এই দেশ, এই প্রকৃতি ও খুব কাছের মানুষ ছেড়ে কোথাও মিলিয়ে যাবো একদিন, সে সব কথা ভাবতে খুব কষ্ট হয়। মানুষের কাছে, প্রকৃতির কাছে আমি ঋণী। সেসব ঋণ শোধ করা হবে না কোনদিনই। তবু যেতেই হবে। যেতে হয়।
আমার প্রতিদিনের ভাবনা এবং জীবনের কিছু কথা যাবার আগে বলে যেতে চাই উত্তর জনপদের কুড়িগ্রাম জেলা ও বৃহত্তর রংপুরসহ সারাদেশের দু:স্থ নারীরা তাদের ভাগ্য ফেরাতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে গৃহীত এই কর্মসূচিতে দেশের প্রতিটি ইউনিয়ন থেকে ১০ জন দু:স্থ নারীকে কর্মসংস্থানের আওতায় আনা হয়েছে। তবে মঙ্গাকবলিত উত্তরাঞ্চলের প্রতিটি ইউনিয়নে ৩০ জন নারীকে এই সুযোগ দেয়া হয়েছে, যাতে তারা মঙ্গাকে চিরবিদায় জানাতে পারে।
সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে ২০০৮ সালের জুন থেকে ৫ বছর মেয়াদী দেশব্যাপী আরইআরএমপি কর্মসূচি চালু হয়। সরকারের গৃহীত প্রকল্পে কাজ করে কুড়িগ্রামসহ বৃহত্তর রংপুরের ৫ জেলার প্রতিটি ইউনিয়নের ৩০ জন দুস্থ নারী শ্রমিক মঙ্গাকে জয় করে ভবিষ্যতে নিজেদের পায়ে দাঁড়াবার স্বপ্ন দেখছে।
এদের পরনে লাল পেড়ে হলুদ শাড়ি। দেখে মনে হতে পারে বাসন্তি উৎসবে মেতেছে এসব নারী। বিষয়টি তা নয়। প্রকল্পের কাজ করার জন্য এটা তাদের ইউনিফর্ম, যাতে কাজের তদারক করতে সুবিধা হয়। এসব নারী শ্রমিক কোদাল আর ডালি হাতে ক্ষুধা জয় ও ভবিষ্যত নির্মাণের স্বপ্ন দেখছে।
সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে দেশব্যাপী ৫ বছর মেয়াদী আরইআরএমপি কর্মসূচির আওতায় দুই সহস্রাধিক স্বামী পরিত্যক্তা, বিধবা ও দু:স্থ নারী শুধু ক্ষুধা থেকে মুক্তি ও ভবিষ্যতে সমৃদ্ধ জীবনের জন্য নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে।
এই কর্মসূচিতে প্রতিদিন ৯০ টাকা মজুরি হিসেবে নারী শ্রমিকরা কাজ করছে। শ্রমিকরা মাস শেষে বেতনের শতকরা ৬০ ভাগ টাকা উত্তোলন করতে পারছে। বাকী ৪০ ভাগ জমা হয় তার সঞ্চয় তহবিলে। ৫ বছর পর প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলে জনপ্রতি ৬৫ হাজার টাকা সঞ্চয় হবে।
এককালীন প্রাপ্ত এই টাকা লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করে স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখছে এসব নারী শ্রমিক।
প্রকল্পভূক্ত নারী শ্রমিকরা প্রতিদিন কোদাল আর ডালি হাতে গ্রামের রাস্তা মেরামতের কাজ করতে ব্যস্ত দেখা যায়। এসব নারী শ্রমিকের কাজের তদারকির জন্য প্রতি ইউনিয়নে ৩ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এরা নারী শ্রমিকদের কাজের তদারকি ও নির্দেশনা দেবেন। এইচএসসি পাস এসব তদারককারীর মাসিক বেতন ৬ হাজার টাকা।
তারাও এই সুবাদে পেয়েছেন কর্মের ঠিকানা।
কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে হলুদ শাড়ি পরিহিতদের রাস্তা মেরামতের কাজ করতে দেখা গেছে। ছিনাই ইউনিয়নের দেবালয় গ্রামে ১০ জনের এই দলটির মধ্যে ৪ জন স্বামী পরিত্যক্তা। বিধবাও রয়েছেন একজন। আর বাকীরা হতদরিদ্র পরিবারের।
বৈদ্যের বাজার গ্রামের নিরবালার স্বামী বছর চারেক আগে আর একটি বিয়ে করে তাড়িয়ে দিয়েছেন তাকে। তিনি এখন বড় বোনের বাড়িতে থাকেন।
এদের অনেকে এর আগে দিনমজুরি করলেও প্রতিদিন কাজ না থাকায় পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে অর্ধাহারে-অনাহারে থাকতে হতো। এ কাজে হাত দেয়ার পর তাদের আর না খেয়ে থাকতে হয় না। এখন তাদের দু’মুঠো ভাতের নিশ্চয়তা মিলেছে।
এদের মধ্যে নিরবালা জানান, হিন্দু স¤প্রদায়ের মধ্যে তালাক দেয়ার বিধান না থাকলেও সে এখন স্বামী পরিত্যক্তা। তার স্বামী তার কোন খোঁজ-খবর নেয় না। জোৎøা রাণীর রিকশাচালক স্বামী ৪ বছর আগে তাকে ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়েছে। এখন ৩ ছেলেমেয়ের দায়িত্ব তার কাঁধে। তার আয় দিয়ে সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ মেটানো সম্ভব হচ্ছে।
সালেহাকে স্বামী ত্যাগ পর ৩ সন্তানকে নিয়ে যখন দু'চোখে অন্ধকার দেখছিল ঠিক তখনি সে এ কাজে নিয়োজিত হয়। এখন এক ছেলেকে কলেজে পড়ানো ও আরো দু’টি সন্তানের লেখাপড়ার খরচ যোগাতে কারো কাছে হাত পাততে হয় না তাকে। স্বামী পরিত্যক্তা মোর্শেদাও জানান তার কষ্টের গল্প। তার কথা ‘এই কাম পাবার আগোত হামরা প্রায় দিন উপাসে থাকছিলোং, এলা হামার ভাতের চিন্তা নাই। ’
ছিনাই ইউনিয়নের বড়গ্রামে অপর একটি রাস্তা সংস্কারের কাজে নিয়োজিত রহিমা জানান, তার স্বামী হাকিম অসুস্থ হয়ে ঘরে পড়ে আছেন।
কোন কাজ করতে পারে না। ৫ জনের সংসার এখন এই কাজের আয়ে চলে। তার কথা ‘কোন মাসে টাকা পাইতে দেরি হলে দোকানোত বাকী নিয়া চলি, হাতোত কাম থাকায় দোকানদাররা হামাক বাকী দিতে চিন্তা করে না’।
এই ইউনিয়নের ফ্যাসিলিটেটর সোহাগ জানান, এলাকাবাসীরাও যেন এই সব শ্রমিকের কাজের তদারক করতে পারে তার জন্যে ইউনিফর্ম দেয়া হয়েছে। ইউপি চেয়ারম্যান সাদেকুল হক নুরু জানান, প্রতিদিন ৩০ জন শ্রমিক নিয়মিত কাজ করায় এলাকায় কোন রাস্তা আর চলাচল অনুপযোগী থাকে না।
কুড়িগ্রামের স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী এসকে দাস জানান, ব্যতিক্রমী এই প্রকল্পে সরকারি টাকার কোন অপচয় নেই, দুর্নীতিরও কোন সুযোগ নেই। জেলার ৭২টি ইউনিয়নে ২ হাজার ১৬০ জন নারীর ৫ বছরের কর্মসংস্থানের সুযোগ মঙ্গা মোকাবেলায় দৃষ্টান্ত হতে পারে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।