আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

"নাকডাকা" অসচেতনতায় বড়মাপের অসুস্থতা।

মানুষ কেন নাক ডাকে? যখন কারও নাক ডাকে, তখন তাকে লক্ষ্য করলে দুটো জিনিস দেখতে পাওয়া যায়। যার নাক ডাকছে সে চিত হয়ে শুয়ে আছে আর গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। গভীর ঘুমের সময় শ্বাস-প্রশ্বাস খুব গভীর হয়। একে বলে গভীর শ্বাস। চিত হয়ে থাকার সময় আমাদের জিভ গলবিলের ভিতর ঠেলে যায়।

ফলে বাতাসের পথ সংকীর্ণ হয়ে আসে। গভীরভাবে শ্বাস নেওয়ার সময় বাতাস ওই সংকীর্ণ পথে ঢুকতে গিয়ে বাধা পায়। ফলে বাতাসের বেগ আরও বেড়ে যায়। তালুর পিছনে যে নরম তালু রয়েছে, বাতাসের চাপে তাতে কাঁপন হয়। এর ফলে যে শব্দের সৃষ্টি হয়, তাকেই আমরা নাসিকা গর্জন বা নাকডাকা বলে থাকি।

কেউ নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে_ভাবলেই মনে হবে আহ্ লোকটা কী শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। কিন্তু নাকডাকা মোটেই কোনো শান্তির লক্ষণ নয়। নাকডাকার পেছনে বেশ কিছু অসুখ দায়ী। এর মধ্যে আছে প্রাণঘাতী অসুখও। আর যদি বিছানা কারো সঙ্গে শেয়ার করতে হয়, তাহলে নাকডাকার কারণে ওই সঙ্গীর ঘুমের বারোটা বেজে যেতে পারে।

পাশ্চাত্যে অনেক বিয়ে ভেঙে যায় শুধু নাকডাকার কারণে। আমার স্কুল কলেজ জীবনের সহপাঠি ঘনিষ্ট বন্ধু মনির যে এখন আমার রুমমেট। তার নাকডাকার পরিমান এত বেশী যে আমার ঘুম আসতে খুবই কষ্ট হয়। গভীর সম্পর্কের কারনে কিছু বলতে ও পারি না। অনেকটা সহ্য করেই গভীর রাত পর্যন্ত জেগে কমপিউটার নিয়ে বসে থাকি।

কয়েক দিন আগে তাকে নিয়ে ডাঃ কাছে গিয়েছিলাম ডাঃ কোন ঔষধ না দিয়ে কিছু পরামর্শ দেয়। কিন্ত পরামর্শে কোন কাজ হচ্ছে না। বরং আমার বন্ধু আমার জন্য কানের তুলি নিয়ে আসে যাতে ওর নাক ডাকার আওয়াজ আমার কানে না আসে। তারপরও কাজ হচ্ছে না। তার নাক ডাকার আওয়াজ এত বেশী যে তুলি ব্যবহারের পর হেড ফোন লাগিয়ে গান শুনলেও আওয়াজ আমার কানে আসে।

তবে এই পদ্ধতিতে আমার বন্ধুর কোন উপকার না হলেও আমার কিছু উপকার হয়েছে অন্য কোন আওয়াজ না আসায় আমার সকাল বেলার ঘুম ভাল হয়। যে অসুখে নাকডাকে সাধারণত মুটিয়ে গেলে, নাকের সাইনাসে সমস্যা থাকলে, নাকে পলিপ থাকলে কিংবা অ্যালার্জির কারণে মানুষ যখন ঘুমিয়ে যায় তখন শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় বিশেষ শব্দ হয়। এ শব্দই নাকডাকা। তাছাড়া স্লিপ অ্যাপনিয়া বা ঘুমের মধ্যে নিঃশ্বাস সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে যাওয়া নামের একটি অসুখের কারণে বহু মানুষ নাকডাকে। এ অসুখের কারণে শ্বাস বন্ধ হয়ে ঘুমের মধ্যে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

জীবনের কোন একটা পর্যায়ে কমবেশি সবাই নাক ডাকায় অভ্যস্ত থাকে৷ বিশেষ করে শরীরের ওজন যাদের মাত্রাতিরিক্ত তাদের বেলায় এই প্রবণতা একটু বেশি৷ গবেষকদের মতে, পুরুষদের মধ্যে ৪০ এবং মহিলাদের মধ্যে ২৪ ভাগই নাক ডাকায় অভ্যস্ত৷ ঘুমের ঘোরে নাক ডাকলেও এদের কেউই তা টের পান না কিংবা টের পেলেও দোষের কিছু মনে করেন না তারা৷ কিন্তু আশেপাশে অবস্থানকারীদের এটি মহাবিরক্তির কারণ৷ স্বামীর নাকডাকা অভ্যাস সহ্য করতে না পেরে আলাদা বসবাস এমনকি বিয়ে বিচ্ছেদের মতো ঘটনার নজিরও চোখে পড়ে৷ চোখে পড়ে এর উল্টোটিও৷ এসবের কথা বাদ দিয়েই বিজ্ঞানীরা শুনিয়েছেন এ সংক্রান্ত এক ভয়ংকর তথ্য৷ তাদের মতে, উচ্চগ্রামে নাকডাকা অভ্যাসের সঙ্গে রয়েছে হৃদরোগ ও স্ট্রোকের নিবিড় যোগসূত্র৷ হাঙ্গেরির একদল বিজ্ঞানী সম্প্রতি ১২ হাজার নারী-পুরুষের সাক্ষাতকার গ্রহণ করেন৷ এ সময় তাদের কাছে নাকডাকা অভ্যাস সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে বেরিয়ে আসে ভয়ংকর সব তথ্য৷ প্রাপ্ত তথ্য ও উপাত্তের উপর নির্ভর করে বিজ্ঞানীরা একটি নিবন্ধ রচনা করেন৷ ঐ নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়, শরীরের ওজন মাত্রাতিরিক্ত হলে নাকডাকার প্রবণতা বৃদ্ধি পেতে পারে৷ আর এ কারণেই ঘুমের ঘোরে যারা নাকডাকায় অভ্যস্ত অন্যদের তুলনায় তাদের হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি থাকে ৩৪ ভাগ বেশি৷ পক্ষান্তরে, সাধারণ লোকের চেয়ে তাদের স্ট্রোকের ঝুঁকি থাকে ৬৭ ভাগ৷ গবেষকদের ভাষায়, উচ্চগ্রামে নাকডাকা ও শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলার প্রবণতা থেকে সহজেই হৃদরোগ সনাক্ত করা হয়৷ তাদের মতে, একেবারে নীরবে যারা শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ-বর্জন করেন তাদের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি একেবারেই কম৷ বিজ্ঞান বলছে, ঘুমের মধ্যে নাক ডাকা মানেই অসুস্থতা, তা কিন্তু নয়৷ বার্লিনের শারিটে ইউনিভার্সিটির স্লিপ মেডিসিন বিভাগের প্রধান গবেষক আলেকজান্ডার ব্লাউ বেশ দীর্ঘ গবেষণার পর জানিয়েছেন, অনেক ক্ষেত্রেই নাকডাকা কোন একটা অসুস্থতার লক্ষণ, কিন্তু সব ক্ষেত্রে সেটা বাস্ততবসম্মত নয়। কিন্তু ঘুমের মধ্যে নাক ডাকার কারণ সম্পর্কে জার্মান গবেষণাকেন্দ্র ডিজিএসএম- এর ইয়ান লোয়লার বলছেন, নাকের হাড়ের গঠনে বিচ্যুতি থেকে ঘুমোতে যাওয়ার আগে মদ্যপান, নাক ডাকার কারণ একটি নয় অনেকগুলো। সেগুলোর ব্যাখ্যা দিয়ে তাঁর মন্তব্য, যে সমস্ত ব্যক্তির নাক ডাকে বিস্তর পরিমাণে, তাঁদের কিন্তু সতর্ক হওয়া দরকার, কারণ নাক ডাকা বড়মাপের অসুস্থতা ডেকে আনতে পারে। ডিজিএসএম এর গবেষণা বলছে, যে সব মানুষ ঘুমের মধ্যে বিস্তর পরিমাণে নাক ডাকায় ভোগেন, তাঁদের চিকিৎসার পরিভাষায় বলা হয়, ম্যালিগন্যান্ট স্নোরিং। বিশদভাবে বললে, অবস্ট্রাক্টিভ স্লিপ আপনিয়া (Obstructive Sleep Apnea) বা সংক্ষেপে ওএসএ।

যারা এই ওএসএ-র শিকার তাঁদের অনেকেই ভোগেন হার্টের সমস্যায়। এদের মধ্যে কারও যদি থাকে উচ্চ রক্তচাপ কিংবা ডায়াবেটিসের মত রোগ, তাহলে সমস্যা আরও বেড়ে যায়। সেক্ষেত্রে ঘুমের মধ্যে নাক ডাকতে ডাকতে অনেক সময় ত্রিশ সেকেন্ড পর্যন্ত কোন অক্সিজেন শরীরে পৌঁছায় না সেই ব্যক্তির। রক্তে কার্বনের পরিমাণ বাড়তে থাকে৷ সেটা তো মস্ত এক জটিলতা। ডিজিএসএম তাদের গবেষণায় বলেছেন, যারা এই ওএসএ তে ভুগছেন, সচরাচর সারারাত নাক ডেকে ঘুমিয়েও পরের দিনটা তাঁরা অবসন্ন বোধ করেন, ঝিমুনি আসে, কাজে ছন্দ পান না।

তার কারণটাও ওই রক্তে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। এক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াটা তাঁদের জন্য জরুরি। দ্রুত এই সমস্যা দূর করার উপায়ও বলেছে ডিজিএসএম। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমোতে যাওয়াটা জরুরি। ঘুমের আগে কোন অবস্থাতেই অ্যালকোহল পান না করা দরকার এবং সেইসঙ্গে চিকিৎসা তো অবশ্যই।

নিজস্ব চিকিৎসা পদ্ধতি: * চিৎ বা উপুড় হয়ে না ঘুমিয়ে কাত হয়ে ঘুমান। * মুটিয়ে গিয়ে থাকলে ওজন কমান। * নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞকে দেখিয়ে নিশ্চিত হোন নাকে কোনো অসুখ আছে কি না। স্লিপ অ্যাপনিয়া বা ঘুমের মধ্যে শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হওয়ার রোগ আছে কি না, তা দেখান। দেশের বেসরকারি কয়েকটি হাসপাতালে এখন এ রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা হচ্ছে।

এর আগে যদিও বিজ্ঞানীরা সনাক্ত করেছিলেন যে, নাকডাকা অভ্যাসের সঙ্গে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে-এবারই হাঙ্গেরীয় বিজ্ঞানীরা এর সঙ্গে মুটিয়ে যাওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত হলেন৷ তবে আশার বাণীও শুনিয়েছেন বিজ্ঞানীরা৷ তারা জানান, পুরুষদের নাকডাকার প্রবণতা-৭০ বছর বয়সের পর ধীরে ধীরে কমতে থাকে৷ তাদের মতে, নাকডাকার মতো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা এড়াতে শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিত৷ এজন্য নিয়মিত ব্যায়ামের বিকল্প নেই৷ পাশাপাশি সুষম খাদ্যাভ্যাসও গড়ে তোলা জরুরী৷ তবে নাকডাকা প্রবণতা পরিহার করা যেতে পারে৷সুতরাং, আর হাসাহাসি নয়, নাকডাকা নিয়ে সচেতনতা বাড়ানো উচিত। নাক ডাকা থেকে অনেক রোগেরও সৃষ্টি হতে পারে। তাই ভালো করে ঘুমোতে চান, সুস্থ হয়ে বাঁচতে চান, তো নাকডাকা আগে কমান। তথ্যসূত্র: ∙বাংলাটাইমস টুয়েন্টিফোর ∙ডা. সাঈদা ফাতেমা ∙গবেষণা, স্বাস্থ্য ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.