আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রাঙামাটি বিএনপি এর হালচাল

বৃষ্টি যেরকম আসতে আসতে ফিরে যায়..তেমনি বৃষ্টির মতো আমিও ফিরেছি বহুবার... বিএনপি ঃ ভেতরে তুষের আগুন দীর্ঘ ২৪ বছর দলের সভাপতির দায়িত্বে থাকা নাজিমউদ্দিন আহম্মেদ এর রাজনীতি থেকে নিজেকে ক্রমশঃ গুটিয়ে নেয়া আর দীর্ঘ ২০ বছরের সাধারন সম্পাদক এম জহির আহম্মেদ তুচ্ছ অভিযোগে জরুরী অবস্থায় কারাবরণের কারণে বিএনপি যখন নেতৃত্ব শূণ্যতায় অনেকটাই অভিভাবকহীন তখনই দলের হাল ধরতে এগিয়ে আসেন সাবেক যুগ্ম জেলা জজ এডভোকেট দীপেন দেওয়ান। শুরুতে দলের একটি অংশ তাকে মেনে না নিলেও পরে ধীরে ধীরে কর্মীদের আস্থা অর্জন করে পুরো জেলা বিএনপিকে একটি ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্মে নিয়ে আসেন তিনি। প্রতিটি উপজেলায় সম্মেলনের পর জেলা সম্মেলনে সরাসরি দলের সভাপতি হন তিনি। কেবল তাই নয় নতুন আইনী প্রক্রিয়ায় যখন তার নির্বাচনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয় তখন নিজের স্কুলশিক্ষিকা স্ত্রী মৈত্রী চাকমাকে দলীয় মনোনয়নে চারদলীয় জোটের প্রার্থী করে কারিশমা দেখাতেও সক্ষম হন তিনি। কেবল তাই নয়,এর আগে বিএনপিতে আসা বাকী পাহাড়ী নেতা পারিজাত কুসুম চাকমা,মনিস্বপন দেওয়ান,ড.মানিকলাল দেওয়ানদের পর মনে হচ্ছিলো চলে যেতে নয়,বিএনপির জাতীয়তবাদী রাজনীতিতেই থাকতেই এসেছেন ব্যতিক্রমী দীপেন।

আর সাবির্ক চিত্রে মনে হচ্ছিলো বিএনপিতে দীর্ঘদিনের নেতৃত্ব শূণ্যতা বোধ হয় এবার গেলো। কিন্তু বিধিবাম ! বিএনপির কর্মীদের প্রবল উচ্ছাস দেখে সৃষ্টিকর্তা বুঝি নীরবে হাসছিলেন। সংকটের শুরুটা হয় বিএনপিতে যারা একসময় দীপেন দেওয়ানের প্রবেশে ভূমিকা রেখেছিলেন তাদের সাথেই। দীপেন দেওয়ানের একসময়কার কাছের মানুষ হিসেবে খ্যাত বর্তমান পৌর মেয়র সাইফুল ইসলাম ভূট্টো,জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এডভোকেট সাইফুল ইসলাম পনির এর সাথে নানা কারণে দীপেন দেওয়ানের তিক্ততা সৃষ্টি হয়। এই সম্পর্কের অবনতির জন্য তারা ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্যও দেন।

এইসব নেতাদের অভিযোগ- দীপেন দেওয়ান মনে প্রাণে বিএনপিকে ধারণ করেননা,তিনি সন্তু লারমার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার জন্যই বিএনপিতে এসেছেন। দীপেনের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের ফর্দ তুলে ধরে তারা দাবী করেন-দীপেন দেওয়ান তার জুম্ম জাতীয়তাবাদী চেতনা থেকে বের হয়ে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদকে ধারণ করতে পারেননি,তার উগ্র সাম্প্রদায়িক মনোভাব বিভিন্ন সময় আচার আচরন,কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে ঠিকই বেরিয়ে এসেছে। এর জের ধরে সর্বশেষ পৌরসভা নির্বাচনে নিজ দলীয় প্রার্থীকে পরাজিত করতে দীপেন দেওয়ান গোপনে নানাভাবে চেষ্টা করেছেন বলে অভিযোগ আছে। আবার নিজের আত্মীয়স্বজনকে বিএনপি যোগদান করিয়ে কেন্দ্রীয় পদ এবং বিভিন্ন উপজেলা কমিটি গঠনের সময় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়ে তিনি দলেল পুরনো ত্যাগী নেতাদের অবমূল্যায়ন করেছেন। তবে এইসব বক্তব্য মানতে নারাজ দীপেন দেওয়ান।

তিনি বলেন,বিএনপিতে কোন বিরোধ নেই। দলে কোন গ্রুপিং এর অস্তিত্ব নেই দাবী করে তিনি বলেন-কই,আমিতো কিছু জানিনা। কারো আমার বিরুদ্ধে কি অভিযোগ করছে সে সম্পর্কে আমার জানা নেই। দীপেন দেওয়ানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী জেলা বিএনপির সাধারন সম্পাদক মোঃ শাহ আলম এবং যুগ্ম সম্পাদক মামুনুর রশীদ মামুন বলেন-আমরা কোন ব্যক্তির ইচ্ছায় দল করিনা,আমরা খালেদা জিয়ার বিএনপি করি,নেত্রী যাকে নেতা বানাবেন আমরা তার পক্ষেই কাজ করব। তবে তারা দুইজনই বলেন,যারা কদিন পর পর নতুন নেতা আমদানি করেন তাদের এই ‘আমদানী’ বন্ধ করে নিজেদেরই আগামী দিনের নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা উচিত।

অন্যদিকে পৌর মেয়র সাইফুল ইসলাম চৌধূরী ভূট্টো বলেন,দীপেন দেওয়ানের ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতি,আত্মীয়করণ,পৌর নির্বাচনের দলীয় প্রার্থীকে পরাজিত করতে নানা ষড়যন্ত্র করার কারণে তিনি বিএনপিতে কোন এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে এসেছেন,সেটা নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রশ্ন আছে। তার কারণেই রাঙামাটি বিএনপি এখন সাংগঠনিকভাবে সংকটে পড়েছে। তার হাতে বিএনপির নেতৃত্ব নিরাপদ নয়। জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এডভোকেট সাইফুল ইসলাম পনির বলেন-দীপেন দেওয়ান পার্বত্য ইস্যূতে কেন্দ্রীয় বিএনপির বিপরীত ভূমিকা পালন করছেন। তার বিতর্কিত ভূমিকার কারণে পুনর্বাসিত বাঙালী যারা বিএনপির ভোট ব্যাংক হিসেবে পরিচিত তাদের মাঝে বিএনপির গ্রহণযোগ্যতা কমে যাচ্ছে।

তিনি কারো মতামতের তোয়াক্কা না করে নিজের ইচ্ছায় দল পরিচালনা করেন। একজনমাত্র ব্যক্তির কারণে বিএনপির সাংগঠনিক ক্ষতি আমরা মেনে নিতে পারিনা। দীপেন দেওয়ানের সাথে শীর্ষ নেতাদের এই বিরোধ তৃনমূলেও পৌঁছে গেছে। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন সাবেক সামরিক কর্মকর্তা লেঃকর্ণেল মণীষ দেওয়ান। আপাততঃ দীপেন দেওয়ানের বিরুদ্ধে পাল্টা প্রতিপক্ষ হিসেবে মনীষকেই সামনে নিয়ে এসেছে তার প্রতিপক্ষরা।

মুক্তিযুদ্ধের সম্মুখভাগে লড়াই করা এবং দলীয় প্রধান বেগম খালেদা জিয়ার ভাই সাইদ ইস্কান্দার এর ঘনিষ্ঠ বন্ধু মনীষকে বিশাল শোডাউন এর মাধ্যমে বরণও করে নেয়া হয়েছে। সেই বরণ করে নেয়ার অনুষ্ঠানেও ছিলো নানা ঘটনা দুর্ঘটনা আর পাল্টাপাল্টি মিছিল-শোডাউন। রাঙামাটি বিএনপি এখন ত্রিধারায় বিভক্ত। একদিকে দীপেন দেওয়ানসহ সদর থানা বিএনপির সভাপতি এডভোকেট মামুনুর রশীদ,জেলা ছাত্রদলের সাধারন সম্পাদক,সাংগঠনিক সম্পাদক,স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি,সাধারন সম্পাদক এবং শ্রমিক দলের সভাপতি আর অন্যদিকে পৌর মেয়র ভূট্টোসহ জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক,পৌর বিএনপির সাধারন সম্পাদক শফিউল আজম,জেলা যুবদলের সভাপতি সাইফুল ইসলাম শাকিল,সাধারন সম্পাদক ইলিয়াস হোসেন,জেলা ছাত্রদলের সভাপতি আবু সাদাত মোঃ সায়েম,যুগ্ম সম্পাদক কামাল হোসেনসহ আরো নেতারা। লেঃকর্ণেল মণীষ সম্পৃক্ত হওয়ায় এই অংশের প্রভাব বলয় আরো বেড়েছে বলে দাবী তাদের সমর্থকদের।

এই দুই ধারার বাইরেও কিছু নেতাকর্মী আছেন যারা এখনো কোন পক্ষেই সুস্পষ্ট অবস্থান নেননি। বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো সিরিয়র কেউ এই অংশে না থাকলেও উপজেলা বিএনপির বেশ কটি ইউনিট এখন এই অসস্থান নিয়েছে। তবে বিএনপির এই বিরোধ নিয়ে বেশ অস্বস্তিত্বে দলটির নেতাকর্মীরা। সম্প্রতি দলটির বেশ কয়েকটি কর্মসূচীতে বিপরীত অংশের নেতাকর্মীদের উপস্থিতি কম দেখা গেছে। পাল্টাপাল্টি বিরোধের কারণে কর্মীরাও এখন আর দলীয় কর্মসূচীতে অংশ নিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেননা।

আর সিনিয়র নেতাদের মধ্যে নিজ নিজ গ্রুপে কর্মী টানা নিয়ে চলছে নানা টানাপোড়েন। এক গ্রুপ থেকে সটকে আরেক গ্রুপে ভেড়ার প্রবণতা বেড়েছে কর্মীদের মধ্যেও। নেতারাও নানা প্রলোভনের মাধ্যমে কর্মীদের প্রলুদ্ধ করছেন। সব মিলিয়ে বেশ সংকটে রাঙামাটির জাতীয়তাবাদী রাজনীতি। বিরোধ প্রকাশ্য রূপ নিলেও এখনো সংঘাত বা সহিংসতা দেখা না দেয়ায় দলটির ভেতরে তুষের আগুণ জ্বলছে।

যেকোন সময় এই আগুন প্রকাশ্য রূপ নিয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে এমন আংশকা দলটির নীতিনির্ধারক,কর্মী সমর্থক সবার মাঝেই। তবে তৃনমূলের প্রত্যাশা নিয়েও আছে ভিন্ন ভিন্ন মত। কেউ কেউ ঐক্যবদ্ধ বিএনপির কথা বললেও আবার অনেকেই ভাড়াটে নেতা আনার প্রবণতা এবং দলের ভেতর থেকেই বাঙালী নেতাদের দলীয় মনোনয়ন দেয়ার কথাও জানান। তাদের বক্তব্য-পার্বত্য চট্টগ্রামে বিএনপি বরাবরই সেটেলার ভোটব্যাংক ভিত্তিক একটি দল,তাই পাহাড়ীরা অতীতেও কোনদিন বিএনপিতে ভোট দেয়নি,দিবেওনা। তাই ভাড়াটে পাহাড়ী নেতা আর না এনে দলের ভেতর থেকেই দীর্ঘদিন যারা বিএনপি করছে তাদেরকেই দলীয় মনোনয়ন দেয়া উচিত।

আশির দশকে জিয়াউর রহমানের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত বিএনপিতে পাহাড়ী নেতাদের মধ্যে সুকোমল দেওয়ান,পারিজাত কুসুম চাকমা,মনিস্বপন দেওয়ান,মানিক লাল দেওয়ান,দীপেন দেওয়ানের পর এখন সর্বশেষ সংযোজন মনীষ দেওয়ান। বিএনপির এই পাহাড়ী নেতাদের আসা যাওয়ার মিছিলে এখন দুই দেওয়ান একই সাথে বিএনপির দুই গ্রুপের নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। সর্বশেষ লড়াইয়ে কোন দেওয়ান নিজের শক্তিশালী প্রভাব বলয় তৈরি করতে পারেন,তাই এখন দেখার বিষয়। তবে সর্বশেষ আসা লেঃকর্নেল (অব.) মনীষ দেওয়ান জানালেন-কোন জাতি বা গোষ্ঠীর পক্ষ হয়ে নয়,শহীদ জিয়ার জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে সামনে নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিএনপির অবস্থান শক্ত করে বেগম জিয়ার হাতকে শক্তিশালী করাই আমার চূড়ান্ত লক্ষ্য। বহুজাতিক রাষ্ট্র বাংলাদেশে, ‘বাঙালী জাতীয়বাদ’ নয়, ‘ বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ই পাহাড়ী-বাঙালীর ঐক্য ও সম্প্রীতির সূতিকাগার।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।