হরিষে বিষাদ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট নামের সামাজিক আন্দোলন এখন পুঁজিবাদি ব্যবস্থাকেই টার্গেট করেছে। মাস খানেকের মধ্যেই এই আন্দোলন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সীমানা পেরিয়ে গেছে। ফ্রাঙ্কফ্রুট এবং লন্ডনের মতো অর্থনৈতিক প্রধান কেন্দ্রগুলোসহ ইউরোপের বৃহৎ শহরগুলোতে হাজার হাজার মানুষ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে এসেছে।
আমেরিকায় বৈষম্যপূর্ণ এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলনগুলো দানা বেঁধে উঠেছিল ২০০৮ সাল থেকে। এরপর বিশ্বের সকল পুঁজিবাদি শাসনব্যবস্থাপূর্ণ দেশগুলোতে বিশেষ করে ইউরোপে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
২০০৮ সাল থেকে অর্থনৈতিক যে ভয়াবহ সংকট শুরু হয়েছে তা দীর্ঘকালীন এবং সুগভীর একটি সংকট। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় দেশগুলো গত কয়েক দশক ধরে এই সংকট মোকাবেলা করে যাচ্ছে। পশ্চিমা অর্থনীতিবিদগণ জটিল এই সংকট মোকাবেলা করার জন্যে যতোরকমের পরামর্শ আর প্রেসক্রিপশনই দিয়েছেন, সেসব কোনো কাজেই আসে নি। উল্টো বরং ইউরোপ এবং আমেরিকা সংকটের নতুন জোয়ারের মুখে পড়েছে। এইসব সংকট কখনো বাজেট ঘাটতির রূপে, কখনোবা সাধারণ ঋণের আকারে ফুটে উঠেছে।
আমেরিকার বাজেট ঘাটতির পরিমাণ এক লাখ চল্লিশ হাজার কোটি মার্কিন ডলার, আর তাদের ঋণের পরিমাণ ১৫ হাজার বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের অধিকাংশ সরকারও ঘাটতি বাজেট এবং সাধারণ ঋণ সংকটে জর্জরিত। গ্রিসের মতো বেশ কয়েকটি দেশ দেয়ালিয়াত্ব সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল বা আই.এম.এফ'র অর্থ সাহায্যের ফলে অর্থনৈতিক সংকটপূর্ণ এই দেশগুলো এখন কোনো মতে টিকে আছে। অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত পশ্চিমা সরকারগুলো বাজেট ঘাটতি হ্রাস করা এবং ঋণের পরিমাণ কমানোর লক্ষ্যে যে ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণ করেছে, তারই অনিবার্য সামাজিক পরিণতি হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলনের মডেলে ইউরোপে ভিন্ন নামে গড়ে ওঠা আন্দোলনগুলো।
ইউরোপ এবং আমেরিকায় অর্থনৈতিক সংকটের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলনগুলোর অভিন্ন কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তাহলো এই আন্দোলনগুলো গড়ে উঠেছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত ক্ষোভের আগুন থেকে।
পশ্চিমা সরকারগুলোর নীতির বিরুদ্ধে এই আন্দোলন বা গণবিক্ষোভ সংগঠিত করার পেছনে বিরোধী দলগুলো কিংবা বিভিন্ন সংস্থা বা ইউনিয়নের ভূমিকা একেবারেই নগণ্য। অপর যে বিষয়ে তাদের মাঝে মিল রয়েছে তাহলো- গুটিকয়েক ব্যক্তির হাতে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত থাকার বিরুদ্ধে মধ্যশ্রেণীর বিরোধিতা এবং পুঁজিবাদি বিশ্বের কর্মকৌশলের বিরুদ্ধে তাদের উদ্বেগ। এই উদ্বেগ উৎকণ্ঠার বিষয়টি তারা বিভিন্ন পদ্ধতিতে প্রকাশ করেছে।
ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলনের মূলে রয়েছে আমেরিকায় সম্পদের অসম বণ্টন এবং পুঁজিবাদি স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ উত্থান। ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলনকারীরা মনে করছে দেশের শতকরা ৯৯ ভাগ সম্পদ রয়েছে কেবলমাত্র শতকরা এক ভাগ লোকের হাতে। এ কারণেই কালক্রমে দেশের শাসন, সামাজিক স্তর এবং জনগণের বিভিন্ন শ্রেণীর মাঝে গভীর ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। আমেরিকার পুঁজিবাদী ব্যবস্থা একটি অন্যায় এবং বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা। এই সরকার ব্যবস্থা একটি সংখ্যালঘু ধনিক শ্রেণীর সৃষ্টি করে সমাজের অপরাপর শ্রেণীগুলোকে শোষণ করার মধ্য দিয়ে ধ্বংস করে ফেলেছে।
যুদ্ধের বিভিন্ন সমরাস্ত্র উৎপাদন শিল্পগুলোর কারণে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিয়ে সেই অস্ত্র বিক্রি করতে হয়।
যার ফলে একদিকে যেমন সমগ্র বিশ্বে অশান্তি এবং নিরাপত্তাহীনতা বৃদ্ধির কারণ হয়েছে তেমনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে সেনা সমাবেশ করতে বাধ্য হয়। এই সেনা সমাবেশের কারণে দেশের বিরাট অংকের অর্থ ব্যয় হয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ইরাকে প্রতি সেকেন্ডে মার্কিন সামরিক ব্যয়ের পরিমাণ পাঁচ হাজার ডলার। বিগত আট বছরে সেখানে মার্কিন সামরিক ব্যয়ের পরিমাণ এক হাজার বিলিয়ন ডলারেরও ওপরে।
এই বিশাল খরচের প্রাথমিক চাপটি পড়েছে আমেরিকার স্বল্প আয়ের মানুষগুলোর ওপর, তারা দরিদ্র থেকে দরিদ্রতরো হয়েছে। আর লাভবান হয়েছে আমেরিকার যুদ্ধবাজ গুটিকয়েক ব্যবসায়ী গোষ্ঠি যারা অস্ত্র উৎপাদন ও ব্যবসার সাথে সরাসরি জড়িত। চলমান অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলনের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা আরো বেশি সংকটের মুখে পড়ছে।
দুঃখজনকভাবে এই সংকটের মাশুল গুনতে হচ্ছে নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীকেই। কেননা পশ্চিমা সরকারগুলো ব্যয় সংকোচন নীতির আওতায় শিক্ষা, জনকল্যাণ এবং সামাজিক সেবামূলক ব্যয় কমানোর ফলে তার চাপটি এই দুই শ্রেণীর ওপরেই পড়েছে, ধনিক শ্রেণীর পরে নয়।
ইউরোপ ও মার্কিন জনগণের সামনে যে প্রশ্নটি উঠে এসেছে তা হলো অর্থনৈতিক এই সংকটের পেছনে যেসব কোম্পানির ভূমিকা রয়েছে,তাদেরকে কেন আর্থিক সাহায্য দেয়া হচ্ছে,কেন এইসব কোম্পানির পরিচালক বা ব্যবস্থাপকদেরকে বড় অংকের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দেয়া হচ্ছে,আর সাধারণ জনগণ কেন এই অর্থনৈতিক সংকটের চাপ সহ্য করবে? আসলে পুঁজিবাদি ব্যবস্থাটাই এক ধরনের অর্থনৈতিক স্বৈরাচার, যার মাঝে জবাবদিহিতা কিংবা স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যায়বিচার ও শান্তি জোটের সদস্য ক্যারোলিন আইজেনবার্গ প্রেস টিভির সাথে আলাপকালে বলেছেনঃ 'ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলন' মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যতের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। আমার মনে হয় এই আন্দোলন এক্ষুণি প্রভাব ফেলছে। ' অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট' আন্দোলনের ওয়েব সাইটে বলা হয়েছে, বিশ্বের বহু দেশের বিক্ষোভকারী সংগঠন তাদের আন্দোলনের সাথে ঐক্য ও সংহতি প্রকাশ করেছে। জডসন মেমোরিয়াল গির্যার পাদ্রি মিখাইল এলিক সাংবাদিকদের বলেছেনঃ 'যতোদিন পর্যন্ত অর্থনৈতিক সাম্য বাস্তবায়িত না হবে ততোদিন পর্যন্ত ন্যায়বিচারের কোনো সম্ভাবনা নেই।
'
যাই হোক, অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলনের ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। রিপাবলিকানদের সম্পর্ক যেহেতু পুঁজিপতিদের সাথে ঘনিষ্ট সেজন্যে তারা এই আন্দোলনকে গুন্ডাদের আন্দোলন বলে অভিহিত করেছে। পক্ষান্তরে ডেমোক্যা এটরা চুপচাপ থেকে আন্দোলনকারীদেরকে নিজেদের প্রতি আকৃষ্ট করতে চেয়েছে।
অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলনের ব্যাপারে মার্কিন রাজনৈতিক পক্ষগুলোর প্রতিক্রিয়া যাই হোক না কেন, সরকার কিন্তু কঠোর অবস্থানে চলে গেছে। আন্দোলনকে ছত্রভঙ্গ করার জন্যে ব্যাপক ধরপাকড় করা হয়েছে।
আন্দোলন দমন করার জন্যে মার্কিন সরকার যেই পদক্ষেপই নিয়ে থাকুক না কেন বা ভবিষ্যতেও নেওয়া হোক না কেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে নতুন করে একটি সামাজিক পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে তা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। এই পরিবর্তন কায়েমি পুঁজিবাদী স্বৈরাচার এবং বৈষম্যমূলক শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।