"কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরিয়া গেছে.। "
১৮৮৬ সালে একবার শিকাগোর রাস্তায় ধাক্কা খেয়েছিল পুঁজিবাদ। সেদিন মেহনতি মানুষের সন্মিলিত আঘাতে পুঁজিবাদী সমাজ বাধ্য হয়েছিল শ্রমিকের শ্রমসীমার অধিকার ফিরিয়ে দিতে। ইতিহাসে ১৮৮৬ সালের এই ঘটনা ভোগবাদি সমাজের বিপরীতে শোষিত মানুষের প্রথম আনুষ্ঠানিক বিজয় হিসেবে ধরা হয়।
কিন্ত এরপরের সময়টুকু পুরোটাই পুঁজিবাদের ।
নানান চড়াই-উত্তরাই, যুদ্ধ বিগ্রহ, রাজনৈতিক উত্থান পতন, যুগান্তকারী আবিস্কার -উদ্ভাবনের মধ্যে দিয়ে পৃথিবী সোয়াশত বছর সামনে এগিয়ে এসেছে। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি সাধারণ মানুষের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি। বরং সাধারণ মানুষের ঘাড়ে আরো শক্তিশালী হয়ে ঝেঁকে বসেছে পুজিঁবাদ। দেশে দেশে পুঁজিবাদ নানা ফর্মূলায় বিস্তার লাভ করেছে এবং নীরবে লম্বা হতে থাকে শোষিত মানুষের মিছিল। কি উন্নত বিশ্ব কি তৃতীয় বিশ্ব, রাষ্ট্রযন্ত্রগুলো ক্রমশ পুঁজিবাদের পরিপূরক হয়ে উঠেছে।
রাজনীতিতে কৌশলে কোনপ্রকার অভিজ্ঞতা ছাড়াই অনুপ্রেবশ ঘটেছে ব্যাবসায়ীদের। রাজনীতিবিদদের পাশকাটিয়ে এলিট ব্যবসায়ী শীল্পপতিরা হয়ে উঠে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মূল ভাগীদার তথা রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারক। বিশ্ব মোড়ল আমেরিকা থেকে শুরু করে ভারত কিংবা আমাদের বাংলাদেশ সবখানেই বড় রাজনৈতিক দলগুলো হয়ে পড়েছে বড় বড় জাতীয় ও বহুজাতিক কোম্পানীর অনুদান নির্ভর। রাষ্ট্রযন্ত্রগুলো গনতন্ত্রের মিথ্যে খোলসে হয়ে উঠছে আনএথিক্যাল এবং পুঁজিবাদের নৈপথ্য পৃষ্টপোষক।
ধর্মগুরুরা চাঁদা ও ডোনেশানের ভাগবাটোয়ারার লোভে পরনিণত হয়েছে পুঁজিবাদের ক্রিড়ানকে।
মিডিয়া কিংবা সংবাদমাধ্যম চলে গেছে পুঁজিবাদের দখলে। পুঁজিপতিরা পত্রিকা আর টিভি মিডিয়ার মালিক সেজে বসেছে। বিক্রি হয়ে গিয়েছে সামজের বিবেক। প্রতিথযশা সাংবাদিক কর্পোরেট বেনিয়ার পক্ষে কলম ধরেছে হামেশাই। এভাবে বড় বড় কোম্পানীগুলো তাদের সীমাহীন দূর্নীতি ও শোষন কে যে কোন কাঠামোয় জায়েজ করার ক্ষমতা অর্জন করে নিয়েছে।
অভিভাবক হীন হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ; নিগৃহিত হতে থাকছে তাদের মৌলিক স্বার্থ। নির্বিঘ্নে শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে রচিত হচ্ছে সাধারণ মানুষকে শোষনের নব নব কলাকৌশল।
বিগত কয়েক দশকে পুঁজিবাদীদের স্বার্থ রক্ষায় বড় বড় রাষ্ট্রের মদদে বিশ্বকে বরণ করে নিতে হয়েছে বেশ কয়েকটি যুদ্ধ। ৯০-এর দশকে ইরাক যুদ্ধ কিংবা সাম্প্রতিক কালের লিবিয়া যুদ্ধ এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এই যুদ্ধের মূল কারণ বহুজাতিক কোম্পানীগুলোর মধ্যপ্রাচ্যের খনিজ সম্পদ লুন্ঠনের প্রয়াস।
সাধারণ মানুষের করের কোটি কোটি টাকা ব্যায় করা হল বহুজাতিক কোম্পানী গুলোর স্বার্থে পরিচালিত যুদ্ধ বিগ্রহে।
David C. Korten পুঁজিবাদের স্বরূল তুলে ধরতে গিয়ে একে সুস্থ দেহে নীরব ঘাতক ক্যান্সার সাথে তুলনা করে বলেন, "The relationship of capitalism to a market economy is that of a cancer to a healthy body."
অপরদিকে খোদ সাধারণ জনগন এক অদ্ভুত ফাঁদে আটকা পড়ে আছে। নানারকম বিজ্ঞাপনী মন্ত্র ও কর্মসূচীর মাধ্যমে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হয়ছে সাধারণ মানুষের চেতনাকে। শোষিতরা নিজেরাই হয়ে উঠেছে পুঁজিবাদের বড় সমর্থক। অবস্থা এমন দাড়িঁয়েছে যে নিজের শেষ সম্বল লুঙ্গিটা বিসর্জন দিয়ে উলংগ হয়ে সবাই দৌড়াচ্ছে পুঁজিবাদি দর্শনের পেছনে।
খায়েস একদিন কোট টাই পড়ে ঘুরে বেড়াবে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পুঁজিবাদ আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশটি জিম্মি হয়ে পড়েছে গুটিকয়েক এলিট ব্যবসায়ীর কাছে। দুই প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামিলীগ ও বিএনপি হয়ে পড়েছে পুঁজিবাদী লুটেরাদের আশ্রয়স্থল। জাতীয় সংসদের ৩০০ জন আইন প্রণেতার অধিকাংশই এলিট ব্যাবসায়ি কিংবা তাদের সাথে কোন না কোনভাবে সম্পর্কযুক্ত।
এই তথাকথিত গণপ্রতিনিধিদের মূল উদ্দশ্য আমজনতার স্বার্থ কে উপেক্ষা করে কর্পোরেট স্বার্থ রক্ষা করা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য বাসস্থানের মত মৌলিক অধিকার নিয়ে চলছে রমরমা ব্যবসা। সীমাহীন মূল্যবৃদ্ধি ও চোখ ধাঁধাঁনো বিজ্ঞাপনের ফাঁদে ফেলে লুটে নেওয়া হচ্ছে সাধারণ জনগনের সামান্য আয়ের সিংহভাগ। দিনে দিনে স্ফীত হচ্ছে গুটিকয়েক মানুষের সম্পদের পাহাড়। সম্পদের অসম বন্টন আর ধনী গরিবের বৈষম্য দিনকে দিন বেড়ে চলছে।
নামকাওয়াস্তে মজুরি ও অনির্ধারিত শ্রমঘন্টার যাঁতাকলে নিরবে নিষ্পেষিত হচ্ছে শ্রমিক শ্রেনী। ঈদে পূজা পার্বণে শ্রমিক রাস্তায় নেমে আসছে তার ন্যায্য বেতন বোনাসের দাবিতে। শ্রমিকের ন্যায্য বেতন বোনাস মেরে দিয়ে পুঁজিপতিরা স্বপরিবারে শপিং করে বেড়াচ্ছে ইউরোপ আমেরিকা কিংবা স্বদেশের সুবিখ্যাত মলে। অথচ যাদের শ্রমে এতকিছু তাদের জীবন মান উন্নয়নে যেন কারো কোন দায়বদ্ধতা নেই। রাষ্ট্রযন্ত্র সেখানে কেবল নীরব দর্শক।
তদুপুরি রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় জন্ম নেয় সালমান এফ রহমানদের মত লুটেরা এবং শেয়ার বাজার নামক ক্যসিনো। যেখানে অতি মুনাফার লোভ দেখিয়ে ডেকে এনে সর্বশান্ত করা হয়ছে ৪০ লক্ষ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী কে। এসব এলিট পুঁজিপতিরা শেয়ারবাজার থেকে লুটে নেয় আনুমানিক ৪০ হাজার কৌটি টাকা যার পুরোটাই খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত আয়ের ক্ষুদ্র সঞ্চয়। অথচ যারা এই সবের মূলহোতা তারা বাহাল তবিয়তে রয়েছে। রাষ্টযন্ত্র স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে সাধারণ মানুষ মরুক তাতে কি কিন্তু এলিট লুটেরাদের কিছু বলা যাবেনা।
এভাবে রাষ্ট্রের ছত্রছায়ায় পুঁজিবাদের শোষনের স্বীকার হচ্ছে বাংলার হত দরিদ্র সাধারণ মানুষ।
এখানেই শেষ নয়। দেশী লুটেরাদের সাথে সাথে আছে বহুজাতিক লুটেরা। নাইকো, কনকো-ফিলিপস, টেলিনরের মত বহুজাতীক কোম্পানী গুলো ছিনিমিনি খেলছে এই দরিদ্র জনগোষ্টির নিজস্ব সম্পদ নিয়ে। রাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন সহযোগীতায় এরা লুটে নিয়ে যাচ্ছে এদেশের তেল, গ্যাসের মত সম্পদ।
কুম্ভ কর্নের ঘুম একদিন ভাঙ্গে, দেরিতে হলেও গন্ডারের গায়ে সুড়সুড়ি লাগে। একইভাবে ব্লগ, ফেইসবুক, টুইটারে তথা সহজলোভ্য ইন্টারনেট যোগাযোগের এই সময়ে এসে অবশেষে জেগে উঠেছে শোষিত জনগোষ্ঠী। এই যেন রূপকথার ফিনিক্স পাখির ঘুরে দাঁড়ানো। পুঁজিবাদের জন্মদাতা খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হয়েছে নিষ্পেষিত মানুষের আন্দোলন। যে আন্দোলনের নাম দেওয়া হয়েছে “ওকোপাই ওয়াল ষ্ট্রীট” ।
নিউ ইয়র্কের ওয়ালস্ট্রীটে রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ স্টক এক্সচেঞ্জ এবং অনেক কর্পোরেট হাউজের হেড অফিস। এছাড়া আমেরিকার এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বড় বড় ব্যংক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অবস্থিত ওই ওয়ালস্ট্রীটে। ওয়ালস্ট্রীট এবং এর আশপাশকে নিয়ে নিউ ইয়র্ক তথা আমেরিকার অর্থনৈতিক বলয় রচিত।
১৭ সেপ্টেম্বর থেকে লির্বাটি প্লাজা পার্কে অবস্থান নিয়েছে আন্দোলনকারীরা। পার্কের এক কোণায় বসানো হয়েছে মিডিয়া কর্ণার।
ইন্টারনেট,লেপটপ, কম্পিউটার,ক্যামেরা,ওয়ারলেসের মাধ্যমে চলছে প্রচারণা। বিক্ষোভকারীরা শ্লোগান দিচ্ছে "সারাদিন , সারা সপ্তাহ ওয়াল স্ট্রিট দখলে রাখ। " তারা আরো শ্লোগান দেয় "আমরা ৯৯ শতাংশ। " অনেকে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিয়ে বলেছে-"আমরা আমাদের দেশকে জনগণের কাছে ফিরিয়ে দিতে এসেছি। "
দাবানলের মতো ওয়ালস্ট্রীট মুভমেন্ট ছড়িয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র হয়ে বিশ্বব্যাপী সারা দুনিয়ার নিস্পেষিত মানুষ আজ পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে একাট্টা।
আমেরিকার প্রধান প্রধান শহর এবং ছয়শ'রও বেশী কমিউনিটিতে চলছে এই মুভমেন্ট। কানাডায়, ইউরোপে, সিডনী, টোকিও সিংগাপুর, ম্যানিলায়, রোম, নেদারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, স্পেনে ছড়িয়ে পড়েছে নাগরিকের প্রতিবাদ ।
নড়ে চড়ে বসেছে পুঁজিপতিরা। আন্দোলন থামাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। মার্কিন পুলিশ আন্দোলনকারীদের সাথে অতি মাত্রায় সহিংস হয়ে উঠেছে।
কিন্তু কিছুতেই দমানো যাচ্ছেনা আন্দোলন কারীদের।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কি করছি? আমাদের কি সময় হয়নি ঘুরে দাঁড়াবার। আমাদের নিষ্পেষিত জনগন কবে জেগে উঠবে? কে আওয়ামিলীগ, কে বিএনপি" কে ডান কে বাম এসব ভূলে কবে ১৬ কৌটি মানুষ একসাথে আঘাত হানবে তথাকথিত দরবেশ মুনি ঋসিদের দূর্গে। নাইকো, কনকো-ফিলিপস, টেলিনরের মত বহুজাতিক বর্গীর হাত থেকে আমাদের সম্পদ রক্ষার উৎকৃষ্ট সময় কি এটা নয়? নাগরিক হিসেবে বিশ্বে আমরাই সবচেয়ে বেশী শোষনের শিকার। তাহলে কেন বিশ্ব আন্দোলনের অগ্নিস্পর্শ থেকে দুরে থাকবে পুঁজিবাদের চরম শিকার ছোট্ট বাংলাদেশ?
কবে শুরু হবে " ওকোপাই মতিঝিল"?
আমার বিশ্বাস সোনার বাংলাদেশ ১৬ কৌটি মানুষের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার অগ্নি শপথে আজ না হোক কাল ঠিকই জেগে উঠবে এদেশের উজ্জিবীত তারুণ্য এবং সেই সাথে প্রতিটি নাগরিক।
জয় হোক মেহনতি মানুষের।
জয় হোক মানবতার ।
বাংলাদেশ হোক ১৬ কৌটি মানুষের।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।