আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ওয়ালস্ট্রিট দখল আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে

হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোনজন, কান্ডারি বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা'র এক মাস পেরিয়ে গেল অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলনের। ভোগবাদী পশ্চিমা জীবন ব্যবস্থায় কর্পোরেট আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাতে ভুলে যাওয়া আমেরিকার জনসাধারণ নেমে এসেছে রাজপথে, প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে শতকরা ৯৯ শতাংশ গণমানুষের উপর শতকরা ১ শতাংশ বেনিয়া-রাজনীতিবীদ-সুশীল সিন্ডিকেশনের শাসন শোষনের বৈধতার প্রতি। কর্পোরেট লোভের বিরুদ্ধে সামাজিক সমতার দাবিতে তারা দখল করে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বেনিয়া ক্ষমতার উৎস বলে পরিচিত ওয়ালস্ট্রিটের রাজপথ। তারা স্লোগান দিচ্ছে, মিছিল করছে, পুজিবাদের বেহেশত বলে পরিচিত খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই তারা পুজিবাদ বিরোধী আওয়াজ তুলছে। এই আন্দোলনের ৩৭ শতাংশ অংশগ্রহনকারী ঘোষনা করছে পূজিবাদের অপবত্রিতা, এর আবশ্যিক মৃত্যু পরোয়ানা, ৪৬ শতাংশ আন্দোলনকারী পূজিবাদের বিনাশ না চাইলেও মুক্ত বাজারের নিয়ন্ত্রন চাচ্ছেন।

টাইম ম্যাগাজিনের জরিপ অনুযায়ী আন্দোলনের সরাসরি অংশগ্রহণ না করলেও ৫৪ শতাংশ মার্কিন জনগণেরই সমর্থন আছে এই আন্দোলনের প্রতি। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভোগবাদ, পূজিবাদ বিরোধী এহেন গণজাগরণ তাই রূপকথার চেয়ে কোন অংশে কম মনে হয়না, একিসাথে কেউ কেউ এতে নতুন পৃথিবীর সম্ভাবনার আশাবাদও খুঁজে পেতে পারেন। বর্তমান দুনিয়ার পূজিবাদী ঔপনিবেশীক ক্ষমতা কাঠামোর প্রান্তিক এবং শোষিত একটি রাষ্ট্র বাংলাদেশের ৯৯ শতাংশ সাধারণ জনসাধারণ হিসাবে আমাদের প্রতিনিয়ত ঔপনিবেশীক আগ্রাসন, কর্পোরেট দখলদারিত্ব, দেশীয় ১ শতাংশ ঔপনিবেশিক দালাল শাসক সিন্ডিকেশনের বিরুদ্ধে নিজেদের মাটি, জাতীয় সম্পদ, মন ও মগজের মালিকানার জন্যে, অধিকারের জন্যে সংগ্রাম করতে হয়। জনসাধারণের মালিকানা প্রতিষ্ঠার এই মুক্তিসংগ্রাম আমরা অব্যাহত রেখেছি পুরো পূজিবাদী ঔপনিবেশিক কালপর্বেই, এই সংগ্রাম চলছে এবং চলবে নিজেদের শরীর, মন, মাটি’র উপর আমাদের পূর্ণ মালিকানা প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত। ওয়ালস্ট্রিট দখলের এই আন্দোলনের প্রতি বাংলাদেশের ৯৯ শতাংশ জনগণের পক্ষে থেকে তাই আমরা শতভাগ সংহতি জানাই, জানাই নৈতিক এবং আদর্শিক সমর্থন।

তবে এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে উত্তর ঔপনিবেশিক ও উত্তর পূজিবাদী নতুন পৃথিবীর সম্ভাবনার আশাবাদ খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রে আমরা আমাদের শঙ্কা প্রকাশ করছি। ইতিহাস আমাদের এই শঙ্কা প্রকাশ করতে বাধ্য করে। আমরা দেখেছি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তি সামাজিক হতাশা থেকে পশ্চিমা ভোগবাদী জীবনব্যবস্থা, কর্পোরেট সাম্রাজ্যবাদ আর মার্কিন সামরিক আধিপত্ত্ববাদের বিরুদ্ধে প্রবল তারুন্যের স্ফুর্তিতে জন্ম নেয়া ৬০/৭০ এর হিপ্পি/পাংক মুভমেন্টও হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। আমরা দেখেছি গোলকায়ন বিরোধী ৯০ এর সিয়াটল মুভমেন্টকেও নাই হয়ে যেতে। পশ্চিম বার বার ভুলে যায়, পশ্চিমের জনগনের মন মগজে ভোগবাদের যেই দখলদারিত্ব, পশ্চিমা মিডিয়া হেজেমনির যেই আধিপত্ত্ব তার বিরুদ্ধে রূখে দাঁড়াতে তারা ভুলে যায়।

‘তৃতীয় বিশ্ব’ নামক ‘অপর’ এবং ‘অর্বাচিন’দের বাসভুম বলে পরিচিত বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রগুলোর গনমানুষের মুক্তিসংগ্রামের তারা খবর রাখেনা। প্রবল রাষ্ট্রযন্ত্রের নিয়ন্ত্রিত সামাজিক নিরাপত্ত্বা, পন্য ফেটিশের ভোগবাদী বিলাস বেসনে ডুবে থেকে তারা ভুলে যায় এই শান্তি, এই সুখ, এই নিরাপত্ত্বা, এই আলোকময় শিল্পন্নত সভ্যতার যেই ইমারতে তাদের বসবাস সেই ইমারত গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের মতো বহু ঔপনিবেশিক শোষনে শোষিত ভুখন্ডের জনগণের হাড়গোরের উপর, উপনিবেশিত এইসব জনগণের রক্ত চুষে এই পশ্চিমা সভ্যতা দিন দিন গায়ে গতরে ফুলে ফেপে বিরাট হয়েছে। তারা ভুলে যায় শোষিত উপনিবেশিত এইসব ভুখন্ডের জনগণের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে দাঁড়াতে। নিজেদের জাতীয় সম্পদের উপর নিজেদের ন্যাজ্য মালিকানা প্রতিষ্ঠা করার জন্যে যখন আমাদের কর্পোরেট কনকো ফিলিপসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয়, এশিয়া এনার্জির দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে যখন আমাদের বুকের রক্ত দিতে হয়, বিশ্বব্যাংকের মাতুব্বরির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যখন আমাদের সাধরণ জনগণের শিক্ষার অধিকারের জন্যে জেল খাটতে হয়, তখন বাংলাদেশের ৯৯ শতাংশ জনগণের এইসব ন্যাজ্য আন্দোলন সংগ্রামের পক্ষে সংহতি জানাতে দেখিনা আমরা পশ্চিমের ৯৯ শতাংশ জনগণকে। আজকে অর্থনৈতিক মন্দার প্রকোপে যখন পশ্চিমের সাধারণ জনতার ভোগবাদী জীবন যাপন অসম্ভব হয়ে পরেছে, অর্থনৈতিক অসাম্য আর কর্মসংস্থান যখন প্রবল তখনি তারা দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলছে কর্পোরেট আধিপত্ত্ব আর পূজিবাদী ভোগবাদের বিরুদ্ধে।

তারপরও আমরা তাদের সামাজিক ঐক্যের দাবিতে এই ন্যাজ্য আন্দোলনে সংহতি জানাই। আমরা বলতে চাইযে আমাদের উপনিবেশ বিরোধী যেই সংগ্রাম, কর্পোরেট সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আমাদের যেই লড়াই সেই লড়াই এবং তাদের লড়াই একই শত্রুর বিরুদ্ধে। বাঙালির বিউপনেবিশায়নের মুক্তি সংগ্রামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈপ্লবিক কাল ১৯৭১এর মুক্তিযুদ্ধ। সেই মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন রাষ্ট্রযন্ত্র তার ঔপনিবেশিক স্বভাব এবং স্বার্থের কারনেই বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের বিরোধীতা করেছে, অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছে পাকিস্তানী হানাদারদের। কিন্তু ঠিক তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে যখন ৭০ এর প্রতিবাদী মার্কিন তারুন্যের প্রতিনিধীত্বে, জর্জ হ্যারিসনের গিটারে বাংলাদেশের সাধারণ জনতার সংগ্রামের প্রতি সংহতি উঠে এসেছে তখন কর্পোরেট রাষ্ট্রযন্ত্রের স্বার্থ এবং চরিত্রের বাইরেও গোলকায়নের দুনিয়ায় প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের সাধারণ জনতার, ৯৯ শতাংশ জনগণের স্বার্থ ও চরিত্রের ঐক্য আমাদের ধরতে অসুবিধা হয় নাই।

সেই ঐক্যের স্বার্থেই, এবং সেই নৈতিক অবস্থান থেকেই ওয়ালস্ট্রিট দখলকারী সংগ্রামী মার্কিন জনতাকে আমরা বিপ্লবী শুভেচ্ছা জানাই, জানাই তাদের আন্দোলনের প্রতি সংহতি। সেইসাথে আন্দোলনরত মার্কিন জনতার প্রতি আমাদের আহবান থাকবে উপনিবেশ এবং কর্পোরেট আধিপত্ত্বের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ৯৯ শতাংশ জনতার প্রতিনিয়ত সংগ্রামের পাশে দাঁড়ানোর। আমরা আরো বলতে চাইযে আমাদের ৯৯ শতাংশের মালিকানা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম যত প্রবল এবং দুর্বার হবে আপনাদের কর্পোরেট রাষ্ট্রযন্ত্র ততই ব্যর্থ হবে আপনাদের সামাজিক নিরাপত্ত্বা এবং বিলাসী জীবনের নিশ্চয়তা দিতে। আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থে যতই সচেতন হবো ততই ক্ষতিগ্রস্থ হবে আপনাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের আধিপত্ত্ববাদী এবং দখলদারিত্বের অর্থনীতি। আর ততই আপনাদের রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যর্থ হবে আপনাদের অর্থনৈতিক নিরাপত্ত্বা নিশ্চিত করতে।

ভুলে যাবেন না, কর্পোরেট রাষ্ট্রযন্ত্র জনসাধারণের স্বার্থ বিচার করেনা, মুষ্টিমেয়ের ভোগের নিশ্চয়তাই এর পরম ধর্ম। আমাদের আহবান থাকবে আপনাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আমাদের সংগ্রামের পক্ষে আওয়াজ তুলুন, ঠিক যেমনি আমরা আওয়াজ তুলছি আপনাদের সংগ্রামের পক্ষে। শুধুমাত্র এই ঐক্যের আওয়াজের মধ্য দিয়াই আমরা “দুনিয়ার ৯৯ শতাংশ এক হও” স্লোগান তুলতে পারি, স্বপ্ন দেখতে পারি নতুন দুনিয়ার। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।