপনকে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের সামনে স্থাপনা হিসেবে গন্য করে প্রতিবাদ করে এদেশের ইসলামপ্রিয় জনগোষ্ঠি এবং এরই ধারাবাহিকতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মানাধীন অপরাজেয় বাংলা উতপাটনের হুমকী দেয়া হয়। জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবির এই ভাস্কর্য নির্মূলের সমর্থনে স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযানে গিয়ে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী পক্ষের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়। পরবর্তীতে পুলিশী হস্তক্ষেপে শান্ত হয়েছিল সে সময়ের পরিস্থিতি এবং বাকী কাজ সমাপ্ত হয় কোন বাধা ছাড়াই। সাম্প্রদায়িক শক্তির এই আক্রমন আবার লক্ষ্য করা যায় ২০০৮ সালে।

বিমানবন্দরের সামনে লালনের মূর্তি স্থাপনের বিরোধিতা করে দাবী জানায় হজ্জ মিনার স্থাপনের। এই দাবী থেকে সংঘর্ষ এবং আন্দোলনে রূপ নেয়। হজ্জ মিনার স্থাপনের এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন মুফতি আমিনী। সাম্প্রদায়িক শক্তির বাধার মুখে সরকার লালনের মূর্তি অপসারণ করলেও সেখানে স্থাপন করেনি কোন হজ্জ মিনার। মাসখানেকের ব্যবধানেই মতিঝিলের বলাকা ভাস্কর্য ভাঙ্গার চেষ্টা চালায় অজ্ঞাত দুর্বৃত্ত।

সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী শক্তি একত্রিত হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে প্রতিবাদ হয়। প্রতিবাদস্বরূপ চারুকলা অনুষদের ছাত্র ছাত্রীরা নির্মান করে আরেকটি অপরাজেয় বাংলা। সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী উতসব আয়োজন হয়, মিছিল হয়, পিচঢালা রাস্তায় আকা হয় বাউল মূর্তি, লেখা হয় – বাংলাদেশ মানে অপরাজেয় বাংলা। মীরা মিডিয়ার ব্যানারে নির্মিত ৬০ মিনিটের এই তথ্যচিত্র প্রযোজনা করেছেন শফিউল ওয়াদুদ। পরিচালক সাইফুল ওয়াদুদ হেলাল কানাডা প্রবাসী হলেও বাংলাদেশকে নিয়ে তার প্রামান্যচিত্রগুলিতে বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি দারুণভাবে ফুটে উঠে।

তার পরিচালিত ‘বিশ্বাসের রং’ মন্ট্রিয়াল ওয়ার্ল্ড ফিল্ম ফেস্টিভালে অফিসিয়ার সিলেকশন হিসেবে প্রিমিয়ার হলে তিনি আলোচনায় আসেন। স্মৃতি একাত্তর, ছবির হাট, আনিকার বাড়ি এবং সিনেম্যানিয়া তার অন্যান্য চলচ্চিত্র। ভিন্ন ভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করা হেলালের সর্বশেষ সৃষ্টি – অপরাজেয় বাংলা। সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী অবস্থান থেকে নির্মিত অপরাজেয় বাংলা তথ্যচিত্রের উদ্দেশ্য এদেশে সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান কারণ নির্ণয় নয় বরং সাম্প্রদায়িক শক্তির চোখ খুলে দেয়া। ফলে সাম্প্রদায়িক শক্তির বক্তব্য জানার সুযোগ হয়ে উঠেনি এই তথ্যচিত্রে, জানা যায়নি সাম্প্রদায়িক এবং সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী এই দুই পক্ষের বিরোধ অবসানের উপায়, অবশ্য এ অপ্রাসঙ্গিকও বটে।

আবহসংগীত হিসেবে তাই লালনের ‘এসব দেখি কানার হাটবাজার’ গানটি বেশ খাপে খাপ লেগে যায় এবং স্লোগানের সাথে মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণাদায়ক গান ‘মোরা একটি ফুলকে বাচাবো বলে যুদ্ধ করি’ গানের ফিউশন এই চেতনাকে রক্ষা করার আয়োজনকেই তুলে ধরে। প্রযুক্তিগত দিক থেকে খুব জটিলতায় যাননি পরিচালক। হয়তো অর্থ স্বল্পতার কারণেই কম্পিউটার প্রযুক্তি ব্যবহার করে এর নির্মান প্রক্রিয়া তুলে ধরার চেষ্টা করেন নি, বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার তাগিদে অভিনেতাদের সাহায্যে সাদাকালোয় ভাস্কর্য নির্মান প্রক্রিয়া দেখিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্য স্বাধীনতার প্রতীক অপরাজেয় বাংলার ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার অনুষ্ঠিত হয়েছে জ্যাকসন হাইটস এর দ্য জুইশ সেন্টার এ, আয়োজন করেছে নিউইয়র্ক ফিল্ম সেন্টারে। ১৩ই ডিসেম্বর থেকে ঢাকার ধানমন্ডিতে আর্ট সেন্টারে প্রদর্শিত হচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্য হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে এখানে তেমন কোন প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়নি নানা কারণে। চারুকলার বিপরীতে ছবির হাটে ১৬ই ডিসেম্বরে প্রথম প্রদর্শনীর পর আজ সিনেট ভবনে এর দ্বিতীয় প্রদর্শনী। যথাযথ প্রচারণার অভাব কিংবা শৈত্য প্রবাহ যাই হোক না কেন এই প্রদর্শনীতে দর্শক ছিল কম। যে তারুণ্য মুক্তি সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়েছে, দেশকে বারবার বাধামুক্ত করেছে সেই তারুণ্যের কাছে তারুণ্যের প্রতীক, অপরাজেয়তার প্রতীক অপরাজেয় বাংলার ইতিহাস পৌছে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া উচিত। নির্মাতা সাইফুল ওয়াদুদ হেলাল এই আগ্রহেই ছুটে বেড়াচ্ছেন এখান থেকে সেখানে।

ভাস্কর্য এবং তথ্যচিত্র অপরাজেয় বাংলার নির্মানে আরেকটি মানুষের নাম জড়িয়ে আছে – তিনি হলেন বুদ্ধিজীবি মুনীর চৌধুরীর ছেলে আশফাক মুনীর মিশুক বা মিশুক মুনীর। অতি সম্প্রতি সড়ক দুর্ঘটনায় অকালে মৃত্যুবরণকারী এই চিত্রগ্রাহক ১৯৭৯ সালের নির্মান কাজ পুনরায় শুরু হলে প্রায় একবছর দিনে রাতে এর সাথে থেকে ছবি তোলেন। ছবি তোলার উদ্দেশ্য ফটোগ্রাফি শেখা হলেও কালের বিবর্তনে এখন সেই ছবিগুলোই ইতিহাস হয়ে দাড়িয়েছে। মিশুক মুনীর বিদায় নিয়েছেন পৃথিবী থেকে, একদিন বিদায় নিবেন ভাস্কর সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ – কিন্তু ভাস্কর্য অপরাজেয় বাংলা নির্মানের মাধ্যমে যে ইতিহাসে তারা নিজেদের নাম যুক্ত করেছেন, সেই একই ইতিহাসে প্রামাণ্যচিত্র ‘অপরাজেয় বাংলা’ও লেখা থাকবে। প্রথম প্রকাশ: দারাশিকোর ব্লগে ফেসবুকে দারাশিকো ব্লগের সাথেই থাকুন  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.