‘এক রাজাকারের ফাঁসি হচে বড়ো আব্বা!’
ছোট ভাই সাহেব আলীর মেয়ে সামিনার চিৎকার শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে নায়েব আলী। পশ্চিম পাশের বারান্দা থেকে ততোক্ষণে উঠানে নেমে এসেছে সামিনা। তার চোখে মুখে এক ধরনের আলো ছড়ানো উত্তেজনা। একজন রাজাকারের মৃত্যুদ-ের খবরে তার মুক্তিযোদ্ধা চাচা কতটা খুশি হবেন তা আর কেউ না জানলেও সামিনা ঠিকই জানে। ছোট ভাইয়ের কলেজে পড়া এই মেয়েটা তার বড় আব্বার কাছে থেকে শোনা গল্পগুলোকেই দেশের ইতিহাস হিসাবে বিশ্বাস করে।
দৌড়ে এক চিলতে উঠান পার হয়ে সে নায়েব আলীর বারান্দায় এসে ওঠে।
‘কী হচে রে মা? কার ফাঁসি হচে?’
‘দেলু রাজাকার, এখোন বলে নাম লিচে দেলোয়ার হোসেন সাইদি। এক্খনি টেলিভিশনের খবরোত কলো বড়ো আব্বা! আন্তোরজাতিক আদালত রায় দিচে। ’
মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কিংবা সামিনার ভাষায় ‘আন্তোরজাতিক আদালত’ সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকলেও সে বুঝতে পারে ঘটনা একটা ঘটেছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের বছর যারা মানুষ মেরেছিল, ঘর বাড়ি লুটপাট করেছিল এবং মুক্তিযোদ্ধাদের পাকিস্তানিদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল, অনেক দিন পরে হলেও তাদের শাস্তির একটা ব্যবস্থা বোধহয় সত্যিই হতে যাচ্ছে।
নায়েব আলীর নিজের ঘরে কোনো টেলিভিশন নেই। কলেজে ক্লাস অথবা মিটিং মিছিল না থাকলে সামিনা প্রায় সারাদিনই বিভিন্ন চ্যানেলে হিন্দি বাংলা ছবি দেখে সময় কাটায়। আজও টেলিভিশনে ছবি দেখার ফাঁকে হঠাৎ করেই ব্রেকিং নিউজে চোখ পড়ে যায় সামিনার আর সঙ্গে সঙ্গেই সে বড় আব্বাকে খবর দিতে ছুটে আসে। সামিনার এই উত্তেজনা দ্রুত নায়েব আলীর মধ্যে সঞ্চারিত হলে সে ‘জয়বাংলাÑ স্বাধীন বাংলা’ বলে একটা হুংকার দিয়ে ঘরে ঢোকে। এরপর তাড়াহুড়ার মধ্যে গায়ে একটা জামা চড়িয়ে বোতাম লাগাতে লাগাতে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়।
দুপুরে খাওয়ার পরে জমে থাকা থালা-বাসন এবং হাঁড়ি-কুড়ি বাড়ির পাশে পুকুরের ঘাটে ধুতে নিয়েছিল নায়েব আলীর স্ত্রী রাহেলা। উত্তেজিত নায়েব আলী বেরিয়ে যাবার কিছুক্ষণ পরেই সে ঘাট থেকে ফিরে আসে। ঘরে ঢুকে স্বামীকে দেখতে না পেয়ে প্রথম অবস্থায় সে কিছু মনে করে না। তবে দীর্ঘক্ষণ পেরিয়ে যাবার পরেও তাকে না দেখে ইতি উতি খোঁজ করতে বের হয়। হরতালের কারণে দুই নাতি নাতনি স্কুলে যায়নি।
তাদের দুজনেই পাড়ার জনাকয়েক ছেলে মেয়ের সাথে মিলে বাড়ির সামনে বরই গাছে ঢিল ছুঁড়ে বরই পাড়ছিল। তারা তাদের দাদির প্রশ্নের সদুত্তর দেয়া তো দূরের কথা কোনো ভ্রুক্ষেপও করে না। রাহেলা শেষপর্যন্ত বাড়িতে এসে সামিনাকেই ডাক দেয়।
‘ক্যারে সামিনাÑ তোর বড়ো আব্বা কোনটে গ্যালো কওয়া পারিস?’
‘দেলু রাজাকারের ফাঁসি হচে শুনে বড় আব্বা জামা গায়ত দিয়ে ব্যার হচে। মোনে হয় জয়পুরের দিকে গ্যালো।
’ বড় আম্মার ডাক শুনে বারান্দায় বেরিয়ে বলে সামিনা।
‘ক্যাÑ অক কি ফাঁসি দেওয়ার জোন্যে ডাকিচে? রাজাকারের ফাঁসি দেওচে! রাজাকারের ইয়াক তুলে বোঝা ব্যান্দে তেবেসিনি বাড়িত ফিরবে। ’ স্পষ্টতই বিরক্ত হয় রাহেলা। তবে দেবরের মেয়ের সামনে তার বিবেচনায় অশ্লীল শব্দটি উচ্চারণ না করে ‘ইয়াক’ প্রতিশব্দ ব্যবহার করে সে।
জয়পুরহাট শহরের ঠিক বাইরে আউশগাড়ার বাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের অফিসে পৌঁছাতে নায়েব আলীর আধাঘণ্টার বেশি সময় লাগে না।
এরই মধ্যে পুরোনো বন্ধু বান্ধবের মধ্যে কেউ কেউ অফিসে এসে জড়ো হয়েছে। সহযোদ্ধাদের অনেকেই অবশ্য এখন মৃত। ইপিআর-এর শাকিল ওস্তাদ নেই, কাশিয়াবাড়ি স্কুলের এমদাদ মাস্টার নেই, কড়ই কাদিপুরের অশ্বিনী নেই, অল্প কিছুদিন আগে মারা গেছে জন্তিগ্রামের আশরাফ।
‘আহা আশরাফ! এমন আনন্দের দিনে আশরাফ নাই। ’ সবচেয়ে ঘনিষ্ট সহযোদ্ধা একাত্তরের টগবগে তরুণ আশরাফের কথা মনে করে নিজের অজান্তেই বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে নায়েব আলীর।
এ সময় আরও এক মুক্তিযোদ্ধা বন্ধু নজিবরের কথা তার মনে হয়। অনেকদিন হলো পক্ষাঘাতে পঙ্গু হয়ে বিছানায় পড়ে আছে, তাকেও একবার খবরটা দিতে যাওয়া দরকার। অন্তত একজন নেতা কিসিমের রাজাকারের ফাঁসির হুকুম হয়েছে শুনলে অসুস্থ নজিবরের মুখেও হাসি ফুটবে।
বিকেল থেকে শুরু করে সন্ধ্যার অনেকটা পর পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের সহযোদ্ধা, বন্ধুবান্ধব এবং শুভাকাক্সক্ষী সমর্থক মিলিয়ে প্রায় পঁচিশ ত্রিশজন বয়োবৃদ্ধ মানুষ তরুণদের মতো অকারণ আনন্দ উল্লাসে মেতে ওঠে। কয়েকদিন আগে অন্য এক যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির আদেশ না হওয়ায় যারা ক্ষুব্ধ হয়েছিল তারাও এবারে সন্তুষ্ট বলেই মনে হয়।
তবে শেষপর্যন্ত ফাঁসির এই রায় কার্যকরী হবে কি না তা নিয়েও কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করে। এরই মধ্যে কে একজন শ্যামলাল ঠাকুরের দোকান থেকে দুই বাক্স লাড্ড ু নিয়ে আসে। হৈ হৈ করে মুহূর্তের মধ্যে মিষ্টির বাক্স খালি হয়ে যায়। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সদ্য অবসর প্রাপ্ত সহকারী পরিচালক আজাহার ম-ল বলতে চেষ্টা করেন, ‘মোর ডায়বিটিশ হচে রে, মিষ্টি খাওয়া নিষেধ। ’ কিন্তু হৈ চৈয়ের মধ্যে তার কথা চাপা পড়ে যায়।
সহযোদ্ধা মন্তাজ আলী তার মুখেও জোর করে একটা লাড্ডু গুঁজে দেয়।
শহরের প্রান্তসীমায় হলেও আউশগাড়াকে এখন পর্যন্ত গ্রামই বলা যায়। তার মধ্যে হঠাৎ করে ইলেক্ট্রিসিটি চলে যাওয়ায় সাড়ে আটটার মধ্যেই রাত গভীর বলে মনে হয়। রাহেলা স্বামীর জন্যে অপেক্ষা করে প্রথমে নাতি নাতনিদের খাইয়ে দিয়ে পরে ছেলের বউকে সঙ্গে নিয়ে নিজেও খেয়ে নেয়। একমাত্র ভবঘুরে ছেলে কখন বাড়ি ফিরবে কোনো ঠিক ঠিকানা নেই।
কাজেই তার চাকরিজীবী স্ত্রী কোনো দিনও স্বামীর ফেরার অপেক্ষা করে না। কিন্তু শ্বশুরের এই অনির্ধারিত বিলম্বে সেও বিস্মিত হয়। শ্বাশুড়ি এবং পুত্রবধূ যখন নায়েব আলীর এহেন রুটিন বহির্ভূত আচরণ নিয়ে আলোচনা করছে, তখনই অন্ধকারের মধ্যে থেকে ভুস করে উঠানে এসে হাজির হয় নায়েব আলী।
‘আজ ম্যালাদিন পরে একখান কামের কাম হচে। ’ হাসতে হাসতে স্ত্রী এবং ছেলের বউকে জানায় নায়েব আলী।
‘আব্বা কি দেলু রাজাকারের ফাঁসি দিয়ে ফিরলেন?’ পুত্রবধূ লতিফার কণ্ঠে স্পষ্টতই কৌতুকের সুর।
‘ফাঁসি কি মুখের কতা! কেবোল রায় হচে, আপিল হোবে, শুনানি হোবেÑ ম্যালা কিবা কিবা তারপরে ফাঁসি। সোংসদ অপিসে এলা নিয়েই সব আলোচনা সোমালোচনা। ’
‘ল্যাও ল্যাও হচেÑ এখোন খায়ে দায়ে হামার জীবোনডা এ্যানা জুড়াবার দ্যাও। ’ রাহেলা স্বামীর গুরুত্বপূর্ণ ‘আলোচনা
সোমালোচনা’কে কোনো পাত্তা দেবার প্রয়োজন বোধ করে না।
অতএব নায়েব আলী নিজেই নতুন করে বিষয়টি উত্থাপনের চেষ্টা করে।
‘এইবারে আর শালাঘরে র্যক্ষা নাই। ’
‘এ্যাতোগুলা বছোর ধরে শালাঘরে কী করিছিন তোমরাই? যুদ্ধ করে যেমোন দ্যাশ স্বাধীন করিছিন তেমোন হচে তোমার সরকার। খালি বড়ো বড়ো কতা। ’
‘ক্যাÑ সরকার কোম কি করিচে! মাসে মাসে ভাতা দেওচে না।
চাকরিত সুযুগ সুবিধা করে দেয়নি? তোমার ব্যাটা চাকরি করবে না তাক কে ড্যাকে লিয়ে চাকরি দিবে! আর শোনেক, হামি মরলে লাশ পতাকা দিয়ে ঢ্যাঁকে গার্ড অফ ওনার দিয়ে তেবেসিনি কব্বোর দিবে। এ্যালা কেচুই লয়?’
‘হয় হয়! বাঁচতে দিল না মুখত ফুঁ, মরলে দিবে ইয়াকত ফুঁ!’ রাহেলার কথায় স্বাভাবিকভাবেই যথেষ্ট ক্ষোভ ঝরে পড়ে।
এরপর কথা আর খুব বেশি এগোয় না। নায়েব আলী হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসে এবং অভ্যাস মতো খাওয়ার পরপরই বিছানায় গড়িয়ে পড়ে। কিন্তু অন্যান্য দিনের মতো চট করে ঘুম আসে না তার।
দীর্ঘক্ষণ এ পাশ ও পাশ করে পুরোপুরি ঘুমিয়ে যাওয়ার আগে সে জেগে জেগেই স্বপ্ন দেখে এক এক করে সব রাজাকারকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র হাতে আনন্দ উল্লাস করছে। ঘুমিয়ে নাকি জেগে সে ঠিক বুঝতে পারে না, কিন্তু স্পষ্ট শুনতে পায় অসংখ্য কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে ‘জয়বাংলা’ শ্লোগান।
ভোর বেলা ঘুম ভেঙে যেতেই নায়েব আলী বিছানা ছেড়ে লাফ দিয়ে উঠে পড়ে। অন্যান্য দিনের মতো নিমের দাঁতন চিবিয়ে সকাল পার না করে চট জলদি তৈরি হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় সে। রাহেলা তখন চুলার পাড়ে পেঁয়াজ আর কাঁচা মরিচ দিয়ে রাতের বাসি ভাত ভাজায় ব্যস্ত ছিল।
কিন্তু নায়েব আলী নাস্তাপানির অপেক্ষা না করেই শহরের দিকে যাত্রা করে। সকাল সকাল শহরে পৌঁছেও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ অফিস, শহীদ মিনার, এমন কি পাঁচুর মোড়েও সগোত্রীয় কাউকে না পেয়ে সে একটু হতাশ হয়। এদিকে বেলা বাড়ার সাথে সাথে পেটের ভেতরটা মোচড় দিতে থাকে। অগত্যা একপা দুপা করে দিল বাহার রেস্টুরেন্টে ঢুকে কোণার দিকে একটি টেবিল দখল করে বসে পড়ে।
এই রেস্তোঁরায় নায়েব আলীর নিয়মিত আসা যাওয়া না থাকলেও তাকে চেনে না এমন কেউ নেই।
অতএব সে টেবিলে বসার সাথে সাথে কালাচাঁদ নামের অল্পবয়েসী ছেলেটি এসে জিজ্ঞেস করে, ‘কি নানাÑ আজ নানি বুঝিল বাড়িত নাস্তা খিলায়নি?’
‘আরে সরকার বলে সব রাজাকারক ধরে ধরে ফাঁসি দেওচেÑ এখোন বাড়িত বসে থাকলে হোবে! নতুন করে বলে সোংগ্রাম শুরু হচে। দেরে কালাচাঁন পরোটা দে। ’
‘পরোটার সাথে কি নানাÑ ডিম মামলেট, রসোগোল্লা না খালি ডালভাজি?’ কালাচাঁনের প্রশ্নে একটু বিব্রত হয় নায়েব আলী। পকেটের অবস্থা বুঝে নিয়ে একটু কুণ্ঠিতভাবেই বলে, ‘দুডা পরোটা আর ডালভাজিই দেরে চ্যাংড়া। ’
কালাচাঁন নাস্তার অর্ডার নিয়ে যাবার পরপরই রেস্তোঁরায় ঢোকে নায়েব আলীর এক সময়ের সহপাঠি মোকলেস।
স্কুলে ক্লাস টেন পর্যন্ত একসাথে পড়লেও নায়েব আলীর এসএসসি পাশ করা হয়নি। একাত্তরে পরীক্ষার বছরই শুরু হয়েছিল স্বাধীনতার যুদ্ধ। ইচ্ছা ছিল যুদ্ধ শেষে স্বাধীন দেশে নতুন করে পড়াশোনা শুরু করবে। কিন্তু ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে দেশে ফিরে পোড়া ভিটায় ঘর তুলতে না তুলতেই বাবার মৃত্যু আর তাকে কোনো দিকে তাকাবার অবসর দেয়নি। ছোট ভাইকে লেখাপড়া শিখিয়ে বোনদের বিয়ে দিয়ে নিজের ঘর সংসার গুছিয়ে বসতে বসতেই সময় শেষ।
সামান্য জমিজমায় বেশি করে ফসল ফলানোর নিরন্তর চেষ্টায় লেগে থাকা কৃষক আর শীতকালে বাড়তি কিছু আয় রোজগারের আশায় চিনিকলে মৌসুমি শ্রমিকÑ কৃষক শ্রমিক এই দুই পরিচয়েই একনিষ্ঠ নায়েব আলীর জীবনে মুক্তিযুদ্ধ বাড়তি কিছু যোগ করেনি। তারপরেও একাত্তরের হত্যা, ধ্বংস, রক্ত আর যুদ্ধ গত বিয়াল্লিশ বছর ধরে প্রতিনিয়ত তাকে তাড়িত করে।
মোকলেস একটা দৈনিক পত্রিকা হাতে নিয়ে রেস্টুরেন্টে ঢুকে নায়েব আলীর টেবিলে বসে প্রথমে প্রধান শিরোনামগুলোতে চোখ বুলায়। তারপরেই ‘গোলাম আযম দিব্যি আছেন’ শিরোনামের খবরটি শুরু থেকে শেষপর্যন্ত উচ্চকণ্ঠে পড়তে শুরু করে।
‘দেলোয়ার হোসেন সাঈদী ফাঁসির রায়ের পরপরই গুজব ছড়িয়ে পড়ে জামায়াতে ইসলামের সাবেক আমির গোলাম আযম হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছেন।
তিনি রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিজন সেলে চিকিৎসাধীন। ’ এ পর্যন্ত পড়ার পরে মোকলেসকে থামিয়ে নায়েব আলী জিজ্ঞেস করে, ‘পিজন সেল কী রে মোকলেস?’
‘পিজন সেল বুঝলু না। হাঁসপাতালের মধ্যে খাঁচার মতো সব ঘর ব্যানে থুচে। দামী দামী সব চোর ডাকাত, দুর্নীতিবাজ, বড়ো বড়ো রাজাকার এগলাক আটকে থোয়ার জোন্যে হাঁসপাতালের মধ্যে জেলখানা। ’
‘ও তাই! গোলাম আজোমক তাহলে খাঁচাত আটকে থুচে।
ভালই হচে, তারপরে কি হলো তাই পড়। ’ নায়েব আলী তাড়া দিলে মোকলেস আবার পড়তে শুরু করে।
‘এ গুজবের বিষয়ে বিকেল তিনটায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল মজিদ ভূঁইয়ার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, খবরটি সঠিক নয় বরং গোলাম আযম সাহেব খুবই সুস্থ আছেন। এইমাত্র তার রক্তচাপ মেপে দেখা হয়েছে, হৃদকম্পনের মাত্রা পরীক্ষা করা হয়েছে। সবই পুরোপুরি সুস্থ আছে।
ওই কর্মকর্তা আরও জানান, সকালে গোলাম আযম দুটি ডিম দিয়ে নাস্তা করেছেন। সকাল এগারটায় মুরগির স্যুপ খেয়েছেন এবং দুপুরে সময় মতো খাবার খেয়েছেন। তাঁর কোনো অসুবিধা নেই। ’
’দাঁড়া দাঁড়া পেপারত কী লেখিছেÑ গোলাম আজোম কী দিয়ে নাস্তা করিচে আরেকবার পড়তো রে মোকলেস। ’
‘সকালে গোলাম আযম দুটি ডিম দিয়ে নাস্তা করেছেন।
সকাল এগারটায় মুরগির স্যুপ খেয়েছেন এবং দুপুরে...’ মোকলেস আবার পড়তে শুরু করলেও নায়েব আলী শেষপর্যন্ত না শুনেই প্রশ্ন করে, ‘রাজাকারের নাস্তাপানির ব্যবস্থা কে করে? এই শালাঘেরে নাস্তার ট্যাকা দেয় কে?’
‘সরকার দেয়Ñ জেলখানার বুন্দি আর হাঁসপাতালের রুগি, সগলার খাদ্য খানার ব্যবোস্থা করে সরকার। ’
‘তুই ঠিক জানিস?’ মোকলেসের কথায় আশ্বস্ত হতে পারে না নায়েব আলী।
নায়েব আলীর জন্যে নিয়ে আসা পরোটা ভাজি টেবিলে নামিয়ে রেখে কালাচাঁন অপেক্ষা করছিল। প্রথমে তাকেই সাক্ষী মানে মোকলেস।
‘হামার কথা বিশ্বাস না হলে এই কালাচাঁনক পুছ কর।
তা না হলে অই যে নৃপেন মাস্টার না হলে জসিমের কাছে শুনে দ্যাখ। ’ কাছের এবং একটু দূরের আরও দুটি টেবিলের দিকে সহযোদ্ধার দৃষ্টি আকর্ষণ করে মোকলেস।
‘রাজাকারের জোন্যে ডবল ডিমের মামলেট, আর হামার জোন্যে ডালভাজিÑ শালার নাস্তাই খামো না। ’ কালাচাঁনের নিয়ে আসা নাস্তার প্লেট ঠেলে দিয়ে টেবিল থেকে উঠে দ্রুত বাইরে বেরিয়ে যায় নায়েব আলী। পেছন থেকে কালাচাঁন তাকে নাস্তা করে যাবার জন্যে ডাকে, কিন্তু সে ফিরে আসে না।
মোকলেস দৌড়ে বেরিয়ে এসে বলে, ‘তোর ডিম মামলেটের ব্যবস্থা হোবে, তুই নাস্তা খায়ে যা। ’ কিন্তু কারও কথায় কান দেয় না সে। প্রায় ছুটতে ছুটতে বাড়ি ফেরার পথে বিড় বিড় করে একই কথা উচ্চারণ করে সে।
‘রাজাকারের জোন্যে ডবল ডিম, আর মুক্তিযোদ্ধার ডাল ভাজি! শালার সরকারের ইয়াকত ডবল ডিম ভরে দেও রে, মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়েরা কে কোন্টে আছিন!’
পরবর্তী দিন তিনেক একটা ঘোরের মধ্যে কাটে নায়েব আলীর। প্রতি মুহূর্তে তার মাথার মধ্যে একটা হিসাব ঘুরপাক খেতে থাকে।
একজন রাজাকারের নাস্তায় যদি ডবল ডিম, মুরগির স্যুপ ইত্যাদি সুস্বাদু স্বাস্থ্যকর খাবার দেয়া হয়ে, তাহলে দুপুরের খাবার, রাতের খাবার মিলিয়ে তার পেছনে সরকার প্রতি মাসে কত টাকা ব্যয় করে! অথচ একজন মুক্তিযোদ্ধার ভাতা মাসে দুই হাজার টাকা দিতে সরকারের কষ্ট হয়। দেলু রাজাকারের ফাঁসির রায় তার মধ্যে যে উৎসাহব্যঞ্জক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল তা কোথায় যে মিলিয়ে যায় নায়েব আলী বুঝতেও পারে না। তার পরিবর্তে এক রাজ্যের হতাশা এসে তাকে গ্রাস করে। সে টেলিভিশনের খবর দেখে না। ভাতিজি সামিনা বা পুত্রবধূ লতিফা কিছু বলতে এলে রেগে যায়।
প্রায় সারাক্ষণই তার মনে হয়, এভাবে অপমানিত লাঞ্ছিত হয়ে এ দেশে বেঁচে থাকার আর কোনো মানে হয় না।
জামাতের ডাকা হরতালের শেষদিন বিকেলের দিকে সামিনা তার ঘর থেকে বেরিয়ে ধীর পায়ে নায়েব আলীর ঘরের বারান্দায় ওঠে। তার কণ্ঠে ক্ষোভ থাকলেও পুরো উত্তেজনা নিজের মধ্যে সামলে রেখে সে বলে, ‘বড়ো আব্বা! রাজাকারেরা কলেজের শহীদ মিনার ভাঙে গুঁড়া করে দিছে, জাতীয় পতাকা ছিঁড়ে ফেলাছে আর আপনাঘেরে মুক্তিযোদ্ধা সোংসদের অফিসত আগুন দিছে। ’
সামিনার কথা বুঝতে একটু সময় লাগে নায়েব আলীর। সে চুপ করে থাকায় সামিনা আবার বলে, ‘খবোরের মধ্যে ছবি দেখাচ্ছে বড়ো আব্বা!’
‘ডবল ডিম খায়ে শালার রাজাকারের গায়েত জোর ব্যাড়ে গেছে।
দ্যাশ থ্যাকে এই রাজাকারের গুষ্টি শ্যাষ না করলে আর শান্তি নাই। ’ বারান্দার চালে আটকানো শড়কি এক টানে খুলে ফেলে নায়েব আলী তারপর লাফ দিয়ে উঠানে নেমে হুঙ্কার দেয় ‘জয়বাংলা! স্বাধীন বাংলা!’
সামিনা তার ওড়না আঁটসাঁট করে কোমরে পেঁচিয়ে নেয়। তারপরে দুইজন ছুটতে থাকে, সম্ভবত শহীদ মিনারের উদ্দেশে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।