শেষ কবে চোখের পানি ফেলেছিলাম,মনে নেই। হয়তো বা বাবার শাসনে বা টিচারের বকুনিতে। তখনকার কাঁদুনিতে যতটা না শোক ছিল,তার চেয়ে বোধ হয় ক্ষোভ ছিল বেশী। আবেগকে রুদ্ধ করতে গিয়ে মানুষের চোখে যে জল আসে,তার ধারা যে কতটা শক্তিশালী হয় সেটা অনুভব করলাম ক্যাম্পাস থেকে আমাদের বিদায় বেলায়। "জীবন-আবেগ রুধিতে না পারি" কবির এই কথাটি কতটা সত্য অনুধাবন করলাম গত কয়েকটা দিনে।
এ অনুভূতি ব্যক্ত করার মত নয়,কেবল আমরা যারা আমাদের নাড়ীর টান ছিঁড়ে এসেছি তারাই বুঝতে পারছি এই বিদায়ের ব্যথা।
আমাদের বিদায়ের সুর বেজেছিল ঈদের ছুটির পর থেকেই। এ ক্যাম্পাস ছেড়ে অন্যত্র যেতে হবে,মনের ভেতর এক অজানা ভয়-শোক-হতাশা মিশ্রিত এক অদ্ভুত অনুভুতির শুরু সেখান থেকেই। এরপর স্যারদের সিগনেচারের জন্য ওয়ার্ডগুলো দৌড়োদৌড়ি করতে হয়েছে সবাইকে। আমাদের তখন মনে হয়েছে,ইশ...এই ওয়ার্ডে আর আসা হবে না,নাইট করা হবে না।
আমাদের হাসপাতাল যেন একটি বৃক্ষ,একে একে যেন এই বৃক্ষের শিকড়গুলো কেউ কেটে দিচ্ছে আর গাছটা ধীরে ধীরে প্রাণশূন্য হয়ে পড়ছে। অথচ এই বৃক্ষের প্রাণরসের বিনিময়ে আমরা ধীরে ধীরে কলি থেকে প্রস্ফুটিত পুষ্পে পরিণত হয়েছি।
অবশেষে সেই দিনটি চলে এল। নভেম্বরের ত্রিশ তারিখ। সকাল থেকেই সবার প্রস্তুতি,কখন র্যালি হবে,কে কি সাজব।
যে ফরটি টু ক্যাম্পাসে হাতে গোনা কয়েকটা প্রোগ্রাম করেছে,তারাই এক দিনের প্রস্তুতিতে এম এম সি-র ইতিহাসে অন্যতম সাফল্যজনক একটি সারম্বর র্যালি করে ফেলল। আমরা সবাই অবাক হয়ে গেলাম,একটু আফসোসও খেলা করে গেল মনে,"আরে...আমরাও তো পারি। আমরাও তো ইচ্ছে করলে প্রতি বছর কেন,প্রতি মাসে মাসে সফলতম প্রোগ্রাম উপহার দিতে পারতাম। "সেদিন বিকেলে আবার প্রাতিষ্ঠানিক কাজ,সবাই হাসপাতালের অফিস রুমে জড়ো হলাম। জড়ো হলাম আমাদের চলে যাবার পাসপোর্ট "Internship completion certificate" এর জন্য।
তখনও আমাদের গতানুগতিক ব্যস্ততা,হুড়োহুড়ি। মনে হচ্ছিল আমরা বোধ হয়,কোন পরীক্ষার জন্য সবাই মিলে ফর্ম ফিলআপ করছি। হায় ! এই ফর্ম ফিলআপ আমাদের যেন মায়ের কোল থেকে কেড়ে নিয়ে এক কঠিন যুদ্ধে ঠেলে দিল।
রাত হল। সবাই একত্রিত হলাম আমাদের কলেজ ক্যান্টিনে।
রাতভর প্রোগ্রাম চলল,আমরা সবাই মেতে উঠলাম আনন্দ উৎসবে। প্রদীপ নেভার আগে যেমন শেষবারের মত উজ্জ্বল হয়ে উঠে,আমরাও বোধ হয় সেরকম প্রজ্বলিত হয়ে উঠলাম। নেচে গেয়ে পার হল প্রায় সারা রাত,আমাদের উৎসাহের কমতি নেই,আনন্দের ভাটা নেই। যে ক্যাম্পাসে কাটিয়েছি সাড়ে ছয় বছর,যে ক্যান্টিনগুলোতে খেয়ে বেড়ে উঠেছে আমার দেহের কোষ,তাকে ছেড়ে যাব কিভাবে?অনুষ্ঠানের শেষ ভাগে আমার মনে করুণ আর্তিতে ভরে গেল,আমি আর বন্ধুদের সাথে নাচতে গাইতে পারলাম না। দূর থেকে বসে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম আমার বন্ধুদের দিকে।
ধীরে ধীকে ফিকে হয়ে গেল সব রং,শুন্যতা এসে ভর করল সবার হৃদয়ে। হায় রে বাস্তবতা ! তুই এত নিষ্ঠুর কেন?কেন তুই কেড়ে নিতে চাস আমার বন্ধুদের?যাদের সাথে কাটিয়েছি মুহুর্তের পর মুহুর্ত,এক দিনের ব্যবধানে তাদের হারাব সময়ের গহ্বরে,এ কেমন নিয়তির খেলা?আমি আর পারছিলাম না,মনে হচ্ছিল চিৎকার করে বলি,"না...না...আমরা যাব না,আমরা থাকব আমাদের ক্যাম্পাসে। প্রতিদিন লেকচারে যাব দল বেঁধে,একসাথে আইটেম-কার্ড-টার্ম-প্রফ দিব। আমরা মেডিকেল স্টুডেন্ট হব,আমরা ইন্টার্ন হব আবার। দরকার নেই আমার বড় বড় প্রফেসর হবার।
আমরা থাকব,আমরা ফর্টি টু হিসেবেই থাকব। "
চোখ তুলে তাকিয়ে দেখি,আমাদের ব্যাচের শক্ত মনের ছেলেটা আমার দিকে এগিয়ে আসছে। কিছু বোঝার আগেই ও আমাকে জড়িয়ে ধরে ভেউ ভেউ কেঁদে ফেলল। কি করব,কি বলব ওকে?আর বলবই বা কিভাবে?নিজের অজান্তেই তখন আমার চোখে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ধীরে এই বৃষ্টি ছড়িয়ে গেল চোখ থেকে চোখে,অন্তর থেকে অন্তরে।
ক্যান্টিনের ছেলেরা অবাক হয়ে দেখছে,মামারা খালারা কাঁদছে কেন এইভাবে?এমন কি দুঃখ তাদের?হায় রে...কিভাবে বুঝাব ওদের,কিভাবে বুঝাব পুরো পৃথিবীকে?আমরা ছিলাম পরিবার,এম এম সি ছিল আমাদের বসতবাড়ি। হঠাৎ মহাকাল নামের এক কালবৈশাখী এসে সেই ঘরকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিয়ে গেল। আমরা আর সেই ঘরে থাকতে পারব না,বাড়ির উঠানে দৃপ্ত পদচারণা করতে পারব না। এ কেমন নিয়তি?
আমরা কাঁদলাম সবাই। কেউ প্রকাশ্যে,কেউ মনে মনে।
সেই অশ্রুর স্রোতে ভেসে গেল আমাদের ক্যাম্পাস,আমাদের হাসপাতাল। আমরা বর্তমান থেকে হয়ে গেলাম অতীত। অফিসের নথিপত্রে জমা হল আরো কিছু ফাইল,ধুলো পড়ার অপেক্ষায় থাকল তারা। আর আমরা গ্রহ ভেঙ্গে হয়ে গেলাম গ্রহাণু,গ্রহাণু থেকে উল্কা কিংবা ধুমকেতু। ছুটে গেলাম মহাকাশে,নিয়তিকে সাক্ষ্য রেখে।
বলে গেলাম,"ভাল থাকিস তোরা,খুব ভালো। আমরা হয়তো আর মিলতে পারব না কোনদিন,তৈরি করতে পারব না নতুন গ্রহ। কিন্তু দূর থেকে যেন একে অন্যের আলোর বিচ্ছুরণ বলতে পারি,আমরা একসময় একই গ্রহের ধূলিকণা ছিলাম। বিদায় এম ফরটি টু। "
[লেখাটা লিখেছিলাম আমাদের ব্যাচের ফেইসবুক পেইজের নোটস হিসেবে।
যাদের ছাত্রত্ব শেষ হয়ে গিয়েছে,তারা জানে ক্যাম্পাস ছাড়ার বেদনা কত মর্মন্তুদ। তাই ব্লগের বন্ধুদের সাথে শেয়ার না করে পারলাম না। ] ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।