দেশ গড়ার প্রত্যায় নিয়ে এগিয়ে আসুন স্টাফ রিপোর্টার
একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় সম্পূরক চার্জশিটে এক নম্বর আসামি মুফতি আবদুল হান্নান জবানবন্দি প্রত্যাহার আবেদনে তার ওপর লোমহর্ষক বর্বর নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন। অমানুষিক নির্যাতনের মাধ্যমে তার কাছ থেকে জোরপূর্বক জবানবন্দি নেয়া হয়েছে দাবি করে তিনি বলেছেন, ‘জবানবন্দিতে উল্লিখিত সমস্ত তথ্য তদন্ত কর্মকর্তা আবদুল কাহার আখন্দের লেখা। নির্যাতনের মাধ্যমে আমার কাছ থেকে জোরপূর্বক এতে স্বাক্ষর নেয়া হয়। ম্যাজিস্ট্রেটের সামনেই অন্য এক ব্যক্তি আমার হাত ধরে স্বাক্ষর নেন। ’
এ জবানবন্দি প্রত্যাহার করার জন্য মুফতি হান্নান গত মঙ্গলবার আদালতে লিখিত আবেদন জানান।
দ্রুত বিচার ৯ নম্বর
ট্রাইব্যুনালে তিনি এ আবেদন করেন। আবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘বিগত ০৭/০৪/১১ ইং তারিখে ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ১৬৪ ধারায় রেকর্ডকৃত কথিত জবানবন্দি প্রত্যাহার প্রসঙ্গে’।
এ আবেদনে বলা হয়, রাজনৈতিক নেতা এবং নিজের জড়িত থাকার বিষয়ে স্বীকারোক্তি দিতে তার ওপর অমানুষিক বর্বর নির্যাতন করা হয়েছে। উলঙ্গ করে পুরুষাঙ্গে বৈদ্যুতিক শক; নাকে, কানে, জিহ্বাসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় বৈদ্যুতিক চার্জ, বেধড়ক লাঠিপেটা, দু’হাতের ৯টি আঙুলের নখ তুলে ফেলা হয়। প্রত্যেকটি আঙুলের মাথায় আলপিন ঢোকানো এবং আঙুলের অগ্রভাগ গ্যাসলাইট দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়।
পায়ের আঙুলগুলো পাথর দিয়ে থেঁতলে দেয়া হয়। সম্মুখভাগে হাজার ভোল্টের বাল্ব জ্বালিয়ে রেখে মুখসহ বিভিন্ন জায়গা ঝলসে দেয়া হয়। এছাড়া পা ওপরের দিকে দিয়ে মাথা নিচের দিকে দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হতো জিজ্ঞাসাবাদের সময়। এছাড়া ভেজা গামছা নাকে ও মুখে রেখে মরিচ মিশ্রিত গরম ও ঠাণ্ডা পানি ঢালা হতো। অনেক সময় আদিম বর্বর যুগের মতো একটি ইট পুরুষাঙ্গে ঝোলানো হতো।
বর্বরতার চূড়ান্ত পর্যায়ে কাটিং প্লায়ার্স দিয়ে শরীরের বিভিন্ন জায়গার চামড়া তুলে ফেলা হতো। দাঁড়ি টেনে তুলে ট্রে’র ভেতর রাখা হতো। বৈদ্যুতিক ঘুরন্ত চেয়ারে ঘোরানো হতো।
জবানবন্দি প্রত্যাহারের আবেদনে মুফতি আবদুল হান্নান বলেন, ‘আমি নিম্নস্বাক্ষরকারী মুফতি আবদুল হান্নান মুন্সী, পিতা-মরহুম মুন্সী নুর মোহাম্মদ, সাং-হিরন, থানা-কোটালীপাড়া, জেলা-গোপালগঞ্জ, সবিনয় নিবেদন এই যে, আমি উপরোক্ত মামলার ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানি না। কোনো প্রকারে জড়িত নহে এবং কাহারা জড়িত, তাহাও আমি জানি না।
আমি সূত্রের মামলার আসামি ছিলাম না এবং আমাকে উক্ত মামলার আসামি হিসাবে গ্রেফতার করা হয় নাই। ’
মুফতি হান্নান লিখিত আবেদনে বলেন, ২০০৯ সালের ৩ আগস্ট আবার ওই মামলার পুনঃতদন্ত দেয়ার পর আমাকে বর্তমান চার্জশিট জমা দেয়া পর্যন্ত বিভিন্ন মামলায় বিভিন্ন মেয়াদে (প্রায় দুইশ’ তিন দিন) রিমান্ডে নিয়ে ওপরোল্লিখিত নির্যাতনসহ নানা ধরনের ভয়-ভীতি, লোভ-লালসা প্রদান করে। এ মামলার ২য় জবানবন্দি রেকর্ড করার আগে অর্থাত্ ২০১১ সালের ৪ এপ্রিল রাত অনুমানিক ১১টার দিকে কাশিমপুর কারাগার হতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আমাকে নেয়া হয়। জেলগেটে পৌঁছানোর পর সিনিয়র জেল সুপার তৌহিদুর রহমান লিখিত একটি কাগজে স্বাক্ষর করতে বললে আমি অস্বীকার করায় আমাকে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করে বিষ প্রয়োগে হত্যার হুমকি দেয়। পরদিন সকালে ৬ সেল বনফুল ৬নং রুমে আমার অবস্থানে আনুমানিক সকাল ৭.৩০ মিনিটে সুপার ও তার সঙ্গে জেলার, ডেপুটি জেলার সেই কাগজটা দিয়ে স্বাক্ষর করতে বললে আমি আবারও অস্বীকার করি।
এতে সুপার গালাগাল দিয়ে আমাকে হত্যার হুমকি দিয়ে চলে যায়।
ওইদিন সন্ধ্যায় সিলেটে আমার কোর্ট থাকার দরুন চালান পাঠায়। সিলেটে কোর্ট শেষে আবার পরদিন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে আসে। সন্ধ্যায় জেলগেটে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে জেলগেট থেকে সিআইডির ফজলুল করিম ও আরও ক’জন সিআইডি অফিসার তাদের গাড়িতে করে ঢাকা কোর্টে নিয়ে আসে। সে সময় জেলের কোনো কর্মকর্তা ও কর্মচারী ছিল না।
কোর্টে পৌঁছে আমাকে কোর্টের একটি রুমে রাখে। যেখানে আইনজীবীরা বসেন। পরে আমাকে ম্যাজিস্ট্রেট রুমে ফজলুল কবির নিয়ে যায়। আমি সেখানে ম্যাজিস্ট্রেটকে এখানে আনার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, আপনার দরখাস্তের মধ্যে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় জবানবন্দি রেকর্ড করার জন্য এখানে আনা হয়েছে। এ কথা শুনে আমি হতচকিত হয়ে বিচলিত হয়ে পড়ি।
তখন ম্যাজিস্ট্রেটের হাতে ফজলুল কবির এবং পূর্বে ম্যাজিস্ট্রেটের রুমে বসে থাকা আবদুল কাহার আকন্দ (সিআইডি) আমার হাতে একটি কাগজ দেয়। যেখানে বর্তমান আমার কথিত জবানবন্দিতে উল্লিখিত নাম, যেমন—তারেক জিয়া, হারিছ চৌধুরী, পিন্টু ও বাবরসহ অনেকের নাম রয়েছে। আমি ওই রেকর্ড প্রস্তুতকৃত জবানবন্দিতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করলে আমাকে জেলের ভেতরে হত্যা করাসহ রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করার হুমকি দেয়া হয়।
মুফতি হান্নান বলেন, রাত ১১টার দিকে ম্যাজিস্ট্রেট, আবদুল কাহার আকন্দ ও ফজলুল কবিরের উপস্থিতিতে কয়েকটি সাদা কাগজে স্বাক্ষর করতে বললে আমি সাদা কাগজে স্বাক্ষর করিনি। স্বাক্ষর না করার দরুন আমাকে পুলিশ দিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
উল্লেখ্য, ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে উপস্থিত করার আগে আমাকে বিভিন্ন মামলা দিয়ে রিমান্ডে নিয়ে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করা হতো। ফজলুল কবির ও আবদুল কাহার আকন্দ মাঝেমধ্যে কালো কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে র্যাবের কাছে নিয়ে যেত। র্যাব আমাকে নিয়ে শহরের বাইরে যেত। আর বলত—তুমি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, আবদুস সালাম পিন্টু, বাবর এদের সঙ্গে হাওয়া ভবনে মিটিং করেছ স্বীকার করতে হবে এবং বলতে হবে বাবর এবং আবদুস সালাম পিন্টু গ্রেনেড ও টাকা দিয়েছে। তা না হলে তোমাকে হত্যা করা হবে।
এ পর্যন্ত গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে র্যাব, ডিজিএফআই ও সিআইডিসহ বিভিন্ন সংস্থা প্রায় ৪১০ দিন রিমান্ডে নিয়ে আমার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালিয়েছে। ফলে আমার দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পেয়েছে। স্মৃতিশক্তিও হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানে আমার ডান হাত ও ডান পা অবশ হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, আমি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত নই।
আমি তারেক জিয়া, হারিছ চৌধুরী ও বাবরের সঙ্গে হাওয়া ভবনে কোনো সময়ই দেখা করিনি। পিন্টু সাহেবের বাসায় কখনও যাইনি বা তাকে চিনি না। অন্যান্য আসামিকেও আমি চিনি না। আগেও কোনো পরিচয় ছিল না।
২৭ সেপ্টেম্বর তিনি আদালতে উপস্থিত হয়ে নিয়োজিত আইনজীবীর মাধ্যমে তার বক্তব্য লিখিয়ে পাঠ করেন এবং সঠিক পেয়ে স্বেচ্ছায়-সজ্ঞানে অন্যের বিনা প্ররোচনায় অত্র প্রত্যাহারমূলক জবানবন্দিতে প্রতি পাতায় নিজ নাম স্বাক্ষর করেন বলে আবেদনে উল্লেখ করেন।
লিখিত আবেদনে মুফতি আবদুল হান্নান বলেন, এর আগে র্যাব জেআইসিতে নিয়ে আমাকে কয়েক দফা নির্যাতন করে। একবার টর্চারিং সেলে নেয়ার পর আমাকে ফুলের মালা পরিয়ে দু’পাশে দাঁড়িয়ে থাকা র্যাব অফিসাররা ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে এক ভয়ার্ত ও আতঙ্কিত পরিবেশের সৃষ্টি করে। র্যাব অফিসাররা আমাকে বলে—জান, তোমাকে কি জন্য আবার এখানে আনা হয়েছে? আমি জানি না বললে এক র্যাব অফিসার এবং ওই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বলে—তোমাকে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিষয়ে যা বলব, তা স্বীকার করতে হবে। তা না হলে আগের রিমান্ডের চেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি তোমাকে মোকাবিলা করতে হবে অথবা দুনিয়া থেকে চিরবিদায় নিতে হবে। পরদিন আদালত থেকে আবার রিমান্ডে আনা হলো এবং আমি মামলা সম্পর্কে কিছুই জানি না বলতেই শুরু হলো আমার ওপর অমানুষিক বর্বর নির্যাতন।
অনেক সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলতাম। জ্ঞান ফিরে এলে শুরু হতো নতুন কায়দায় নির্যাতন। ভেজা গামছা নাকে ও মুখে রেখে মরিচ মিশ্রিত গরম ও ঠাণ্ডা পানি ঢালা হতো। এই নির্যাতন জাহেলিয়াতের যুগের নির্যাতনকেও হার মানায়। অতঃপর তাদের সীমাহীন অত্যাচারে অতিষ্ঠ ও দিশেহারা হয়ে যাই।
তারা আমাকে রাজসাক্ষী করতেও চায়।
২০০৭ সালের ১ নভেম্বর পুলিশ ও র্যাব প্রহরায় ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে আমাকে প্রায় আধমরা অবস্থায় উপস্থিত করে। তখন সেখানে উপস্থিত ছিল র্যাব অফিসার এবং এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। ম্যাজিস্ট্রেট ওই মামলা সম্পর্কে আমাকে জিজ্ঞাসা করা মাত্র যখন মামলা সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না বলি, তখন উপস্থিত কর্মকর্তাদ্বয় ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে আগেই লিখিত একটি কাগজ দেখিয়ে বলে—উনি খুব অসুস্থ, এটা থেকে আপনি দেখে দেখে লিখে নিন। ম্যাজিস্ট্রেট তাই করলেন।
যা ছিল সম্পূর্ণ প্রস্তুতকৃত। মুফতি হান্নান বলেন, আমাকে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে যখন উপস্থিত করা হলো, তখন রাত আনুমানিক ১২টা-সাড়ে ১২টা। আমাকে ওই জবানবন্দিতে স্বাক্ষর করতে বললে আমার আঙুলের অগ্রভাগ দেখিয়ে স্বাক্ষর করতে অক্ষমতা প্রকাশ করলে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের পাশে বসে থাকা এক ব্যক্তি তার হাত দিয়ে আমার হাত ধরে স্বাক্ষর করে। এ সময় আমি মেঝেতে শুয়ে ছিলাম। ওই মামলার চার্জশিটের বিচার চলাকালীন ওই জবানবন্দির প্রত্যাহারপত্র বিচারিক আদালতে জমা দিয়েছিলেন বলেও জানান মুফতি হান্নান
সূত্র আমার দেশ, তািরখ ২৯/০৯/২০১১
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।