এই ব্লগের কোন লেখা আমার অনুমতি ব্যতীত কোথাও ব্যবহার না করার অনুরোধ করছি বেশ কিছুদিন হলো আমি ভয় পাচ্ছি।
এমনিতে আমি বেশ সাহসী ধরণের ছেলে, কবরস্থান বা লাশ-কাটা-ঘর বা আপাতদৃষ্টে অশরীরি বলে প্রচলিত যে কোন যায়গায় আমি বাজি ধরে রাত কাটিয়েছি। আমাদের দেশের প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী যে সব কাজ সাধারণত মানুষ ভয় পায় বা এড়িয়ে চলে, ছোট থেকেই আমার সেসব বিষয়ে প্রচন্ড আগ্রহ ছিল। তন্ত্র-মন্ত্র, কুফুরি কালাম, বান-মারা ও আরও অনেক হাস্যকর বিষয় যে মিথ্যে, বানোয়াট- এটা প্রমাণ করার জন্যে আমি নিজের নামে এসব করে করে বন্ধুদের কাছে প্রমাণ করেছি; আমি অনেকটা এই ধরণের ধাঁচে বড় হওয়া মানুষ। আমার বয়স ২৪ বছর, যুক্তিবাদী মানুষ বলতে যা বোঝায়, আমি বরাবরই তা।
বৈজ্ঞানিক যুক্তিতে ব্যাখ্যা করা অসম্ভব এমন একটা জিনিসই আমি কিছুটা বিশ্বাস করি- সেটার নাম 'সৃষ্টিকর্তা', এবং তাঁর অস্তিত্ব আছে কি নেই সেটা নিয়ে শত বছরের বিতর্ক থাকলেও, তাঁর কাজ যে মানুষকে ভয় দেখানো নয়- এটা সর্বজনবিদিত। কাজেই, আমার হঠাৎ করে ভয় পাওয়াটা কিছুটা নয়, বেশ অস্বাভাবিক।
বিষয়টা শুরু থেকে বলা যাক।
আমি একটা উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। আমার বাবার অনেকগুলো ছেলে-মেয়ে ছিল, আমি তাঁর সর্বশেষ সন্তান।
বয়সের পার্থক্য হিসেবে আমার সবচেয়ে বড়ভাইয়ের সাথে আমার প্রায় ১৯ বছরের একটা গ্যাপ আছে, তাই আমার সাথে তাঁদের সখ্যতা তেমন একটা কখনো গড়ে উঠেনি। আমার বাবা মারা যান আমি যখন ক্লাস এইটে পড়ি, এক অর্থে আমি তখন থেকে সম্পূর্ণ একা-ই বড় হয়েছি। এর আগেও একাই ছিলাম, কিন্তু পুরোপুরি একা বোধহয় আমার বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে হয়ে গেছি। কারণ, তখন আমাদের পরিবারের সদস্যদের মাঝে যেই বন্ধনটা ছিল, সেটা পিতার মৃত্যুতে আর দশটা বাঙালি পরিবারের মতোই আর অটুট থাকেনি, ফলে আমিও অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করেছি, এবং নিজের মতোই বড় হয়েছি, একা একা।
আমি খুব ডানপিটে ধরণের ছিলাম, মেট্রিক পরীক্ষা দেয়ার আগ পর্যন্ত ক্রিকেট আমার ধ্যান-জ্ঞান ছিল, বাসার বাইরে যতক্ষণই থাকতাম, ক্রিকেট নিয়েই পরে থাকতাম।
আর বাসায় ফিরে আমার ক্রমাগত নৈঃশব্দ্যের আঁধারে ডুবতে থাকা পরিবারে আমার একমাত্র সঙ্গী ছিল- বই, তবে সেগুলো পাঠ্যপুস্তক নয়। আমি প্রচুর বই পড়তাম, এখনো পড়ি, যে কোন বিষয়ের বই ঘাঁটতে আমার ভালো লাগে, কালো কালো অক্ষরগুলোর মাঝে যে কী গভীর রহস্য লুকিয়ে থাকে সেটা আমাকে খুব অল্প বয়সেই বিমোহিত করেছিল। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার ঠিক আগে আমি ছেড়ে দেই ক্রিকেট খেলা বা বাইরে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়া, কেন যেন হঠাৎ করেই আমি বুঝতে পারি- আমার পরিবার ঠিক আমার মতো করে নয়, ওরা আমার জন্যেও নয়, মানুষ আসলে সবসময় একা-ই বড় হয়, একা-ই বাঁচতে শিখে। আমি একা বড় হয়েছিলাম প্রায়, কিন্তু একা তখনো বাঁচতে শিখিনি, তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর আমি নিজেকে সম্পূর্ণ গুটিয়ে নেই নিজের ভেতর, পড়াশোনা ছাড়া আমার ধ্যান-জ্ঞান আর অন্য কিছু ছিল না। এর পেছনে অন্য একটা কারণও ছিল- আমার খুব সখ ছিল আমি একটা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হব।
আমি আমি দেশের মোটামুটি নামকরা একটা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম, খুব ধীরে ধীরে আমি নিজেকে উন্নত করছিলাম সেখানে। বছর দুয়েক না ঘুরতেই আমি আমার বিভাগের সেরা ছাত্র হয়ে উঠি, শুধু ক্লাসেই আমি নিজেকে আবদ্ধ রাখিনি, যেগুলোকে আমরা কো-কারিকুলাম এবং এক্সট্রা-কারিকুলাম একটিভিটি বলে থাকি, আমি কম-বেশি সেগুলোতেও জড়িয়ে ছিলাম অনেক। তবে পরীক্ষায় ফলাফল ভালো করার পিছনে আমার চেষ্টাটা ছিল চোখে পড়ার মতো, দুঃখজনকভাবে আমার হলের দু'জন রুমমেট ছাড়া সেটা অন্য কেউ খুব একটা দেখেনি। আমি দিন-রাত পড়তাম, মুখস্থ করা নয়, আমি পড়তাম নিজের আনন্দের জন্য, ভাল লাগার জন্য। প্রকৌশল বিদ্যার মতো মজার জিনিস আসলে খুবই কম আছে এটা আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগে বুঝিনি।
এমন অনেক রাত গেছে, সামান্য একটা অঙ্কের সমস্যার একটা লাইন থেকে পরের লাইনটাতে কী করে যাওয়া হয়েছে সেটা বুঝতে পারছি না দেখে আমি সন্ধ্যা ভোর পর্যন্ত সেটা নিয়ে ভেবেছি। আমার রুমমেটরা আমার উপর অগাধ আস্থা রাখত, তাই ওরা নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে উঠে আমার কাছ থেকে পড়া বুঝে নিত, এবং নিশ্চিতভাবেই অনেক অবাক হতো আমি কী করে এই রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে জেগে থেকে পড়াশোনা করছি, এবং দিব্যি সুস্থ আছি!
সত্যি বলতে, আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের রুটিনে ঘুম নামক বিষয়টার জন্য সময় বরাদ্দ ছিল খুবই অল্প। আমি যতক্ষণ পড়তাম না, ততক্ষণ লেখালেখি করতাম, বান্ধবীর সঙ্গে টেলিফোনে গল্প করতাম, বা ল্যাপটপ খুলে ইন্টারনেটে সময় কাটাতাম, এমনকি হাই-তোলা হিন্দি বা শরীরে কাঁটা দেয়া ইংরেজি সিনেমাগুলোও খুব আগ্রহ নিয়ে দেখতাম- তবে এসবের জন্য সপ্তাহে ৪/৫ ঘন্টার বেশি সময় বরাদ্দ ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবার বাসনা আমাকে প্রচন্ডভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল আমার সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন স্যাঁতস্যাঁতে ঘরের রাত্রিগুলোকে, সম্পূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকত, আর আমার পড়তে পড়তে হঠাৎই সিগারেটের তৃষ্ণা জেগে উঠত, আমি হলের করিডরে জ্বলন্ত সিগারেট হাতে পায়চারি করতে করতে ভাবতাম- নিজেকে আর কতটা পোড়ালে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারব?
এভাবেই কেটে গেল বিশ্ববিদ্যলয় জীবন, আমাদের অনেকের কাছেই বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন বলতে যেই প্রাণোচ্ছল, রঙীন, আনন্দমুখর সময়গুলো ভেসে ওঠে; আমার কাছে বিশ্ববিদ্যালয় বলতে তার ঠিক বিপরীত একটা চিত্র ভেসে আসে- আমি অন্ধকার রাতে চার্জ-লাইট জ্বালিয়ে পড়ছি, আমার এক রুমমেট নাক ডেকে ঘুমুচ্ছে, আর একজন কানে হেডফোন লাগিয়ে সিনেমা দেখছে আর মাঝে মাঝে এমন ভাবে চিৎকার করে হাসছে যেন ঐ সিনেমাটা দেখে তার মতো এত আনন্দ আর কেউ কখনো পায়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করার জন্য আমার পরিশ্রমের কোন কার্পণ্য আমি করিনি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার জন্য আমার পক্ষে যতটুকু করার ছিল আমি করেছিলাম।
ফার্স্ট হওয়ার চেয়ে বেশি কিছু আমি করতে পারতাম না, কিন্তু আমার ২৪ বছরের জীবনে আমি সত্যিকারের প্রথম ধাক্কাটা খেলাম পাশ করে বের হবার ঠিক সাথে সাথেই- যখন আমার বিভাগের প্রথম নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে আমার বিশ্ববিদ্যালয় তার প্রথম স্থান অধিকার করা মানুষটিকে অবহেলা ভরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নিয়োগ দিল অন্য এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২২তম স্থান অধিকার করে আসা একটি মেয়েকে, যে ছিল আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের আত্নীয়া। খুব ক্ষোভ নিয়ে আমার একজন শিক্ষককে ফোন করে জিজ্ঞেস করেছিলাম- এমন কেন হলো? উনি আমাকে বলেছিলেন, ঐ মেয়েটার সিজিপিএ নাকি আমার চেয়ে বেশি! বিশ্ববিদ্যালয় ভেদে সিজিপিএর যে কতটা পার্থক্য হয় এবং সেটাই যে কেউকে পরিমাপ করার একমাত্র বিষয় নয় এবং সর্বোপরি নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের একজনকে বাদ দিয়ে অন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেউকে নিয়ে আসাটা যে যৌক্তিক নয়, সেটা কেউ চিন্তা করে দেখেনি।
এক মাসের মাথায় আবার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বের হয় আমার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, আমার স্থান হয় না এবারও। এবারও বাইরে থেকে একটা মেয়েকে নিয়োগ দেয়া হয়, তাঁর ইউএসএ থেকে নিয়ে আসা একটা ডিগ্রি আছে। প্রথমবারের ধাক্কাটা আমি কোনভাবে সামলে নিয়েছিলাম, দ্বিতীয় ধাক্কাটা আমার সহ্য হলো না আর, এক ঝটকায় বিশ্বাস উঠে গেল স্রষ্টা নামক বস্তুটার প্রতি, বুকের ভেতর প্রচন্ড কষ্ট নিয়ে তাঁকে বললাম- এই জন্যেই কি আমি রাতের পর রাত জেগে পড়াশোনা করেছিলাম? আমার পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, শুভাকাঙ্খী সহ অনেকেই আমাকে সান্তনা দিতে এগিয়ে এলেন, কেউ কেউ সান্তনার সাথে উপদেশও দিলেন- অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চেষ্টা কর।
আমার ইচ্ছে করত তাঁদের গলাটা চেপে ধরে জানতে চাইতে- অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও কি এমন যে নিজেদের প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করা ছেলেকে দূরে ছুঁড়ে ফেলে বাইরের কেউ কে নিয়োগ দেয়? আর দেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আমার আত্নীয় নন, আর হলেও আমি কারো কাছে যেতাম না, কারণ, আমি মনে করি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা একটি পবিত্র দায়িত্ব, এই দায়িত্ব গ্রহণের জন্য যথেষ্ট যোগ্য আমি ছিলাম, আমি কেন দু'নম্বরী করতে যাব এই পদের জন্য?
অগত্যা এরপর থেকে আমি আসলে সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়ি, কতটা একা আপনারা কখনো হয়েছেন আমি জানি না, কিন্তু আমার মতো করে শূণ্যতাটা সম্ভবত আমি একাই শুধু বোধ করতে শুরু করি। আমি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা দিয়ে শুরু করি আমার চাকুরি-জীবন, একটি বিশ্ববিখ্যাত কোম্পানিতে চাকরির অফার ফিরিয়ে দেই শুধুমাত্র শিক্ষকতাটাকে আমি পূজো মনে করি বলি। এটা আমার কাছে কোন পেশা নয়, কোন ভাল-লাগাও নয়, শিক্ষকতাটা আমার কাছে একটা আরাধনা। যে আরাধনা দীর্ঘ অনেক বছর আমি আমার হলের অন্ধকার একটি ঘরে করে এসেছিলাম।
আমার ভয় পাওয়ার ঘটনাটা শুরু হয় এখান থেকেই।
দ্বিতীয়বার প্রত্যাখ্যাত হওয়ার সংবাদটা আমার কাছে যেদিন পৌঁছায় সেদিন আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাসায় ফিরি দেরি করে, পরীক্ষার হলে দায়িত্ব ছিল আমার সেদিন। খুব স্বাভাবিকভাবেই আমি প্রতিদিনের মতো গোসল সেরে খাওয়া-দাওয়া করে নেই এবং আমার ছয় তলার নিঃসঙ্গ ফ্ল্যাটে এসে ঘুমানোর আয়োজন করি। একটা গবেষণার কাজ করছিলাম কয়েকদিন ধরেই, সেটা সংক্রান্ত কয়েকটা পেপার দেখছিলাম, কিন্তু একটু খারাপ লাগাতে সেটা আর না দেখে শুয়ে পড়ি দ্রুত। পরদিন আমার ঘুম ভাঙ্গে একটা বিচিত্র অনুভূতি নিয়ে, ঘুম থেকে উঠেই মনে হয় আমি এতক্ষণ একটা গভীর স্বপ্ন দেখছিলাম, ঐ স্বপ্নটার ভেতর আমি একটা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছিলাম। স্বপ্নটা আমার ভালো মনে ছিল না, এখনো নেই, তবে শেষ দৃশ্যটা আমার খুব ভালো মনে ছিল- আমি ক্লাসে কেউকে দাঁড় করিয়ে প্রশ্ন করছিলাম, সবাই কম্পিউটার সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে কেন কেবল এটার ইঞ্জিনিয়ারিং অংশটার দিকেই ঝুঁকে যাচ্ছে, সাইন্স-টার দিকে কেউ আসছে না কেন?
একটু মন খারাপ করা ভাব নিয়ে আমার সেই দিনটাও কাটে, সারাদিনে আমি কাজের ব্যস্ততায় ভুলেই যাই স্বপ্নটার কথা, এমনকি পরদিন রাতে ঘুমুতে যাওয়ার সময়ও আমার মনে থাকে না স্বপ্নটার কথা।
তবে ঠিক যখন ঘুমে চোখ দু'টো লেগে এসেছে, আমি তন্দ্রার চেয়ে সামান্য গভীর একটা স্তরে গিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছি, এবং একই সঙ্গে বুঝতে পারছি যে এটা আসলে স্বপ্ন, আমি প্রচন্ড আতঙ্কে শিউরে উঠি স্বপ্নটার প্রথম দৃশ্যটা দেখে, একজন ছাত্র চোখ ভরা দুষ্টুমির হাসি নিয়ে আমাকে বলছে- স্যার, কারণ সাইন্স অংশটায় টাকা নাই, ইঞ্জিনিয়ারিং অংশটায় টাকা আছে!
আমি বুঝতে পারছিলাম স্পষ্ট যে আমি আগের রাতে ঠিক এখানেই স্বপ্নটাকে শেষ করেছিলাম এবং পরদিন রাতে ঠিক একই জায়গা থেকে শুরু করেছি। আমি বেশ ভয় পাচ্ছিলাম, আমার যুক্তিবাদী মন কিছুতেই মানতে চাইছিল না ঘুমের ভেতর, তবু আমি ঘুম ভেঙে উঠতে পারছিলাম না, আমাকে কেউ জোর করে স্বপ্নটা দেখাচ্ছিল।
তার পরদিন আমি বেশ আতঙ্কে কাটাই। আমার সারাটা দিনই মনে হতে থাকে- আমার এমন কেন হচ্ছে, আমি কি আজ রাতে মা-র সাথে ঘুমুব কি না, না-কি জেগেই কাটিয়ে দিব- এমন আরো অসংখ্য প্রশ্ন; আমি বুঝতে পারছিলাম যে দ্বিতীয়বার প্রত্যাখ্যাত হওয়ার আঘাতটা আমি আসলে সহ্য করতে পারছি না, কিন্তু সেটা এমনভাবে কেন যন্ত্রণা দিচ্ছে? সে রাতটা না ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিলাম পুরোপুরি, বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্ঘুম রাত অসংখ্য কাটিয়েছি, কাজেই আমার উপর তার কোন প্রভাব পড়ল না। কিন্তু এর পরদিন ঘুমালাম, এবং একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল।
আমি আগের বার ঠিক যেখানে স্বপ্নটা শেষ করে উঠছি, পরদিন ঘুমানোর সাথে সাথে আমি ঠিক সেখান থেকেই আবার স্বপ্ন শুরু করছি- ব্যাপারটা প্রমাণ করার জন্যে আমি বালিশের পাশে একটা নোটবুকে লিখে রাখতে শুরু করলাম স্বপ্নটার প্রতিদিনকার শেষাংশ।
প্যারালাল ওয়ার্ল্ড বলে একটা বিষয় আছে, বিজ্ঞানের কিছু কিছু অংশ সেটাকে সমর্থনও করে, কিন্তু আমার সাথে যেটা হচ্ছে সেটাকে আমি কী বলতে পারি? স্বপ্ন সাধারণত অস্পষ্ট ও বহুঅর্থবোধক হয়, এবং মানুষের মানসিক অবস্থার একটা ছাপ স্বপ্নে সবসময়ই থাকে। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিটা হয়নি দেখে খারাপ লেগেছে, ভয়াবহ খারাপই লেগেছে, এমন কষ্ট আমি আমার ২৪ বছরের জীবনে কখনো পাইনি, তাই এটার একটা প্রভাব আমার স্বপ্নে বিস্তৃত হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু এটা পুরোপুরিই অস্বাভাবিক যে আমার স্বপ্নের মাঝে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা জীবন চলছে, আর বাস্তবে আর একটা জীবন চলছে। এটা কখনো হতে পারে না, এই দু'টা জগতের কোন একটা পুরোপুরিই মিথ্যে, কিন্তু কোনটা? আমি কি উন্মাদ হতে চলেছি? আজীবন যুক্তি দিয়ে বিচার করা এই আমি এখন যুক্তি খুঁজে পাচ্ছি না আর, আমার সঙ্গে করা একটামাত্র অযৌক্তিক কাজ আমার সমস্ত যুক্তি সম্ভবত কেড়ে নিয়েছে।
হয়তো এর পরেও ভয় পেতাম না, কিন্তু গত রাতের একটি ঘটনা আমাকে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করে দেয়।
আমার বাসাটা ছয় তলা, আমি ছয় তলাতেই থাকি, সম্পূর্ণ একা। আমার মা এবং ভাই-বোনেরা নিচের তলা গুলোতে থাকে। আমরা সবাই এক সাথেই এখনো খাই, সম্ভবত আমার মা যতদিন আছেন, এটার ব্যতিক্রম হবে না; তাই রোজকার মতো মা-র ঘর থেকে রাতের খাওয়া সেরে আমি ছয় তলায় চলে আসি ঘুমুতে। অনেক বছরের অভ্যাস ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করা, সেটা কাল রাতেও করি।
ইন্টারনেটে কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করি, কিছুক্ষণ গান শুনি, কিছুক্ষণ কম্পিউটারের সাথে দাবা খেলি, এবং এক পর্যায়ে বাথরুম থেকে ঘুরে এসে দরজা বন্ধ করেছি কি-না আবার চেক করে এসে শুয়ে পড়ি। ঘুমুতে ভয় লাগে, তবু এক সময় ঘুম চলে আসে; আধো আলো আধো ছায়ায়, আধো তন্দ্রা বা অবচেতন মনে বুঝতে পারি রোজকার মতো আগের রাতে শেষ করা স্থান থেকে আবার আমার স্বপ্নটা শুরু হচ্ছে, আমার ভয় লাগতে থাকে আবার, তবু ঘুমে তলিয়ে যেতে থাকি ধীরে ধীরে।
কয়েকদিনের অভ্যেসবশতঃ ঘুম ভেঙে ওঠার পর বালিশের পাশে রাখা নোটবুকে তারিখ দিয়ে লিখে রাখি- “অফিসের দরজা খুলে করিডরে বেরিয়েছি মাত্র”। এরপর বাথরুমে যাই, সময় নিয়ে দাঁত মাজি, ফ্রেশ হই, জামা-কাপড় পরি, এবং অবশেষে নিচে নামার জন্যে আমার ফ্ল্যাটের দরজার কাছে এসে দাঁড়াই, দেখতে পাই, আমার ফ্ল্যাটের দরজা অর্ধেকটা খোলা! ঠিক যেমনভাবে আমি কিছুক্ষণ আগে স্বপ্নে দেখেছি! আমার চারপাশে ঝকঝকে সূর্যের আলো, এর মাঝেও আমি শিউরে উঠি খানিকটা, আমি নিশ্চিত, গতরাতে আমি দরজা বন্ধ করে আবার একবার সেটা চেক করে পরে ঘুমিয়েছি; এমনও নয় যে এই দরজা বাইরে থেকে খোলা সম্ভব, কেউ খুলে দিয়েছে।
হয়তো পৃথিবীতে ব্যাখ্যা করা যায় না এমন অনেক কিছুই ঘটে, হয়তো এমন কিছুই ঘটছে এখন; হতে পারে আমার আরাধনাটুকুকে নষ্ট করে দেয়া হয়েছে বলে আমি মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েছি; এমন আরো অনেক 'হয়তো' আর 'হতে পারে'র গ্রাসে বেঁধে ফেলতে পারি আমার এই মূহুর্তের জীবনটাকে, কিন্তু আমার কোন অভিযোগ নেই কারো প্রতি।
আমার সঙ্গে যা হয়েছে সেটা নিয়েও আমার কোন অভিযোগ নেই আর। আমি নিশ্চিত হয়েছি স্রষ্টা বলে কিছু নেই, থাকলে এতটা অবিচার কারো সঙ্গে হতো না, তাই আমার কোন অভিযোগ নেই। আমার কোন অভিযোগ নেই অন্য কোন কিছু নিয়েও, আমার শুধু একটাই প্রার্থনা আছে, আমি শুধু এই ভয়াবহ দুঃস্বপ্নগুলো থেকে মুক্তি চাই, মুক্তি চাই আমার সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে চাওয়ার স্বপ্ন থেকেও, সম্ভব হলে আমি মুক্তি চাই এই পৃথিবী থেকেও।
আমি এখন বসে আসি আমাদের ছয় তলা বাসার ছাদে, আকাশে অনেক বড় একটা গোল চাঁদ, বেশ স্বচ্ছ রাতের আকাশ। চারপাশে অনেকটা দেখা যাচ্ছে ঘৃণার চাদরে ঢেকে যাওয়া আমার দেশ, যেই দেশকে আমি একদিন অনেক গভীর উষ্ণ ভালবাসায় সিক্ত করতে চেয়েছিলাম।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।