আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

খোদা রয় আদমে মিশে

হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোনজন, কান্ডারি বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা'র ঈশ্বর একটা কনসেপ্ট। এই কনসেপ্টটা আলোচনার দাবিদার, এমনকি বর্তমান নিরীশ্বরবাদের জয়জয়কারের যুগেও ঈশ্বর কনসেপ্টটা খুবি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার দাবি রাখে। ঈশ্বর কনসেপ্টএর নানান বিবর্তনের ইতিহাস ঘেটেঘুটে দেখেলে বুঝা যায়যে যুগে যুগে স্থান ভেদে মানুষের নিজস্ব ক্ষমতা আকাঙ্ক্ষা, বিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা এবং 'আদর্শ'এর আকাঙ্ক্ষার সামষ্টিক পরিণতি হলেন ঈশ্বর। অলৌকিক ঈশ্বর তাই না থাকলেও লৌকিক মানুষের জীবনবোধে ঈশ্বর হয়ে ওঠেন মূর্ত। আধুনিক যুগে এসে নতুন জ্ঞান বিজ্ঞাপনের পালে হাওয়া লেগে ইব্রাহিমী ঈশ্বরের কনসেপ্ট যখন একেবারে মারাই গেলো তখন মানুষের ক্ষমতা, বিবর্তন, এবং আদর্শ আকাঙ্ক্ষার মূর্ত ঈশ্বরকে খুঁজতে গিয়া আধুনিক যুগের বড় বড় বেশ কয়েকজন দার্শনিক যেমন পাশ্চাত্যের নিৎসে, মার্ক্স এবং প্রাচ্যের লালন প্রস্তাবনা দিলেন মানুষের মাঝেই ঈশ্বরের সন্ধান করতে।

অলৌকিক ইব্রাহিমী ঈশ্বরের কনসেপ্টকে বাদ দিয়া মানুষের ভজন করার প্রস্তাবটাই ভিন্ন ভিন্ন ভাবে তারা দিলেন। বাংলাদেশে অবশ্য মানুষের মাঝেই ঈশ্বরের অধিষ্ঠানের এই তত্ত্ব অনেক আগে থেইকাই দর্শনে বেশ দরকারি আলোচ্য বিষয় ছিল। আমি মনে করিনা যে মোহাম্মদ ঈশ্বরের নিজের মতো যেই বর্ণনা দিছেন তা ভুল দিছেন, তার সময়ে তিনি যা বুঝছেন সেই আলোকে সঠিক দিছেন। যুগ পাল্টাইছে, এখন আমরা জানিযে সৃষ্টি করার, জগৎ পর্যবেক্ষণ করার, প্রকৃতিকে জানার মধ্য দিয়ে নিজেরে জানার যেইসব ঐশ্বরিক ক্ষমতার কথা আমরা জানি তা মানুষেরই আছে। যা কিছু 'মানবিক' তার পরবর্তি পর্যায়ে উত্তরণের আকাঙ্খাই 'ঐশ্বরিক'।

নিজ সময় এবং বুঝ অনুযায়ী মানবতার চুড়ান্ত, সর্বোচ্চ, শুদ্ধতম 'ভালো'র মাঝে তাই ঈশ্বরের আবাস। এই কারনেই বোধহয় মোহাম্মদের সময়ে ঈশ্বর যেইখানে থাকেন ১৪০০ বছর পরের তার কোন উম্মতের ঈশ্বর আর সেইখানে থাকেনা। মরুভূমিতে নিজেদের এক টুকরা ভূমি আর সম্মানের জন্যে ঘুরে বেরানো যাযাবরদের ঈশ্বর তাই হয়ে ওঠেন মাটির নিচে নহর বওয়া স্বর্গতূল্য ভুখন্ডের শত শত বৎসরের স্বপ্নময়, আর সেই স্বপ্নপূরণে আবির্ভুত হয়ে ওঠেন নির্মম নিষ্ঠুর পরদেশ লুন্ঠনকারী বীরের যুদ্ধদেবতা, আবার এই ঈশ্বরই কোন এক ফারাওয়ের বিরুদ্ধে মুক্তিকামী জনতার 'একতা'য় মূর্ত ছিলেন কয়দিন মাত্র আগেই। ধানের দেশে সেই ঈশ্বরই আবার প্রেমের কথা বলে, সমতা আর মুক্তির কথা বলে। মানুষের মাঝে অথবা মানুষের মাথায় হাজির হওয়া অথবা ধরা দেওয়া যেইসব অজানা, অধরা জিনিস আমাদের ভাষার মধ্য দিয়া প্রকাশ হয়, অথবা 'আদর্শ' সম্বন্ধে নানান ধারণা আমাদের মাথায় হাজির হলে কোন এক ধর্ষিতা মেয়ের মতো নির্যাতিতাদের পাশে দাঁড়াতে গিয়া আমরা যখন সেই 'আদর্শ' কেন্দ্রিক নৈতিকতার কাছে মাথা নোয়াই তখন আমাদের কাছে মনে হতে পারে যেই এই আদর্শ, এই অজানা অধরা, জ্ঞান থেকে ভাষা হয়ে ওঠা এই কালাম, ওহী এইসব বুঝি অলৌকিক কোন অজানা জগৎ থেকে আসে।

আগের লোকজন তেমনি ভাবতো, আর তাই প্রাচীন কালে লিখিত বেশিরভাগ কিতাবই পেতো ধর্ম পুস্তকের মর্যাদা, ঐশ্বরিক প্রতিনিধিত্ব। দর্শন থেকে শুরু করে আইনশাস্ত্র, লোকগাথা থেকে শুরু করে আদীরস, ঐশী কিতাবের তালিকা খুলে বসলে সবি পাওয়া যাবে। সেই হিসাবে 'কুরআন' ঐশী কিতাব বটে, তবে সাথে সাথে 'অরিজিন অব স্পিসিস'ও ঐশী কিতাব। এইটা যে বুঝেনা সে ধর্ম বুঝেনা, সে মানুষ বুঝেনা, এবং তার ঈশ্বর বোঝার ক্ষমতা অবশ্যই নাই। মোহাম্মদ যদি ওহী পাইয়া থাকেন, তো ডারউইনও ওহী পাইছে্ন।

মোহাম্মদে ঈশ্বর থাকলে, ডারউইনেও ঈশ্বর আছে, আমার মাঝেও ঈশ্বর আছে। ঈশ্বরের ডাকে কে সারা দেয় সেইটা চারিদিকে তাকাইলেই বুঝা যায়। মুসলমান পরিচয় নিয়া যে খুন, ধর্ষণ, দুর্নীতি, চাপাবাজি চালায়, গনমানুষের কল্যাণে যার মন নাই ঈশ্বরের ডাকে সে সারা দিছে এই কথা মানা সম্ভব না। আগের কালের লোকে হয়তো মনে করতো যে অথবা নিজেদের জ্ঞান অনুযায়ী বুঝার জন্যে ভাবতো যে ঈশ্বর অনেক উপর থেইকা ডাকেন, ফেরেশতা পাঠায়া ডাকেন, কিন্তু কোন মানুষরে হাজির নাজির না মাইনা কিন্তু ঈশ্বর গণমানুষের সাথে কথা বলতে পারে নাই, তাদের দ্বিনের পথে ডাকতে পারে নাই। এখন আমরা জানি যে নৈতিকতা, আদর্শ, আর জ্ঞান-ক্ষমতা অর্জনের যেই ডাক সেই ডাক কেউ উপর থেইকা দেয় না, ভেতর থেইকা দেয়।

ঈশ্বর সে তো সাত আসমানের উপরে বইসা নাই, আমার ভিতরেই তার আবাস। যুগোপযোগী নৈতিকতা, আদর্শ আর প্রগতির ডাকে যে সারা দেয় সেই ঈশ্বরের ডাকে সারা দেয়, ঈশ্বরের সাথে তৈরি হয় তার যোগাযোগ সম্বন্ধ, ঈশ্বর তার মধ্য দিয়াই মানব সমাজে হাজিরা দেন। সুফিদের মইধ্যে এই নিয়া একটা কাহিনী প্রচলিত আছে, কাহিনীটা খুব সম্ভবত রূপক শিক্ষা। একদিন নাকি মুহাম্মদ জিবরাইলরে জিগাইলো যে, ওহে জিবরাইল, তুমি যে আমার কাছে ওহী নিয়া আসো, কার কাছ থেইকা আনো? তারে কোনদিন দেখছো? যাও গিয়া দেইখা আসো। জিবরাইল ৭০০০০ পর্দা পাড়ি দিয়া গিয়া দেখলো যে মোহাম্মদ বইসা বইসা কালাম আবৃতি করতাছে।

জিবরাইল তখন ভাবে, কার‍ কালাম আমি কার কাছে নিয়া যাই? কাহিনীর মূল শিক্ষা হইল যে আমাগো কালাম, আমাগো জ্ঞানই আমাগো কাছে ধরা দেয়, মাঝখানে জিবরাইল হইল সহজবুদ্ধির লজিক মাত্র। বহুকিছু সম্বন্ধে যেমন আমাদের জ্ঞান দিন দিন পরিস্কার হয়, ঈশ্বর সম্পর্কেও হয়, হবে। গাল গপ্প, কাহিনী পড়ে যারা রাজামার্কা ঈশ্বর চিনে, ব্যক্তিগত লোভ লালসায় যারা অন্ধ, মানবতার কল্যানে যাদের মন নাই, তারাই প্রাচীন ঐশ্বরিক কনসেপ্টে ঘুমায়া থাইকা ঈশ্বর বিমুখ জীবন যাপন করে, প্রগতি এবং মানবতাবিরোধী কাজ কাম করে। বাউলদের মইধ্যে একটা দারুন জিনিস প্রচলিত আছে, বিশেষ কইরা লালনের দর্শনে। এমতে দাবি করা হয় যে মানুষের আলাদা ব্যক্তিক অস্তিত্ব আসলে কোন ধর্তব্যের বিষয় না।

এই কারনে জন্ম মৃত্যু এই দুইয়ের কোন তাত্ত্বিক আলোচনা বাউল মতে নাই। মানুষের এই শরীর হইল একটা বাহন মাত্র, এই বাহনে পরমাত্ত্বা বা ঈশ্বর পার হয়া যান। এই পরশি বা পরমাত্ত্বা আমার দেহেই আছে, মূর্খতার কারনে এরে আমি দেখতে পারিনা, চিনতে পারিনা, ধরতে পারিনা। লালন বিবর্তনবাদ বুঝতেন না, ডারউইন জানতেন না, বায়োলজিকাল ব্যাখ্যায় এই থিওরির মূল্য বুঝা তার পক্ষে সম্ভব ছিলনা, তিনি দার্শনিক কায়দায় চিন্তা করছেন। এখন দেখেন, ডারউইন আর ডকিন্সের বরাতে আমরা জানি যে আমাগো এই শরীর হইল জিন আর মিমএর বাহন মাত্র।

এককোষি একটা জীবের ক্রম বিবর্তনের এবং বাইচা থাকার, টিকা থাকার, জ্ঞানার্জন কইরা অগ্রসর হওয়ার বাহন আমাগো শরীর। সেই এককোষী জীবও কি অন্যকোন বিবর্তনের ফসল, অন্যকোন ক্রমিক সচেতনতার প্রয়াসেই কি তার আবির্ভাব? আমি যখন চিন্তা করি তখন কি সেই জীব নিজেই চিন্তা করেনা? অথবা আমি যখন চিন্তা করি তখন কি এই জগৎ সংসার নিজেই চিন্তা করেনা? আমি তো এই জগৎ সংসারেরই অংশ মাত্র। বাহন হিসাবে এই সমগ্রতা আমরা ধরতে পারিনা সবসময়, এই ক্রম প্রগতির লক্ষ্য কি, উদ্দেশ্য কি আমরা জানিনা। তার চেয়েও বড় কথা হইল যে আমরা বেশিরভাগ সময় এই সমগ্রতারে ঠিক মতো উপলদ্ধিও করতে পারিনা। প্রগতির ডাকে সারা দিলেই ঈশ্বরের ডাকে সারা দেয়া হয়।

যুগোপযোগী আদর্শ, নৈতিকতা আর প্রগতির পথে লড়াই করলেই ঈশ্বরের জিহাদ হয়। মানুষরে ভজন করলেই ঈশ্বরের ভজন হয়। মানুষের বাইরে কোন ঈশ্বর নাই। মানুষ ভজন করলে আর প্রগতির পক্ষে থাকলেই মূর্খতার অন্ধকার কাটে, মানুষের সাথে মানুষের, মানুষের সাথে পশু পক্ষির, মানুষের সাথে প্রকৃতির, মানুষের সাথে প্রকৃতিপূর্ব অধরার সম্পর্ক তৈরি হয়, মানুষ সমগ্রতার মাঝে বিলীন হয়, সত্যের সাথে একাকার হয়। আমি তাই ভাবি এবং বুঝি যে মানুষের বাইরে কোন ঈশ্বর নাই।

এই কারনে সমসাময়িক এবং প্রগতির পক্ষে ভালো মন্দের বুঝ জ্ঞান নিয়া ঐশ্বরিক দায়িত্ব পালনে আমি উৎসাহী এবং অন্যরেও উৎসাহ দেই। এতে আমার এবং অপরের এবং সকলের মুক্তি সম্ভব বলে মনে করি। যা কিছু অন্যায় মনে হয়, যা কিছু অনৈতিক মনে হয় তারে জাহান্নামে পাঠানির দায়িত্ব আমার, আপনের, সকলের। উপর থেইকা কোন ঈশ্বর নাইমা আইসা তা কইরা দিবেনা। আমার হাত দিয়াই ঈশ্বরের লড়াই করতে হবে, সৃষ্টি করতে হবে।

লালনের ভাষায় কইতে গেলে কইতে হয় যে, মানুষ তত্ত্ব জানলে আর অন্য তত্ত্বের দরকার নাই। মানুষ ধর্ম বুঝলে আর অন্য ধর্মেরও দরকার নাই। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।