ইতিহাস, নেই অমরত্বের লোভ/ আজ রেখে যাই আজকের বিক্ষোভ... প্রথম শটে দেখা যায় একটি রাশান গ্রাম, সে গ্রামের সীমানায় স্তেপের আদিগন্ত প্রান্তর চিরে সুদূরে চলে গেছে একটি মেঠোপথ। পথের প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন এক মধ্যবয়সী রমণী, চোখে উদভ্রান্ত দৃষ্টি, বোবা চোখ দুটো মেলে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি অন্তহীন অপেক্ষায়। নেপথ্যে বর্ণিত হতে থাকে প্রেক্ষাপট- জননী দাঁড়িয়ে আছেন তার সৈনিক ছেলের অপেক্ষায়, যে গেছে দেশের জন্য যুদ্ধজয়ের মহান ব্রত নিয়ে এ গ্রাম থেকে বহু দূরে।
ছবিটি দেখা শুরু করতেই আমার মায়ের মুখ মনে পড়ল: আদি, অকৃত্রিম- ডিপার্চার লাউঞ্জের এ্যালুমিনিয়াম ফ্রেম ধরে দাঁড়িয়ে থাকা, কাঁচের বিভেদ অতিক্রম করে সেই নাতিখর্ব বিষণ্ন, নিরালম্ব অবয়ব। উৎসুক- যতক্ষণ তার একমাত্র সন্তানের শেষ ছায়াটুকু চোখে পড়ে; যতক্ষণ না ইমিগ্রেশন ডেস্কের আড়ালে শেষ হাত নাড়াটুকু বিলীন হয়ে যায়।
অগাস্ট ১৫, ২০১১, দিবাগত রাত ২ টা। মা’কে একা রেখে চলেছি স্বপ্নময় সম্ভাবনার দেশে। বোর্ডিং পাস নেবার জন্য কাতার এয়ারওয়েজের লাইনে দাঁড়িয়েছি; আম্মু চেনা বোরকার আড়ালে অচেনা আশঙ্কা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইমিগ্রেশনে দাঁড়ানর আগে শেষবারের মত বাইরে আসলাম। আম্মুর মাথায় হাত রাখতেই বাঁধ ভাঙল।
অস্ফুট কান্নার দমক বাঁধ না মানা ঢেউয়ের মত উছলে পড়তে লাগল তার পোড় খাওয়া চোখের বালুচরে। বাড়িয়ে ধরা হাতের আলিঙ্গন ভেঙ্গে ছোট্ট ছেলের মত চোখ কচলাতে কচলাতে ঢুকে পড়লাম ইমিগ্রেশন এরিয়ায়।
পেছনে তখনো রূপালী রেলিং ধরে ঈষৎ ঝুঁকে ঝুঁকে অক্ষম যন্ত্রণায় ভিজিয়ে চলেছে ডিপার্চার হলের মেঝে- আমার স্নেহময়ী মা; আমার একলা মা। আম্মুর হাইট বেশি নয়; পাঁচ ফিট এক কি দুই। লাল চোখে, বুড়ো আঙ্গুলে ভর করে, ডানে বামে কাত হয়ে, শূণ্য দৃষ্টিতে সারি সারি মানুষের গতায়াতকে পাশ কাটিয়ে প্রাণপণে চেষ্টা করে চলেছে কাঁচের আড়াল থেকে আমাকে দেখার।
এক মুহূর্তও যেন অপচয় করতে চাচ্ছেনা শেষ দেখার সুযোগটাকে। যতবার ইমিগ্রেশন লাইনের আড়াল থেকে পেছন ফিরে তাকিয়েছি- কাঁপা কাঁপা হাত উপরে তুলে ধরেছে, ছোট্ট খুকির মত ডানে বামে চেপে লুটে নিতে চেয়েছে সন্তানের অপসৃয়মান অবয়ব।
“ও, পিএইচডি করতে যাচ্ছেন; আসবেন তো ফিরে, নাকি? ওদিকে গেলে কেউ তো আর ফিরে আসতে চায়না”- ধ্যান ভাঙ্গল ইমিগ্রেশন অফিসারের প্রশ্নে। দেশ ছাড়ার আগে, এমনকি প্রবাসেও বহুবার সম্মুখিন হতে হয়েছে এ প্রশ্নের। তাদের অবিশ্বাসভরা চটুল মুখের ওপর বারবার একটি কথাই ছুঁড়ে দিয়েছি- “নিশ্চয় ফিরব, ফিরব না কেন?”
আলিওশার মত আমারো বাড়ির ছাদ নেই; অগণিত ক্ষুধার্ত মুখ অবোধ প্রত্যাশায় চেয়ে আছে।
আলিওশার মতো আমারো এক মা আছে- এক মধ্যবয়সী রমণী, চোখে উদভ্রান্ত দৃষ্টি, বোবা চোখ দুটো মেলে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি অন্তহীন অপেক্ষায়।
যার এমন একটি মা আছে, বাড়ির ছাদ সারাতে দুরতিক্রম্য পথ পাড়ি দিয়ে তাকে তো ফিরে আসতেই হবে সবুজ আঁচলের আশ্রয়ে।
{গ্রেগরি চুখারয়ের ১৯৫৯ সালে মুক্তি পাওয়া কালজয়ী ছবি ব্যালাড অফ এ সোলজার। ছবিটির আলোচনা পোস্টের বিষয়বস্তু নয়; যাঁরা আগ্রহী এই লিঙ্কে চমৎকার রিভিউ পাবেন। ছবিটি দেখে আমার যে অনুভূতি হয়েছে তা শেয়ার করতেই এ পোস্ট।
}
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।