জ্ঞানের সাগরের এক ফোঁটা জল এখনো গ্রহণ করতে পারিনি। তবুও নিজেকে সবজান্তা বলি। সকলকে কিছু জানাতে পারার জন্যই লিখে থাকি। উৎসর্গঃ রেজোওয়ানা আপুকে, যার ব্লগের বিভিন্ন পোস্ট পড়ে আমি এই লেখা লেখার অনুপ্রেরনা পেয়েছি।
ট্রয়
ট্রয়, ইতিহাস বিখ্যাত ধংশপ্রাপ্ত নগরীগুলুর মধ্যে অন্যতম।
গ্রিক ভাষাই ট্রয়কে বলা হয় ‘ত্রোইয়া’ বা ‘ইলিয়ন’। লাতিন ভাষাই ‘ত্রুইয়া’ বা ‘ইলিউম’। হিত্তিয় ভাষাই ‘ওয়িলুসা’। ট্রয়ের তুর্কী নাম ত্রুভা। এটি একটি কিংবদন্তির শহর যাকে কেন্দ্র করে বিখ্যাত ট্রয়ের যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল।
এই শহর এবং সংশ্লিষ্ট যুদ্ধের বর্ণনা প্রাচীন গ্রিসের অনেক মহাকাব্যেই দেখা যায় যেমন ওডিসি, ইলিয়াড। প্রধানত মহা কবি হোমার-এর অমর কাব্যগ্রন্থ ইলিয়াড-এ ট্রয়-এর তৎকালীন রুপ দেখতে পাওয়া যাই।
ট্রয়ের নাগরিক এবং সংস্কৃতি বোঝাতে ট্রোজান শব্দটি ব্যবহৃত হয়।
অবস্থানঃ এককালের চরম ব্যস্ত নগরী ট্রয় বর্তমানে একটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের নাম।
হোমারের ইলিয়াডে যে ট্রয়ের উল্লেখ রয়েছে সেটিকেই এখন ট্রয় নামে আখ্যায়িত করা হয়।
এর অবস্থান আনাতোলিয়া অঞ্চলের হিসারলিক নামক স্থানে। ট্রয়ের তুর্কী নাম ত্রুভা। অর্থাৎ, আধুনিক হিসারলিক-ই সেই প্রাচীন ট্রয় নগরী। এর ভৌগলিক অবস্থান তুরস্কের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কানাক্কাল প্রদেশের সমুদ্র সৈকতের নিকটে এবং আইডা পর্বতের নিচে দার্দানেলিসের দক্ষিণ পশ্চিমে।
রোমান সম্রাট অগাস্টাসের রাজত্বকালে প্রাচীন ট্রয় নগরীর ধ্বংসস্তুপের উপর ইলিয়াম নামে নতুন একটি শহর নির্মিত হয়।
কনস্টান্টিনোপল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ইলিয়াম বিকশিত হয়েছে, কিন্তু বাইজান্টাইন রাজত্বের সময় ধীরে ধীরে এর পতন হতে থাকে।
১৮৭০ সালে জার্মান প্রত্নতত্ত্ববিদ হাইনরিশ শ্লিমান এই এলাকায় খনন কাজ শুরু করেন। এই খনন চলতে থাকায় এক সময় প্রমাণিত হয় যে, এখানে একের পর এক বেশ কয়েকটি শহর নির্মিত হয়েছিল। সম্ভবত এই শহরগুলোরই একটি হোমারের ট্রয় (ট্রয় ৭)। অবশ্য এ নিয়ে সন্দেহ আছে।
কিন্তু এটা প্রায় নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, হিত্তীয় রচনায় উল্লেখিত উইলুসা শহরটি এখানেই অবস্থিত ছিল। অনেকে মনে করেন ইলিয়ন এই উইলুসা নামেরই গ্রিক সংস্করণ।
১৯৯৮ সালে ট্রয় নামক এই প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশন ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকায় যুক্ত হয়।
প্রত্নতত্ত্ববিদগণের ট্রয়ঃ প্রত্নতত্ত্ববিদগণ ট্রয় নগরিকে এর সময়কাল ও পুনর্গঠনকে কেন্দ্র করে একে ৯টি ভাগে বিভক্ত করেছে। ১৯৯৮ সালে ট্রয়এর সম্বন্ধে প্রত্নতত্ত্ববিদগণের এই মতামত ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকায় যুক্ত হয়।
1. ট্রয় ১: ৩০০০-২৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ (সমইকাল)
2. ট্রয় ২: ২৬০০-২২৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ
3. ট্রয় ৩: ২২৫০-২১০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ
4. ট্রয় ৪: ২১০০-১৯৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ
5. ট্রয় ৫: বিংশ-অষ্টাদশ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ
6. ট্রয় ৬: সপ্তাদশ-পঞ্চদশ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ
7. ট্রয় ৬h: তাম্র সভ্যতার শেষ দিকে চতুর্দশশতাব্দী খ্রিষ্টপূর্বাব্দ
8. ট্রয় ৭a: মহা দুর্ঘটনাটি এই সমইএ ঘটে ১৩০০-১১৯০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। ধারনা করা হয়, হোমারের কাব্যগ্রন্থে ট্রয়নগরীর এই রুপের বর্ণনাই দেওয়া হয়েছে।
9. ট্রয় ৭b¬1: দ্বাদশ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ
10. ¬¬ট্রয় ৭b¬¬2 : একাদশ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ
11. ট্রয় ৭b¬¬3: মহা দুর্ঘটনা ঘটার আগে পরজন্ত ৯৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ
12. ট্রয় ৮: ৭০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দএর দিকে
13. ট্রয় ৯ : ১০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ
লক্ষ্য করুনঃ এখানে বারবার ‘মহা দুর্ঘটনা’ বলা হয়েছে। ইংরেজী ‘catastrophe’ এর মানে অর্থে ‘মহা দুর্ঘটনা’ ব্যাবহার করা হয়েছে। আর এখানে ৭b ৬h এসবের মানে আমি নিজেই জানিনা।
এদের মধ্যে ট্রয় ৬,৭ও ৯ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ট্রয় ৬ : ১৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দএর দিকে ধ্বংস হয়ে যাই যার মূল কারণ ছিল ভূমিকম্প।
ট্রয় ৭: ট্রয় নগরী একাধিকবার ধ্বংস হইয়েছিল এবং পুনরাই তা গঠিত হয়েছিল। প্রত্নতত্তবিদ্গন ট্রয়-এর ৯টি ভিন্ন স্তর খুঁজে পেয়েছিল। ট্রয়-৬ এবং ট্রয়-৭কে ট্রোজান যুদ্ধের নিকটতম সাক্ষী মনে করা হয়।
ট্রয়-৭ এর সময়েই ট্রয় ধ্বংস হইএছিল যার মূল কারণ বিখ্যাত ট্রোজান যুদ্ধ। ট্রয়-৭ ১৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ-এ পূর্ণ রুপ লাভ করে এবং ১১৯০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ধ্বংস হয়। নগরীটি প্রায় ১০০ বছর স্থায়ী হয়। এবং ৭০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দএ পুরোপুরি পরিতেক্ত হয়। মনে করা হয় নগরীটি যুদ্ধে ধ্বংস হয়েছিল কিন্ত তা স্পষ্ট নই।
কারণ খননের ফলে সেখানে শুধু একটি মানুষের মাথার খুলি, একটি বুকের হার আর একটি পূর্ণ কঙ্কাল পাওয়া যাই। আরও খননকার্জ সেই উত্তর না পাওয়া প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারে। বেশীরভাগ প্রত্নতত্তবিদ্গন একমত যে ট্রয় ৭ এর ধংশের মূল কারণ ট্রোজান ওয়ার।
ট্রয় ৯: ট্রয় নগরির শেষ শহর। রোমান সম্রাট অগাস্টাসের সময় ট্রয় ৯ আবিষ্কৃত হয় এবং রোমান সাম্রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিনত হয়।
কনস্টান্টিনোপল স্থাপিত হওয়ার পর এই নগরী বাণিজ্যিক ক্ষেত্রতে অপ্রয়োজনীয় হইয়ে পরে এবং সম্রাট বাইজান্তাইন এর সময়ই এটি ক্রমে ক্ষয় প্রাপ্তির মাধ্যমে ধ্বংস হইয়ে যায়।
প্রত্নতত্ত্ববিদগণের ডিজাইনে ট্রয় ৬
প্রত্নতত্ত্ববিদগণের ডিজাইনে ট্রয় ৭
ট্রয়(movie): ২০০৪ সালে ট্রয় সিনেমাটি মুক্তি পাই। সর্বকালের ব্যাবসা সফল ছবিগুলুর মধ্যে এটি জায়গা করে নেই। যদিও এটি যেহেতু একটি সিনেমা তাই ইতিহাসকে বদলে ফেলা হয়েছে। যেমন ইতিহাসে জানা যাই, গ্রিক ও ট্রোজানদের মধ্যে প্রথম যুদ্ধ হয় হেক্টর ও এজেক্স এর মাধ্যমে।
তারা একটি পৃথক যুদ্ধে অংশগ্রহন করে এবং তাদের যুদ্ধ সারাদিন স্থায়ী হয়। কিন্ত মুভিটিতে দেখন হয় যুদ্ধের এক পরজায়ে তাদের দেখা হয় এবং হেক্টর এজেক্সকে হত্যা করে। প্রকৃতপক্ষে হেক্টর এজেক্সকে হত্যা করতে পারেনি। এছাড়া মুভিটিতে গ্রিকরা ট্রয়কে মাত্র কইএকদিনে ধ্বংস করে কিন্ত হোমারের মতে তারা অবস্থান করেছিল ১০ বছর! এভাবে সিনেমাটির বিভিন্ন জাইগাই মূল ঘটনার বদল ঘটেছে সিনেমার খাতিরে।
ট্রয়ের দেওয়াল:গ্রিক পুরাণে অসংখ্যবার ট্রয়ের দেওয়ালের নাম নেওয়া হয়েছে।
মুলত সেই দেওয়ালের কারনেই বহু বছর ট্রয় অজেই ছিল। তবে গ্রিক রাজা ওডিসিয়াসের বুদ্ধিতেই ট্রয়কে ধ্বংস করা সম্ভব হয়। ট্রয় ধ্বংসের অন্যতম কারণ ছিল মহাবীর হেক্টরের মৃত্যু এবং গ্রিকবীর একিলিস।
ট্রোজান ওয়ার: ট্রোজান ওয়ার সংগঠিত হয়েছিল ট্রোজানদের ও গ্রীকদের মধ্যে। হোমারের কাব্যগ্রন্থ ইলিয়াডে যুদ্ধের মধ্যবর্তী বর্ণনা পাওয়া যাই আর ওডিসিতে পাওয়া যাই ট্রোজান যুদ্ধ শেষে ওডিসিয়াসের যাত্রার বর্ণনা।
গ্রিক পুরাণের অনুসারে, ট্রোজান ওয়ার একটি ঐতিহাসিক যুদ্ধ যাতে আরো অনেকের সাথে দুই মহাবীর হেক্টর ও একিলিস মারা যাই। এই যুদ্ধে দেব-দেবীদের অংশ নেওয়ার কথাও আছে। এই যুদ্ধ বহু বছর স্থায়ী হয় এবং শুধু গ্রিকদের পক্ষ থেকেই ৫০’০০০ যোদ্ধা অংশ নেয়। বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ যুদ্ধ হিসেবে এটি পরিগনিত হয়। আর সবচেয়ে বড় কথা হল এই যুদ্ধের কারনেই সমৃদ্ধ নগরী ট্রয় ধ্বংস হয়েছিল।
পরিশিষ্ট: ট্রয় নামটি বর্তমানে প্রত্নতাত্ত্বিক এবং ঐতিহাসিক। উপরের বর্ণনা ও বিভিন্ন উৎস থেকে পাওয়া তথ্যে সহজেই বোঝা যাই ট্রয় নগরী নিয়ে বিশ্বাসযোগ্য কোন তথ্য নেই। ট্রয় নিয়ে তেমন নতুন কিছু জানা আর সম্ভবও নই। বিভিন্ন ঐতিহাসিক কারণ ও একটি নিদারুণ কষ্টের ভালোবাসার গল্পের কারনে ট্রয় নামটি কখনোই ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে যাবে না।
বি:দ্র; তথ্যের জটিলতা, অস্পষ্টটা, বিভিন্ন ভাষার শব্দের বাংলাই রুপ দেওয়া, অনেক ধরনের উৎস ইত্যাদি কারনে এখানে কিছু ভুল থাকতে পারে।
দয়া করে ক্ষমা করবেন।
উৎসঃ উয়িকিপিডিয়া, গুগল ইমেজ ইটিসি। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।