গ্রাম-প্রকৃতি-সবুজ-সারল্য যেখানে মিলেমিশে একাকার, সেখানে ফিরে যেতে মন চায় বার বার। গ্রামের নাম ডাসারা। মাদারীপুর জেলার কালকিনি উপজেলা সদর থেকে আট কিলোমিটার দূরের এই গ্রামে এসে শেষ হয়েছে একটি জেলা সড়ক। ৩০ ফুট প্রশস্ত এই সড়কের নির্মাণকাজ এগোচ্ছে দ্রুতগতিতে। মাটি ভরাট, ইট-বালু বিছানোসহ ৮০ ভাগ কাজ ইতিমধ্যেই শেষ হয়েছে।
বাকি শুধু পিচ ঢালা।
একটি দৃষ্টিনন্দন বাড়ির সামনে গিয়ে হঠাৎ শেষ হয়ে গেছে রাস্তাটি। বাড়িটির দুই পাশে দুটি কলেজ। সামনে একটি বড় পুকুর। আছে কিছুটা খোলা মাঠ।
কলেজ দুটি করেছেন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন। একটি মন্ত্রীর বাবার নামে ডি কে সৈয়দ আতাহার আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজ, অপরটি প্রধানমন্ত্রীর নামে—শেখ হাসিনা একাডেমী অ্যান্ড উইমেনস কলেজ।
যোগাযোগমন্ত্রীর বাড়ির কিছুটা সামনে এগিয়ে প্রশস্ত সড়কটি শেষ হয়েছে। এ বাড়িতে তিনি এখনো ওঠেননি, প্রস্তুতি চলছে। রাস্তাটির উল্টো দিকে মন্ত্রীর পৈতৃক বাড়ি।
মাদারীপুর-আগৈলঝাড়া সড়ক উন্নয়ন ও প্রশস্তকরণ প্রকল্পের অধীনে এই রাস্তাটি হচ্ছে। ২০০৯ সালে নেওয়া ৩১ কোটি ৪৭ লাখ টাকার এ প্রকল্পে আগে খরচ হয়েছিল তিন কোটি ৩৯ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১২ কোটি টাকা। এই টাকা খরচ হচ্ছে ১৯ কিলোমিটার রাস্তা প্রশস্তকরণে। এর মধ্যে ইটেরপুল এলাকা থেকে ঘোষেরহাট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার এবং ঘোষেরহাট বাজার থেকে কাঁঠালতলা বাজার হয়ে দক্ষিণ ডাসার গ্রামে মন্ত্রীর বাড়ি পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার।
এরপর বাকি রাস্তা সরু।
যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেছেন, রাস্তাটি ওখানেই শেষ নয়, এখানে মাদারীপুর জেলা অংশের কাজ শেষ হবে। এর উল্টো দিক থেকে আরেকটি রাস্তা আসবে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া থেকে। ওই রাস্তার কাজও শিগগিরই শুরু হবে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, যোগাযোগমন্ত্রীর বাড়ির অংশে সড়ক নির্মাণের ধুম চলছে।
স্থানীয় লোকজন জানান, এ রাস্তা দিয়ে দু-একটি ভ্যান ছাড়া তেমন কোনো যানবাহন চলাচল করে না। পায়ে হাঁটা পথ হিসেবেই এটি ব্যবহূত হয়ে আসছে।
জানতে চাইলে মাদারীপুর সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান বলেন, শুধু মন্ত্রীর বাড়ি বলেই ওই পর্যন্ত রাস্তা হচ্ছে, এটা ঠিক নয়, ওখানে দুটি কলেজও আছে। সে কারণেই সওজের রাস্তাটি ওই পর্যন্ত করা হয়েছে। ভবিষ্যতে তা আরও বাড়ানো হবে।
তিনি আরও জানান, এখানে এলজিইডির একটি রাস্তা ছিল। কিন্তু সওজ এ রাস্তাটি তাদের কাছ থেকে নিয়ে বড় করছে। আর অনেক স্থানে সড়কটি সোজা করার জন্য নতুন করে রাস্তা করতে হয়েছে। তিনি জানান, মন্ত্রীর বাড়ির জন্য পাঁচ কিলোমিটার একটি সংযোগ সড়ক করা হচ্ছে।
এ সড়কে তৈরি করা হয়েছে একাধিক পুল-কালভার্ট।
মন্ত্রীর বাড়ির সামনে একটি বড় সেতুও নির্মাণ করেছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর। পাশে এলজিইডির করা আগের সেতুটিও আছে।
যোগাযোগসচিব মোজাম্মেল হক খান প্রথম আলোকে বলেন, ওখানে দুটি কলেজ রয়েছে। এ রাস্তার কারণে এলাকাবাসী উপকৃত হবেন।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, রাস্তা প্রশস্তকরণের জন্য স্থানীয় এলাকাবাসীর জমি অধিগ্রহণের কথা শোনা গেলেও কেউ ক্ষতিপূরণ পাননি।
ক্ষতিপূরণের টাকা না দিয়েই রাস্তার মাটি ভরাট করে ফেলায় জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ক্ষতিগ্রস্ত বলেন, ‘জমি গেছে যাক, মন্ত্রীর বিরুদ্ধে কথা কইয়া ঝামেলায় পড়তে চাই না। তবে আগের রাস্তাই যথেষ্ট ছিল। এত বড় রাস্তার দরকার ছিল না গ্রামে। জায়গা নষ্ট হইছে আমাগো, লাভ হইছে মন্ত্রীর।
এহন আমাগো ক্ষতিপূরণ দিয়া দেউক। ’
স্থানীয় মাইজপাড়া গ্রামের আবদুর রহমান বলেন, ‘সারা উপজেলায় ভালো রাস্তা নেই। অথচ যে রাস্তায় গাড়ি তো দূরের কথা, নিয়মিত ভ্যানও চলে না, সেখানে মন্ত্রীর বাড়ি যাওয়ার জন্য গরিবের জমি নষ্ট করে এত বড় রাস্তা করার কী দরকার!’
তবে যোগাযোগসচিব প্রথম আলোকে বলেন, জমি অধিগ্রহণ নিয়ে একটু জটিলতা ছিল। এখন তা কেটে গেছে। শিগগিরই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা ক্ষতিপূরণের টাকা পাবেন।
সরেজমিনে খোঁজখবর করে জানা যায়, যোগাযোগমন্ত্রী ২০০৬ সালের শেষদিকে তাঁর গ্রামে নতুন বাড়ি নির্মাণ শুরু করেন। ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারি হলে নির্মাণকাজ থেমে যায়। বর্তমান সরকারের মন্ত্রী হওয়ার পর ২০০৯ সালে আবার নির্মাণকাজ শুরু হয়।
এ সময়ই ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে সহজে যেতে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল এলজিইডির এ এলাকায় থাকা রাস্তাটিকে নিজ মন্ত্রণালয়ের অধীন সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের আওতায় আনেন মন্ত্রী। ২০১০ সালে এলজিইডি রাস্তাটি হস্তান্তর করে।
এলজিইডির গ্রামীণ রাস্তাটি অনেক স্থানে সোজা করতে গিয়ে এখন জায়গায় জায়গায় নতুন রাস্তা করতে হয়েছে। ভরাট করতে হয়েছে একাধিক পুকুর।
রাস্তার কাজের এক অংশের ঠিকাদার লেনিন ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, রাস্তার বাঁক কমাতে কয়েকটি পুকুর ভরাট করতে হয়েছে। এ জন্য প্রকল্পের খরচ বাড়ছে।
এ রাস্তা নির্মাণের জন্য ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে ১১ কোটি ৮৭ লাখ ২০ হাজার ছয় টাকার দরপত্র আহ্বান করা হয়।
জেবি কনস্ট্রাকশন ও এসিএস লিমিটেড নামের দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ২০১০ সালের ২ মার্চ আট কোটি ৭৮ লাখ ৬৭ হাজার ৪৭৪ টাকার কার্যাদেশ দেওয়া হয়। এর মধ্যে জেবি চার কোটি ৮৮ লাখ ৯৫ হাজার ৮৯৭ টাকা ও এসিএস তিন কোটি ৮৯ লাখ ৭১ হাজার ৫৭৭ টাকার কাজ পায়।
৩০ ফুট প্রশস্ত এ রাস্তাটির ২৪ ফুট পাকা। আর দুই পাশে ছয় ফুট কাঁচা দেখানো হয়েছে। ঢালসহ গড়ে ৫০ ফুট পরিমাণ জায়গা ব্যবহার করা হয়েছে।
উপসহকারী প্রকৌশলী (এসও) মাসুম বিল্লাহ জানান, ইটেরপুল থেকে ঘোষেরহাট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার ও ঘোষেরহাট থেকে দক্ষিণ ডাসার পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার সংযোগ সড়কের কাজ সওজের। ঘোষেরহাট থেকে আগৈলঝাড়া পর্যন্ত রাস্তার কাজ করবে বরিশাল সড়ক বিভাগ।
মন্ত্রীর বাড়িতে যাওয়ার সড়ক নির্মাণের এই প্রকল্পটি দ্রুতগতিতে এগোলেও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) অন্যান্য সড়কের ভাগ্য অবশ্য এত ভালো না। যোগাযোগমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণাধীন সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের আওতায় রয়েছে ১৪৭টি প্রকল্প। এর মধ্যে বেশির ভাগই অল্প অর্থ বরাদ্দ পাওয়ায় ধীরগতিতে বাস্তবায়ন হচ্ছে।
এর মধ্যে ১৯৯৮ সালে নেওয়া তিনটি প্রকল্প আছে। আবার বিগত সরকারের সময় নেওয়া অনেক প্রকল্প আছে, যা বাস্তবায়নের গতি অত্যন্ত শ্লথ। এসব প্রকল্পে অল্প অল্প অর্থ বরাদ্দ দিয়ে এডিপিতে কেবল নামটি রাখা হয়েছে।
একই সময় অনুমোদন পেয়েছিল গৌরনদী-আগৈলঝাড়া-পয়সারহাট-কোটালীপাড়া-গোপালগঞ্জ সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প। এটিও শেষ হবে ২০১২ সালে।
১৬৪ কোটি টাকার এই প্রকল্পে এখন পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে মাত্র এক কোটি ৬৭ লাখ টাকা। আবার বিগত বিএনপি সরকারের সময় নেওয়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সংযোগ সড়ক নির্মাণ প্রকল্প ২০০৪ সাল থেকে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এই প্রকল্প গত বছর বরাদ্দ পেয়েছিল মাত্র ১০ লাখ টাকা।
যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ডাসার এলাকায় দুটি বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এগুলো দেখতে অনেক বিখ্যাত মানুষ এসেছেন।
প্রধানমন্ত্রীকেও ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দেখাতে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা আছে। এ জন্যই পুরোনো বাড়ির পাশে নতুন একটি বাড়ি করা হয়েছে।
সারা দেশের যোগাযোগব্যবস্থার বেহালদশায় মন্ত্রী সমালোচিত হলেও নিজের বাড়ির জন্য কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে সড়ক নির্মাণ জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
সূত্র - আজকের প্রথম আলো
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।