নিজের সম্পর্কে লেখার কিছু নেই । সাদামাটা । ভুতের আছর................ নার্ভাস কথাবলী ……..
(তিন খন্ডে সমাপ্ত *** প্রথম খন্ড)
আপনাকে কি কখোনও ভুতে বা শয়তানে আছর করেছে ? কিম্বা জ্বীন-পরীতে পেয়েছে ? পায়নি ..? গুড ! পাওয়ার অবশ্য কোনও কারনও নেই ।
আপনাকে না পেলেও হয়তো শুনেছেন, অমুক কে ভুতে ধরেছে । ওঝা-ফকির চলছে ।
কেউ বিশ্বাস করেন, কেউ করেন না ।
আসলে আপনার শরীরটি একটি সর্বোন্নোত প্রানীর শরীর এবং সঙ্গত কারনেই তা বেশ জটিল । আর এর মধ্যে আপনার মগজটি হলো সবচেয়ে জটিল এবং দুর্বোধ্য । অথচ এই মগজটি খুবই শান্তিপূর্ণ আর সার্বক্ষনিক ব্যস্ত । এর সকল ক্রিয়াকান্ডই সুক্ষ ভাবে ব্যালান্সড ।
তারপরেও এখানে মাঝে মাঝে ঝড় উঠতে পারে । এই ঝড় হতে পারে বাইরের পরিবেশগত কারনে অথবা শরীরের ভেতরের রাজনৈতিক কারনে । এই ঝড় বা গন্ডগোল হলেই আমরা বলি- ভুতে আছর করেছে, জ্বীন-পরীতে পেয়েছে ।
জেনে রাখুন, এই গন্ডগোলগুলি মোটেও ভুতের ভয়, শয়তানের আছর অথবা অপদেবতাদের রোষ থেকে হয়না ।
এগুলো সবই আপনার মগজে ঘটতে থাকা জৈব-রাসায়নিক ক্রিয়াকান্ডের ফল ।
তাই আপনার মগজে কি ঘটছে আর কি করেই বা ঘটছে তা জেনে রাখা ভালো যাতে ভুত-শয়তান-জ্বীন-পরী আপনার ত্রি-সীমানায় ঘেসতে না পারে ।
আসুন, গল্পে গল্পে তা জানি…………..
ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দুঃখ হলো, এ পর্য্যন্ত মানুষের মস্তিষ্ক বা হিউম্যান ব্রেইন রয়ে গেল মানুষের কাছেই অচেনা আর অনেকটা অবহেলায় ।
ইতিহাসের সমস্ত কালটা জুড়েই এই মস্তিষ্ক মানুষের মানবতা এবং মানবিক গুনাবলী প্রকাশে সক্রিয় থেকেছে । আর এ কারনেই পাখা না থাকলেও মানুষ পাখীর মতো উড়ছে আকাশে, লেজ না থেকেও মানুষ ডুব দিচ্ছে সাগরের গহীন তলে । মস্তিষ্কের কারনেই মানব ইতিহাসের দূর্যোগময় সময়গুলো কাটিয়ে মানুষ আশার আলো জ্বেলেছে ।
আর ধ্বংশকে রূপান্তর করেছে সৃষ্টিতে । শতাব্দীর পর শতাব্দী চলে গেছে বৈজ্ঞানিক নিরীক্ষা (Scientific Exploration) আর ধারনার (Speculation) গবেষনায় তার পরেও মানুষের মস্তিষ্ক রয়ে গেছে এখোনও রহস্যময় । এমনকি এটি ফিজিওলজী ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞদের কাছেও রয়ে গেছে প্রায় অচেনা । কারন কি ?
কারনটি তাহলে খুলেই বলি –
আমাদের মাথার খুপড়িতে (Skull)যে মগজটুকু(Brain)আছে তার ওজন মাত্র ৩ পাউন্ড । অল্প জায়গা জুড়ে থাকা এই ব্রেইনটিতে আছে ১৫ বিলিয়ন স্নায়ুকোষ বা নিউরোন (Neuron)।
কেবলমাত্র এই এতোগুলো কোষকে নিয়ন্ত্রন করা খুব সহজ একটা কাজ নয় । তার উপর রয়েছে নিউরোগ্লিয়া(Neuroglia)বা সংক্ষেপে “গ্লিয়া” নামক আর এক ধরনের কোষ যারা সর্বক্ষন নিউরোনগুলোকে পরিচর্যা আর সংস্কার করে চলেছে । এদের সংখ্যা মাত্র ১৫০ বিলিয়ন । তার উপরে আছে এদের কানেকটিং ফাইবারগুলি(Connecting Fibres)। পুরো নার্ভাস সিষ্টেম বাদ দিয়ে কেবলমাত্র মস্তিষ্কের গঠনটাই এমোন জটিল ।
আর এই জটিলতার কারনেই একে বুঝে ওঠা আসলেই কষ্টকর ।
কতোখানি কষ্টকর, তার একটা তুলনা করলে মন্দ হয়না – সারা পৃথিবীর সকল টেলিফোন সেটের কথাই ধরুন । পৃথিবীতে এখোন প্রায় ৬বিলিয়ন এর বেশী লোকের বাস । এই হিসেবে সারা বিশ্বের সকল টেলিফোন সেট, তাদের সংযোগ লাইন এবং সারাদিনে যে শত শত কোটি সংবাদ আদান প্রদান হচ্ছে তার বিশালতার কথা চিন্তা করুন, বুঝতে চেষ্টা করুন তার জটিলতা । আমরা যদি এই বিশালতা আর জটিলতাকে মাথায় রাখি তবে একজন মানুষের মস্তিষ্কের জটিলতার তুলনায় পার্থিব এই জটিলতা মোটেও তুলনার যোগ্য নয় ।
এই জটিলতার কথা জানার কি প্রয়োজন আপনার, এমোন প্রশ্ন উঠতেই পারে ।
এই যেমন আপনি, এই মূহুর্তে আমার এই লেখাটি মনোযোগ দিয়ে পড়ছেন কিম্বা ভাবছে“আজাইররা পোষ্ট” অথবা বিরক্ত বোধ করছেন এটা ভেবে যে কি কুক্ষনে আপনি এই ব্লগে ঢুকলেন; ইত্যাকার যে প্রতিক্রিয়া আপনার ভেতরে ঘটে চলেছে এই মূহুর্তে তা আর কিছু নয়, আপনার মস্তিষ্কের জটিলতারই বা জৈব-রাসায়নিক ক্রিয়াকান্ডের ফল ।
আপনার কি এটা জানতে ইচ্ছে করেনা, কেনই বা আপনি রেগে যাচ্ছেন, কেনই বা আপনার ভেতরে একটুখানি ভালোবাসা দানা বাঁধছে ধীরে ধীরে ? কেনই বা আপনার মনখানা হঠাৎ হঠাৎ উদাস হয়ে যাচ্ছে ? কেনই বা ভাল্লাগছেনা কিছুই ? কেনই বা আপনি এরকমটি না হয়ে ওরকম ? এগুলো জানতে হলে আপনাকে মগজের ভেতরে একটু ডুব দিতেই হবে । কারন জটিল বলে একে এড়িয়ে গেলে, জ্বীন-পরী বা শয়তানের আছর হয়েছে এমোন আজগুবী ধারনা থেকে কখনও মুক্ত হতে পারবেন না । আবার সবকিছুকেই মনস্তাত্বিক ধাঁধাঁ (Psychological Puzzle) বলে ধরে নেয়াও ঠিক হবেনা ।
তাহলে মস্তিষ্কের পাহাড়-উপত্যকার মনোরম পরিবেশে একটু ঘুরে এলে দোষ কি ? ঘুরে আসা না বলে, ডুব দিয়ে আসা বললেই বোধহয় বেশী যুক্তিযুক্ত হতো ।
মগজে ডুব দিতে গেলেই প্রথমে যে বাঁধাটা আসবে তা হলো ২০টি হাড়ের সমন্বয়ে গঠিত মাথার খুলি বা Skull. এটি পেরিয়ে যখন আমরা মস্তিষ্কের উপরি ভাগে পৌছবো তখন সত্যিকার ভাবেই আমাদের লাগবে ডুবরীর পোষাক । কারন মস্তিষ্কের উপরিভাগে যে তিন স্তর বিশিষ্ট আবরন (Meningis)রয়েছে তার মধ্যেই রয়েছে সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুয়িড (CSF)যা আপনার মগজে পুষ্টির যোগান দেয় আর বাইরের আঘাত থেকে রক্ষা করে । এই ফ্লুয়িড বা তরলের ভেতর ডুব দিয়েই আপনি যেখানে পৌছে যাবেন সেটি হলো সেরিব্রাল হেমস্ফিয়ার (Cerebral Hemisphere)। দেখতে পাবেন এটি বাম এবং ডান, দুটি ভাগে বিভক্ত ।
মজার ব্যাপার হলো, ডান হেমস্ফিয়ারটি আপনার শরীরের বামদিকের সকল কাজ আর বাম হেমস্ফিয়ারটি আপনার শরীরের ডানদিকের সকল কাজ নিয়ন্ত্রন করছে । এই যেমন আপনি এখন ডান হাতটি দিয়ে মাউসটিকে ঘোরাচ্ছেন, তা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে আপনার মগজের বাম হেমস্ফিয়ারটি দিয়ে । এগুলো একটি ভৌতিক ছবিতে দেখা সাপের মতো আঁকাবাঁকা পাহাড়-উপত্যকায় ঘেরা এলাকা । এই পাহাড়ের মতো উঁচু উঁচু জায়গাগুলোকে বলা হয় Gyrus আর উপত্যকা বা নীচু জায়গাগুলোকে বলা হয় Sulcus । সব মিলিয়ে (সামনে-পেছনে-পাশে-উপরে)আপনার মগজটিকে চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে Frontal, Occipital, Temporal এবং Parietal Lobe বা অঞ্চল এই হিসেবে ।
এই এলাকাগুলিই ভিন্ন ভিন্ন ভাবে আমাদের যাবতীয় কাজগুলি নিয়ন্ত্রন করে থাকে । যেমন Frontal Lobe আমাদের মাংশপেশীর কার্য্যক্রমকে নিয়ন্ত্রন করে থাকে । Parietal Lobe আমাদের যাবতীয় অনুভুতিগুলোকে সংগ্রহ করে থাকে । দৃষ্টিকে শাসন করে থাকে Occipital Lobe আর Temporal Lobe আমাদের কথা বলাকে নিয়ন্ত্রন করে থাকে । এছাড়াও আরো শতশত রহস্যজনক কাজকর্ম যেমন সচেতনতা, আবেগ, অনুভুতি, সৃজনশীলতা, মোহমায়া ইত্যাদিও নিয়ন্ত্রন করে থাকে এই এলাকাগুলিই ।
একটু পেছনে আর নীচে ডুব দিলেই আপনি গিয়ে পড়বেন Cerebellum (সেরেব্লাম) এলাকায় । এই এলাকাটি মস্তিষ্ক এমনকি আমাদের শরীরের ভারসাম্য রক্ষার কেন্দ্র । এই এলাকার নিয়ন্ত্রনের কারনেই আমরা সাধারনত “হেট-মুন্ড উর্দ্ধ-পদ “ হয়ে থাকিনা । এখানেই আপনার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নড়াচড়াকে পরিমার্জিত (Refined) ও সমন্বিত (Co-ordinated) করা হয় । যখন আপনার চলাচলে একটি কাব্যিক ভাব এসে যায় তখন আপনার ঐ নড়নচড়নের ছন্দময় কবিতাটি এই এলাকাতেই লেখা হয় ।
ভালো একটা উদাহরন হলো র্যা ম্পে মডেলদের ক্যাট-ওয়াক । যার Cerebellum যতো ছন্দময়তা সৃষ্টি করতে পারে র্যা ম্পে সে ততো দৃষ্টি নন্দন তার চলাফেরায় ।
আরো নীচে নামলে আপনি পৌছে যাবেন Lower brain stem এলাকায় । এন্টার্কটিকার মতো মস্তিষ্কের সর্ব দক্ষিন (নিম্ন) এলাকাই এটি । এখানে আছে আবার দুটো আলাদা ষ্ট্রাকচার, একটি Pons অন্যটি Medulla. এরাই সেরিব্রাল হেমস্ফিয়ার কে স্পাইনাল কর্ড (Spinal cord)এর সাথে সংযুক্ত করেছে ।
আপনি যদি সমস্ত স্নায়ুতন্ত্রকে (Nervous System)বিদ্যুত সরবরাহ ব্যবস্থার সাথে তুলনা করেন তবে আপনার মস্তিষ্কটি হলো একটি বিদ্যুত কেন্দ্র (যেমন ঘোড়াশাল বিদ্যুত কেন্দ্র)আর স্পাইনাল কর্ড হলো সেই বিদ্যুত কেন্দ্র থেকে যে মোটামোটা কেবল (Cable)মাটির নীচ দিয়ে প্রতিটি শহরে শহরে চলে গেছে সেরকম স্নায়ু কেবল । বিদ্যুত সরবরাহ ব্যবস্থায় যেমন সাব-ষ্টেশন, ট্রান্সফর্মার ইত্যাদি থাকে তেমনি স্নায়ুতন্ত্রেও এই রকম ব্যাপার স্যাপার আছে । এই ধারনাটুকু মাথায় থাকলে স্নায়ুতন্ত্রকে বুঝতে আপনার সুবিধে হবে ।
Medulla নামক এই এলাকাটি চীরজাগ্রত একটি দেশ । এখানে আপনি ঘুমপরীদের খুঁজে পাবেন না ।
কারন এই এলাকার জনগণ (মানে নিউরোন)ঘুমায় না কখোনও কারন এরাই আপনার জীবনের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় কেন্দ্র যেমন হার্ট-রেট নিয়ন্ত্রন কেন্দ্র (Heart rate control centre), শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রন কেন্দ্র (Centre for Breathing)কব্জা করে রেখেছে । তাই এদের ঘুমানোর কোনও সুযোগ নেই । এরা যদি ঘুমিয়ে পড়ে, জানবেন আপনি “ওয়ান-ওয়ে টিকিট” কেটে ফেলেছেন । এই Medullaই স্পাইনাল কর্ডে এসে শেষ হয় । আপনার স্পাইনাল কর্ডটিই মস্তিষ্কের প্রধান কমিয়্যুনিকেশন কেবল যা আপনার মেরুদন্ডের হাড়ের ভিতর দিয়ে নীচে নেমে গেছে ।
এই কর্ডের মাধ্যমেই আপনার শরীরের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে মস্তিষ্কে চলে আসে যাবতীয় সংবাদ । সংবাদগুলো হতে পারে স্পর্শ, স্বাদ, ব্যথা, শীত কিম্বা গরমের অনুভুতি । নিউটনের তৃতীয় সূত্র – এ্যাকশান ইক্যুয়াল টু রিএ্যাকশানের মতো এই অনুভুতিগুলোর প্রতিক্রিয়াই আবার আপনার মস্তিষ্ক থেকে স্পাইনাল কর্ড বেয়ে প্রয়োজনীয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে পৌছে যাবে । সুতরাং স্পাইনাল কর্ডে দু’ধরনের তার (Cable) থাকতে হবে । আপনার গৃহকর্মে ব্যবহৃত প্রচলিত ইলেকট্রিক তারে যেমন দু’রঙের তার দেখতে পান তেমনটি ।
এর একটিকে আমরা বলি – Sensory fibre যা অনুভুতিগুলোকে মগজে নিয়ে আসে আর অন্যটি হলো Motor fibre যা মগজের নির্দেশকে পৌছে দেয় প্রান্তীয় অঞ্চল পর্য্যন্ত ।
এ পর্য্যন্ত আপনি মগজের ভৌগলিক (Geographical Areas)ও জনসংখ্যাগত (Neural Population)তথ্য সম্পর্কে জেনেছেন । এবারে আসুন এই Neural Population এর পলিটিক্যাল সিচ্যুয়েশানে । এতো শক্তিশালী হয়েও মগজের কিন্তু নিজস্ব কোনও প্রাকৃতিক সম্পদ (Natural Resources)নেই । মগজের জন্যে জ্বালানী হিসেবে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন এবং পুষ্টিকে ( প্রধানত গ্লুকোজ ) আনতে হয় বাইরে থেকে ।
তাই হার্ট, ফুসফুস, পাকস্থলীর উপর তাকে দখলীসত্ব কায়েম রাখতেই হয় । অর্থাৎ এ্গুলোর সাহায্য ছাড়া মগজ অচল । এই আভ্যন্তরীন চাহিদা মেটাতে মগজকে তাই নিয়ন্ত্রন রাখতে হয় শরীরের শ্বাস-প্রশ্বাস, খাদ্যবস্তু হজম, রক্ত-সঞ্চালন ইত্যাদি জীব-দৈহিক কাজকর্মের উপরে । নিজের জন্যে আপনার মগজটি শরীরের রক্ত-সঞ্চালনের এক তৃতীয়াংশই বরাদ্দ দিয়ে রাখে, যদিও শরীরের ওজনের মাত্র ২% মগজটির ওজন । জাষ্ট লাইক আ ডিক্টেটর …..
( চলবে ।
তিন খন্ডে সমাপ্ত *** দ্বিতীয় খন্ড সম্ভবত কালকেই পাবেন )
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।