ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না, একলা জেগে রই।
প্রতিবছর আশ্বিন মাস এলেই হাসি ফোটে খোদেজা খাতুনের মুখে। যে হাসি স্থায়িত্ব পায় চৈত্র পর্যন্ত টানা সাত মাস। পঞ্চাশোর্ধ্ব এই নারী একজন দক্ষ গাছি। এ সময়ে খেজুরগাছ কেটে রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি।
তাই বৈশাখ থেকে ভাদ্র—এই পাঁচ মাস কোনোভাবেই যেন শেষ হয় না তাঁর। শুধু দুই মুঠো অন্নের জন্য ৩৫ বছরের বেশি সময় ধরে খেজুরগাছ কাটার মতো কঠিন পেশা বেছে নিয়েছেন তিনি।
চুয়াডাঙ্গা জেলা শহর থেকে ২৯ কিলোমিটার দূরবর্তী সদর উপজেলার গবরগাড়া গ্রামের একটি খেজুরবাগানে দাঁড়িয়ে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় খোদেজা খাতুনের। খোদেজার কাঁধে তখনো বাঁশের তৈরি একটি বাঁকের দুই প্রান্তে ১২টি খালি ভাঁড় (মাটির হাঁড়ি) ঝুলছে। খেজুরগাছ কেটে সেগুলো টাঙানোর জন্য তিনি বাগানে যাচ্ছিলেন।
আলাপের একপর্যায়ে কাঁধ থেকে বাঁক নামান এবং তাঁর সংগ্রামী জীবনের কাহিনি শোনান। সদর উপজেলার গবরগাড়া গ্রামের পুরোনোপাড়ার মফিজ উদ্দিন ও বছিরন নেছা দম্পতির ছিল ছয় মেয়ে ও দুই ছেলে। পাঁচ মেয়ের পর দুই ছেলে এবং সর্বশেষ আর এক মেয়ে—এই আটজনের মধ্যে খোদেজা ছিলেন দ্বিতীয়।
খোদেজা জানান, দেশ স্বাধীনের পাঁচ-ছয় বছর পর বড় বোন আয়েশা খাতুনের বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের কয়েক মাসের মাথায় বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে বাড়ি ছেড়ে চলে যান।
বিয়ের পর বাবা মাঠের পুরো জমি বিক্রি করে দেন। এ সময় মা বছিরন নেছা সাত ছেলেমেয়েকে নিয়ে মহা সংকটে পড়েন। ভিটেমাটি ছাড়া আর কোনো সম্বল ছিল না তখন। চরম ওই দুঃসময়ে মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে সাহস জোগান ১৪ বছরের খোদেজা। মা-মেয়ে মিলে অন্যের জমি ইজারা নিয়ে চাষাবাদ শুরু করেন।
জমি চাষাবাদের পাশাপাশি ওই বছরই প্রথম সাহস করে খেজুরগাছ কেটে রস সংগ্রহের কাজ শুরু করেন খোদেজা। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই দক্ষ গাছি হিসেবে নিজ গ্রাম ছাড়াও আশপাশের গ্রামে পরিচিতি লাভ করেন। এভাবেই কঠোর পরিশ্রম করে ছোট ছয় ভাইবোনকে সাধ্যমতো লেখাপড়া শেখানোর পাশাপাশি তাঁদের বিয়ের ব্যবস্থা করেন খোদেজা। কিন্তু নিজের দিকে তাকানোর সুযোগ হয়নি তাঁর। এরই মধ্যে দিন মাস বছর পেরিয়ে ৫২ বছরে পা রেখেছেন তিনি।
এ বয়সেও তরুণ পুরুষ গাছির মতোই সকাল-বিকেল তরতরিয়ে লম্বা খেজুরগাছে উঠে গাছ কাটা, ভাঁড় টাঙানো এবং নামানোর কাজ করে চলেছেন। সেই রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি এবং ১৮ কিলোমিটার দূরবর্তী সরোজগঞ্জ হাটে গিয়ে বিক্রির কাজও একাই করেন তিনি নিজে। চলতি বছর গুড়ের দাম বেশি হওয়ায় বেশ খুশি খোদেজা। খেজুরগাছ কাটার পাশাপাশি কৃষিজমি ইজারা নিয়ে সেখানে বিভিন্ন ফসল আবাদ করেন তিনি। বর্তমানে দেড় বিঘা জমিতে ভুট্টার আবাদ করেছেন।
এ ছাড়া নিজের উপার্জনের অর্থে কেনা একটি শ্যালো মেশিন দিয়ে কৃষিজমিতে সেচের ব্যবসা করেন। বাড়িতে চালকুমড়াসহ বিভিন্ন সবজির আবাদ করেন এই নারী।
কর্মদক্ষতার কারণে খোদেজা খাতুনের পরিচিতি নিজ গ্রাম ছাড়াও আশপাশের গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে। তবু জীবনের চলার পথে অভাব পিছু ছাড়ে না তাঁর। প্রতিবেশী চানবানু প্রথম আলোকে জানান, ভাইবোনকে মানুষ করতে গিয়ে খোদেজা বিয়েশাদি না করে চিরকুমারী থেকে গেছেন।
অথচ সেই ভাইবোনদের কেউই এখন তেমন খোঁজ নেন না।
দুই ভাই-ই বিয়ের পর থেকে শ্বশুরবাড়িতে ঘরজামাই হিসেবে বসবাস করছেন। এর মধ্যে ভিটেবাড়ির জমি নিজেদের অংশও বিক্রি করে দিয়েছেন তাঁরা। পাঁচ-ছয় বছর আগে সেজো বোন জহুরার স্বামী মারা যাওয়ার পর বোন খোদেজার কাছে ফিরে আসেন। সেই থেকে দুই বোন একসঙ্গেই থাকেন।
খোদেজার একমাত্র ঘরটি ছয়-সাত বছর আগে অতিবর্ষণে ভেঙে যাওয়ার পর অর্থাভাবে তা মেরামত করা হয়নি। ভাঙা ঘরের সঙ্গে একটি মাচা তৈরি করে সেখানেই বসবাস।
খোদেজার বড় প্রয়োজন এখন একটি থাকার ঘর। এলাকার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা হুমায়ুন কবীর প্রথম আলোকে জানান, খোদেজা খাতুন নিজের গুণে একটি স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করে নিয়েছেন। তিনি একজন আদর্শ কৃষকও বটে।
তিতুদহ ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মনিরুজ্জামান জানান, খোদেজা খাতুন এই বয়সেও যে সাহসিকতার সঙ্গে কাজ করে চলেছেন, তা দীর্ঘদিন দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।