বাইট্টা জালাল বাড়িতে আছো নাকি ? ও জালালের বউ , বাইট্টা গেছে কই ? বলতে বলতে জালাল এর বাড়ির উঠোনে ঢোকে সোবাহান শেখ ।
রাগে জাহেদার শরীর জ্বলতে থাকে । কি বলবে , মুরুব্বী মানুষ । মাথায় আঁচল টেনে উঠোনে এসে দাঁড়ায় সে ।
সালাম আলাইকুম চাচা ।
উনি বাড়িত নাই , কামে গেছে ।
অলাইকুম । আসলে কইয়ো আমি খুঁজতাছি । শুনলাম বাইট্টা নাকি মোবাইল কিনছে ? মোবাইল দিয়ে হ্যায় করে কি ? ঘোড়া রোগ হইছে তোমাগো !
ক্যান চাচা , মুবাইল থাকোন কি দুষের নাকি ? মানুষটা বাইট্টা হইছে বইলা কি শখ আল্লাদ থাকতে পারবো না ? সে তো আর চুরি করে নাই , নিজের পয়সায় কিনছে । একটানা কথা গুলো বলতে পেরে স্বস্তি বোধ করলো জাহেদা , মাইনষের কি ক্ষতি করছে মানুষটা ! ভাবে সে ।
চ্যাতো ক্যান ? এমনি কইলাম , নাম্বরটা দাও ফোন করুমনে । ওরে দরকার ছিলো ।
হেই দিনই তো পাকের ঘরের বেড়া ঠিক কইরা দিয়া আসলো ।
না , ঘরামীর কাম না । অন্য একটা বিষয় ।
ওরে কইয়ো আমি আইছিলাম - বলে জাহেদার দিকে তাকালো সোবাহান শেখ । তুমি বাড়িতে একলা নাকি ? পোলাপান কাউরে দেখতেছি না ।
জাহেদা আঁচলটা ভালোমতো টেনে দেয় শরীরে । মিথ্যে বলে , না শাশুড়ি আছে ঘরে , নামাজ পড়ে । এই মানুষটাকে ও দেখতে পারে না ।
মেয়েমানুষ দেখলেই ছোঁক ছোঁক করে । দীর্ঘশ্বাস ফেলে জাহেদা , স্বামী বেশি খাটো বলে কতো মানুষ যে সুযোগ নিতে চায় । বলে , ওমন স্বামীর ঘর করার চেয়ে সতীনের ঘর করা ভালো ।
প্রথম প্রথম জাহেদা শুধু কাঁদতো । কথা সত্যি জালাল খাটো কিন্তু মানুষটার ওপর ওর অনেক মায়া ।
১৪ বছর আগের সেই দিনটার কথা জাহেদার খুব মনে আছে । জালালের বোন জমিলা ওর মায়ের কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলো ।
বলেছিলো , আমার ভাইডার কুনো খুঁত নাই । কুনো বদ অভ্যাস নাই , বিড়ি সিগ্রেট পরজন্ত খায় না । মাইয়া মাইনষের দিকে চোখ দেয় নাই কুনোদিন ।
দুষের মইধ্যে হ্যায় একটু বাইট্টা , এই ধরেন আমার লাহান । আমি মাইয়া মানুষ দেইখা দ্যাখতে খারাপ লাগে না , হেরে একটু খারাপ দেখা যায় । হেই লাইগাই তো গরীব ঘরের মাইয়া খুঁজতাছি ।
জাহেদা দেখেছে জমিলা তার মতোই লম্বা হবে । ওর শখ ছিলো ওর বর হবে অনেক লম্বা , সিনেমার নায়কের মতো ! থাক , কি হবে একটু খাটো হলে ? সে বিধবা মায়ের কথায় রাজী হয়ে গেলো ।
যৌতুক দিতে হবে না এইটাই ওর মায়ের কাছে অনেক বড় । জাহেদার মনে নাই ওর বাবার কথা । দুই ভাই তাদের সংসার নিয়ে ব্যস্ত । ও আর ওর মা এর ওর বাড়ির ফুট ফরমাশ খাটে , তাই দিয়েই কোনোমতো খেয়ে পড়ে মা মেয়ের দিন যাচ্ছিলো ।
ভাই বউগুলো এমন দজ্জাল ! বলে , আমাগোই চলে না ।
দুইজন মাইনষেরে খাওন দিলে আমাগো পোলাপান কি না খাইয়া থাকবো নাকি ?
আর যাই হোক খাবারের খোঁটা সহ্য করা যায় না । অসুস্থ মাকে নিয়ে জাহেদা আলাদাই থাকতো । ইচ্ছে ছিলো বিয়ের আগে মানুষটাকে একবার দেখবে । আসলেই কি বেশি খাটো ? মা মানা করলো , সে নাকি দেখেছে । জমিলার কথাই ঠিক , বেশি খাটো না ।
ভাই'রা তো আর কোন খোঁজ করবে না । ওকে নিয়ে ভাববার সময় কোথায় ?
এক সন্ধ্যায় জালালের সাথে ওর বিয়ে হয়ে গেলো । শাহ্ নজর এর সময় ভাবিরা হাসতে হাসতে এ ওর গায়ে গড়িয়ে পড়ছিলো । ও দুলা মিয়া , তুমি দেখি বামুন হইয়া চাঁন পাইলা ।
জাহেদা ঘোমটার আড়াল থেকে দেখার চেষ্টা করেছিলো কিন্তু অল্প আলোয় ভালোমতো দেখতে পারে নি ।
আবার মুরুব্বিরা কে কি মনে করে এই ভেবে তেমন চেষ্টাও করেনি ।
বিদায় দেবার সময় মা অনেক কাঁদছিল । বলছিলো , মারে তুই আমারে মাপ কইরা দিস , মনে কোন কষ্ট রাখিস না । সবার ভাইগ্যে সব হয় না রে মা ।
জাহেদাও পাগলের মতো কাঁদছিল , অসুস্থ মাকে একলা ফেলে যেতে বুকটা ভেঙে যাচ্ছিলো ।
শ্বশুর বাড়ি এসে তো সে অবাক । কি সুন্দর ওয়াল করা টিনের ঘর ! কারেন্ট ও আছে । জাহেদা মনে মনে অনেক খুশি হয়েছিলো । তার মামাতো বোন সালেহার শ্বশুর বাড়ি টিনের ওয়াল করা ঘর আছে তাই নিয়ে সালেহার কি দেমাগ ! এখন ওর শ্বশুর বাড়িও তো এমন । তো ? শুধু ওর স্বামী একটু খাটো ।
জাহেদা মনে মনে ভাবলো , মানুষটাকে একটা হিল জুতা কিনতে বলবে । আচার অনুষ্ঠান পালনের সময় আশেপাশের বাড়ি থেকে অনেক বউ ঝি আসছিলো । সেমাই , ফিরনী কতো কিছু খাওয়ালো সবাই !
মুরব্বী গোছের এক মহিলা বলছিলো , ও জালালের মা , তুমার এমুন পোলা ! বউ তো পাইছো চাঁন্দের লাহান ।
জাহেদার শাশুড়ি ওর দিকে একবার তাকিয়ে মুখ ঝামটা দিয়ে বলেছিলো , চাঁন দেখলা কুনহানে ? কালা মাইয়া ! আমার পোলা কি ফ্যালনা নাকি ? সোনা ব্যাকা হইলেও সোনা ।
জাহেদার খুব খারাপ লাগছিলো ।
তার গায়ের রঙ সামান্য চাপা হলেও মুখটা মিষ্টি । ওদের গ্রামের সবাই এই কথা বলে । পাশের বাড়ির সালাম ওকে তো এই জন্যই পছন্দ করতো । কিন্তু গরীবের মেয়ে বলে সালামের মা বাবা রাজি হয় নাই । বলেছিলো যৌতুক লাগবে চল্লিশ হাজার টাকা ।
মা কোথায় পাবে এতো টাকা ? সালাম বিয়ে করলো অন্য জায়গায় ।
দেখা হলেই বলতো , জাহেদা তোরে আমি ভুলতে পারি নাই । এই চাঁন্দের লাহান মুখ ক্যামনে ভুলি !
দীর্ঘশ্বাস ফেলে জাহেদা ।
ও বউ আমি যাই, তোমরাও সবাই যার যার বাড়িত যাও । বউডা বিশ্রাম নিক ।
জালাল ,ও জালাল গেলি কই ? নতুন বউরে একলা রাখোন ঠিক না । বউ নিজের হাতে দরজা বন্ধ কইরো , বলে শাশুড়ি সবাইকে নিয়ে বের হয়ে গেলো ঘর থেকে ।
জাহেদা , ঘোমটা সরিয়ে আশেপাশে তাকালো । বেশ বড় একটা ঘর , আলমারি ও আছে একটা , একটা আলনা ও আছে - পায়ের আওয়াজ পেয়ে চট করে ঘোমটা টেনে দেয় সে । কেমন একটা লজ্জা পেয়ে বসেছিলো ! অচেনা একটা মানুষ তার স্বামী ! তার সাথে এক ঘরে থাকতে হবে ।
সে যা চাইবে তাই করতে হবে । ভাবতেই লজ্জায় শিউরে উঠেছিলো জাহেদা । মানুষটা ঘরে ঢুকেছে অনেকক্ষণ কিন্তু কাছে আসছে না । সেও কি ওর মতো লজ্জা পাচ্ছে নাকি ?
বেশ কিছুক্ষণ পর জাহেদা ঘোমটা সরালো । আরে এইটা কে ! একটা ছোট বাচ্চা ছেলে জানালার দিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়ানো ।
আশেপাশের কোন বাড়ির ছেলে হবে , নতুন বউ দেখতে এসে নিজেই লজ্জা পাচ্ছে । ও আস্তে করে নেমে এলো , তারপর পেছন থেকে বাচ্চাটাকে ধরতেই সে ঘুরে তাকালো । চমকে উঠলো জাহেদা , কে ! একটা বামন !!! ছোটবেলায় সার্কাসে দেখেছে । এরা মুখে রঙ মেখে জোকার সাজে । এ এখানে কি করে !!
তুমি মানে আপনি এইখানে কি চান ?
আমি জালাল , তোমার স্বামী ।
আমি ছাড়া কেডা আসবো তোমার ঘরে ?
মানে ? জাহেদা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে । ওর মাথায় কিছু ঢুকছিলো না । তাহলে এই বামনটার সাথেই বিয়ে হয়েছে ওর ! ওর সমান তো দূরের কথা ওর কোমর পর্যন্ত হবে বড়জোর !
এইডা মায় করলো কি ! হের লাইগাই বিদায় দেওনের সময় অমন কাঁনতেছিলো ! জাহেদা আর ভাবতে পারে না । মাটিতেই বসে পড়ে , দু'চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে পানি পড়তে শুরু করলো জাহেদার ।
ওর কান্না দেখে জালাল বোকা হয়ে যায় !তবে কি মেয়েটা আগে কিছুই জানতো না ! জমিলা তো বলেছিলো , গরিব ঘরের মেয়ে তাই সব জেনেও রাজি হয়েছে ।
জালাল তো এমন না জানিয়ে বিয়ে করতে চায়নি । কি করবে ও এখন ? আহারে ! নতুন বউটার জন্য ভীষণ মায়া লাগতে শুরু করলো ওর । এতো সুন্দর একটা মেয়ে ! সেই মেয়েটাকে বাসর ঘরেই এমন কাঁদতে হচ্ছে ! নিজেকে সামলাতে পারে না জালাল । বউ এর পাশে বসে পড়ে ।
বলতে থাকে , বউরে ,আমারে দেইখা তুমি এমুন দুঃখু পাইবা জানলে আমি তোমারে বিয়া করতাম না ।
তুমি দেইখো আমি তুমারে কুনুদিন কিছু কমু না , অনেক ভালোবাসমু । ও বউ , তুমি কাইন্দো না । তুমি কাঁনলে আমি কই যামু ? জালাল শিশুর মতো ফুঁপিয়ে ওঠে ।
জালালের কান্নার শব্দে জাহেদা অবাক হয়ে তাকায় ! এতো বড় একজন পুরুষ মানুষ এইভাবে কাঁদে নাকি ! হঠাৎ জাহেদার বড় মায়া হয় , আহারে ! মানুষটার না জানি কতো দুঃখ ! আসলেই তো মানুষটার কি দুষ ? আল্লাহ এমুন বানাইলে হ্যায় কি করবো ? তার নিজের কপালই মন্দ , তাই এমুন স্বামী জুটছে ! নিজেকে সান্তনা দেয় সে । জাহেদা জালালের হাত ধরে , আশ্চর্য বিষয় ! তার একটুও লজ্জা করেনি !
জালাল চোখের পানি মুছে বলে, বউরে আমি মানুষটা খাটো হইতে পারি কিন্তু আমার ভালোবাসা খাটো না ।
দেইখো বউ আমি তুমার দুঃখ ভুলাইয়া দিমু ।
জাহেদার স্পষ্ট মনে আছে সে রাতে দুজনে অনেক কেঁদেছে । একসময় কি এক কথায় দুজনেই হেসে দিয়েছিলো । শেষ রাতে জালাল পকেট থেকে একটা পাতার বাঁশি বের করে বাজিয়েছিলো । জাহেদা মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলো ! কি যে সুন্দর সেই সুর ! কি করুণ ! ওর মনে হলো বাঁশির সুরে বনের সব পশু পাখি কাঁদছে ! মানুষটাকে ঐ সময়ই ভালোবেসে ফেলেছিলো সে ।
এই চৌদ্দ বছরে সে ভালোবাসা একটুও কমে নাই । মানুষটাও তার কথা রেখেছে , কোনদিন একটা খারাপ কথাও বলেনি তাকে ।
বিয়ের পরদিন ভোর বেলায় শাশুড়ি এসে বলেছিলো , বউ কাপড়চোপড় গোছায় নিয়া তোমার ঘরে যাও । এইডা মাইজা পোলার ঘর । আমি বুড়া মানুষ , আমারে থাকতে দিছে আমি তাতেই খুশি , বলে উঠোনের কোনায় একটা ছাপরা দেখিয়ে দিলো !
জাহেদা বুঝলো ও যা ভাবছিলো তা না ।
এইটা ওর স্বামীর ঘর না । এক এক করে সব জানলো সে , আত্মীয়স্বজন এর মধ্যে কেউই এমন না । জালালের পর আরো তিন ছেলে এক মেয়ে হয়েছে ওর শাশুড়ির । সবাই স্বাভাবিক গড়নের , শুধু জালালই আর লম্বা হয় নাই । ওর ভাই বোনরা ওকে নিয়ে লজ্জা পায় , সব জায়গায় পরিচয় ও দিতে চায় না ।
আহারে মানুষটা ! বুকের মধ্যে কেমন করে ওঠে জাহেদার !
জালাল মাঝে মাঝেই বলে , বউ তুমি আমার লাহান এই বাইট্টা মানুষটারে এতো ভালোবাসো ক্যামনে ! আল্লার কাছে আমার আর কিছু চাওনের নাই ।
অন্য ভাইয়েরা ভালো কাজকর্ম করে । কেউ রাজমিস্ত্রি , কারো বাজারে দোকান আছে । পড়াশুনায় মাথা ছিলো না বলে অন্য ভাইয়েরা কিছু পড়াশুনা করলেও জালাল পারেনি । শশুর চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু উচ্চতা নিয়ে সবার কটূক্তি জালাল কে সব সময় বিব্রত করতো ।
জোর করেও স্কুলে পাঠাতে পারেনি ওকে আর ।
এখন টুকটাক ঘরামীর কাজ করে । উচ্চতার জন্য অনেক কাজই সে করতে পারে না । শরীরেও জোর কম । দুই দিন পরিশ্রম করলেই হাঁপিয়ে ওঠে ।
জাহেদা বলে , থাক তুমি অতো খাইটো না তো । দুইজন মানুষ , নাহয় কম খামু । তুমার এতো কষ্ট করোন লাগবো না । দুই দিন কাম করবা আর দুই দিন আমারে বাঁশি বাজাইয়া শুনাবা ।
জালাল খুব অবাক হয় , এখনো রাস্তা ঘাটে কতো মানুষ কতো কথা বলে ! তুই তোকারি করে ।
ছোট ছেলেপুলেরা খ্যাপায় , লাঠি দিয়ে খোঁচা দেয় ! আপন মানুষেরা নানা বিদ্রুপ করে । আর এই সুন্দর মেয়েটা তাকে কিভাবে এতো ভালোবাসে ! একসময় জালাল খুব দুঃখ করতো । ছোটবেলায় শখ ছিলো সাইকেল চালাবে । কিন্তু এই সামান্য শখটুকুও পূরণ হয় নাই । চার পাঁচ বছরের একটা শিশুর মতো লম্বা হতেই ওর উচ্চতা থেমে গেলো ।
তার বাবা তাকে ডাক্তার দেখিয়েছিলো কিন্তু ডাক্তার বলেছিলো একেবারে ছোটবেলায় নাকি দুইটা ইনজেকশন দিলে নাকি জালাল লম্বা হতো ।
জালালের মা অনেক আফসোস করতো , আহারে দুইডা ইংজেনশন এর লাইগা আমার পোলায় লম্বা হইলো না !
পরে সে শুনেছে এটা ঠিক কথা না । কতো বড়লোকের ঘরে এমন আছে ! তারা কি আর সময় মতো চিকিৎসা করায় নাই ?
জাহেদার মনে পড়ে প্রথম সন্তানের জন্মের কথা । দুই জনের অনেক খুনসুটি হতো এ নিয়ে ।
জালাল বলতো , দেইখো বউ তোমার চান্দের লাহান মাইয়া হইবো ।
আমি হ্যারে নিয়া গঞ্জের হাডে যামু । পুতুল কিন্যা দিমু । তারপর আমি আর আমার মাইয়া এক লগে পুতুল খেলুম ।
জাহেদা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে , ও আল্লা ! তুমি এইডা কউ কি ! আমার একখান পোলা হইবো । হ্যায় আমারে গাছের থন কাঁচা আম পাইড়া দিবো ।
পেয়ারা পাইড়া দিবো । তোমার মাইয়া কি এইডা পারবো ? আমি হ্যার নাম রাখমু জাহিদ । আমার নামের লগে মিলাইয়া ।
এই নিয়ে জালালের সেকি অভিমান ! জাহেদা হাসতো , এই , তুমি এমুন পোলাপানের লাহান গোসসা করো ক্যান ? আচ্ছা যাও এইবার হইবো পোলা , পরের বার তোমারে একখান পরীর লাহান মাইয়া দিমু ।
এইসব ভালো লাগার মাঝে এক ভয় সব সময় তাড়িয়ে বেড়াতো ।
যদি বাচ্চাটা জালালের মতো বামন হয় ! তাহলে বাচ্চাটার কতো কষ্ট হবে । তারপর নিজেরাই নিজেদের সান্তনা দিতো , না না । তা হবে না । জাহেদার মতোই স্বাভাবিক হবে ।
অভাবের সংসার ।
ডাল ভাত জোটানোই যেখানে কষ্ট সেখানে জালাল লুকিয়ে লুকিয়ে মেয়ের জন্য লাল জামা , জুতো , চুল বাঁধার ফিতা এগুলো কিনে এনে লুকিয়ে রাখতো । জাহেদা ঘর ঘোছাতে গিয়ে দেখেছে কিন্তু কিছু বুঝতে দেয় নি জালাল কে ।
নামাজে বসে আল্লাহর কাছে বলতো , আল্লা আমার পোলা লাগবো না । হ্যার মাইয়ার শখ , তুমি এই মানুষটার শখটা পূরণ কইরো ।
একদিন হঠাৎ জাহেদার বড় ভাই এলো ।
ভাইয়ের মুখ শুকনো দেখে জাহেদার বুকটা কেঁপে উঠেছিলো ভাইয়েরা কোনদিন কোন খোঁজ নেয় না , আজ হঠাৎ তার বাড়িতে !
মায় আর নাইরে , বলেই কেঁদে ওঠে ভাই ।
ভাই ওকে নিতে এসেছিলো । জাহেদার পৃথিবী তখন দুলছে । পোয়াতি মেয়ে , শরীরটা হঠাৎ অনেক খারাপ করেছিলো তাই আর শেষ বারের মতো মাকে দেখা হলো না ।
জাহেদার ছেলে হলো এক বৃহস্পতিবার ।
জালাল কাজ থেকে ফিরেই শোনে , বউ এর ব্যাথা উঠেছে । খানিক বাদেই ওর মা বেরিয়ে এসে খবর দিলো , ছেলে হয়েছে । আজান দিতে হবে ।
ওকে বললো , যা তো বাজান । হুজুররে খবর দে , আজান দিতে হইবো ।
মেয়ে হয়নি ছেলে হয়েছে উত্তেজনায় জালালের এই গুলা মাথায় কিছুই কাজ করেনা । কিন্তু জাহেদা এমন কাঁদছিলো । আহারে মানুষটা একটা মেয়ে চেয়েছিলো । জালাল হেসেই খুন ।
বলে , আরে পাগলী ! এর পর দেইখো মাইয়া হইবো ।
তোমার পোলারে কিন্তু এখন আমার মাইয়ার কাপরই পরানো লাগবো । জাহেদা বাধ্য হয়েই হেসে ফেলেছিলো ।
জাহেদা শখ করে ছেলের নাম রাখে জাহিদ । কাজ শেষে দু'জন বাচ্চাদের মতো খেলে ছেলের সাথে । জালালের শখ ছেলেকে অনেক পড়ালেখা শেখাবে ।
অনেক বড় চাকরি করবে ছেলে । হাজারো স্বপ্ন । জাহেদা মানুষটার ছেলেমানুষি দেখে আর হাসে ।
ইশ !! মাইয়া হইলে না জানি আরো কতো খুশি হইতো মানুষটা !
খুশিগুলো একসময় কমতে শুরু করে । জাহিদ কেমন যেন দেখতে হচ্ছে ! হাত পা ঠিক লম্বা হচ্ছে না ।
চার বছর হতে চললো কিন্তু ...
জালাল পাগলের মতো হয়ে গেলো । ডাক্তারের কাছে ছেলে কে নিয়েও গেলো । কিন্তু কোন সমাধান হলোনা । ডাক্তার বললো , কিচ্ছু করার নেই । ছেলে বামনই হবে ! হাড়ের গড়ন দেখে নাকি বোঝা যায় ।
জালাল সেদিন পাগলের মতো কেঁদেছিলো । জাহেদা পাথর হয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে স্বামীর পাশে এলো । বললো , তুমি শান্ত হও । আমারে দেইখা নিজেরে বুঝ দাও । পোলায় তোমারে কাঁনতে দেইখা ভয় পাইবো তো ।
দেইখো এর পর একটা মাইয়া হইবো । আমার লাহান লম্বা হইবো ।
না ! জালাল চিৎকার করে ওঠে ।
জাহেদা অবাক হয়ে যায় । মানুষটা তো এমন করে কোনদিন রেগে যায়নি !
না , আর কোন জালাল আইবো না দুনিয়ায় ।
একটাও না । না । বলেই হনহন করে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে । জালালের চিৎকার শুনে মেজো বউ , শাশুড়ি বের হয়ে আসে ঘর থেকে ।
এমনিতে মেজো বউয়ের অনেক দেমাগ ।
আজ জাহেদার মাথায় হাত দিয়ে বলে , থাউক বইন । দুক্ষু কইরো না । আল্লার উপরে তো আর কারুর হাত নাই ।
শাশুড়ি বোকার মতন বসে থাকে জাহেদার পাশে । জালাল সে রাতে অনেক দিন পর পাতার বাঁশি বাজিয়েছিলো ।
জাহেদা ঘুমের ভান করে পড়েছিলো বিছানায় ।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে জাহেদা । সব ছবির মতো ভাসে ওর চোখে । জাহিদের বয়স এখন ১২ । জালালের মতোই উচ্চতা ।
ক্লাস থ্রি তে পড়ে । সেই একই জীবন ! পাড়ায় সবাই আজেবাজে কথা বলে ছেলেটাকে । ছেলের টিভি দেখার শখ । কিন্তু কার বাড়িতে দেখবে ?
সবাই দূর দূর করে । বলে , বাইট্টার পোলা বাইট্টা ।
জাহেদা মানুষের এই নিষ্ঠুরতায় যতোটুকু না কষ্ট পায় ,অবাক হয় তারচেয়ে বেশি । এই টুকুন একটা বাচ্চার সাথে মানুষ কিভাবে এমন করতে পারে তা কিছুতেই ভেবে পায় না সে । এক এক সময় জালাল খুব রেগে যায় । কিন্তু কি করার আছে ওর ! গরীব মানুষের আবার দুঃখ !
জালাল বাড়ি ফিরলে জাহেদা বলে সোবাহান শেখ এর কথা ।
জালাল গালি দিয়ে ওঠে , হারামজাদা ! শয়তানডার সাথে দেখা হইছে ।
ওর কতো বড় সাহস ! বউ জানো , কি কয় আমারে ? কয় আমারে আর আমার পোলারে চাকরি দিবো । সার্কাসে ! না খাইয়া মইরা গেলেও তো আমার পোলারে আমি সার্কাসে দিমু না । আমাগো বেচনের ধান্দা করছে হারামজাদা !
জাহেদা কিছু ভাবতে পারে না । চোখের সামনে দেখে এক সার্কাসের মঞ্চ । দুইজন বামন মুখে রঙ মেখে জোকার সেজেছে , সবাই তাদের বিদ্রূপ করছে ।
গায়ে ঢিল ছুঁড়ে মারছে । মাটিতে বসে পড়ে জাহেদা । জাহেদার এই বিহ্বল অবস্থা দেখে সম্বিৎ ফিরে পায় জালাল । দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে বউকে । ও বউ , বউ ।
তুমি এমুন ভাইঙ্গা পইরো না তো । দুনিয়ার কেউ পারবো না তোমার পোলারে সার্কাসে নিতে । আমি কি মরছি নাকি ?
জাহিদ স্কুল থেকে ফিরে অবাক এক দৃশ্য দেখে - বাবা , মায়ের পাশে বসে পাতার বাঁশি বাজাচ্ছে । দুজনের চোখেই পানি । ও দৌড়ে এসে জাহেদার কোলে বসে পড়ে ।
ও মা , কি হইছে ?
কিছু না বাজান । তুমি হাত মুখ ধুইয়া আসো , আমি তুমার খাওন দেই ।
একদিন হঠাৎ কাজে গিয়ে খানিক বাদেই ফিরে আসে জালাল । জাহেদা রান্নার জোগাড় করছিলো কেবল । অসময়ে জালাল কে দেখে ভয় পেয়ে গেলো সে ।
কি হইছে ? ফিরা আসলা যে ?তুমার শরিল খারাপ নাকি ?
বউরে আমি মানুষ না রে বউ , আমি মানুষ না । ডুকরে কেঁদে ওঠে জালাল । যেই বাড়িতে কাম করতে গেছি হেই বাড়িতে পোয়াতি আছে একজন । বউরে , আমারে দেইখা এমুন চিক্কুর দিলো !! দৌড়ায় গিয়া ঘরের দরজা দিছে রে বউ ! কইতেছিলো , কে আমারে বাড়িতে ঢুকাইছে ! আমারে দেখলে নাকি হ্যার আমার মতো পোলা হইবো । ও বউ , তুমি তো আমারে অনেক ভালোবাসো ।
তুমি কও বউ আমি কি পশু ! ও বউ , তুমি আমারে পোয়াতি কালে কেন দেখছিলারে বউ ? কেন দেখছিলা ? হেই লাইগাই তো তোমার ঘরে এমুন পোলা হইছে । ও বউ আমারে মাইরা ফালাও । এই জীবনের কুনু দাম না গো বউ । আমি একখান অভিশাপ ! আমারে বিষ দিয়া মাইরা ফালাও রে বউ ।
জাহেদা স্বামীর কাছে আগায় না ।
অবাক দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকায় ।
মা বলতো , আল্লা সাত আসমানের উপরে থাকে । তিনি নাকি তার বান্দারে ওইখান থেইকা দেখেন । বান্দার সুখ শান্তি নাকি তার হাতে !
আজ তার মনে প্রশ্ন জাগে , তিনি কি আছেন ? না জালাল রে তিনিও পশু মনে করেন !
৯/১২/২০১১
( এই গল্পের জালাল কোন কাল্পনিক চরিত্র নয় । আমাদের মতোই সাধারণ একজন মানুষ ।
ফরিদপুরে এক রাস্তায় তাঁর সাথে আমার দেখা । তাঁর মতো মানুষ হয়তো সচারাচর দেখতে পাই আমরা । কিন্তু আমাকে বিস্মিত করেছিলো তাঁর তিন পুত্র । যারা তাদের বাবার মতোই হয়েছে । অসহ্য এক কষ্ট আমায় নির্বাক করে দিয়েছিলো ।
আমি তাঁর সাথে কথা বলতে তাঁর বাড়ি গিয়েছিলাম । তাঁর অবাক কষ্টের জীবন ! এই লেখায় কিছু কল্পনার আশ্রয় নিতে হয়েছে । এই লেখার উদ্দেশ্য , আমরা যেন জালালদের মতো শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষকে বিদ্রূপ না করি । তাদের সম্মান করি । আমাদের মতো তাঁদের রয়েছে এই পৃথিবীতে স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকার ।
তাঁরা ঊনমানুষ নয় ,মানুষ ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।