কাছাকাছি৯৬ ২১ ডিসেম্বর ২০১১ (৭ পৌষ ১৪১৮ বঙ্গাব্দ) মরমী কবি ও বাউল দেওয়ান হাছন রাজার ১৫৬তম জন্মদিন। তাঁর জন্ম ১৮৫৪ সালের ২১ ডিসেম্বর (৭ পৌষ ১২৬১) সেকালের সিলেট জেলার সুনামগঞ্জ শহরের নিকটবর্তী সুরমা নদীর তীরে লক্ষণছিরি (লক্ষণশ্রী) পরগণার তেঘরিয়া গ্রামে। পিতা জমিদার দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরী, মাতা মোসাম্মৎ হুরমত জাহান বেগম। হাছন রাজা ছিলেন জমিদার বংশের সন্তান। তার পূর্বপুরুষ ছিল হিন্দু রাজবংশের উত্তরাধিকারী।
তাঁদেরই একজন বীরেন্দ্রচন্দ্র সিংহদেব মতান্তরে বাবু রায় চৌধুরী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। হাসন রাজার পুর্বপুরুষের অধিবাস ছিল অয্যোধ্যায়। সিলেটে আসার আগে তাঁরা দক্ষিণবঙ্গের যশোর জেলার অধিবাসী ছিলেন। সিলেটের রামপাশা ও ভাটি অঞ্চল নামে খ্যাত সুনামগঞ্জের লক্ষ্মণশ্রী বিস্তৃত ছিল তাদের রাজত্বকাল।
তিনি তেমন কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করতে পারে নি।
তবে তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত। বংশের নিয়মানুসারে তিনি প্রথমে আরবী এবং পরে বাংলা ভাষায় পাঠ শুরু করেন। হাসন রাজা যে যুগে জন্মেছিলেন সে যুগে মুসলমান সমাজে ইংরেজি শিক্ষার তত প্রচলন না থাকায় বিদ্যালয়ের পড়াশুনায় তিনি বেশিদুর অগ্রসর হতে পারেন নি। নিজে আধুনিক শিক্ষায় বেশি অগ্রসর হতে না পারলেও শিক্ষা প্রসারে তিনি উদার হাতে সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান করতেন। সুনামগঞ্জের প্রধান ক’টি শীর্ষ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠাকল্পে তাঁর অফুরন্ত দান ছিল।
এর মধ্যে সুনামগঞ্জ জুবিলী হাই স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য জায়গা প্রদান উল্লেখযোগ্য।
হাছন রাজা রাজবংশে জন্মগ্রহণ করেও সম্পূর্ণ বিপরীত ছিলেন চলনে-বলনে। যদিও প্রথম জীবনে তাঁর পোশাক আশাক এ আভিজ্যাত্যের পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি মখমলের চোগা, চাপকান ও জরির পাগড়ি ছাড়া বাইরে বের হতেন না। তাছাড়া লুঙ্গির মতো করে পেচিয়ে ধুতি ও হাতাওয়ালা গেঞ্জি নিয়মিত পরতেন।
পরবর্তিতে তিনি জমিদারি চালচলন ছেড়ে সাধারণ মানুষের মত একদম সহজ সরল জীবন যাপন করেন।
উত্তারিধাকার সূত্রে তিনি বিশাল ভূসম্পত্তির মালিক ছিলেন। ১২৭৬ বাংলা (১৮৬৯ খ্রিঃ) ১৫ বছর বয়সে তিনি জমিদারিতে বসেন। প্রথম যৌবনে তিনি ছিলেন ভোগবিলাসী এবং সৌখিন। এসময় তিনি নারীদের প্রতি খুব আকৃষ্ট হয়ে পরেন।
তাঁর এক গানে নিজেই উল্লেখ করেছেন-
"সর্বলোকে বলে হাসন রাজা লম্পটিয়া"
প্রতিবছর বিশেষ করে বর্ষাকালে নৃত্য-গীতের ব্যবস্থাসহ তিনি নৌকায় চলে যেতেন এবং বেশ কিছুকাল ভোগ-বিলাসের মধ্যে নিজেকে নিমজ্জিত করে দিতেন।
এক আধ্যাত্নিক স্বপ্ন-দর্শন হাসন রাজার জীবন দর্শন আমূল পরিবর্তন করে দিল। হাসন রাজার মনের দুয়ার খুলে যেতে লাগলো। তাঁর চরিত্রে এলো এক সৌম্যভাব। বিলাস প্রিয় জীবন তিনি ছেড়ে দিলেন।
ভুল ত্রুটিগুলো শুধরাতে শুরু করলেন। জমকালো পোশাক পড়া ছেড়ে দিলেন। শুধু বর্হিজগত নয়, তার অন্তর্জগতেও এলো বিরাট পরিবর্তন। জীব-হত্যা ছেড়ে দিলেন। কেবল মানব সেবা নয়, জীব সেবাতেও তিনি নিজেকে নিয়োজিত করলেন।
ডাকসাইটে রাজা এককালে 'চন্ড হাসন' নামে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু এবার তিনি হলেন 'নম্র হাসন'।
ধন সম্পদের উপর থেকে তাঁর নেশা চলে গেল। জীবন ধারণের উপর থেকে মন উঠে গেল। মনের মাঝে ভর করল এক বৈরাগ্য ও উদাসীনতা,শুরু করলেন গান লেখা এবং আধ্যাত্মিকতা।
এর পর একের পর এক লেখতে ও সুর করতে লাগলেন- “লোকে বলে বলেরে, ঘর বাড়ী ভালা নায় আমার/কি ঘর বানাইমু আমি, শূন্যের-ই মাঝার/ভালা করি ঘর বানাইয়া, কয় দিন থাকমু আর/আয়ন দিয়া চাইয়া দেখি, পাকনা চুল আমার”-এর মত অসংখ্য কালজয়ী গান।
তাঁর রচিত গানের সংখ্যা অনেকের মতে হাজারের ও বেশি কিন্তু আমরা মাত্র ৫৫৩টি গানের হদিস পেয়েছি বাকি গুলো আর পাওয়া যায় নি। তাঁর উল্লেখযোগ্য গান গুলো হল- নিশা লাগিল রে,সোনা বন্ধে আমার,এগো মইলা,আমি না লইলাম,রঙ্গিয়া রঙ্গে আমি,পিরীত করিয়ে পিরীত,লোকে বলে বলেরে,যমের দূতে আসিয়া,বিচার করি চাইয়া দেখি সকলেই আমি,আমি তোমার কাঙ্গালী গো ইত্যাদি।
হাসন রাজা ১৯২২ সালের ৬ ডিসেম্বার পরলোক গমন করেন।
রবীন্দ্রনাথের চোখে হাসন রাজা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯ ডিসেম্বর ১৯২৫ Indian Philosophical Congress-এর প্রথম অধিবেশনে সভাপতি নির্বাচিত হন।
সভাপতির অভিভাষণে তিনি প্রসঙ্গক্রমে হাসন রাজার দুটি গানের অংশবিশেষ উদ্ধৃত করে তাঁর দর্শন চিন্তার পরিচয় দেন। ভাষণটি 'Modern Review' ( January 1926) পত্রিকায় 'The philosophy of Our People' শিরোনামে প্রকাশিত হয়। এর অনুবাদ প্রকাশিত হয় 'প্রবাসী' ( মাঘ ১৩২২) পত্রিকায়। ভাষণে হাসন রাজা সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক অংশ এখানে উদ্ধৃত হলোঃ
"পূর্ববঙ্গের এক গ্রাম্য কবির [হাসন রাজা] গানে দর্শনের একটি বড় তত্ত্ব পাই সেটি এই যে, ব্যক্তিস্বরূপের সহিত সম্বন্ধ সূত্রেই বিশ্ব সত্য। তিনি গাহিলেন-
মম আঁখি হইতে পয়দা আসমান জমিন
শরীরে করিল পয়দা শক্ত আর নরম
আর পয়দা করিয়াছে ঠান্ডা আর গরম
নাকে পয়দা করিয়াছে খুসবয় বদবয়।
এই সাধক কবি দেখিতেছেন যে, শাশ্বত পুরুষ তাঁহারই ভিতর হইতে বাহির হইয়া তাঁহার নয়নপথে আবির্ভূত হইলেন। বৈদিক ঋষিও এমনইভাবে বলিয়াছেন যে, যে পুরুষ তাঁহার মধ্যে তিনিই আধিত্যমন্ডলে অধিষ্ঠিত।
রূপ দেখিলাম রে নয়নে, আপনার রূপ দেখিলাম রে।
আমার মাঝত বাহির হইয়া দেখা দিল আমারে। ।
১৯৩০ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে 'হিবার্ট লেকচারে' রবীন্দ্রনাথ 'The Religion of Man' নামে যে বক্তৃতা দেন তাতেও তিনি হাসন রাজার দর্শন ও সঙ্গীতের উল্লেখ করেন।
হাসন রাজার স্মৃতি সংরক্ষণঃ
হাসন রাজার স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য সিলেট নগরীর প্রানকেন্দ্র জিন্দাবাজারে গড়ে তোলা হয়েছে একটি যাদুঘর। এর নাম দেওয়া হয়েছে মিউজিয়াম অব রাজাস’। এখানে দেশ বিদেশের দর্শনার্থীরা হাছন রাজা ও তার পরিবার সম্পর্কে নানা তথ্য জানতে প্রতিদিন ভিড় করছেন।
মিউজিয়ামে দেওয়ান হাছন রাজার মূল্যবান ব্যবহার্য জিনিসপত্র ও গানের পান্ডুলিপি শোভা পাচ্ছে।
প্রবেশদ্বারে রয়েছে হাছন রাজার বাড়ির ধ্বংসাবশেষের একটি পিলার। মিউজিয়ামটির সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হচ্ছে-পবিত্র কোরআন শরীফের ছোট আকারের একটি কপি। কোরআন শরীফটির সাইজ হচ্ছে-পৌণে এক ইঞ্চি বাই এক ইঞ্চি। এখানে শোভা পাচ্ছে-হাছন রাজার ঘোড়ার বেল্ট, তাঁর জন্মস্থান ও জমিদারী এলাকা থেকে সংগৃহীত ইট, রাজার পোষা কুড়া পাখি ও হাতির নামের তালিকা, তার ব্যবহৃত শ্বেত পাথর ও রুপার তৈজস পত্র, হাছন রাজার ওপর নির্মিত পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়া ছবিতে ব্যবহৃত পোষাক ও ছবির সিডি, তার স্ত্রীর ব্যবহার্য জিনিসপত্র, দেওয়ান একলিমুর রাজার ব্যবহৃত চেয়ার, তার স্ত্রীর ব্যবহার্য সোনার তারের ও রুপার তারের তৈরী পোষাক, তার ব্যবহৃত হিসাবের খাতা, বৃটিশ সরকার প্রদত্ত খান বাহাদুর মেডেল এবং দেওয়ান তাছাড়া রাজা সংগৃহিত হাছন রাজার গানের পান্ডুলিপি।
এক নজরে হাসন রাজাঃ
নামঃ দেওয়ান হাসন রাজা চৌধুরী
ডাক নামঃ হাসন রাজা
জন্ম তারিখঃ ৭ পৌষ ১২৬১ বাংলা (২১ ডিসেম্বর ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দ)
উচ্চতাঃ ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি (১.৭৮ মিটার)
জন্মস্থানঃ তেঘরিয়া (লক্ষণশ্রী), সুনামগঞ্জ (বৃহত্তর সিলেট)
পিতাঃ দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরী (১২০৭-১২৭৬ বঙ্গাব্দ) (১৮০০-১৮৬৯ খ্রিঃ)
মাতাঃ মোসাম্মত হুরমত জান বিবি (১২৩৫-১৩১০ বঙ্গাব্দ) (১৯২৮-১৯০৩ খ্রিঃ)
ভাইঃ দেওয়ান ওবায়দুর রাজা চৌধুরী (১৮৩২-১৮৬৯), দেওয়ান মোজাফ্ফর রাজা চৌধুরী (১৮৫২-১৮৭৯)
বোনঃ সহিফা বানু (১৮৫০-১৯১৭)
স্ত্রীঃ আজিজা বানু, বোরজান বিবি, সাজেদা বানু, জোবেদা খাতুন, লবজান চৌধুরী
পুত্রঃ খান বাহাদুর দেওয়ান গণিউর রাজা চৌধুরী (১২৮৩-১৩৩৯ বাংলা), দেওয়ান হাসিনুর রাজা চৌধুরী (১২৮৫-১৩৫১ বাংলা), খান বাহাদুর দেওয়ান একলিমুর রাজা চৌধুরী (১২৯৬-১৩৭১ বাংলা) দেওয়ান আফতাবুর রাজা চৌধুরী (১৩০৩-১৩৬২ বাংলা)
কন্যাঃ রওশন হুসেইন বানু, রওসন হাসান বানু, আলী হুসেইন বানু, রওশন আখতার বানু।
মৃত্যুঃ ২২ অগ্রহায়ণ,১৩২৯ বাংলা (৬ ডিসেম্বর, ১৯২২)
সূত্রঃ উইকিপেডিয়া,দৈনিক প্রথম আলো ও সিলেট পোর্টাল ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।