আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পিপলী ( রং ঝলমল এক সুচী শিল্পীদের গ্রাম)

পথের প্রান্তে আমার তীর্থ নয় ,,,,,পথের পাশেই আছে মোর দেবালয় অপরূপ এপ্লিক কাজ এই বিশ্বের কোন এক দেশের একটি গ্রামের নারী পুরুষ নির্বিশেষে প্রায় সকল বাসিন্দা শুধুমাত্র সুচী কর্মেই নিয়োজিত এমনও কি হয় কখনো ! বিষয়টি খুবই অবাক করার মত। কিন্ত এমনটি হয়ে আসছে অনেক অনেক বছর ধরে। আর তা হচ্ছে পিপলী গ্রামে, ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যের রাজধানী ভুবনেশ্বর থেকে অল্প দূরে যার অবস্থান। এ ব্যাপারে যারা খোঁজ খবর রাখেন তারা সহজেই চিনবেন পিপলী নামের গ্রামটিকে। উড়িষ্যা রাজ্যের পাশেই রয়েছে আমাদের চির চেনা সমুদ্র বংগোপসাগর।

এর তীরেই হিন্দু সম্প্রদায়ের পুন্যতীর্থ শহর পুরী। ১১শ শতাব্দীতে সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয় হিন্দু ধর্মের অন্যতম দেবতা শ্রী জগন্নাথের মন্দির। সংস্কৃত শব্দ জগতের নাথ থেকেই জগন্নাথ শব্দটির উৎপত্তি বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। অবশ্য এ ব্যাপারে আরো অনেক মতবাদ রয়েছে । পিপলীর এপ্লিকের দোকান এই মন্দিরের দেবতাদের দর্শনের মাধ্যমে পুন্যের আশায় সারা বছর জুড়েই পুরীতে থাকে হাজারো ভক্তের ভীড়।

কিন্ত তাদের সবচেয়ে বড় উৎসব হচ্ছে বাৎসরিক রথযাত্রা যা প্রতি বছর আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বীতিয়ায় অনুষ্ঠিত হয়। সে সময় সারা দেশ থেকে আসা পূন্যার্থীদের পদভারে মুখরিত হয়ে উঠে পুরী নগরী। এই উৎসবে যোগ দেয়ার জন্য পুন্যার্থীদের তখনই আগাম হোটেল বুকিং দিতে দেখলাম। আমাদের ঢাকার অদুরে ধামরাইতেও ছোট আকারে এই রথযাত্রার উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। রং ঝলমল বাতির শেড পুরীর এক দোকানে এই রথযাত্রারই এক প্রধান উপকরণ হলো পিপলীর সুচী শিল্পীদের তৈরী এপ্লিকের বিভিন্ন উপাদান।

এপ্লিক হলো এক ধরনের সুচীকর্ম যা একটি কাপড়ের উপর অন্য রংয়ের কাপড় টুকরো করে কেটে কেটে জুড়ে তালির মত করে লাগিয়ে বিভিন্ন ডিজাইন তৈরী করা। পিপলীতে শিল্পীদের তৈরী এপ্লিকের ময়ুর পৃথিবীর অনেক দেশেই এপ্লিক সুপরিচিত, কিন্ত এপ্লিকের জন্য জগৎবিখ্যাত পিপলীর শিল্পীরা এ ছাড়া অন্য কোন সুচীকর্ম করে কিনা আমার জানা নেই। অর্থাৎ এত এপ্লিক শিল্পী পৃথিবীর আর কোথাও একসাথে, একই জায়গায় বসবাস করে না বলেই সবার ধারণা । ১০৫৪ সনে উড়িষ্যার রাজা ছিলেন বিরাকশোর। তিনি এই সুচীশিল্পীদের অসাধারণ সুচীকর্মে মুগ্ধ হয়ে সেখানকার মন্দিরের দেবদেবীদের বসন ভুষনসহ বিভিন্ন সাজসজ্জার উপকরণ তৈরী ও সরবরাহের জন্য তাদের স্থায়ীভাবে নিযুক্ত করলেন।

আর তাদের বসবাসের জন্য পুরীর অদুরে গড়ে তোলেন পিপলী গ্রামটি । ভক্তদের নিয়মিত দেয়া মন্দিরের ভোগ বা খাবার থেকে তাদের সবার প্রতিদিনের খাবার সরবরাহ করা হতো। স্বয়ং রাজা ছাড়াও সেখানকার অন্যান্য মহান ধনাঢ্য ব্যাক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতা ও আনুকুল্যে তখন থেকে পিপলীর জনগন এই কাজের সাথে যুক্ত। স্থানীয় ভাষায় তাদেরকে বলা হয় দর্জী। এই দর্জী শব্দটি আমাদের দেশে কাপড় সেলাই কারীদের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

রোদের তেজে ঝিমানো দুপুরে পিপলীর পথে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তিনজন দেবতা পুজিত হয়ে থাকেন। এদের মধ্যে সর্ব প্রধান হচ্ছেন জগন্নাথ যার নামেই মন্দিরটি। বাকী দুজনের একজন ভাই বলভদ্র ও বোন সুভদ্রা। রথযাত্রার সময় এই তিন দেবতা রথে চড়ে জগন্নাথ মন্দির থেকে ২ কিমি দুরত্বে খালার বাড়ী অর্থাৎ গুন্ডিচির মন্দিরে বেড়াতে যান। খালার বাড়ী নয় দিন থেকে আবার রথে চড়ে তারা নিজ গৃহে অর্থাৎ জগন্নাথ মন্দিরে প্রত্যাবর্তন করেন।

পুরীর গ্র্যান্ড রোডে বিখ্যাত রথযাত্রা আষাঢ় মাসের দ্বীতিয় শুক্লায় খালার বাড়ীতে ভাগ্নে ভাগ্নী তিন দেব দেবী বেড়াতে যাবেন। আর তাদের যাওয়া আসার জন্য নির্মিত হয় মন্দিরের আদলে তিনটি রথ। সাজানো হয় তাদের নানা রকম সাজ সজ্জায়। আর তার প্রধান উপকরন হলো পিপলীর এই সব সুচীশিল্পীদের তৈরী এপ্লিকের নানা ডিজাইনের বিভিন্ন সম্ভার। যেমন চাদোয়া, ব্যানার, ছোট ছোট ছাতা, পাখা এসব।

উল্লেখযোগ্য মোটিফের মধ্যে রয়েছে রাহু, চন্দ্র ছাড়াও ফুল, পাখী, লতা, পাতা, আর জ্যামিতিক নকশা । জগন্নাথ মন্দিরের সামনে তিন দেবতার জন্য নির্ধারিত তিন রংয়ের রথ, মাসীর বাড়ী যাবার জন্য তৈরী তিন দেবতার জন্য তিন জোড়া রংয়ের মিশ্রন নির্ধারন করা । যেমন দেবতা বলভদ্রের জন্য বরাদ্দ টকটকে সবুজ আর লাল। বোন সুভদ্রার জন্য টকটকে লাল আর কালো আর বাবা জগন্নাথের হলো টকটকে লাল আর হলুদের কারুকাজ। মন্দিরের সামনে বিশাল গ্র্যান্ড রোড দিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ রং বেরংএর এপ্লিকের সরন্জাম দিয়ে সাজানো রথগুলোকে টেনে নিয়ে যায় ২ কিলোমিটার দুরত্বে গুন্ডিচির মন্দিরে।

রাস্তার পাশে দোকানে রং বেরংয়ের বাতির শেড স্বাধীনতার পর বিভিন্ন দেশ থেকে আসা পর্যটকদের আগ্রহ আর চাহিদা দেখে পিপলীবাসীরা মন্দিরের উপকরণ ছাড়াও এপ্লিকের অন্যান্য জিনিস বানাতে শুরু করলো। যেমন বিছানার চাদর, কুশন কভার, ব্যাগ, ওয়াল হ্যাংগিং লাইটের শেড সহ এমন ঘর সাজানোর অনেক কিছু। এতে রয়েছে দেব দেবীর মুর্তি ছাড়াও কাচ বসানো বা কাচ ছাড়া ফুল, পাখী, আর জ্যামিতিক নকশার কারুকাজ, এছাড়াও রয়েছে তাদের বিখ্যাত ট্রাইবাল আর্টের এপ্লিক। ট্রাইবাল আর্ট এর আগেরবার যখন আমি পুরী গিয়েছিলাম তখন পিপলী যাবার সুযোগ হয়নি। কারন ট্যুর কোম্পানীর প্রোগ্রামে তা অন্তর্ভুক্ত ছিলনা।

কিন্ত এবার পুরী থেকে ভুবনেশ্বর যাওয়া আসার জন্য ট্যুর কোম্পানীর প্রাইভেট কার ভাড়া করলাম। এর সুবিধা অসুবিধা দুটোই আছে। আমরা পর্যটন স্পটগুলো যেমনঃ চন্দ্রভাগা সমুদ্র তীর, কোনার্কের মন্দির, ধৌলি স্তুপা, উদয়গিরি খন্ডগিরি সহ আরো অনেক কিছু দেখার জিনিস নিজেদের মত করে সময় নিয়ে দেখলাম। আবার ড্রাইভারের নিরুৎসাহে আবার অনেক জায়গায় যাওয়া হলো না। তবে সুযোগ থাকায় আগেরবারের না দেখা পিপলী গ্রামটি দেখার আমার সৌভাগ্য হলো।

চৈত্র মাস গরম পড়েছে প্রচুর। আমরা যখন গেলাম তখন প্রায় অপরান্হ। রাস্তার দুপাশে দোকানের সারি। ক্লান্ত দোকানীরা বসে আছে চেয়ারে হেলান দিয়ে ঢুলু ঢুলু চোখে। সিজন শেষ, খদ্দের তেমন নেই বল্লেই চলে।

দোকানগুলোর সাথেই কারখানা এবং বেচাকেনা চলছে টুকটাক। নৃত্যরতা আদিবাসী রমনী দোকান আর কারখানায় ঘুরে ঘুরে আমিও কিনে আনি আমার মনের মত দুয়েকটি জিনিস যা আমার অনেক দিনের শখ ছিল। এর মধ্যে রয়েছে এপ্লিকের ওয়াল হ্যাংগিং,ফ্রেমে বাধানো তালপাতার উপর আঁকা ট্রাইবাল আর্ট, আর ফ্রেমে বাধানো ধাতুর তৈরী ডোকরা ডিজাইনের ট্রাইবাল মুর্তির সারি। আমার কেনা ট্রাইবাল রমনী ওয়াল হ্যাংগিং আমার জন্য কেনা তালপাতার উপর আঁকা ট্রাইবাল আর্ট পুরীতে ফেরার সময় গাড়িতে বসে বসে ভাবলাম পিপলীর এই আলো ঝলমল সৌখিন সব সুই সুতায় বোনা এক একটি জিনিস। এসব কিছুর আড়ালে হয়তো লুকিয়ে আছে কত বন্চনা, কত শোষনের কাহিনী।

কত আংগুলে সুইয়ের খোচায় খোচায় রক্তে ভিজে তৈরী হয়েছে ঘর সাজানোর এসব নিখুত মনকাড়া এক একটি উপকরণ। একটা কথা আছে না আলোর নীচেই সবচেয়ে বেশী অন্ধকার তাই মনে হলো আমার। ধন্যবাদ সবাইকে সাথে ছিলেন বলে।  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.