তুই ভালো থাকিস, আমি সুন্দর থাকবো যাব যাব করে ও UGI এর অফিসিয়াল tour টা হচ্ছিল না । শেষ পর্যন্ত যখন হল ততদিনে ফারুক ভাই, শরিফ ভাই, শোভন ভাই ও পলাশ অন্য ছাদের নিচে আস্তানা গেড়েছে। রায়হান ভাই অফিসিয়াল কাজে, রাজিব ভাই ও কামরুল ভাই সাংসারিক কাজে, আমিনুর ভাই শরীর খারাপ থাকায় আর সাদিয়া ম্যাডাম সেচ্ছায় পদত্যাগ করে শেষ মুহুর্তে এসে tour টা মিস করলো।
ডিসেম্বর এর ১৩ তারিখ (২০১০) রাত নয়টায় বনানী থেকে সুকান্ত ভাই আর এহসান ভাই এর সাথে সি এন জি তে করে রওয়ানা দিলাম গাবতলীর দিকে এবং প্রথম ধরা টা খেলাম সি এন জি ওয়ালার কাছে । ১৫০ টাকা ভাড়া তিন জন ৫০ টাকা করে শেয়ার করে যখন নামলাম তখন বাস ছড়তে আর ২০/ ২৫ মিনিট বাকি।
বাসে উঠে কষ্ট লাগলো রুবেল আর সাগর ভাই এর জন্য, আমরা সবাই যেখানে পিছনে বসে মজা করতে করতে যাচ্ছি, সেখানে তারা সামনে বসে ঝিমাচ্ছে।
যাবার পথে সবচেয়ে বেশি টেনশনে ছিল সুকান্ত ভাই, তার টেনশন এর একমাত্র কারণ আমরা সব ধরনের ঔষধ নিলেও টেনশন কমানোর কোনো ঔষধ নেইনি।
আমরা যাচ্ছি বান্দরবান কিন্তু বাস যাচ্ছে কক্সবাজার, পথিমধ্যে আমাদের কথা বার্তা শুনে আমাদের আশে পাশের লোক জন ও একটু টেনশেন পড়ে গেল বাস আসলে যাচ্ছে কোথায়?
অবশেষে ভোরে এসে নামলাম সাতকানিয়া, এখান থেকে লোকাল বাস এ করে যেতে হবে বান্দারবান শহরে। চট্টগ্রাম - কক্সবাজার মহাসড়কের সাথে বান্দারবান সড়কের সংযোগস্থল সাতকানিয়া থেকে বান্দারবান শহরের দূরত্ত মাত্র ৩০ কিঃমিঃ। বান্দারবান শহরে এসে আমরা প্রথম যে কাজ টা করলাম তাহলো ফেরার টিকেট কাটা, আর ডোবার (রুবেল) যে কাজ টা করলো টা হল ডাওনলোড, এবং এ কাজ করতে গিয়ে সে টয়লেটর বাইরে লম্বা জনযট বানিয়ে ফেলল মাত্র ৩০ মিনিটে।
জয়তু ডোবার
এরপর ট্রান্সপোর্ট ডিপার্টমেন্ট (আমি, মতিয়ার ভাই, সুকান্ত ভাই) গেল চান্দের গাড়ি ঠিক করতে আর ফুড ডিপার্টমেন্ট (এহসান ভাই, উনার চেয়ে যোগ্য আর কে হতে পারে) থাকলো নাস্তা-র হোটেল ঠিক করতে।
৩৫০০ টাকায় চান্দের গাড়ি ঠিক করলাম থানচি পর্যন্ত, পথি মধ্যে প্রথম নামলাম শৈ্লপ্রপাত এ এসে এবং জয়নুল ভাই সাথে সাথে ক্যামেরা নিয়ে তার শিকাড় এ নেমে পরলো।
কিছুক্ষন এখানে কাটিয়ে চান্দের গাড়িতে আবার রওয়ানা দিলাম, পরবর্তী গন্তব্য চিম্বুক পাহাড়। আমি, সুকান্ত ভাই, জয়নুল ভাই আর এহসান ভাই চরলাম গাড়ির ছাদে, আর বাকিরা ভিতরে। আকা বাকা পথ আর চড়াই উতরাই পেরিয়ে ঘন্টা দুয়েক পর চিম্বুক এসে পৌছালাম , এরি মাঝে চলতে থাকল ফটো সেশন আর খাওয়া দাওয়া, ইতিমধ্যে সাগর ভাই তার শুকনা খাবার নিয়ে তার কাজ শুরু করে দিয়েছে।
চিম্বুকে বেশি সময় নষ্ট না করে কিছু ছবি তুলেই আবার রওয়ানা দিলাম এবং পাড়ি দিলাম বাংলাদেশ এর সবচেয়ে উচু সড়ক পিক ৬৯। একটু পর পর আচমকা বাক, এই উপরে উঠছি তো এই নামছি, এক পাশে নিরেট পাহাড় তো অন্য পাশে গভীর খাদ, ডান দিকে যদি মেঘ থাকে হাত বাড়ানো দূরে তো বাম দিকে অসিম শুন্যতা। এভাবে চলতে চলতেই এক সময় এসে দাড়ালাম থানচি বাজারের কোল ঘেষে সাঙ্গু নদীর পাড়ে। এসেই দেখি বুয়েট এর একদল ছেলে মেয়ে মাত্র নাফাখুম থেকে আসল, ৫ টা ছেলের সাথে যদি ৮ টা মেয়ে নাফাখুম থেকে ঘুরে আসতে পারে, তাহলে আমরা ১০ জন কেন পারবনা, এ সময় যদি রায়হান ভাই ও এসে আমাদের না করতো তাহলেও মনে হয়না আমাদের ফেরাতে পারতো (সরি রায়হান ভাই)।
থানচি বাজারে এসে পার করলাম সবচেয়ে বাজে সময় টা, এবং মনে মনে কষে নিজেকে কয়েকটা গালি দিলাম একোমোডেশন ডিপার্টমেন্ট এর দায়িত্ত নিজের কাধে নেবার জন্য।
প্রায় ২ থেকে ২.৫ ঘন্টা পর আমাদের থাকার জায়গা মিলল জনস্বাস্হ্য প্রকৌশলী অধিদপ্তরের অফিস এ আর এ জন্য ধন্যবাদ দিতে হয় স্থানীয় সালাঊদ্দীন ভাইকে।
রাতটা পার করে দিতে পারতাম অনেক শান্তি নিয়ে, না পারার পিছনে সবচেয়ে বেশি অবদান এহসান ভাই, শাকিল ভাই, ফিকরি ভাই আর রুবেল এর। ফিকরি ভাই যদি শ্যলো মেশিন চালু করে তো এহসান ভাই তোপ ছাড়ে, শাকিল ভাই যদি কামান হাকায় তাহলে রুবেল জেট বিমান এর আওয়াজ তোলে। এক সময় এই সংঘবদ্ধ নাসিকা গর্জন কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ডুব দিলাম ঘুমের সাগরে।
পরদিন ভোর পাচটায় আমাদের যাত্রা শুরু করার কথা থাকলেও নৌকা ছাড়তে ছাড়তে আট টা বেজে গেল।
এক নৌকায় উঠলো মাতিয়ার ভাই, রাহাদ ভাই, শাকিল ভাই, জয়নুল ভাই ও রুবেল আর অন্য নৌকায় আমরা বাকি ৫ জন।
আমাদের নৌকাটা ছিল একটু পুরানো যে কারনে নৌকাতে ক্রমাগত পানি উঠতে লাগলো এবং কোনো এক্সসেপশান হান্ডেলিং দিয়ে ই এই পানি উঠানো থামানো যাচ্ছিলো না, এক মাত্র প্রতিকার ক্রমাগত পানি সেচে যেতে হবে। বিক্ষুব্ধ নদীতে কান্ডারির ভুমিকায় নেমে পরে আমাদের সাগর ভাই এক হাতে তুলে নিল বাকা বাশের বাশরী (পানি সেচার বাটি) আর এক হাতে রন তূ্র্য (ধুম্র শলাকা) , তিন্দু পর্যন্ত আমি আর তিন্দু থেকে রেমাক্রি পর্যন্ত সুকান্ত ভাই সাগর ভাই এর সহকারী হিসেবে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে গেলাম। সহকারীর ভুমিকায় না আসায় মাঝে একবার মনে হয়েছিল এহসান ভাই আর ফিকরি ভাইকে তুলে পানিতে ফেলে দেই
আবার শুরুতে ফিরে আসি, আটটায় যাত্রা শুরু করলেও তখনো সূর্যদেবের মুখ কুয়াশার আড়ালে লুকানো। সবার গায়েই শীতের কাপড় পড়া, জড়সড় হয়ে বসে চারপাশে দেখতে দেখতে কুয়াশার মাঝ দিয়ে ধীরে ধীরে আমরা যাচ্ছি তিন্দুর দিকে।
আশে পাশের পাহাড়ে লোকজনের চলাচল, পানির কুল কুল আওয়াজ, মাঝিদের কন্ঠে উপজাতীদের ভাষায় গান, কেমন যেন একটা প্রমোদ ভ্রমনের আমেজ নিয়ে এলো, কিন্ত......... তা মাত্র বিশ মিনিটের জন্য।
বিশ মিনিট পরেই নৌকা থেকে নামতে হল এই হীমশীতল পানিতে, আমরা যাচ্ছি সাঙ্গু নদীর উজানে, আর সাঙ্গু পাহারী নদী হওয়াতে আমরা এখন নদী দিয়ে যত সামনে যাব, তত সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উপরে উঠতে থাকব। নৌকাকে যেতে হবে স্রোতের বিপরিতে আর উঠতে হবে উপরে, কাজেই যে খানে ঢাল বেশি, সেখানে নৌকা থেকে নেমে হেটে হেটে আমরা উপরে উঠছি আর মাঝিরা নৌকা তুলছে ঠেলে ঠে......... কি দরকার ছিল বাবা এই শীতের সকালে এখানে আসার???
পাহাড়, নদী, বালুচর আর পাথরের মাঝ দিয়ে আমরা চলতে থাকলাম তিন্দুর দিকে, এরি মাঝে চলতে থাকল ফটো সেশন, কলা ছোড়াছুড়ি, খাওয়া দাওয়া আর ....... পানি সেচা ।
বান্দারবান এর ভূ-স্বর্গ তিন্দু আসতে আসতে আমাদের প্রায় ১ টা বেজে গেল । তিন্দু থেকে রওয়ানা দেবার পর ফিকরি ভাই ভুলে গেল আমরা নৌকাতে আছি (রি স্টার্ট মারছিল, আমাদের ৪ দিনের টুর এ ফিকরি ভাই আর ও কয়েকবার রি স্টার্ট খাইছে )।
শোয়া থেকে উনি লাফ দিয়ে উঠে বসতে গেলেন পা ধুবার জন্য, আমাদের নৌকা ততক্ষনে একদিকে কাত হয়ে উলটে যাবার অবস্থা, আর আমাদের অবস্থা "ছেরে দে ফিকরি ভাই ঢাকা গিয়ে মরি" । যাই হোক এ বারের মত খরচা হবার হাত থেকে বেচে গেলেও হাসি আটকাতে পারলাম না, কারন... ফিকরি ভাই এর তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া "আমি ভুলে গেছিলাম নৌকাতে আছি, আর হবে না"।
আধাঘন্টা যাবার পরে-ই চলে আসলাম বড় পাথর। বড় পাথর একটা পাথরের নাম না, এটা একটা জায়গার নাম এবং এই এলাকার সব পাথর মনে হয় অর্ডার দিয়ে বানানো। প্রতেকটা পাথর বিশাল আকৃতির, আর একেকটা দেখতে একেক রকম, নদীর মাঝে ছড়ানো ছেটানো বিশাল বিশাল পাথর আর তার মাঝ দিয়ে আকা বাকা সরু পথ (নদী পথ), সেই পথে যদি হত শান্ত তাহলেও একটা ব্যাপার ছিল।
এর-ই মাঝে হল আরেক অভিজ্ঞতা, নদীতে সিগন্যাল এ আটকা পড়লাম। স্থানীয়রা নদীর পাড় দিয়ে হেটে চলে যায় নদীর উজানে, পাহাড় থেকে বাশ কেটে তা দিয়ে নিজেরাই বাশের ভেলা বানায়,আর সেই ভেলা বোঝাই করে বাশ দিয়ে। ২০ / ২৫ হাত লম্বা একেকটা ভেলায় ১০০/ ১৫০ বাশ নিয়ে নদী বেয়ে ভাটিতে নেমে এসে ভেলা সহ সব বাশ দেয় বিক্রি করে। এরকম ৫ টা বাশের ভেলা কে সাইড দিতে গিয়ে প্রায় ২০ মিনিট নদীর হাওয়া খেলাম।
এরপর ৩০ মিনিট যেতে হবে নদীর পাড় ধরে পাথরের মাঝ দিয়ে হেটে, নদীতে এখন এত পাথর, স্রোত আর বাক যে মাঝি আমাদের নৌকাতে রাখতে চাইলেও আমরা থাকতাম না।
বিশাল বিশাল একেকটা পাথর, এক পাথর থেকে ১০ ফুট নামলাম তো পরের পাথরে উঠার জন্য ১৫ ফুট উঠতে হয়। এই পাথরের মাঝখান দিয়ে ই লাফায়ে লাফায়ে পার হচ্ছি, সেই সাথে চলছে ফটোশেষন। এক সময় আমি সবার সামনে, পিছনে তাকিয়ে দেখি এহসান ভাই বিশাল এক পাথরের উপরে ক্যামেরা হাতে দাঁড়ানো আর তার সামনে আরেকটা ছোট পাথরে ছবি তোলার জন্য এক বেপক পোজ দিয়ে দাড়ানো ফিকরি ভাই। এহসান ভাই সাটারে ক্লিক করার আগ মুহূর্তে দেখি ফিকরি ভাই গায়েব হয়ে গেছে। আমাদের আশে পাশে খুজে না পেয়ে কিছুক্ষন পরে দেখি ফিকরি ভাই নিচে কোমর পানিতে দাঁড়ানো, বেচারা আরেকবার রি স্টার্ট মারছিল।
এরপর আরো ঘন্টা খানেক নৌকা ভ্রমন করে বিকাল ৪ টায় এসে নামলাম রেমাক্রি ঘাটে। দুপুরের খাবার খেয়ে গিয়ে উঠলাম রেমাক্রি-র চেয়ারম্যান আফ্রো মং এর রেস্ট হাউজে। ছবির মত সুন্দর একটা রেস্ট হাউজ, একটা পাহাড়ের মাথায় একটাই মাত্র বাড়ী, পশ্চিমে অনেক নিচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে সাঙ্গু নদী, সাঙ্গু-র পরেই আবার খাড়া পাহাড়, উত্তরে আরেকটা পাহাড়ের মাথায় রেমাক্রি বাজার, দক্ষিনে কিছুদুর নেমে অন্য একটা পাহাড় চূড়ায় বি,ডি,আর ক্যাম্প আর পূর্ব দিকে শুধূ পাহাড় আর পাহাড়।
ঘুরে এলাম নাফাখুম - ২ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।