আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মৌলবাদীরা যেভাবে প্রজন্মের সঙ্গে প্রতারণা করছে

মৌলবাদীরা যেভাবে প্রজন্মের সঙ্গে প্রতারণা করছে ফকির ইলিয়াস ======================================= বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবার যখন জাতিসংঘ অধিবেশনে ভাষণ দিতে এসেছিলেন তখন নানা কারণেই নিউইয়র্ক নগরী ছিল সরগরম। আওয়ামী লীগ ও তার সমমনা সমর্থকরা শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানাতে ছিলেন সোচ্চার। নানা বর্ণাঢ্য আয়োজন করেছিলেন তারা। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর সফরে প্রতিবাদ জানাতে বিএনপিও ছিল তৎপর। তারাও বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ করেছে।

সবচেয়ে জঘন্য সমাবেশটি করেছে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত কিছু মৌলবাদী গ্রুপ। এসব গ্রুপ বাংলাদেশের কারাগারে কিছু মৌলবাদী জঙ্গিবাদী নেতার পক্ষে সেস্নাগান দিয়েছে। অবাক করা কথা হচ্ছে, এই মৌলবাদের আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশে বেশ কিছু শিশু-কিশোর-কিশোরীকেও তারা নিয়ে এসেছিল। ছেলেদের মাথায় টুপি আর মেয়েরা হিজাব পরা। তাদের হাতে ছিল বর্তমানে যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচারাধীন, নিজামী-মুজাহিদ, সাঈদী, সাকা চৌসহ অনেকের ছবিসহ ফেস্টুন-ব্যানার।

এসব শিশু-কিশোরের শ্লোগান ছিল- 'এদের মুক্তি চাই। ' বিষয়টি আমাকে খুবই ভাবিয়েছে। এসব শিশু-কিশোর কী জানে, তারা কার ছবি হাতে নিয়ে সমাবেশে দাঁড়িয়েছে? না, সত্য কথা জানে না। তারা জানে না, নিজামী '৭১ সালে আলবদর কমান্ডার ছিল। তারা জানে না, মুজাহিদের বিরুদ্ধে জঘন্য অপকর্মের জন্যই মামলা হয়েছে এবং তা এখন বিচারাধীন আছে।

এসব শিশু-কিশোরের পিতা-মাতারা কেমন নির্লজ্জ মিথ্যাচার করছেন তাদের সন্তানদের সঙ্গে। অভিভাবকরা বোঝাতে সমর্থ হয়েছেন, এরা ধর্মীয় নেতা। এদের গ্রেফতার করা মানে ধর্মের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া। আমরা জানি বাংলাদেশে বেশ কিছু বনেদি মৌলবাদী রয়েছে। এরা নিজেরা ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মকর্মের ধার না ধারলেও ধর্মের নামে রাজনৈতিক ব্যবসা করছে।

ফায়দা নিচ্ছে। বিদেশেও এর অনুসারীরা বেশ সক্রিয়। তারা মওদুদীবাদ প্রতিষ্ঠার নামে উপমহাদেশের হাক্কানি আলেম সমাজের সব নিষেধাজ্ঞাকে অবজ্ঞা করছে। কারণ এসব আলেম সমাজ অনেক আগেই জানিয়েছেন 'মওদুদীবাদ' শুধু ফেৎনা সৃষ্টিই করেনি, ইসলাম ধর্মের অনেক অনুশাসন এবং যাপন প্রণালীকে বিকৃত করেছে। যারা তাদের প্রজন্মের হাতে একজন ঘাতক সরদার, একজন ধর্ষণকারীর মদতদাতার ছবি তুলে দিচ্ছে, তারা আসলে কী মানসিকতা লালন করছে? না, রাষ্ট্রস্বার্থ, সংস্কৃতির স্বার্থবাদের কাছে বড় কোন বিষয় নয়।

মৌলবাদী কিংবা জঙ্গিবাদীদের এই যে একরোখা অবস্থান, তা সভ্য মানবসমাজের জন্য কোনমতেই কল্যাণকর নয়। আমাদের মনে আছে, স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী নামের একজন ওয়াজকারীর উত্থানের কথা। তিনি মূলত গোটা দেশে 'তাফসির মাহফিল'-এর প্রবক্তা হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। সুকণ্ঠের অধিকারী এই বক্তা নানাভাবে মানুষের মন জয় করতে ছিলেন সচেষ্ট। পরবর্তী সময়ে তার রাজনৈতিক পরিচয় বের হতে শুরু করে।

তিনি হয়ে ওঠেন জামায়াতের নায়েবে আমির। এই সেই সাঈদী। যিনি 'নারী নেতৃত্ব'কে হারাম ঘোষণা করে গোটা বাংলাদেশ চষে বেড়িয়েছিলেন। আজ তার বিরুদ্ধে জঘন্য অপরাধগুলো প্রমাণিত হতে চলেছে। দেশের নন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদ, মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, আহসান হাবীবের পিতা ফয়জুর রহমান আহমেদের হত্যার পেছনে এই সাঈদীর হাত ছিল, অভিযোগও ছিল।

সেই একাত্তর সাল থেকেই। সাঈদী বাংলাদেশি এবং দেশের বাইরে অনেক তরুণ-তরুণীর ব্রেনওয়াশ করেছেন। ইসলামী জিহাদের নামে ডাক দিয়ে দেশে জঙ্গিবাদের ইন্ধন জুগিয়েছেন। এসব প্রমাণ তার নসিহতের রেকর্ডগুলো, ক্যাসেট-ডিভিডিগুলো দেখলেই পাওয়া যাবে। এসব সত্যকে উপেক্ষা করে দেশে-বিদেশে 'সাঈদী মুক্তি পরিষদ' গঠন করা হয়েছে।

জাহেলিয়াতকে হালাল করার কী অভিনব প্রচেষ্টা! আমরা দেখছি, যুক্তরাষ্ট্রে একটি মহল, এখন বাংলাদেশে মানবতা লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে নানাভাবে মহড়ার আয়োজন করছে। এরা 'গোলটেবিল' বৈঠকের নামে মূলত দেশে মৌলবাদী, জঙ্গিবাদীদের বাঁচানোর জন্য ওদের পক্ষে কথা বলছে। অথচ বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় বাংলাদেশে যখন পূর্ণিমা রানীর ওপর হায়েনারা হামলে পড়েছিল, তখন এসব 'ফাজেল', 'কামেল'দের আমরা কোথাও সামান্য প্রতিবাদ করতে দেখিনি। যখন দেশজুড়ে বোমা হামলা হয়, যখন ২১ আগস্টের নগ্ন গ্রেনেড হামলা হয়, যখন শাহ এএমএস কিবরিয়া, আহসান উল্লাহ মাস্টারের মতো বরেণ্য রাজনীতিকদের হত্যা করা হয় তখন এসব 'তস্কর মানবতাবাদী'রা ছিলেন সম্পূর্ণ নীরব। নিউইয়র্ক তথা যুক্তরাষ্ট্রের এসব স্বঘোষিত 'থিংক ট্যাংক'রা এখন তৎপর হয়েছে মূলত যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য।

তারা তাদের কর্মকা-ের মাধ্যমে প্রমাণ করছে, একাত্তরে নরহত্যা, ধর্ষণ, অগি্নসংযোগ, লুটপাটকে তারা এখনো সমর্থন করছে। আমাদের বিজয়ের চলি্লশ বছর পরও একটি সুবিধাবাদী, মৌলবাদী মহলের এমন মানসিকতা গোটা জাতির জন্যই চরম দুর্ভাগ্যজনক। অন্যদিকে এসব সুবিধাবাদী নিজেরা ব্যস্ত, দেশে-বিদেশে তাদের লুণ্ঠিত অর্থ-সম্পত্তি সামলাবার জন্য। এ প্রসঙ্গে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত 'সাপ্তাহিক ঠিকানা' পত্রিকার একটি রিপোর্ট উল্লেখ করা যায়। ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১১ তারিখে প্রকাশিত ঠিকানা লিখেছে-'বিএনপি কেন্দ্রীয় নেতাদের ঘন ঘন আমেরিকা সফর : দলীয় নেতাকর্মীদের জন্য গোদের উপর বিষফোড়া'।

প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যাচ্ছে, বিএনপির নেতাদের অনেকেই এখন ঘন ঘন আমেরিকামুখী। এখানে এসে তারা কী করছেন, কেন এত বেশি সফরে আসছেন- এ প্রশ্নের জবাবে সংশ্লিষ্ট একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, এ নেতাদের ধন-সম্পত্তি, বিত্ত, বিভিন্ন নামে যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে। রয়েছে তাদের পুত্র-কন্যা, ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনদেরও। মূলত তারা পাচার করা অর্থ দেখভাল করার জন্যই এখন আমেরিকামুখী। চারদলীয় জোট সরকারের সময় লুটপাট হয়েছিল, এখন সেসব অর্থ-বিত্ত বিভিন্ন সেক্টরে সামলাচ্ছেন তারা।

মৌলবাদী এবং তাদের দোসরা এই প্রজন্মকে নানাভাবে বিভ্রান্ত করছে। তারা ধর্মের দোহাই দিয়ে কলহ বাড়াচ্ছে। হাজার বছরের বাংলা সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, কৃষ্টি এখন হুমকির মুখে। তাদের হুমকি-ধমকি রাষ্ট্র শাসনকে বিচলিত করছে। ত্রিশ লাখ জঙ্গির আত্মপ্রত্যয় তাদের কাছে 'মূল্যহীন' বলেই, এই দেশকে তারা ব্যবহার করতে চাইছে তাসের তুরুপ হিসেবে।

আমি প্রজন্মকে এদের ব্যাপারে সতর্ক থাকার বিনীত অনুরোধ করি। শুধু সত্য ইতিহাসের অন্বেষণই নতুন প্রজন্মকে আলোর দিশা দিতে পারে। আর সেজন্য আমাদের মহান মুক্তিযুুদ্ধের ইতিহাস হতে পারে তরুণ-তরুণীদের আইকন। দেশে সার্বজনীন দুর্গা উৎসব চলছে। পুজো, মানুষের অন্তরাত্মাকে পরিশুদ্ধ করে।

অর্চনায় ডুবে যাওয়ার মাঝে মানুষ খুঁজে শান্তি ও শক্তির ঐতিহ্য। পুজোর আলোয় সব আঁধার সরে যাক। মাটি ও মানুষ ভাসুক আনন্দে। সব অসুর পরাজিত হোক। সবাইকে পুজোর শারদীয় শুভেচ্ছা।

আসুন, আমরা মানবতার জয়গানে নিজেদের সমৃদ্ধ করি। নিউইয়র্ক, ৫ অক্টোবর ২০১১ ------------------------------------------------------------------------------ দৈনিক সংবাদ / ঢাকা / ৭ অক্টোবর ২০১১ শুক্রবার ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।