আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প: আইসক্রিম

নিঃস্বার্থ মন্তব্যকে ধন্যবাদ, সাময়িক ভাবে আমি মন্তব্যে নেই একদিন দেখলাম একটা টোকাই ছেলে কাচের দরজা ঠেলে অভিজাত আইসক্রিমের দোকানে ঢুকল। রোদময়লা জামা, হাফ প্যান্ট। উজ্জ্বল আলোর নিচে খোপে খোপে সুস্বাদু ভ্যানিলা, বাদাম, স্ট্রবেরী সাজিয়ে দোকানী দাঁড়িয়ে ছিল। -স্যার, কয় টেকা দাম এই গুলানের? দোকানী তাকে দেখে বিস্মিত হল। দারোয়ানের কর্তব্যে অবহেলা বেড়েছে।

যাদের ক্রয়ক্ষমতা নেই তাদের উপর ক্রোধ প্রদর্শনে মানা নেই। তবুও সে ধৈর্য নিয়ে নিস্পৃহভাবে বলল -৪৯০ টাকা শুনে রোকইন্যার মন নিভে যায়। তার পিতৃপ্রদত্ত নাম রোকুনুদ্দিন ওরফে রোকন। সে যা ভাবছিল আইসক্রিমের দাম তার চেয়ে ঢের বেশী। পকেটে জমানো ১২ টাকা স্পর্শ করে সে বলেছিল।

-এর চে কমে দিবেন না? -না ছেলেটার স্পর্ধ দেখছিলাম আমি। বিধাতা যেমন দেখে তেমনি। দেখে আর খুঁতিয়ে খুঁতিয়ে ভালমন্দ বিচার করে। কিন্তু কোন রকম উপকারে আসে না। এর পরের সপ্তাহে সাকুল্যে তার ১৭০ টাকা জমে গেছিল।

কিন্তু জ্বর এলো। দু দিন পড়ে থাকল বিছনায় । মাথায় মাছের ঝাঁকা নিয়ে যাবার কথা । পারে নি। টিফিন ক্যারিয়ারে করে ভাত টানার কথা।

হয় নি। বকুলতলায় সাহেবদের চায়ের কাপ কুড়িয়ে আনতেও পারে নি । বরং টাকাটা ফুরিয়ে গেল। না পেলে স্বপ্নের তীব্রতা বাড়ে। কাঁথায় শুয়েই সে ভাবছিল কবে ঐ রকম ঘিয়ে চোঙে সর দেয়া বরফ চেটে খাবে।

* প্রতি দিনই এমন হয়। ১০/১২ বছরের ছেলেটা একটু করে থামে। সখটাকে চোখে বয়ে আনে। সে দু চারটা ইংরেজি জানে সে। অভিজাত আইসক্রিমের দোকানের নাম বানান করে পড়ে।

মনে পড়ে একটা আইসক্রিম সে পুরো খেয়েছিল দুই বছর আগে। দাঁড়িয়ে থাকা ভ্যানগাড়ী থেকে। এক বিদেশিনী এসেছিল। দিল দরিয়া মহিলা। সে ডেকে ডেকে দিয়েছিল সবাইকে।

গলে যাওয়া মালাই। মচমচে কোন। এতই সুস্বাদু খাদ্য যেন মৌলানা সা'বের দস্তারবন্দীর খুদবায় বেহেশতের বর্ণনা। আইসক্রিমের দোকান ব্যস্ত ছিল। খদ্দের ঢুকছিল।

খদ্দের বেরিয়ে আসছিল । এই শহরে রাজ্যের বড়লোক। তরুণীরা হেসে কুটি কুটি হয়। জোড়ায় জোড়ায় হাটে। বিড়ালের মত আইসক্রিম চাটে।

আর নতুন প্রাইভেট কার থামতেই অভিজাত শিশুরা লাফাত লাফাতে বের হয়। * রোকনের ওখানে ঢোকা নিষেধ। দাঁড়ানোও নিষেধ। দারোয়ান বদল হয়েছে। দূর থেকে ধোঁয়াশা কাচ মানে দেয়াল ।

রঙিন মানুষেরাই ঢুকে যাচ্ছে অনায়াসে। বেরিয়ে আসার মুহূর্তে টুং করে বিদেশী কায়দায় ঘণ্টা বাজে। যখনই ঘণ্টা বাজে স্বপ্নপার থেকে সে বরফ-দুধের ডাক শোনে। জন্মদিন হচ্ছিল। বেলুন উড়ছিল।

সমবেত গান গাইছিল সবাই । সে দেখতে পেল সমবয়সী কিশোর কিশোরীরা সযত্নে চেটে নিচ্ছে কাপ ভর্তি সর। আর একটা লাল জামা মেয়ে অর্ধেকটা খাওয়া কোন ছুঁড়ে ফেলছে নর্দমায়। * সেদিন গ্যারাজে কাজ শেষ হয় রোকনের। পথে পথে ঘুরে বেড়ালো সে।

টিটির বস্তিতে এক দোস্তর সঙ্গে তার দেখা। সে এক কাজের খোঁজ দিল। দোতলা বাড়ি থেকে মাল নামানো। কে জানত সৌভাগ্য এসে পেখম ছড়াবে ভরতপাখির মত। সে বেরিয়ে এলো পথে, তখন তার পরনে গুচি ব্র্যান্ডের টি-শার্ট।

যদিও বেশ ঢোলা, কিন্তু মনে হবে নতুন। দেখতে বেশ লাগছিল। খোলা সেলুন থেকে সদর্পে চিরুনি নিয়ে আঁচড়ে নিলো। ধনবান বাড়ির সেই মালিক জিনিস নামানোর পর খুশী হয়েছিল । হয়তো চকচকে ৫০০ টাকার নোট তার কাছে ময়লার মতই ।

হাতের ময়লা মুছে সে ছুটছিল পথে। রোকনের প্রথমবারের মত একটা অদ্ভুত ভয় হয়। সে সেদিন বড়লোক। এটা জানলে টাকাটা ছিনিয়ে নেবে কেউ। অথবা পকেটমার দু আঙুলে তুলে নেবে।

বারবার পকেটে হাত দিয়ে দেখছিল । তবে কি যত টাকা হয় মানুষ তত সন্ত্রস্ত হয়? ভর্তি নোটে তার আর ভয় পেল না। সে সোজা ঢুকে পড়ল আইসক্রিম শপে। পায়ের স্যান্ডেল গলিয়ে যদিও নখ দেখা যাচ্ছিল। তবে একটা লজ্জাও হচ্ছিল।

কারণ সে একা। সে ঢুকেই অর্ডার দিল এইটা দেন এক খিলি -দাম জানোস? তোর টাকা আছে? - দোকানদার বেশ বাস্তববাদীর মত জিজ্ঞেস করল। -জি, এই দেখেন। ৫০০ টাকা সে বের করে দোকানদার অবিশ্বাসে আলোয় টাকাটা ধরে দেখল। জল-সুতা দেখে বলল -কোনটা নিবি? ভ্যানিলা? -না, হলুদডা টা দেন।

-বাটার স্কচ? -হ্ -টপিং দিব? ক্যারামেল? -দেন, বেশি কইরা দেন কোন ভরে যায়। রোকন উত্তেজিত হয়ে কোনটাকে হাতে তুলে নেয়। দাম পরিশোধ করে লাফিয়ে ছুটে বের হতে নেয়। এক ইটের সিঁড়ি। হোঁচট খেয়ে সে প্রায় পড়েই যেত।

বহুদিনের পাওয়াটা পথের ধূলোয় লুটিয়ে পড়ত । ডান হাতে বড় আকারের আইসক্রিম কোন। । বহুদিনে প্রতীক্ষার ধন। বহু সখের।

এই ফুর্তি দুনিয়ার কাউকেই সে বোঝাতে পারবে না। তবে আনন্দটুকু এমন দ্রুত শেষ করে নিতে হবে। এখুনি গলতে শুরু হবে। যদি পারতো সে এটা নিয়ে তিন মাইল দুরে যেত। বস্তির জলিল, মোকাদ্দেস আর আবুল আলী থাকত এক সঙ্গে তাদের কে একটু করে দিত।

আর তার মা বেঁচে থাকলে মাকে দিত সবার আগে। বাবার ডায়াবেটিস ছিল। সে এটা খেত না। হাতের আইসক্রিম হাতে নিয়ে চোখ আনন্দে ভিজে যায় টোকাই রোকইন্যার। বহুদিনের স্মৃতিগুলো থেমে থেমে আইসক্রিম ধার চায়।

সে কিছু একটা ভাবছিল। রোদের উত্তাপে বাটার স্কচ গলতে গলতে নেমে আসে কোনের ধার বেয়ে। হয়ত এমনই হয়, স্বপ্নপূরণ হলে বাকি অদেখা স্বপ্নেরা হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মত পিছন পিছন হাটতে থাকে। -- ড্রাফট ১.০ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.