আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দেখা থেকে লেখা- স্টেট অফ কুয়েতে দুইদিন

আমি এখন কুয়েতে, ভ্রমণে নয় ব্যবসা ও ব্যক্তিগত কাজে আমাকে আসতে হয়েছে। যদিও কুয়েতে আসা সহজ না সবার জন্য এবং বিশেষ করে তা যদি এশিয়ান বা আফ্রিকান কোন দেশ থেকে হয় তা হলে তো বিড়ম্বনার শেষ নেই। বর্তমান সময়ে বিশ্বের যে কয়টি দেশের নাগরিকদের জন্য কোন প্রকার ভিসা প্রদান বন্ধ রয়েছে তার মধ্যে এক নম্বারে রয়েছে আমাদের জন্মভূমি সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা সোনার বাংলাদেশ। গত ২৮ অক্টোবরের আগে এই শীর্ষ নম্বারে ছিল ইরাক, নাইজেরিয়া এবং ক্রমানুষারে বাংলাদেশ ছিল ৫ম স্থানে। পরম করুনাময়ের অশেষ মেহেরবাণীতে ২৮শে অক্টোবরের পর থেকেই সেই শীর্ষ অবস্থানের দখলে প্রথম স্থান পেয়েছে বাংলাদেশ, আমার আজব বাংলাদেশ।

এরপরেও যারা আসে তাদের ভোগান্তি কম হয় না। বাংলাদেশী পাসপোর্ট থাকার দরুণ আমাকেও যন্ত্রণার শিকার হতে হলো। প্রথমেই বলেছি ভ্রমণে নয় কাজে এসেছি, চব্বিশ ঘন্টা কি বা কতটুকু দেখা বা জানা যায়!! আমাদের যে ব্যবসার কাজে কুয়েতে আসতে হয়েছে তা আমাকে বার বার স্বরণ দিলেন অগ্রজ জনাব আখতার মোহাম্ম্দ সেলিম রাহমান, এমডি রয়েল বেঙ্গল এয়ালাইন্স। যা বিশ্বের মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশী প্রবাসীদের বিনিয়োগ দ্বারা প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে এবং শ্রীঘ্রই সার্ভিস প্রদান করবে। ফারহাদ হোসাইন তিনি এ্যারোনিউটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার এবং রয়েল বেঙ্গল এয়ারলাইন্সের একজন প্রতিষ্ঠাতা ও অতি গুরুত্বপূর্ন পরিচালক।

আমার বিলম্ব হচ্ছে দেখে উনাদের বিদায় দিলাম, ওনারা রওয়ানা হলেন হোটেলের দিকে। আমাকে কুয়েত এয়ারপোর্টে বসে অপেক্ষা করতে হলো। আহ!! অপেক্ষা কি যে যন্ত্রণার তা ভুক্তোভোগী ছাড়া অন্য কাউকে বোঝানো মুশকিল। আরবীতে অপেক্ষার ব্যাপারে একটি প্রবাদ আছে যা, সহিহ্ হাদীসেরও অংশ বিশেষ তা ব্যাপক প্রচলিত ’আল ইনতিজারো আশাদ্দু মিনাল মাউত’ যা বাংলায় বলা যায়-’অপেক্ষার চাইতে মৃত্যু অনেক ভালো। অনেকক্ষণ বসে থাকার পরে একটু এ দিক সে দিক ঘুরছিলাম, তখনি একজন কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল দেশী কই যাইবেন!! উনার পরনে ইউনিফর্ম দেখে বুঝতে পারলাম উনি কে বা কি করেন।

উনাকে বললাম মাত্র আসলাম এখন ভাই যাবো তো কালকে। এই করে আলাপ জমে উঠল, এক এক করে কয়েকজন বাংলাদেশী ভাই এসে জুটলো। আমার অপেক্ষার যন্ত্রণাও আস্তে আস্তে প্রশমিত হলো। ঘন্টা কয়েকের আলাপ গোটা কুয়েতের মোটামোটি একটি চিত্র পেলাম। বাংলাদেশে যেমন শোনা কথা আমলে পরিণত হয়, যেমন কেউ একজন বাজারে এসে বলল এই শুনছ পরশুদিন থেকে হরতাল-ব্যস আর যায় কই!! সেই দিন হরতাল পালিত হয়।

মধ্যপ্রাচ্যেও অনেক দেশেই শুনা কথা আইন। গোটা মধ্যেপ্রাচ্যর অর্ধেকের বেশি দেশ ভ্রমণ করে আমার যে অভিজ্ঞতা অর্জন হয়েছে এবং বাস্তবতা দেখার সৌভাগ্য হয়েছে তা থেকে বলতে পারি আমাদের সমাজ বা বাংলাদেশী সমাজ প্রায় সব সময়ই শোনা কথায় বিশ্বাস করে। শোনা কথায় কান দেওয়া একটি গর্হিত কাজ এবং মুসলমান হিসাবে তা কোন ক্রমেই ঈমানী আওতার মধ্যে পড়ে না। এমনিতেই গীবত, বা ছোগরখুরী করা বা না জেনে কথা বলা পাপ। এর মধ্যে কেই যদি কারো কাছ থেকে শোনে আবার অন্যদের কাছে ছড়িয়ে দেয় সত্য কি মিথ্যা তা যাচাই না করে, তাহলে তা তো আরো মহাপাপ।

প্রত্যেক দায়িত্ববান সচেতন নাগরিকদের উচিত এই সব পাপ থেকে বিরত থাকা এবং অন্যদেরও বিরত রাখা। এয়াপোর্টে ভাইদের সাথে আলাপ থেকে আড্ডা যখন আপ্যায়নে পরিণত হল তখনি আমার মূল অপেক্ষার পালার সমাপ্তি হল। সামান্য সময়ের আলাপ আপ্যায়নের মাধ্যেমে কাছে আসা প্রবাসী স্বদেশী ভাইদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হোটেলে দৌড়ালাম। কুয়েতের বিখ্যাত সাফির হোটেলে এসে রুমে প্রবেশ করে কয়েকটি প্রয়োজনীয় টেলিফোন শেষ করে ঘুমের জগতে ডুব দিলাম। ঠিক ফজরের আজানের সাথে সাথেই জাগিয়ে দেবার জন্য অনুরোধ করেছিলাম সাফির হোটেলের সুদর্শনী ও দক্ষ ফিলিপিনো রিসিপসনিষ্ট মহিলাকে।

কিন্তু জাগালেন খুবই ভদ্র ও কথায় দক্ষ ভালো কন্ঠের একজন পুরুষ। উনাকে দেখিনি তবে বুঝতে পাললাম তিনি ইন্ডিয়ান-ই হবেন। সালাতুল ফজর আদায় করে নাস্তার টেবিলে গেলাম সেখানেও দেখি সবাই প্রায় বাংলাদেশী। আমার জন্য তো মজা, যেখানে যাচ্ছি সেখানেই পাচ্ছি প্রবাসী বাংলাদেশী। খুব ভোরে পাউরুটি বা টোষ্টবিস্কুট এর সাথে চা পান করা ।

এর স্বাদই আলাদা আমার কাছে। যাই হোক শ্রদ্ধেয় প্রিয় সেলিম ভাই এবং ফরহাদ গেলেন একদিকে আর আমি ও আমার সাথী ক্যাপ্টেন ইয়াচ্ছার অন্যদিকে। নির্ধারিত কাজ শেষে হোটেলে ফিরলাম যখন তখনি ফিরে আসার তাগদা মন থেকে এল। না আসার মতো কিছুই নেই। কারণ ভিসা মাত্র চব্বিশ ঘন্টার বাংলাদেশী পাসর্পোট বিধায় শর্তযুক্ত।

সময় কম কাজ বেশি, এরপরও সাহস করে ড্রাইভারকে সাথে নিয়ে বেরুলাম শুধুমাত্র সিটিটা ঘুরে দেখার জন্য। কুয়েত আসব আর সিটি না দেখে চলে যাব তা কি আর হয়। ভ্রমণ প্রিয় আমি, কাজে এসেছি তাই বলে কি পিপাসা মিটবে না। এত দ্রুত দেখেছি এরপরেও মনে হল কিছুই দেখা হয়নি। অবশ্য বিশাল বিশাল বিল্ডিং ও লম্বাটে মরুভূমি ছাড়া তেমন কিছু দেখার মতো নাইও কুয়েতে।

যত বাহাদুরী কুয়েতীদের তা হচ্ছে মহান রাব্বুল আ’লামীন প্রদত্ত্ব বিশাল খনিজ সম্পদ। এরমধ্যে জ্বালানী তেল অন্যতম, তাও বর্তমানে আমেরিকান প্রহরাধীন। কুয়েতের পুরোনাম হল ’দাউলাত আল কুয়াইত, যার রাজধানী কল কুয়েত এবং আরেকটি প্রধান শহর হল আস সাল ম্যিয়াহ। গোটা দেশের জনসংখ্যা প্রায় ১২ লক্ষের মতো। কুয়েতীদের থেকে বিদেশী বেশি, সবাই কর্মজীবি।

আনুপাতিক হারে দেখলে কুয়েতী হবে শতকরা ৪৭ ভাগ, অন্যান্য আরব দেশের হবে ৩০ ভাগ, ইরানী হবে ৫ ভাগ ইন্ডিয়া-পাকিস্তানী বাংলাদেশী সহ এশিয়ার অন্যান্য দেশের লোক হবে ১৮ ভাগ। আয়তনে ছোট, জনসংখ্যাও কম, তাই দুনিয়া জুড়ে কুয়েতী দিনারের মূল্যমানও বেশি। কুয়েতী এক দিনারে প্রায় ৪ ডলার পাওয়া যায়। কুয়েতীরা অন্যান্য আরব দেশ থেকে বেশি রক্ষণশীল ও কঠোর। কুয়েতের আমীর জনাব আব্দুল্লাহ আল সাবাহ্ এবং প্রধানমন্ত্রী হলেন শেখ নাসের।

বর্তমান আমীর বেশ কিছু পরিবর্তন এনেছেন দেশে। দুবাইতে যেমন সমুদ্র চুরি করে সমুদ্রে বুকে প্রসাদতম অট্টালিকা তৈরী করা হচ্ছে, তেমনি কুয়েতও সেই পথ ধরেছে। প্রায় সব ক্ষেত্রে আধুনিকতার ছোঁয়া দেখতে পেলাম। এতদিন কুয়েতে অফুরন্ত সম্পদ থাকার পরেও এগুতে পারেনি। কুয়েতীরা ঝাঁকে ঝাঁকে দুবাই চলে যায় দৈনন্দিন বাজারের জন্য।

মাত্র ৪৫ মিনিটের ফ্লাইট। কিন্তু বর্তমানে কুয়েতীরাও দুবাইয়ের সাথে তাল মিলিয়ে অনেকটা পরিবর্তন এনেছেন দেশে। অন্যান্য দেশের তুলনায় এখন কুয়েতে বিদেশীরা কোন সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে না। এরমধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে বাংলাদেশীরা। বিভিন্ন দালালের খপ্পরে পড়ে টাকা খরচ করে বাংলাদেশী রা চলে আসে।

একজন ক্লিনার বলল, মাস শেষে বেতন পায় মাত্র ৫০ দিনার। থাকা খাওয়া অবশ্য ফ্রি। আইন কানুন খুবই কঠোর বিদেশীদেও জন্য। এই কঠিন ও কঠোরতর মধ্য দিয়েও প্রবাস জীবন কাঠিয়ে যাচ্ছে প্রবাসীরা অবধান রাখছে কুয়েতকে আধুনিক দেশে রূপান্তরিত করতে। ঘড়ির কাটা দ্রুতভাবে ঘুরছে।

ড্রাইভার বলল, সময় শেষ, আমারও ফ্লাইট ধরতে হবে তাই ছুটলাম এয়াটোর্টের দিকে। কিন্তু মনের বাসনা পূরণ হল না। এই ভেবে যে ভেতরে ঢুকে পুরোপুরি দেখা হল না আমার কুয়েত দেশটিকে। এই কুয়েত সফরের জন্য আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি জনাব আবু রেজা মোহাম্মদ নেজাম উদ্দিন নাদভী সাহেব ও আবু মোসাল্লেম আল জামেল সাহেব এবং রয়েল বেঙ্গল এয়ারলাইন্স টিমকে। বিশেষ করে শ্রদ্ধেয় সেলিম রাহমান সাহেবের কাছে, মোহতারাম মোহাম্মদ মোখলেসুর রাহমান, জসাব ফখরুল হোসেইন সাহেবের কাছে।

তবে শোনা কথা নয়, বাস্তবেই সত্য কুয়েতে এখন বাংলাদেশীদের প্রবেশ নিষেধ। চৌধুরী হাফিজ আহমদ রচনাকাল-২০০৬ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.