আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কালরাতের একজন প্রত্যক্ষদর্শী (দুর্বল চিত্তের মানুষেরা পড়বেন না)

আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান-বুকে একে দেব পদচিহ্ন/ আমি স্রষ্টা-সূদন, শোকতাপ-হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন টাইটেলে একবার বলেছি আবারও বলছি: দয়া করে দুর্বল চিত্তের কেউ এই লেখাটি পড়বেন না। ১৯৭১ সনের ২৭শে মার্চ সকালে রাজধানী ঢাকায় পাকসেনাদের বীভৎস হত্যাকাণ্ডের পর ঢাকা পৌরসভার তৎকালীন চেয়ারম্যান মেজর সালামত আলী খান শূরের প্রশাসনিক অফিসার মি. ইদ্রিস পৌরসভার আরও কয়েকজন অফিসার সঙ্গে নিয়ে একটি মিউনিসিপালিটি ট্রাকে পশু হাসপাতালের সামনে এসে বাঘের মত 'পরদেশী পরদেশী' বলে গর্জন করতে থাকলে আমি ভীত সন্ত্রস্ত ভাবে আমার কোয়ার্টার থেকে বের হয়ে আসি। ইদ্রিস সাহেব অত্যন্ত ক্রুদ্ধভাবে কর্কশ স্বরে বলতে থাকেন, "তোমরা সব সুইপার ডোম বের হও, যদি বাঁচতে চাও অবিলম্বে সবাই মিলে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় স্তূপীকৃত লাশ উঠিয়ে ধলপুর ময়লা ডিপোতে ফেলে দাও। নইলে কাউকে বাঁচানো হবে না। কেউ বাঁচতে পারবে না।

" পৌরসভার সেই ট্রাকে নিম্নবর্ণিত সুইপাররা বসা ছিল- ১. ভারত, ২. লাড়ু, ৩. কিষণ। আমি তার নির্দেশ অমান্য করার কোন উপায় না দেখে ট্রাকে উঠে বসলাম। সেই ট্রাকে করে ঢাকা পৌরসভা অফিসে আমাদের প্রায় আঠারো জন সুইপার ও ডোমকে একত্রিত করে প্রতি ছয়জনের সাথে দুইজন করে সুইপার ইন্সপেক্টর আমাদের সাথে সুপারভাইজার নিয়োজিত করে তিন ট্রাকে তিন দলকে বাংলাবাজার, মিটফোর্ড ও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রেরণ করা হয়। আমি মিটফোর্ডের ট্রাকে ছিলাম। সকাল নয়টার সময় আমাদের ট্রাক মিটফোর্ড হাসপাতালের লাশ-ঘরের সম্মুখে উপস্থিত হলে আমরা ট্রাক থেকে নেমে লাশ-ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে বুকে ও পিঠে মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা করা প্রায় একশত যুবক বাঙালির বীভৎস লাশ দেখলাম।

আমি আমার সুপারভাইজারের নির্দেশে প্রতিটি লাশের পায়ে ধরে টেনে বের করে বাইরে দাঁড়ানো অন্য সুইপারের হাতে তুলে দিয়েছি ট্রাকে ওঠানোর জন্য। আমি দেখেছি প্রতিটি লাশের বুক ও পিঠ মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা। সব লাশ তুলে দিয়ে একপাশে একটা লম্বা টেবিলের ওপর চাদর দিয়ে ঢেকে দেয়া একটি লাশের ওপর থেকে চাদর টেনে উঠিয়ে দেখলাম একটি রূপসী ষোড়শী যুবতীর উলঙ্গ লাশ- লাশের বক্ষ যোনিপথ ক্ষত-বিক্ষত, কোমরের পিছনের মাংস কেটে তুলে নেয়া হয়েছে, বুকের স্তন থেঁতলে গেছে, কোমর পর্যন্ত লম্বা কালো চুল, হরিণের মত মায়াময় চোখ দেখে আমার চোখ বেয়ে পানি পড়তে থাকল, আমি কিছুতেই চোখের পানি রাখতে পারলাম না। আমার সুপারভাইজারের ভয়াল এবং কর্কশ গর্জনের মুখে সেই সুন্দরীর পবিত্র দেহ অত্যন্ত যত্ন সম্ভ্রমের সাথে ট্রাকে উঠিয়ে দিলাম। মিটফোর্ডের লাশ-ঘরের সকল লাশ ট্রাকে উঠিয়ে আমরা ধলপুর ময়লা ডিপোতে নিয়ে গিয়ে বিশাল গর্তের মধ্যে ঢেলে দিলাম।

দেখলাম বিরাট বিরাট গর্তের মধ্যে সুইপার ও ডোমেরা রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে আসা লাশ ট্রাক থেকে গর্তের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। আমি অধিকাংশ লাশের দেহে কোন কাপড় দেখি নাই। যে সমস্ত যুবতী মেয়ে ও রমণীদের লাশ গর্তের মধ্যে ফেলে দেয়া হল তার কোন লাশের দেহেই আমি কোন আবরণ দেখি নাই। তাদের পবিত্র দেহ দেখেছি ক্ষতবিক্ষত, তাদের যোনিপথ পেছন দিকসহ আঘাতে বীভৎস হয়ে আছে। দুপুর প্রায় দুইটার সময় আমরা রমনা কালীবাড়িতে চলে আসি পৌরসভার ট্রাক নিয়ে।

লাশ ওঠাবার জন্য রমনা কালীবাড়ির দরজায় দাড় করিয়ে রেখে আমরা চারজন কালীবাড়ির ভেতরে গিয়ে দেখি সবকিছু পুড়ে ভস্ম হয়ে আছে। কালীবাড়ি বিভিন্ন জায়গায় ছড়ানো ছিটানো ৪১টি পোড়া লাশ আমি ট্রাকে তুলেছি। কালীবাড়ির এসকল লাশ ধলপুরের ময়লার ডিপোতে গর্তের মধ্যে ফেলেছি। লাশ তুলে তুলে মানুষের পচা চর্বীর গন্ধে আমার পাকস্থলী বের হতে চাচ্ছিল। পরের দিন আর লাশ তুলতে যাই নাই, যেতে পারি নাই, সারাদিন ভাত খেতে পারি নাই, ঘৃণায় কিছু স্পর্শ করতে পারি নাই।

পরের দিন ২৯শে মার্চ সকালে আমি আবার ঢাকা পৌরসভা অফিসে হাজির হলে আমাকে ট্রাক দিয়ে লাশ তোলার জন্য আরও কয়েকজন সুইপারের সাথে ঢাকা শাঁখারিবাজারে যেতে বলা হল। জর্জ কোর্টের সম্মুখে আগুনের লেলিহান শিখা তখনও জ্বলছিল, আর পাক সেনারা টহলে মোতায়েন ছিল বলে আমরা ট্রাক নিয়ে সে পথ দিয়ে শাঁখারিবাজারে প্রবেশ করতে পারি নাই। পাটুয়া-টুলি ঘুরে আমরা শাঁখারিবাজারের পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবেশ করে পাটুয়া-টুলি ফাঁড়ি পার হয়ে আমাদের ট্রাক শাঁখারিবাজারের মধ্যে প্রবেশ করল। ট্রাক থেকে নেমে আমরা শাঁখারিবাজারের প্রতিটি ঘরে প্রবেশ করলাম- দেখলাম মানুষের লাশ, নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, বালক-বালিকা, কিশোর-শিশুর বীভৎস পচা লাশ। চারিদিকে ইমারত সমূহ ভেঙ্গে পড়ে আছে, মেয়েদের অধিকাংশ লাশ আমি সম্পূর্ণ উলঙ্গ দেখলাম, দেখলাম তাদের বুক থেকে স্তন তুলে নেয়া হয়েছে।

কারও কারও যোনিপথে লাঠি ঢুকানো আছে। বহু পোড়া ও ভস্ম লাশ দেখেছি। পাঞ্জাবী সেনারা পাষণ্ডের মত লাফাতে লাফাতে গুলি করছিল। বিহারী জনতা শাঁখারিবাজারের প্রতিটি ঘরে ঢুকে মূল্যবান আসবাবপত্র, সোনাদানা লুণ্ঠন করে নিয়ে যাচ্ছিল, আমরা অবিরাম গুলিবর্ষণের মুখে প্রাণের ভয়ে দুই ট্রাক লাশ তুলে লাশ তোলার জন্য সেদিন আর শাঁখারিবাজারে প্রবেশ করার সাহস পাই নাই। ৩০শে মার্চ সকালে আমার দলকে মিল-ব্যারাক থেকে লাশ তুলতে বলা হল।

আমি মিল-ব্যারাক ঘাটে পৌরসভার ট্রাক নিয়ে গিয়ে দেখলাম নদীর ঘাটে অসংখ্য মানুষের লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, বহু লাশ রশি দিয়ে বাধা দেখলাম, প্রতিটি রশির বন্ধন খুলে দশ পনের জনের লাশ বের করলাম। সব যুবক ছেলে ও স্বাস্থ্যবান বালকদের লাশ দেখলাম। প্রতিটি লাশের চোখ বাধা, হাত বাধা, শক্ত করে পেছন দিক থেকে। প্রতিটি লাশের মুখমণ্ডল কালো দেখলাম। এসিডে জ্বলে বিকৃত ও বিকট হয়ে আছে।

লাশের সামনে গিয়ে ঔষধের অসহ্য গন্ধ পেলাম। লাশের কোন দলকে দেখলাম মেশিনগানের গুলিতে বুক ও পিঠ ঝাঁঝরা হয়ে আছে, অনেক লাশ দেখলাম বেটন ও বেয়নেটের আঘাতে বীভৎস হয়ে আছে, কারও মাথা চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে মগজ বের হয়ে আছে, কারও কাঁটা হৃদপিণ্ড বেরিয়ে আছে। নদীর পাড়ে ছয়জন রূপসী যুবতীর বীভৎস ক্ষতবিক্ষত উলঙ্গ লাশ দেখলাম। চোখ বাধা, হাত-পা শক্ত করে বাধা প্রতিটি লাশ গুলি আঘাতে ঝাঁঝরা, মুখমণ্ডল, বক্ষ ও যোনিপথ রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত ও বীভৎস দেখলাম। দুইবারে দুই ট্রাকে আমি সত্তরটি লাশ উঠিয়ে ধলপুর ময়লা ডিপোতে ফেলেছি।

এরপর আমাকে সদরঘাট, শ্যামবাজার, বাদাম-তলী ঘাট থেকে লাশ তুলতে বলা হয়। আমি উপরোক্ত এলাকার নদীর ঘাট থেকে পচা লাশ তুলে ধলপুর ময়লা ডিপোতে ফেলেছি। আমি যেদিন কালীবাড়ি থেকে লাশ তুলেছি সেদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে পিছনে স্টাফ কোয়ার্টার, রোকেয়া হলের পশ্চিম দিকে জনৈক অধ্যাপকের বাসা থেকে লাশ তুলেছি। রোকেয়া হলের পিছনের স্টাফ কোয়ার্টারের ভিতর থেকে আমি যেয়ে পুরুষ ও শিশু সমেত নয়টি লাশ তুলেছি। আর অধ্যাপকের বাসা থেকে সিঁড়ির সামনে লেপের ভিতর প্যাঁচানো জনৈক অধ্যাপকের লাশ আমি তুলে নিয়ে গেছি।

স্বাক্ষর পরদেশী (পিতা: ছোটন ডোম; সুইপার সরকারী পশু হাসপাতাল, ঢাকা) ২১/৩/১৯৭৪ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: অষ্টম খণ্ড গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, তথ্য মন্ত্রণালয় পৃষ্ঠা: ৫০ ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।