আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মেঘদূত বিষয়ক প্যাঁচাল...

সাপের শরীর হয়ে আঁধারের গাছ/ কুয়াশার বন্যায় ডুবো দেবী মাছ! কবিতা তার নিজ গতিতে সামনের পথে হাঁটে। মাঝে মাঝে উন্নতবাহনের কাঁধে চেপে খুব দ্রুত সব নিয়ম কানুন বদলে ফেলে। তবে বাংলা ভাষা সেই যে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা বংশের সন্তান ছিল সে থেকে বদলাতে বদলাতে বর্তমান রূপ লাভ করেছে তাও কিন্তু বিস্ময়ের। ইন্দো ইরানী থেকে প্রাচীন ভারতীয় আর্য আর তারপরের একটা শাখা সংস্কৃতে আটকে গেল। সংস্কৃত শুধু মাত্র সাহিত্যের ভাষা বলে তার পরিবর্তন পরিবর্ধন কিছুই হলনা।

এটা ঠিক যে সাধারন মানুষের জন্য সাহিত্য কল্পনা করাও যেতনা তখন। আর তাই সাহিত্য রয়ে গেল সাধারনের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। ভাষার পরিবর্তন হয় মুখে মুখে। পরিবর্তন হলেও তা জীবন্ত রয়ে যায়। সংস্কৃতের মৃত্যু হল একসময়।

শুধুমাত্র মানুষের মুখে ঠাঁই না পেয়ে। কালিদাসের মেঘদূত ছিল আমাদের পাঠ্য। একটা মৃত ভাষার লেখা হৃদয়ঙ্গম করা যে কি দুঃস্বাধ্য তা কেবল ভুক্তভোগিরা জানে। মাঝে মাঝে বইটি নিয়ে বসি কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকি তারপর দুয়েক লাইন পড়ে আবার রেখে দেই। এভাবে বছর পার করে ফেলেছি।

মাঝখানে একবার অবশ্য ব্লগার মেঘদূতের দেয়া একটা পোষ্ট যেটি নরেন্দ্র দেবের অনুবাদ, পড়েছিলাম। বাল্মীকির রামায়ন কালিদাসের আদর্শ। তিনি প্রথম শ্লোকেই তার প্রমান দেন। সীতার স্নানে পূন্যস্থান হিসেবে রামগিরির কথা বলে। রাম সীতার বনবাসের কালে সীতা অপহৃত হবার পর রাম হনুমানের মাধ্যমে সীতার কুশল জানতে চেয়েছিল।

এ কাব্যে যক্ষ তার প্রিয়ার বিরহে মেঘের হাত দিয়ে প্রিয়ার কুশল জানতে চায়। আধুনিক কবিতা যেভাবে আমাদের স্পর্শ করে তা একমাত্র সারল্য গুনের প্রভাবে। ''মোরে হেরি প্রিয়া ধীরে ধীরে দীপখানি দ্বারে নামাইয়া আইল সম্মুখে- মোর হস্তে হস্ত রাখি নীরবে শুধালো শুধু, সকরুন আঁখি হে বন্ধু, আছো তো ভালো?'' এর মাঝে মেঘদূতের ছায়া আছে। মেঘের মুখ দিয়ে কবি বলছে, ''তোমার সহচর যদিও বিরহিত জীবিত আছে রামগিরিতে অবলা, তোমাকে সে কুশল জিজ্ঞাসে, প্রথমকৃত্য এ প্রশ্ন কেননা প্রানীদের জীবন অস্থির, বিপদ ঘটে অতি সহজে। '' সহজ বাংলায় যার তর্জমা করলে দাঁড়ায় 'ভাল আছো তো?' অথচ এ দুয়ের মধ্যে যুগান্তকারী ব্যবধান।

যক্ষের হৃদয় এক নীতিজ্ঞ জড়বাদীর। তার বিরহে প্রিয়া অন্য কারো হবে তা তার কল্পনাতেই আসেনা। তার একটায় চিন্তা, এ সময়ের ব্যবধানে যেন প্রিয়ার মৃত্যু না হয়। আর যক্ষ যে জীবিত তা জানিয়ে দিয়ে প্রিয়াকে নিশ্চত করা। এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন, আমরা যাকে প্রেম বলি কাম তার শিকড় এতে সন্দেহ নেই, কিন্তু কাম বিচিত্র রূপান্তরের পর দেহমনে আপন যে লীলার সৃষ্টি করে তাতে অন্তত কামগন্ধ আর থাকেনা।

এখানেই সংস্কৃত কবিদের সাথে বর্তমান আমাদের মনস্তাত্তিক পার্থক্য। তাদের প্রণয় বিবরন পড়ে সম্পূর্ন সুখ হয়না, এর কারন যৌন বৃত্তির অকপট উল্লেখ নয় বরং আন্তরিক হৃদ্য আবেদনের অভাব। আমরা যাকে প্রেমে পড়া বলি তাকেই যে তারা কামজ্বর বলতেন তা এখন স্পষ্ট। শুধুমাত্র যৌন প্রনয়কে অবলম্বন করে সর্বাঙ্গসুন্দর কোন কবিতা পৃথিবীর আর কোনো ভাষাতেই লেখা হয়নি। হিন্দু সভ্যতার আদিযুগ থেকেই রতি শাস্ত্রের প্রচলন ছিল।

অথর্ববেদে বহু যৌন প্রসঙ্গের উল্লেখ আছে। (কি করলে পত্নী বা প্রনয়িনী লাভ হয়, সতিন-কাঁটা উপড়ে ফেলা যায়, প্রেমিকার পরিজন কে নিদ্রামগ্ন রাখা যায়, পতি বা উপপতি একান্ত আসক্ত থাকে এসব আর কি) বাৎসায়নের কামসূত্র আসলে যে সব কবির রচনা লুপ্ত হয়ে গেছে তাদের সারসংকলন। কালিদাসের এ কামসূত্রের সাথে পরিচয় হয়নি এমনটা বলা বোকামি। এ কাব্যও তাই আর সব সংস্কৃত কাব্যের মতই স্থুল বর্ননা বেষ্টিত। যক্ষ মেঘকে প্রিয়ার কাছে পাঠাবে সেখানে সে তাকে লোভী করে তুলছে নারীর সৌন্দর্য্য কে পুঁজি করে।

পৃথিবীকে সে যেন গর্ভনী নারীর স্তন মনে করে যখন সে পাহাড়ের উপর দিয়ে যাবে। দৃশ্য হবে যেন ধরার স্তন তট, অমর মিথুনের ভোগ্য গর্ভসূচনায় মধ্যে কালো আর প্রান্তে পান্ডুর ছড়ানো। মেঘদূতে যে সকল পশুপাখির দেখা মেলে তাদের প্রত্যেকের মৈথুন ঋতু বর্ষা। কাকের নীড় নির্মান, হাতীর মদস্রাব এসব কিছু আসলে কামুক যক্ষের অন্তর কে আরো অস্থির করে তুলছে। মেঘকে লোভী করতে কোথাও সে বাতাসের কথা বলছে, যে বাতাসে যুবতীর জলকেলির সৌরভ ভেসে আসে, যে নদীর উপর দিয়ে যাবে সে নদীতে বেতের শাখা এমনভাবে ঝুঁকে আছে যেভাবে প্রিয়র কাছে নারীর ভূষন শিথিল হয়ে পড়ে।

আবার বেত্রবতী নদীর জলের উপর দিয়ে মেঘ যাবে। তার ছায়া পড়বে নদীর জলে। তখন যেন মেঘ আলিঙ্গন দেয়, কারন কামার্ত বসন উন্মুক্ত নারীকে উপেক্ষা করা কোন প্রেমিকের কাজ নয়। নারীকে গহনা ছাড়া কল্পনা করতে পারেন নি কোনো সংস্কৃত কবিই। তবে কালিদাস ই প্রথম কবি যখন তাঁর হাতে রচনায় উঠে আসলো ফুলের গহনার কথা।

অলকায় সোনা আর দামী সব রত্নের প্রাচুর্য এত বিপুল যে কবিকে তার নায়িকাদের মোহিনী করতে ফুলের গহনার বিকল্প নেই। যে সব ফুল ,ঋতু ছয়টি বলে আমরা কখনো একসঙ্গে দেখবোনা। ''হস্তে লীলাকমলমলকে বালকুন্দানুবিদ্ধং নীতা লোধ্রপ্রসবরজসা পান্ডুতামাননে শ্রীঃ চূড়াপাশে নবকুরুবকং চারু কর্ণে শিরীষং সীমন্তে চ ত্বদুপগমজং যত্র নীপং বধূনাম। '' অর্থাৎ- হাতে পদ্ম ,চুলে কুন্দ ফুল, মুখে লোধচূর্ন ব্যবহার করে ক্লান্তি দূর করে সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনে, খোপায় মোরগফুল, কানে শিরীষ, কদমে রয়েছে সিঁথির প্রসাধন। '' কিন্তু এত উপমাও বড় সাধারন।

কবিত্ব থাকেনা। হঠাৎ করে আদিরসের ক্লান্তি কাটিয়ে গীতগোবিন্দে কৃষ্ণ তারপ্রিয়াকে বলে বসল, 'ত্বমসি মম ভূষনং ত্বমসি মম জীবনং ত্বমসি মম ভবজলধিরত্নম--'' তুমিই আমার ভূষণ তুমিই আমার জীবন.... জয়দেবের এ উক্তিই প্রমান করে যে তিনি আধুনিক ধারনার সূত্রপাত করছেন, দাঁড়িয়ে আছেন প্রাচীন আর আধুনিকের সন্ধিস্থলে। কিছু কিছু উপমা তিনি শুধুমাত্র প্রচলিত বলেই ব্যবহার করেছেন। চকিত হরিনীর দৃষ্টি, ভ্রমরপংক্তির মত কটাক্ষ, বিম্বফলের মত অধর,কদলী কান্ডের মত উরু,পর্যাপ্তপুষ্প স্তবকের মত স্তন। অবশ্য এক সময় তিনি বোধহয় এসব উপমায় ক্লান্ত হয়ে থমকে গিয়ে নিজেই কুমারসম্ভবে বলেন, ''নাগেন্দ্রহস্তান্ত্বচি কর্কশত্বাদেকান্তশৈত্যাৎ কদলীবিশেষ্যাঃ লব্ধাপি লোকে পরিনাহি রূপং জাতান্তদূর্বোরুপমানবাহ্যাঃ'' অর্থাৎ- ''হাতির শুঁড় কর্কশ, কলাগাছ ঠান্ডা,আর তাই এরা লোকসম্মত হলেও তোমার উরুর উপমা হিসেবে যুক্তিযুক্ত হতেই পারেনা।

কেননা তা স্পর্শে কোমল ও উষ্ম। '' নারীদেহের বর্ননায় সংস্কৃত কবিরা অক্লান্ত। অবশ্য মেঘদূতে শিক্ষনীয় কিছু নেই। মেঘদূত একটা বাজে চোখের জলের কাব্য। মেঘদূত পাঠের সময় যে অকৃত্তিম আনন্দ পাওয়া যায় সেটুকুতেই তার পাওয়ার আশা শেষ।

শেষের পর একটা মাধুর্য্যে হৃদয় ভরে থাকে। কিন্তু উপরি পাওনার আশা করতে গেলে মেঘদূত পাঠক কে নিরাশ করবেই। কালিদাসের রচনাতে ধ্বনিমাধুর্য আছে নিশ্চয় কিন্তু সংস্কৃত কবিতা আর বর্তমান পাঠকের মধ্যে একটা বুদ্ধির ব্যবধান সব পন্ড করে দেয়। পড়া মাত্র বোঝার উপায় নেই। আচ্ছা বাংলার একটি কবিতার লাইন ধরা যাক- '' আমাকে দু'দন্ড শান্তি দিয়াছিল নাটোরের বনলতা সেন''-- এটি সংস্কৃতে অনায়াসে লেখা যায়- '' নাটোরের দিয়েছিল দু-দন্ড আমাকে শান্তি সেন বনলতা।

'' এই হল সমস্যা। একটি বাক্য যে ঠিক মানেটাকে সামনে এনে সার্থক বাক্য অভিধা তৈরি করবে তার উপায় নেই। যাই হোক সংস্কৃতের সাথে আমাদের বিচ্ছেদ ঘটেছে , কিন্তু সাহিত্য প্রেমিদের কাছে সংস্কৃত সাহিত্যের কদর কমেনি একটুও। তাই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কবি অনুবাদ করেছেন এই মেঘদূত। আশা করতে দোষ নেই বর্তমান শব্দাবলির ব্যবহার করে হয়ত কোন কবি একদিন আধুনিক পাঠকদের জন্য মেঘদূত অনুবাদ করবেন।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।