কার্ণিশ ভাঙ্গা জানালার ফাঁক দিয়ে রাতের আকাশের যেটুকু অংশ দেখা যায়, অইটাই আমার পৃথিবী। আগের পর্ব
সিভিল সোসাইটি ও পুঁজিবাণিজ্যঃ সিভিল সোসাইটি ধারণাটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম উপস্থাপন করেন আঠার শতকের স্কটিশ ইতিহাসের দার্শনিক অ্যাডাম ফার্গুসন। সিভিল সোসাইটির কাঠামোবদ্ধ বা সাধারণের বোধগম্য হয় এমন কোনো সংজ্ঞা এখনো নিরুপিত হয়নি। The London School of Economics এর Centre for Civil Society's working এর প্রদত্ত সংজ্ঞা থেকে সিভিল সোসাইটি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাই। Civil society refers to the arena of uncoerced collective action around shared interests, purposes and values. In theory, its institutional forms are distinct from those of the state, and market, though in practice, the boundaries between state, civil society, and market are often complex, blurred and negotiated. Civil society commonly embraces a diversity of spaces, actors and institutional forms, varying in their degree of formality, autonomy and power.
সিভিল সোসাইটি এখনও সাধারণের কাছে এক রকম ধাঁধা।
“সাধারণ মানুষের ক্ষময়াতন সিভিল সমাজের মূল কথা” শিরোনামে ফ. র. মাহমুদ হাসানের একটি সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, সিভিল সোসাইটি সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, “সিভিল সোসাইটি কি একথা বলে যতোটা ব্যাখ্যা করা যায় তার চেয়ে বেশি বোঝানো যায় সিভিল সোসাইটি কি নয় একথা বলে”। তার মতে রাষ্ট্র, সরকার, বাজার এবং রাজনৈতিক দল- এরা সিভিল সোসাইটি নয়। এছাড়াও তিনি রাষ্ট্র অর্থাৎ সংসদ, আমলাতন্ত্র, সেনাবাহিনী, পুলিশ বাহিনী এবং বিচার বিভাগ। এছাড়াও বড়ো ব্যবসায়ী বা বহুজাতিক কোম্পানীগুলোও সিভিল সমাজের অংশ নয় বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
অন্যদিকে সিভিল সোসাইটি বিষয়ে মাইকেল এ্যাডয়ার্ডস তার “সিভিল সোসাইটি” প্রবন্ধে সিভিল সোসাইটি সম্পর্কে বলেন, সিভিল সোসাইটি বলতে বোঝানো হয় এমন একটি গোষ্টীকে, যারা সমাজে মুক্ত বাজার অর্থনীতি ও ব্যক্তি স্বাধীনতার বিস্তার ঘটিয়ে মৌলিকভাবে রাজনীতির হস্তক্ষেপকে সঙ্কুচিত করতে চায় অথবা এটি দিয়ে ঠিক সম্পূর্ণ বিপরীত জিনিসও বুঝানো যেতে পারে।
যেমন সিভিল সোসাইটি-ই হচ্ছে কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র এবং নিপীড়নমূলক বাজারের একমাত্র বিকল্প।
সিভিল সোসাইটির সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে সিভিল সোসাইটির স্বরুপ যা দাঁড়ায়, তা হলো, সিভিল সোসাইটি এমন একটি অরাজনৈতিক সমাজ যারা সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ে সরকারকে প্রভাবিত করে। সিভিল সোসাইটি ঠিক চাপ “প্রয়োগকারী গ্রুপ” হয়ত নয়। সরকার ও রাজনৈতিক দলের বাইরের একটি সমাজ যারা সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ে সরকারকে চাপ প্রয়োগ করে। তারা কোনও রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় গড়ে উঠে না, তারা রাজনীতি করেন না।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সিভিল সোসাইটির রুপ একেবারে ভিন্ন। বাংলাদেশে সিভিল সোসাইটি দাবিদার প্রতিষ্ঠান সমূহের ক্ষেত্রে দেখা যায়, বেশিরভাগই নিয়ন্ত্রিত হয় ব্যবসায়ীদের দ্বারা যাদের অনেকেই ঋণ খেলাপীর দায়ে অভিযুক্ত অথবা রাজনীতিবিদ যাদের অনেকেই কোন না কোন রাজনৈতিক দলের সাথে সরাসরি এবং সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত। ফলে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বেশীরভাগ সিভিল সোসাইটি সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ে সরকারকে চাপ প্রয়োগের চেয়ে বেশী যে কাজটি করে থাকেন, তা হল দাতা গোষ্ঠীসমুহের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী সরকার ও রাজনৈতিক দল সমূহ যেন মুক্তবাজার অর্থনীতির বিকাশে, পুজিতন্ত্রের পায়ের তলার মাটি যেনো আরও শক্ত হয় সে লক্ষ্যেই কাজ করে তার জন্য চাপ প্রয়োগ করা। পুঁজিতন্ত্রের মুখপত্র ও পৃষ্ঠপোষক। শিল্পায়ন কী ভাবে অতি দ্রুত ঘটে, কৃষি কী ভাবে দ্রুত ধ্বংস হয়, শিক্ষার উপর ভর্তুকি কমানো কেন অতিব জরুরী এইসব বিষয়েই তাদের গবেষণা পত্র, সুপারিশ ও সরকারকে চাপ প্রয়োগ।
বাংলাদেশের সিভিল সোসাইটি রাজনীতি করেন না যেহেতু সংজ্ঞিনুযায়ী সিভিল সোসাইটি সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক সমাজ, কিন্তু দাতা গোষ্ঠীর ইচ্ছার পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য তারা রাষ্ট্র পরিচালনা, রাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন বা নীতি নির্ধারণ সহ রাজনীতিকে পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন। তারা রাজনীতি করেন না কিন্তু সাম্রাজ্যবাদীদের ইচ্ছার পৃথিবী তৈরী করার জন্য রাজনীতিকে তাদের মতো করে তৈরী করেন, তাতে সাধারণ মানুষের কত বড় ক্ষতি হচ্ছে তার কোন ভ্রুক্ষেপ থাকে না। তাদের গবেষণা কর্ম, কার্যক্ষেত্র, গবেষণালব্দ সুপারিশ সমূহের বেশীরভাগই ব্যবসা বাণিজ্য কেন্দ্রিক, মুক্তবাজার অর্থনীতিকে দ্রুত সম্প্রসারণ কেন্দ্রিক।
আমরা বলছি না যে, সবাই এটা করেন। কিন্তু বেশীরভাগই ঘুরেফিরে বাণিজ্যের দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করেন।
মন্তব্য নিষ্প্রয়োজনঃ পৃথিবীর প্রায় সব সমাজ ব্যবস্থা, রাষ্ট্র ব্যবস্থা নারী অধিকারকে গুরুত্ব দিয়েছে। কিন্তু প্রায়ই সব পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থায়, সমাজ ব্যবস্থায় বস্তুত আসল কথা হচ্ছে পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে নারীর কর্মক্ষেত্র হচ্ছে রমণীয় কমণীয় হয়ে কড়া মেকাপের প্রলেপ মেখে ফ্রন্টদেস্কে বসে থাকা, কাস্টমার কেয়ার, রিসিপ্সনিস্ট, কোনো কোনো ক্ষেত্রে কন্সালট্যান্সি পর্যন্ত। পুঁজিতন্ত্র নারী মুক্তির তকমা লাগিয়ে, তাদের গৃহবন্দিদশা থেকে বের করে এনে যে আসনে আসীন করেছে বস্তুত নারীর আসন সেটা নয়। নারীর আসন দামী বা কম দামী কোন পণ্যের শরীরে লেপ্টে থাকা লেভেলে রুপের জৌলুশ ছড়ায়ে গ্ল্যামারস রোমান্টিক যৌনাবেদনময়ী ভঙ্গীতে সেঁটে থাকা নয়।
পরিবারের নীতি নির্ধারণী সভায় একটি আসন নারীরও।
সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, সংবিধান প্রণয়নে অংশীদারিত্ব নারীরও। কিন্তু সত্যি হচ্ছে যেসব নারীবাদী সংগঠন আছে (এবং যে কোন কর্মক্ষেত্রে) ঠিক সেখানেও নীতি নির্ধারক হচ্ছেন একজন পুরুষ এবং ফ্রন্টডেস্কে বসে আছেন একটা মেয়ে পুতুল। কেননা পৃথিবী এখন পুঁজিবাদীদের বারতলগত।
সবশেষেঃ সত্য কথা হচ্ছে আমরা পুঁজিবাদী অর্থনীতির বাজে দিক নিয়ে যতই হল্লা চিল্লা করি না কেন, পুঁজিবাদী অর্থনীতি, নিজের জন্য অবশ্যই একটা শক্তিশালী ভীত এবং বিশ্ব অর্থনীতির নিয়ন্তা হিশেবে, চকচকে অবস্থান তৈরী করে নিয়েছে এতোদিনে। আবার পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার বাইরে যে অর্থব্যবস্থাকে আমরা নিজেদের জন্য কল্যাণকর মনে করছি, সেই কাম্য অর্থব্যবস্থা পেতে হলে আমাদের জনগণকে শিক্ষিত এবং সচেতন হতে হবে।
অথচ ততোদিনে হয়ত আমরা পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার ভিন্নরূপ দেখতে পাব, এবং আমরাও হয়ত এর দ্বারা চমকিত হয়ে আশ্বস্থ হয়ে যাবো। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।