গত ২০০১ সালে ৯/১১ এর হামলার পর বুশের নেতৃত্বে আমেরিকা যে নীতিতে আল-কায়েদা রাজনীতি মোকাবিলার পথ ঠাউরেছিল এর বৈশিষ্টগুলো হলঃ ১। খ্রিশ্চান ইভানজলিক ধারায় এই যুদ্ধকে ইসলামের বিরুদ্ধে ক্রিশ্চান ক্রুসেড মনে করে লড়া। ২। “ওয়ার অন টেরর” এর ডাক দেয়া, এই ডাকে বিভিন্ন রাষ্ট্র দেশ জনগণকে পক্ষে টানা। সবাইকে সতর্ক করা যে এটা গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের বিরুদ্ধে আক্রমণ আর এতে সামিল হয়ে মোকাবিলা করার কমন লাইন হলো, ওয়ার অন টেরর, ৩।
“হয় তুমি আমার পক্ষে নইলে তুমি আমার শত্রু” – এই ভিত্তিতে দুনিয়ার অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোকে নিজের নৌকায় উঠতে বাধ্য করা, গ্লোব জুড়ে এক অক্ষশক্তি তৈরি করা, ৪। রাজনৈতিক দিক থেকে নিজের খ্রিশ্চান ইভানজলিক ধারায় ক্রুসেড বলে মনে করলেও সেটা ভিতরে রেখে বাইরে এই যুদ্ধকে আবার সেকুলারিজমের জন্য যুদ্ধ বলে দাবি, প্রচার চালানো। এখানে এই সেকুলারিজমের সোজা মানে হলো, ইসলামের বিরুদ্ধে লড়া। ইসলাম নামে যত রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক প্রকাশ দুনিয়ায় আছে এমন সবকিছুকে শত্রু ঘোষণা দিয়ে লড়া। ইত্যাদি।
আমাদের নিশ্চয় স্মরণ হবে ৯/১১ হামলার সময় আমরা লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় ছিলাম, একটা সংসদ নির্বাচনের অপেক্ষায়। লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচিত কেউ না হলেও তাকে হামলা বিমানের রিফুয়েলিং ও এয়ার স্পেস দিবে বলে আমেরিকার কাছে কবুল করতে হয়েছিল। অর্থাৎ লীগ বা বিএনপির মত কোন একটা রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় না থাকলেও লতিফুরকে তা করতে হয়েছিল। একটা অন্তর্বর্তি ট্রানজিশন সময়ে ছিল বাংলাদেশ। ফলে বাংলাদেশকে ওয়ার অন টেররের নৌকায় তুলে নেয়ার কাজটাতে একটা পজ দিয়ে অপেক্ষা করা আর ঘোষিত হয়ে যাওয়া সংসদ নির্বাচন শেষে দেশের ভোটাররা কোন দলকে ক্ষমতায় আনে সেটা দেখা পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হয়েছিল।
ওয়াশিংটনে ষ্টেট ডিপার্টমেন্ট আর স্থানীয় এমবেসির এই অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় ছিল না। নির্বাচনের ফলাফলে বিএনপি দুই তৃতীয়াংশ আসন নিয়ে ক্ষমতায় আসে। তবু স্থানীয় এমবেসি যে লাইনে আগিয়েছিল সেটা হলো, ইসলামের নাম গন্ধ আছে এমন সব দল বাদ দিয়ে বাকি সবাইকে নিয়ে একটা জাতীয় সরকার কায়েম করা (একা বিএনপির সরকার নয়)। এই ভিত্তিতে বাংলাদেশ ওয়ার অন টেররের নৌকায় উঠুক। প্রেসিডেন্ট বদরুদ্দোজার উদ্যোগ ছিল এটাই।
কিন্তু মোটা দাগে বললে, বিএনপি বুশের নৌকায় উঠা এড়াতে পারে নাই তবে হাসিনার সাথে ক্ষমতা শেয়ার করা আর ইসলামী রাজনীতি সাংস্কৃতিক প্রকাশগুলোকে শত্রু গণ্য করে একটা ভাগ তৈরি করার পরামর্শটা সে মানে নাই, এড়াতে পেরেছিল। আর ওদিকে রাব গঠন, রেনডিশনের কাজে সহায়তা করা, সন্ত্রাস দমন আইন তৈরি, সন্ত্রাস বিরোধী রাজনীতির সাথে লড়ার জন্য রাষ্ট্রকে আকার দিয়ে সাজানো, কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স প্রস্তুতি নেয়া ইত্যাদি সবধরণের প্রস্তুতি নিয়ে এমবেসিকে আপাত আস্থায় নিতে পেরেছিল। বেচারা বদরুদ্দোজার পদত্যাগ এসবেরই প্রতিকি প্রকাশ। এই পুরা প্রক্রিয়া শেষ হবার পর থেকে, ইতোমধ্যেই নির্বাচনের ফলাফলে হতাশ হাসিনা, পশ্চিমের চাহিদাকে ভাল করে বুঝেছিলেন। এই চাহিদা পুরণ করে দিলে তিনি একছত্র প্রার্থী হতে পারেন – পরবর্তী কালগুলোতে তিনি এই নতুন রাজনীতি করা সাব্যস্ত করেছিলেন।
এখান থেকে হাসিনা পশ্চিমের ওয়ার অন টেররের চাহিদা বুঝতে পারার সুবিধা পায়। সিদ্ধান্ত নেয় এই চাহিদা মোতাবেক নিজে ও দলকে ঢেলে সাজাবেন। এক রাজনৈতিক কৌশল তৈরিতে তিনি উদ্বুদ্ধ হন। উদ্দেশ্য উদ্ভুত পরিস্থিতিতে নিজেকে উপযুক্ত ও একমাত্র ক্যান্ডিডেড হিসাবে পশ্চিমের বাজারে হাজির করা, বিক্রির কাজটা করতে পারা। ওয়ার অন টেরর এর একমাত্র ও উপযুক্ত সৈনিক বলে আমেরিকান সমর্থন যোগাড়।
বিএনপির চেয়ে নিজে উপযুক্ত সৈনিক খেদমতগার হিসাবে হাজির করা। এই লক্ষ্যে ২০০২ দুই থেকে ধ্যান জ্ঞান করে হাসিনা কাজ করে গেছেন।
হাসিনার এই কৌশল হলো, ওয়ার অন টেররের আমেরিকান রাজনীতির নৌকায় তিনি পরিপুর্ণ ভাবে উঠবেন। কিন্তু স্থানীয়ভাবে বাংলাদেশে এর নাম দিবেন “যুদ্ধাপরাধের বিচার”। আবার যুদ্ধাপরাধের বিচারে তিনি একনিষ্ঠ -এই ভাব ধরে তিনি এক "স্বাধীনতার চেতনার" রাজনীতি কায়েম করবেন।
হাসিনার এই “স্বাধীনতার চেতনার” রাজনীতির মানে হবে নিজের বাইরের আর সব রাজনীতি, চিন্তা ততপরতার যা কিছু প্রকাশ বাংলাদেশে আছে তাকে এক পপুলার আপরাইজিং (ফ্যাসিজম) এর উন্মত্ততায় তৈরি করে কঠোর নির্মুল (ফিজিক্যাল সহ), দমনের পথে তিনি যাবেন। এছাড়া হাসিনার বুঝের “স্বাধীনতার চেতনার” ভিত্তিতে একমাত্র এক খাঁটি ইতিহাস, বাঙালি জাতিয়তাবাদের খাটি বাঙালি উন্মাদনা তিনি আনবেন। নিজের বাদে সমস্ত ভিন্নভাবে চিন্তাকে রাজাকারি বা রাজাকারের সহযোগী চিন্তা বলে ট্যাগে চিনিয়ে ফিজিক্যাল নির্মুল করবেন। যারা গত পাঁচ-ছয় বছরের বাংলা ব্লগ ট্রেন্ড খেয়াল করেছেন তারা বুঝবেন ওর ফিজিক্যাল নির্মুল আকাঙ্খা ওখানে কিভাবে চর্চা হয়েছে। সেখান থেকে আর এক কদম বাড়িয়ে ধর্ম বা ইসলাম আমাদের সব চিন্তা ততপরতার প্রধান শত্রু এই ধারণা উঠে আছে।
এখান থেকে শুরু হয় আস্তিক-নাস্তিক বিতর্কের ঝড়। এতটুকু তাও সহনীয় ছিল। সব সমাজে নাস্তিকতা থাকে, আমাদের সমাজেও অনেকদিন থেকে আছে। কিন্তু এবারের ফিজিক্যাল নির্মুল আকাঙ্খার কারণে আস্তিক-নাস্তিক ঝগড়া তর্কটা সহজেই নবীকে নিয়ে পর্ণগ্রাফিক চর্চার নতুন ধারার জন্ম দিয়েছে। কারণ এই রাজনীতির অনুমান লাখ দুয়েক রাজাকার ও রাজাকারি বা রাজাকারের সহযোগী বলে ট্যাগ লাগানো যাদের হবে এমন সবাইকে নির্মুল করে দিলে “স্বাধীনতার চেতনার” রাজনীতিকে একছত্র করা যাবে।
নির্মুল ক্লিঞ্জিং-ই মোকাবিলার পথ। এভাবে এক বাংলাদেশ কায়েম করবেন।
কিন্তু হাসিনার এই নতুন রাজনীতিটার বড় দুর্বলতাগুলো হলো, ১। যুদ্ধাপরাধের বিচার এটা তো বড় জোড় একটা ক্রিমিনাল অপরাধের বিচার করা। এটাকে ওয়ার অন টেরর বা পশ্চিমের চোখের সন্ত্রাস দমনের কাজ হিসাবে দেখে মনে হয় এমন আকারে কতটুকু হাজির করতে পারবেন? ২।
জামাত একটা কনষ্টিটিউশনাল লিবারাল ইসলামী নির্বাচনমুখী দল (বাস্তবেও তাই এটা সৌদি রাজতন্ত্রের পক্ষে স্থানীয় প্রভাব তৈরির দল, এছাড়া সমাজের মধ্যবিত্ত এক অংশের আশা আকাঙ্খার দল)। একে একটা সন্ত্রাসী দল হিসাবে হাজির করবেন কি করে? জামাত যতটুকু ত্রাস সৃষ্ঠি করার ক্ষমতা রাখে তা অন্য দুই প্রধান পার্লামেন্টারী দল আওয়ামী বা বিএনপির চাপাতি, পিস্তলে ত্রাস সৃষ্টি করতে পারার মতই। কিন্তু একটা পার্লামেন্টারী আইনী রাজনীতিক দলকে সন্ত্রাসী দল বলে হাজির করাতে গেলে অন্ততপক্ষে তাকে নিষিদ্ধ ও গোপন সংগঠন বলে হাজির করাতে হবে। যেটা খুব সহজ কাজ নয়। ৩।
বাংলাদেশে জামাতই একমাত্র ইসলামী দল নয়। যারা আফগানিস্তান ফিরত এরা কেউ জামাত রাজনীতি করে না, কখনও করে নাই। আবার মওদুদির রাজনৈতিক চিন্তা বলপ্রয়োগে ক্ষমতা দখলের নয়। বরং ক্যাডার ভিত্তিক রেজিমেন্টেড সৎ চরিত্রের মানুষ গড়ে কনষ্টিটিউশনাল নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার দল। তিনি মনে করতেন রাষ্ট্র ডিরেইলড হয়ে যায়, সৎ চরিত্রের লোক না থাকার জন্য।
সমস্যাটা নৈতিকতার। কিন্তু ৭২ সালের পর মওদুদি বেচে থাকতেই নিজের পুরানা রাজনীতিতে তিনিই আর থাকেননি। যে কোন কারণেই হোক এটা সৌদি রাজতন্ত্রের পররাষ্ট্র উইং – এর রাজনীতিক প্রভাব তৈরি করার রাজনীতি করতে শুরু করেন। এছাড়া ১৯৭৯ সালে ইরানী বিপ্লবের পর নিজসহ অন্য দেশে এর রেডিক্যাল আঁচ প্রভাব থেকে বাচানো কাজটা করতে সৌদি রাজতন্ত্রের কাছে খুবই গুরুত্বপুর্ণ হয়ে উঠেছিল জামাত। সুন্নী প্রধান বাংলাদেশে সৌদি রাজতন্ত্রকে সেই সার্ভিস জামাত দিয়েছে।
এই সময়ে জামাতের ভুমিকা আরও সাক্ষ্য দেয় যে, যে কোন ধরণের রেডিক্যাল ইসলামী রাজনীতি জামাতের লক্ষ্য নয়, অরুচি। বরং রাডিক্যাল রাজনীতি যাতে না জেগে উঠে বরং এরই খেদমতগার হলো জামাত।
হাসিনার নতুন রাজনীতিটার এসব বড় দুর্বলতাগুলো পুরণ করতে সবচেয়ে বড় ভুমিকা রাখেন শাহরিয়ার কবির ও তার নির্মুলের রাজনীতি। এটাকে হাসিনার চিন্তার সাথে শাহরিয়ারের রাজনীতির পারফেক্ট ম্যাচ মেকিং বলা যায়। হাসিনার নতুন কৌশল্টাকে শাহরিয়ার কবির সবচেয়ে পছন্দ করেছিলেন।
সেই ২০০২ সাল থেকে নির্মুলের রাজনীতি ও কাজ নিরলসভাবে করে যাচ্ছিলেন তিনি। একাজে তিনি নতুন শত্রুর যে ভাগটা তৈরি করেন তা হলো, ব্রড হেডলাইনে ইসলাম আর তার প্রকাশ মানেই হলো জামাত। এভাবে কি তিনি করেছিলেন এবং কেন তা পেরেছিলেন এর তিনটা কারণ উল্লেখ করা যায়।
১। বাংলাদেশে আলকায়েদা বা তালেবানদের মত ইসলামী রাজনীতি মানেই এর সোল এজেন্ট, একমাত্র সম্ভাব্য দল হলো জামাত - এই মিথ্যা ধারণা সমাজে প্রতিষ্ঠা করা।
পরিকল্পিতভাবে তিনি একাজ করেছেন। এছাড়া আর একটা গুরুত্বপুর্ণ দিক হলো জামাত মানেই বাংলাদেশে ইসলামী রাজনীতির সব ধরণের ধারার উতস ও প্রতীক। এভাবে বয়ান তৈরির সুযোগ ও সম্ভব হয়েছিল কারণ বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত তো বটেই কমিউনিষ্টরাও দুনিয়ায় বা বাংলাদেশের ইসলামী ধারাগুলোর মধ্যে কোনটার সাথে কোনটার মৌলিক রাজনৈতিক তফাত কি ইস্যুতে এর কোন খবর তারা জানে না, রাখার দরকারও মনে করে না। ব্রড হেডলাইন হলো ইসলাম আর তার প্রকাশ মানেই হলো জামাত এটুকু জানলেই চলে। এটাই শাহরিয়ারকে তার বয়ান তৈরি করতে সহায়তা করেছে।
২। ১৯৭১ সালে জামাতের রাজনীতি আর একালের তালেবান রাজনীতির কোন মিল থাকুক আর নাই থাকুক জামাতের ৭১ সালের ভুমিকাই হলো সে যে একটা তালেবানের মত “সন্ত্রাসী” দল এর প্রমাণ। এই জবরদস্তি শাহরিয়ারের দরকার জামাতের ৭১ এর ভুমিকা নিয়ে জনগনের মনে যে সেন্টিমেন্ট আছে তা ব্যবহার করে সাধারণভাবে সব ইসলামী রাজনীতিকে দানব হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা। ৩। আফগান ফেরতদের দল, জেওএমবির স্বল্পকালীন উত্থান (২০০৫), কিন্তু শহুরে মধ্যবিত্তকে ভয় দেখানোর মত উত্থান, জামাতের রাজনীতির সাথে জেএমবির রাজনীতির সাথে জামাতের মিল না থাকলেও মধ্যবিত্ত, সেকুলার, কমিউনিষ্ট আর মিডিয়ার চোখে এরা জামাত বলে প্রতিষ্ঠা করে দেয়া হয়েছিল।
কিন্তু সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হলো, যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রসঙ্গটা আর বিচার মানে কোন ক্রিমিনাল অপরাধের বিচার থাকল না। বিচারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকল না। বয়ানের পাটাতন একেবারে বদলে গিয়ে হয়ে দাড়ালো, ইসলাম নামে যত রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক প্রকাশ বাংলাদেশে আছে এমন সবকিছুর ফিজিক্যাল নির্মুল – এই অর্থ হয়ে দাড়াল। একাকার করা এই বয়ানে এক দড়িতে ফাঁসি হয়ে গেল “বিচার” আর ইসলামের।
এতে দ্বিতীয় আর এক বিপদ তৈরি হলো।
ধরা যাক ঠিক বিচার নয়, ইসলাম নামে যত রাজনৈতিক,সাংস্কৃতিক প্রকাশ আছে সেগুলোকেই মোকাবিলা করতে চান শাহরিয়ার ও তার নির্মুল কমিটি। তাতে একটু না হয় যুদ্ধাপরাধের বিচার কথাটা ঢাল হিসাবেই ব্যবহারই তিনি করেছেন। এভাবেই যদি ধরি তো সেক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো, ইসলাম নামে সব রাজনৈতিক,সাংস্কৃতিক প্রকাশগুলোর মোকাবিলা কি নির্মুল ক্লিনজিং করে করা যায়, না সম্ভব? কাজটা কি নির্মুল ক্লিনজিং এর? যার যার মাথায়
এসব চিন্তা আছে এমন লোকেদের এক এক করে ধরে মাথা কেটে ফেলার? মোটেই না। চিন্তার মোকাবিলা একমাত্র ওর চেয়ে শক্ত চিন্তা দিয়েই করার কাজ, করা সম্ভব। নইলে তা পরাস্ত হবার কোন কারণ নাই।
অর্থাৎ চিন্তা বা ভাবাদর্শগত পরাস্ত, ফিজিক্যাল মানুষকে নির্মুল করা নয়। চিন্তা ভাবাদর্শগত একটা বিষয়কে খুনোখুনি নির্মুল ক্লিঞ্জিং করে সস্তায় সেরে ফেলতে চেয়েছেন শাহরয়ার। গত চার-পাঁচ বছর ধরে হাসিনা আর নির্মুল কমিটির শাহরিয়ার, মুনতাসির ইত্যাদিরা মুখে যুদ্ধাপরাধের বিচার বলে গেছেন আর মানুষের মনে সফল্ভাবে ঢুকিয়েছেন এক ভয়ঙ্কর নির্মুল ক্লিঞ্জিং আকাঙ্খা। এক উন্মত্ততা।
হাসিনা আর শাহরিয়ারের এই জয়েন্ট বিপদজনক প্রজেক্টের খবর বাংলাদেশের অনেকের মত আমরা কোন খোজ খবর রাখিনি।
বলা বাহুল্য হাসিনার সাথে শাহরিয়ারের এই মহামিলন প্রজেক্টের অভিমুখ ও পরিণতি হলো হাসিনার কারজাই হওয়া। আর প্রতিক্রিয়ায় স্বভাবতই এটা তালেবান রাজনীতিকে দাওয়াত দিয়ে আনা হবে বলাই বাহুল্য। শাহরিয়ার ইসলাম নামে যত রাজনৈতিক,সাংস্কৃতিক প্রকাশ বাংলাদেশে আছে আজীবন তা নির্মুলে সমাধান হিসাবেই দেখেছেন। তার সাফল্য হলো, এই উন্মাদনা তিনি আজ সমাজে ভিত্তি দিতে পেরেছেন। এখন বলে বুঝিয়ে এদের কাউকে বিরত করা যাবে মনে হয় না কারণ তারা রোখ উন্মাদনা তুলে ফেলেছে।
তাদের অনুমানে দুলাখ নির্মুলের পথে যাবার জন্য মন, ইমান বেধে ফেলেছেন জানি। আমি কেবল দেখাবার চেষ্টা করছি হাসিনা শাহরিয়ার এই কাজ করতে গিয়ে গ্লোবাল ও লোকাল শ্রেণি ও স্বার্থ সমাবেশের দিকটাকে,প্রকাশিত ইচ্ছা আকাঙ্খাগুলোকে। কিন্তু একটা দিক পরিস্কার করে রাখা দরকার। হাসিনা, শাহরিয়ার যুদ্ধাপরাধের বিচার ইস্যুটাকে নির্মুল বলে উন্মাদনায় গ্লোবাল লোকাল শ্রেণি, স্বার্থ সমাবেশে ঘটাবার রাজনীতি করতে চাইছেন বলা মানে এই নয় যে যুদ্ধাপরাধের বিচার ইস্যুটা বাংলাদেশে জন্য কোন ইস্যু নয়। বরং এটা বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা বড় অমীমাংসিত ইস্যু।
একটা বড় ক্রিমিনাল অপরাধের বিচার - যেটা বিশ্বাসযোগ্য আইনী প্রক্রিয়া ফয়সালা না করলে সবার নানান পেটি স্বার্থে এটা সবসময় বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঘুটি হিসাবে ব্যবহৃত হতেই থাকবে। যেমন এখানে হচ্ছে।
কিন্তু তবু শেষ বিচারে হাসিনা আর শাহরিয়ারের রাজনৈতিক আকাঙ্খা এক নয়। হাসিনার পথ ও আকাঙ্খা হলো যে রাজনৈতিক লাইন সে বুকে ধরে গত দশ বছর এগিয়েছে তা দিয়ে ২০২১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতা থাকা, ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখা - এই কাজে ব্যবহার। এই বিচারে শাহরিয়ার কিন্তু আসল একনিষ্ঠ সৈনিক।
তাঁর ভাষার “জঙ্গি মৌলবাদ” তিনি খতম নির্মুলের পথেই সমাধান করতে চান। এজন্য তিনি VOA এর মাধ্যমে আমেরিকার কাছে হস্তক্ষেপের সহায়তা চেয়েছেন। হাসিনা যেমন, পশ্চিমের সমর্থন যোগাড়ে তাদের একনিষ্ঠ “ওয়ার অন টেররের” খেদমতগার হয়ে বিনিময়ে একচেটিয়া ক্ষমতায় থাকার কাজে এটাকে ব্যবহার করতে চান, নিজস্ব “স্বাধীনতার চেতনার” বাইরে বাকি সবাইকে মেরে কেটে সাফ করতে চান – শাহরিয়ার চান একই “ওয়ার অন টেররের” খেদমতগার হওয়া (এই পর্যন্ত হাসিনার সাথে তার মিল) কিন্তু বিনিময়ে “জঙ্গি মৌলবাদ” তিনি খতম নির্মুলের পথেই সমাধান চান - এই কাজে তিনি আমেরিকার সমর্থন, লজিষ্টিক, সৈন্য সব কিছু চান। এখানে তিনি হাসিনার থেকে আলাদা। এখানে পাঠক লক্ষ্য করবেন, শাহরিয়ার কিন্তু আর যুদ্ধাপরাধের বিচারের কথা বলছেন না।
বলছেন ওয়ার অন টেররের খাঁটি লাইনে “জঙ্গি ও মৌলবাদ দমন” করতে চাইছেন। এর মানে বিষয়টা আর হাহরিয়ারের কাছে স্পষ্টত আদালত পাড়ার বিষয় নয়, যুদ্ধের মাঠে ফিজিক্যাল নির্মুল করে মোকাবিলা। তাই তিনি প্রকাশ্যে সাক্ষ্যাতকারে দাবি করছেন, “জঙ্গি মৌলবাদ দমনে আমেরিকার সহায়তা প্রয়োজন”। কিন্তু এখন তিনি এই সাক্ষ্যাতকার দিয়ে প্রকাশ্যে চিৎকার করে জানাচ্ছেন কেন? এতদিন আড়ালে যেভাবে চলছিল সেই পর্দা উঠিয়ে ফেললেন কেন?
কারণ হাসিনা আর শাহরিয়ার - প্রতিকি নামের দুই রাজনৈতিক আকাঙ্খা হাত ধরাধরি করে থাকলেও একটা সুক্ষ ফারাক ছিল তা আমরা উপরে দেখিয়েছি। এই ফারাক থাকা সত্ত্বেও এতদিন তাদের মধ্যে একটা সহাবস্থান ছিল, দিনকে দিন সেটা অসহনীয় হয়ে উঠেছে।
শাহরিয়ারের নির্মুল ধারা মনে করছে হাসিনা যথেষ্ঠ কঠোর পথে যাচ্ছেন না। কি সেই কঠোর পথ? সুনির্দিষ্ট করে বললে, সন্ত্রাস দমন আইন ২০০৯ ব্যবহার করে দানব হয়ে মাঠে নেমে পড়া, দাবড়ানো, খুনোখুনি। জিতি অথবা মরি যায়গায় পরিস্থিতি নিয়ে যাওয়া। এখানে একটা কথা মনে রাখতে হবে হাসিনা নির্বাহি ক্ষমতায় আছেন আর শাহরিয়ার আছেন একই আদর্শে, চিন্তায় রাজনৈতিক লাইনে কিন্তু বাইরে। ক্ষমতায় থাকার ঠেলা, হ্যাপার বিপদ শাহরিয়ারের বুঝের বাইরে।
পোলাপান অনেক কিছুই আবদার করে কিন্তু বাবাকে টাকা কামিয়ে, সেই কামানো অনুপাতে ব্যয় করে, কোন দোকান থেকে কখন কোন পথে গিয়ে, কি দামে কিনে আনতে হয় এসব ভেবে চিন্তে এরপর আবদার কতক অংশ পুর্ণ করাতে পারে কতক অংশ পারে না। পোলাপানের আবদারকে ভিত্তি মেনে বাবার চলা অসম্ভব। সন্ত্রাস দমন আইন ২০০৯ নিয়ে মাঠে নেমে পড়া মানে কি এর অর্থ তাতপর্য পরিণতি হাসিনা না বুঝে পা ফেলতে পারে না। বিশেষত আমেরিকাকে নিজের সিদ্ধান্তের পক্ষে সায় না নিয়ে পা ফেলে লাঠি হাকাতে পারেন না হাসিনা। দুইবার যিনি ক্ষমতায় ছিলেন, ক্ষমতা নিয়ে নাড়াচাড়া করেছেন করছেন তিনি কি এমন আহাম্মক হতে পারেন? কারণ সন্ত্রাস দমন আইন দিয়ে নির্মুল ক্লিনজিংয়ে্র লাইনে ঝাপিয়ে পরা মানে শুধু পরিস্থিতি লেজে গোবরে না, শুধু ক্ষমতা চ্যুত হওয়াও না, নিজের জান বাচানো সঙ্গিন হয়ে যেতে পারে।
আন্তর্জাতিক সমর্থন, লজিষ্টিক, রসদের সরবরাহ পাবার কথা নাইবা তুললাম।
হাসিনার দিক থেকে তার স্ববিরোধ হলো, তিনি সচেতনে নির্মুল ক্লিনজিংয়ের ধারণা গত চার-পাঁচ বছর ধরে তাতিয়েছেন। অ-আওয়ামী লীগার, সেকুলারিষ্ট, বামপন্থি, জামাত খুন করার জন্য অবশেশড লোক -সকলকে এক জিঘাংসার উন্মাদনায় উন্মত্ত করেছেন। তিনি এসবই করেছেন এই উন্মাদনাকে ট্রানশ্লেট করে নিজের ক্ষমতা একছত্র চিরদিনের করার জন্য একে ব্যবহার করা। অন্যদিকে শাহরিয়ার চাইছেন, উন্মাদনাকে আক্ষরিক অর্থেই উন্মত্ত ব্যবহারে নির্মুল ক্লিনজিংয়ের কাজ করতে।
এজন্য তিনি পরিস্কার করেই এখন বলছেন আদালতে কোন ‘বিচার’ এমনকি শাহবাগের মত ফাঁসি ফাঁসিও না, নির্মুল ক্লিনজিং - “জঙ্গি মৌলবাদ দমন” তিনি চান। একাজে “আমেরিকার সহায়তা প্রয়োজন”। শাহরিয়ারের পোলাপানি আবদার আর হাসিনার মধ্যে যে তীব্য সংঘাত চলছে এর প্রকাশ ঘটেছিল সপ্তাহ তিনেক আগে ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভির এক টক শো তে। ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলাম সন্ত্রাস দমন আইন ২০০৯ এর প্রয়োগের পক্ষে আর বিপক্ষে ছিলেন এটর্নি জেনারেল মাহবুব। ওখানে মাহবুব বারবার আর্গু করছিলেন পরিস্থিতিকে আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে আর ব্যারিষ্টার আমিরুল ততই বারবার আর্গু করছিলেন সন্ত্রাস দমন আইন ২০০৯ ব্যবহার করে ঝাপিয়ে পড়তে।
শাহরিয়ার ঠিকই বুঝেছেন সন্ত্রাস দমন আইন ২০০৯ এই আইনটা বাংলাদেশের হলেও এটা আমেরিকার, আমেরিকার আগ্রহে ও ষ্টেট ডিপার্টমেন্টে পলিসি গাইড লাইনে এটা তৈরি । এই আইন ব্যবহার করে নির্মুল ক্লিনজিং এর পথে যেতে গেলে আমেরিকার আশির্বাদ লাগবে। কিন্তু শাহরিয়ার, মুনতাসির বা আমিরুল সেটা বেখবর ফলে পোলাপানি আচরণ করছেন, কান্নকাটি করছেন, আমেরিকা কেন আফগানিস্থান বা ইরাকের মত বাংলাদেশেও একটা নতুন তালেবান মোকাবিলার ফ্রন্ট খোলার জন্য তৈরি হচ্ছে না।
সন্ত্রাস দমন আইন - এই আইন কোথায় ব্যবহার করলে এর সব একটিভিটি রিপোর্ট আমেরিকাকে দিতে হবে। কেন? সেটা শুধু আমাদের সাম্রাজ্যবাদ বুঝের সহজ বুঝা ছাড়াও আরও অনেক কিছু দিক আছে সেদিকগুলো বুঝতে হবে।
। আমেরিকাকে না জানিয়ে হাসিনা যদি এই আইন একার বুদ্ধিতে ব্যবহার করে তবে সে কাজের বিরুদ্ধে প্রতিরোধও গড়ে উঠবে। সেটা একটা তালেবান পরিস্থিতি তৈরি করবে যেটার অভিমুখ হবে এন্টি-আমেরিকান, বাংলাদেশের সব পশ্চিমা ইনষ্টলেশন এর টার্গেট হবে। অল-আউট একটা যুদ্ধের ফ্রন্ট ওপেন করলে যেমন ঘটে। শুধু তাই নয়, এর উপচে পড়া প্রতিক্রিয়া কেবল বাংলাদেশে না, আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, সারা ভারতের কেন্দ্রীয় ক্ষমতা, বার্মা এই সারা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়বে।
আমেরিকার জন্য নতুন ফ্রন্ট খোলার অবস্হা হবে। ফলে সন্ত্রাস দমন আইন ২০০৯ দেখতে বাংলাদেশের মনে হলেও এর প্রয়োগ, কনসিকোয়েন্স প্রভাব শতভাগ রিজিওনাল ও গ্লোবাল। যারা দুলাখ জামাত ও রাজাকারি ট্যাগ লাগানো লোক মেরে ক্লিনজিং নির্মুলের মধ্যে ঘটনাকে দেখছেন এদেরকে পোলাপান বললে কম বলা হয়। আমেরিকা পোলাপান হলে সারা দুনিয়ার উপর সাম্রাজ্যের ছরি ঘুরাতে পারত না। তাহলে কি বলতে চাচ্ছি শাহরিয়ারের লাইনে “জঙ্গি ও মৌলবাদ দমন” আমেরিকাকে ডাকার চেষ্টাটা ভুয়া, এতে কিছু হবে না, কোন বিপদ নাই?
না ভুয়া বলছি না।
বলতে পারলে ভাল লাগত। গ্রাউন্ড রিয়েলিটি হলো, যেটা বলছিলাম - আওয়ামি লীগ, অ-আওয়ামী লীগার, সেকুলারিষ্ট, বামপন্থি, জামাত খুন করার জন্য অবশেশড লোক -সকলকে এক জিঘাংসার উন্মাদনায় উন্মত্ত হয়ে আছে। গত চার-পাঁচ বছর ধরে তাতানোর ফলাফল এটা। এটা পটেনশিয়াল, যে কোন দিকে এর মোড় নেবার সম্ভাবনা এতে আছে। হাসিনা একে তার নির্বাচনী বা ক্ষমতা লাভালাভের কাজে পরিণতি টানার চেষ্টা করেছেন এবং পরাজিত হয়েছে।
ফলে তৈরি উন্মত্ততা টা কিছু ঘটিয়ে ফেলার পটেনশিয়াল হাসিনা শীতল করতে পারেনি। ওদিকে শাহরিয়ার, মুনতাসির বা আমিরুল এদের নির্মুলের রাজনীতিক আকাঙ্খাটাকে জীবিত সরব আছে, হচ্ছে। হাসিনার টালটিফালটি দেখে শাহরিয়ার সরাসরি আমেরিকার কাছে আহবান নিয়ে গেছে। রাজনীতির এই ধারাটা এই উন্মত্ততাকে উপযুক্তভাবে ক্যারিয়ার হতে পারে। এই হোল পটেনশিয়াল বিপদ তৈরি হয়ে থাকার দিক।
ওদিকে আমেরিকাও কোন নতুন ফ্রন্ট খুলার কোন তাগিদ, পরিকল্পনা ও অর্থ খরচের সামর্থ এসবের কোনটাই নাই। কিন্তু উন্মত্ততার লাইন প্রথম ঝাপ্টায় ইতোমধ্যে দেড়শ লোক মেরে ফেলেছে, কয়েক হাজার হাসপাতালে কাতরাচ্ছে। প্রথম দফার রক্তারক্তির পর উভয় পক্ষই সমাজকে স্ব স্ব পক্ষীয় সমাবেশ তৈরির জন্য সময় নিচ্ছে। কোন পক্ষই টোন ডাউন করবে এমন বাস্তবতা নাই। কিছু ঘটাবার সক্ষমতা পটেনশিয়াল উভয় পক্ষেই।
এটাই অনিচ্ছুক হাসিনা আর অনিচ্ছুক আমেরিকাকে যুদ্ধের ফ্রন্ট খুলার বাস্তবতায় টেনে নিতে পারে – এই পটেনশিয়াল। একটা লোকাল ঘটনা রিজিওনাল, গ্লোবাল হয়ে উঠতে পারে। এর তাতক্ষনিক প্রতিক্রিয়া আমেরিকাকে কিছু তো করতে হবে। মেরিন পাঠানোর অবস্থা তার নাই। খরুচে।
এখনকার কম খরুচে নুন্যতম কিছু করতে হলে সে ব্যবস্থা হলো, ড্রোন।
এসব বিবেচনায় প্রতিকী ভাবে ড্রোনের কথা এসেছে। কিন্তু মুল বিষয় হলো, যে পটেনশিয়াল পরিস্থিতি তৈরি হয়ে আছে তা যে কোন দিকে মোড় নেবার ক্ষমতা রাখে। এখন এই সক্ষমতা আমাদের কোথায় নিয়ে যায় তা দেখার অপেক্ষায় আমরা। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।