আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নাফাখুম দেখে বান্দরবানের আশেপাশে (পর্ব-১)

***** পরিকল্পনা যেভাবে করেছিলাম সেভাবেই এগিয়ে যাচ্ছিল আমাদের বান্দরবান অভিযানের প্রস্তুতি। ভার্সিটির মিডটার্ম আর আসাইনমেন্ত এর জ্বালা থেকেও রেহাই পাওয়ারও একটা চেষ্টা আগে থেকেই চলছিল। দেড় মাস ধরে দল ঠিক করতে করতে আমার গলদঘর্ম অবস্থা। অবশেষে আমার সহপাঠী তিন জন আর বগুড়া থেকে আমাদের সাথে যোগ দেয়া দুই মামাকে নিয়ে ছয় জনের দল ঠিক করে ফেললাম। বান্দরবান নিয়ে এক মাস পড়াশুনা করে বন্ধুমহলে এক রকম বান্দরবান বিশারদ হিসেবে নিজেকে দাঁর করিয়েছিলাম।

আর ছবি দেখে তো সবার চোখ কপালে উঠল, বিশেষ করে নাফাখুম এর ছবি দেখে কেউ বিশ্বাসই করতে চাইলনা যে এই জাইগাটা বাংলাদেশে। মিশন নাফাখুমের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে যা যা লাগবে তার একটা লিস্ট দিয়ে দিলাম সবাইকে। এর মাঝে এক ফাকে আমদের বাসের টিকেট কিনে ফেললাম। যাত্রা হবে কুরবানি ঈদের এক দিন পরে ৯ই নভেম্বর রাতে। যেভাবে পরিকল্পনা করেছিলাম শেষ পর্যন্ত সব কিছু ঠিকঠাকই ছিল।

৯ই নভেম্বর বুধবার রাতে ফকিরাপুল হতে শ্যামলী পরিবহনের ১০.৪৫ এর গাড়ী ধরে রওয়ানা হলাম পার্বত্যনগরী বান্দরবনে। সায়েদাবাদ যাত্রাবাড়ীর যানজট পার হয়ে কুমিল্লা গিয়ে তাজমহল হোটেলে যাত্রাবিরতী পেলাম ২০ মিনিট। হালকা নাসতা করে আবার যাত্রা (বলে রাখা ভাল যে হোটেলটার খাবার খরচ খুবই বেশি, ভুনা খিচুড়ি ২০০ টাকা!!!), উঁচু নিচু আকাবাকা পথ অত্যন্ত দক্ষতার সাথে চালিয়ে আমাদের বাসের ড্রাইভার বুঝিয়ে দিলেন এ রাস্তাতে কিভাবে গাড়ি চালাতে হয়, অবশেষে ভোর ৫ টায় বান্দরবান শহরে পৌঁছলাম। তখনো চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার, তাই ধুম্র উদ্গিরন আর বাথরুমের কাজ সেরে সকালের আলোর জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। আলো একটু ফোটার সাথে সাথেই ৩ জন গেল চান্দের গাড়ি ঠিক করতে আর আমরা বাকি ৩ জন থাকলাম ঢাকা ফেরার অগ্রিম টিকেট কাটার জন্য বাস কাউনটারে।

আমরা যেহেতু সিজনে বান্দরবান গিয়েছি তাই সব কিছুর ভাড়াই একটু বেশি বেশি চাচ্ছিল। বাসের অগ্রিম টিকেট কিনে সকালের নাস্তা করতে করতে আমাদের চান্দের গাড়ি ঠিক হয়ে গেল। চান্দের গাড়িতে চেপে কিছুদুর যাওয়ার পর গাড়ীর আসল ড্রাইভার উঠে বাজিয়ে দিল উটকো একটা ঝামেলা। আমরা যে ভাড়া ঠিক করেছি সে ভারাতে সে যাবে না। অজ্ঞতা কিছু গালাগালি করে গাড়ী থেকে নেমে অন্য গাড়ীর খোঁজ করতে থাকলাম।

যে চান্দের গাড়ী ভাড়া করেছিলাম সিজনে যাওয়ার জন্য কোন গাড়ী আমরা কব্জা করতে পারছিলাম না। উপাইয়ান্তর না দেখে আমরা বাসে চেপে থানছির পথে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। তবে আসল মজাটা তৈরি করলাম আমি। যদিও বান্দরবান কখনো যাইনি তবুও যারা যারা আগে গিয়েছে, তাদের থেকে শুনে শুনে অভিজ্ঞতার পাল্লাটা একটু বেশি ছিল আমার। সেই আলোকে বাসের ভেতরে না বসে আমরা আসন গারলাম বাসের ছাদে।

বাসের ছাদে প্রথমে সবাই একটু ভয়ের মধ্যে থাকলেও চান্দের গাড়ী থেকে বাসের ছাদে যাওয়ার সাহসী পদক্ষেপটা যে আসলেই ঠিক ছিল সেজন্য সবাই আমাকে ধন্যবাদ দিয়েই গেল। এটা বলতে পারি যে বাসের ছাদে করে যারা বান্দরবান থেকে থানছির পথে না গিয়েছে তারা দেখেনি বান্দরবানের আসল সৌন্দর্য। পাহাড়ি পথ বম আদিবাসী আমাদের বাস যখন বান্দরবান শহর ছেড়ে পাহাড়ি রাস্তা ধরেছে, আসে পাশে তখন আমাদের চোখে পরছে উপজাতি বা আদিবাসীদের গ্রাম। তাদের দিকে হাঁ হয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমাদের বাস উঁচু নিচু আঁকা বাঁকা সর্পিল পথ ধরে কখনও উপরে উঠতে থাকল আবার নামতেও থাকল। বাসের ছাদ থেকে আমরা যেন রোলার কোস্টারের মজা পাচ্ছিলাম।

বাসের ড্রাইভার গিয়ার ১ এ ফেলে পুরো এক্সেলারেটর চেপে ইঞ্জিনের তীব্র প্রতিবাদকে উপেক্ষা করে এরকম বিটকেলে রাস্তাটা যেভাবে পার করছিল তা দেখে অনেক শহুরে বাবুদের ড্রাইভারও হা হয়ে যাবেন। কিছুক্ষনের মধ্যেই আমরা এসে পৌঁছলাম শৈলপ্রপাত নামক এক পর্যটন স্পটে। শৈলপ্রপাত সম্মন্ধে আগেই জানতাম যে এটা একটা খিনস্রতা ঝর্না, তাই এখানে নেমে সময়ক্ষেপণ না করে আমরা আসল উদ্দেশ্যের পথেই চলতে থাকলাম। শৈল প্রপাত বাসের ছাদ থেকে নেয়া পাহাড়ি দৃশ্য শৈলপ্রপাতের পর থানছির পথে দেখার মত স্পট আছে আর দুটো, চিম্বুক পাহাড় আর নীলগিরি। এ পথে চলাচলকারী সব বাসই যাত্রাবিরতি করে চিম্বুক পাহাড়ের পাদদেশে “চিম্বুক নিলাদ্রি পর্যটন কমপ্লেক্স ক্যান্টিনের” সামনে।

১০-১৫ মিনিটের বিরতিতে হালকা খাবার সিঙ্গারা সমুচা আর কোক পান করে আমরা আবার আমাদের যাত্রা শুরু করলাম। বান্দরবান থেকে থানছির পথে সবচে আকর্ষণীয় স্পট নীলগিরি, তবে আমরা ফিরে আসার পথে নীলগিরি দেখব বলে সেখানে আর নামলামনা। নীলগিরির পরেই শুরু হবে বান্দরবানের আসল পাহাড়ি রাস্তা। এ রাস্তা যে কতো বিপদজনক হতে পারে আনাড়ি চালক হলে তা হারে হারে টের পেত। তো লাটিমের মত পাক খেতে খেতে বাংলাদেশের সর্বচ্চ রাস্তা পিক ৬৯ পেরিয়ে এলাম।

আমাদের সাথে অবসরপ্রাপ্ত একজন সামরিক অফিসারের ছেলে ছিল, তার কাছ থেকেই জানলাম যে এসব রাস্তা আমাদের দুর্দান্ত সামরিক বাহিনীর হাতে তৈরি। কিভাবে এই দুর্গম অঞ্চলে এমন পথ তৈরি করতে পারল তা ভাবতে ভাবতে আমরা ভরতপারা ভাঙ্গা রাস্তাই এসে পৌঁছলাম। এখানে এসে আমাদের বাস পরিবর্তন করতে হবে কারন সামনে রাস্তার কিছু অংশ ধ্বসে গেছে। এই ভাঙ্গা পথ পার হয়ে পরের বাস না আশা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হল। এখানে উপজাতীয় কিছু দোকান চোখে পরবে আর রাস্তার পাশে পাহাড়ি কমলা আর মালটা কিনতে পাওয়া যাবে।

সেগুলোর স্বাদ খুবই মিষ্টি এবং আলাদা। পাহাড়ি মালটা আর কমলা পরের বাসের ছাদে আমাদের সাথে কিছু পাহাড়ি যুবক যোগ দিল আর তাদের সাথে কথা বলে বুঝতে পারলাম যে এখানকার মানুষ কতো সরল। নিজেদের মধ্যে তারা উপজাতীয় ভাষা ব্যবহার করলেও আমাদের সাথে বাংলাতেই কথোপকথন হচ্ছিল। এই সরল মানুষদের সাথে কথা বলতে বলতেই আমরা পৌঁছে গেলাম সাঙ্গু নদীর তীরে থানছি বাস স্ট্যান্ডে। বাস থেকে নেমে দেখলাম সামনে একটা অর্ধনির্মিত ব্রিজ।

সেই ব্রিজের নিচ দিয়েই বয়ে চলেছে খরস্রোতা সাঙ্গু নদী। নদীর গভীরতা নভেম্বরের দিকে খুব বেশি নয়, আমাদের কোমর পর্যন্ত হবে। প্রতিজন ৫ টাকা করে আমরা নদীটা পার হয়ে গেলাম চিকন হাতে টানা নৌকা দিয়ে। নদী পার হলেই থানছি বাজার। সাঙ্গু নদী থানছি বাজার বান্দরবানের ৭টি উপজেলার মধ্যে থানছি একটি।

নদীর তীর ধরে গড়ে উঠা থানছি বাজারটা বেশ বড় আর সাজানো গোছানো। এখানে রয়েছে একটা বিজিবি ক্যাম্প আর বাজারের শেষ প্রান্তে রয়েছে থানছি থানা। বাজারে গিয়েই আমরা কিনে ফেললাম রাবারের তৈরি বাংলা স্যান্ডেল (নামঃ আরামিট), এগুলো স্যান্ডেল খুবই হালকা আর পাথরে আর পানিতে চলাচলের জন্য উপযুক্ত। দাম পরবে ১০০ টাকা। আমরা যেহেতু আজ রাত মানে ১০ই নভেম্বর রাতটা থানছি কাটাব তাই থাকার জন্য স্থান খুঁজতে থাকলাম, আমাদের পেছনের নৌকাই ৯ জনের একটা বড় দল দেখতে পেয়েছি তাই তাড়াতাড়ি সরকারি রেস্টহাউসে চলে গেলাম।

এখানে আমাদের ৬ জনের জন্য ৩ বেডের একটা রুম আমরা কব্জা করলাম, ভাড়া প্রতিজন ৭০ টাকা। যেখানে থেকেছিলাম-থানছি রেস্টহাউস এখানে খাট আছে এবং থাকার জন্য বালিশ, মশারী, তোষক সবই আছে আর ছোট একটা লাইট আছে যা রাতের অন্ধকার দূর করার জন্য মোটেই উপযুক্ত নয়। ব্যাগট্যাগ রেখে তাড়াতাড়ি আমরা সাঙ্গু নদীতে গোসল সেরে নিলাম কারন ক্ষুধাই সবার তখন ত্রাহি অবস্থা। বাজারে শুঁটকির দোকানের সামনেই ভাল একটা খাবারের দোকান আছে, সেখানেই ৮০ টাকাই মুরগী আর ডাল দিয়ে খাবার পেটে চালান করলাম, আর ৫ টাকা দিয়ে এই হোটেলেই পান করলাম অসাধারন এক কাপ চা। থানছির একটি ভাল হোটেল চলবে . ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.