এখন ওর রুমে ওর দুই রুমমেট নেই- বাইরে গেছে সিগারেট খেতে। এই সুযোগে কেঁদে নিচ্ছে সে। এমন সময় রুপম এসে ঢুকল। নাহিদের ক্লাস মেট রুপম ওর সাথেই ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। কিন্তু বড়লোক বাবার ছেলে বলে নাহিদের মত অভাব নেই ওর।
নাহিদ এখন খুব কষ্টে আছে। প্রাইভেট ইঊনিভারসিটি তে পড়ছে- অনেক টাকা প্রতি সেমিষ্টার ফি দিতে হয় ওকে। এই মাসেই চলতি সেমিষ্টার ফি দিতে হবে ওকে- এখন ও দিতে পারেনি। কিভাবে পারবে? ওর বাবা মারা গেছেন এক বছর হল। সরকারী চাকরি করতেন তিনি- চাকরির মাঝেই হার্ট এটাক করে মারা যান তিনি।
তাই পেনশনের টাকা হাতে পায়নি নাহিদ। বাড়িতে মা আর বোন থাকে- পড়ালেখার খরচ চালান নাহিদের মা। উনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্র পড়ান। আর নাহিদ ও টিউশনি করে চালায়। কিন্তু এই মাসে হটাত করে দুইটা টিউশনি চলে যাউ নাহিদের।
তিনটা টিউশনি র মাঝে যেটা বাকি ছিল সেটা তে যে টাকা পায় তাতে নিজের থাকার খরচ ই মেটাতে পারেনা। এখন কিভাবে সেমিষ্টার ফি দেবে সেটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে কেঁদে ফেলল সে।
রুমে ঢুকেই রুপম বলল-
"দোস্ত- তুমি কি ঐ প্রকাশকের কাছে গেসিলা?"
প্রকাশকের কথা শুনে মন আরো খারাপ হয়ে গেল তার। গতমাসে ওর লেখা একটা গল্প সংকলন নিয়ে গিয়েছিল বাংলাবাজারে প্রভৃতি প্রকাশনের মালিক দিদার সাহেবের কাছে। উনি ঘোষনা দিয়েছিলেন যে একটা প্রতিযোগিতা হবে- সেখানে যে প্রথম হবে তাদের বিনামুল্যে বই বের করে দেয়া হবে একুশে বইমেলায়।
নাহিদ ও পাঠিয়েছিল সেই প্রতিযোগিতায়। অনেক গল্প লিখেছে নাহিদ। কিন্তু প্রতিযোগিতার কথা শুনে সে গল্প গুলো নতুন করে লিখে একটা পান্ডুলিপি বানিয়ে পাঠিয়েছিল প্রভৃতি প্রকাশনীতে। সেখানে সে প্রথম হয়েছিল। কথা মত ওকে বই বের করে দিচ্ছে কিন্তু বই বের করা বাবদ ওর কাছে চাইছে দশহাজার টাকা।
প্রতিযোগিতার শর্তে এটা লেখা ছিলনা। এমনিতেই ও অনেক গরীব। এর মাঝে ফ্রি তে বই বের করে দেবে চিন্তা করেই টেবিলের কোনায় পড়ে থাকা গল্প গুলো বই আকারে চেয়েছিল। সাথে দশ হাজার টাকা উপহার ও পাওয়ার যোগ ছিল। এখন সেটা বেমালুম অস্বীকার করছে প্রকাশনী প্রধান।
তাই মন খারাপ করে বলল সে-
"হ্যাঁ গিয়েছিলাম। ঐ একই কথা বলল সে। কোন ভাবেই আমাকে দশ হাজার টাকা দেবে না। বলেছে টাকা আমাকে ই দিতে হবে এবং সেটা তিন দিনের ভেতর। না দিলে যে ২য় হয়েছে তাকেই বই বের করে দেয়া হবে।
এজন্য তিন দিনের মাঝেই বই এর জন্য টাকা দিতে হবে। "
বলেই যেন মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল নাহিদের। ওকে সান্তনা দিল রুপম। কিন্তু সবাই ওকে সান্তনাই দিল- কেউ ওর বিপদে এগিয়ে আসল না। বাস্তবতা তার করুন চিত্র যেন নিজের চোখে খুটে খুটে দেখাচ্ছে নাহিদ কে।
না খেয়েই শুয়ে পড়ল নাহিদ। রাতে না খেলে একটা মিল বেঁচে যাবে- সেই টাকা দিয়ে সেমিষ্টার ফি কিছুটা ও হলে দেয়া যাবে ভেবে পানি খেয়ে পেট ভর্তি করে শুয়ে পড়ল সে। সারাদিন দৌড়া দৌড়ী করে কাহিল ছিল শরীর। তাই শুতেই ঘুমিয়ে পড়ল সে।
ঘড়িতে যখন ঠিক দুইটা- এমন সময় ওর মোবাইলে একটা ফোন আসল।
ঘুমের মাঝে ফোনটা কোন ভাবে কেটে দিয়ে আবার ঘুমিয়ে গেল সে। ঘুমিয়ে থাকলে কারো ফোন রিসিভ করেনা সে। আজো করবেনা ভেবে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। একটু পর আবার রিং আসতেই আবার কেটে দিল। এবার মোটামুটি ঘুম ভেঙ্গে গেলে ও প্রাইভেট নাম্বার দেখে রিসিভ করেনি।
রাতে বিরাতে জীনের বাদশা র মত কিছু ভন্ড মানূষ কে ফোন করে ভয় দেখায়। অনেক সময় সেই নাম্বার গুলো প্রাইভেট নাম্বার হয়। এটা ভেবেই ফোনটা ধরেনি সে।
একটু পরেই তৃতীয় বার রিং বাজতেই ফোনটা রিসিভ করল সে। করেই বললঃ
"হ্যালো "
ওপাশ থেকে কোন উত্তর আসছেনা দেখে আবার বললঃ
"হ্যালো- কে বলছেন?"
কোন উত্তর নেই।
এবার ক্ষেপে গেল সে- চিৎকার করে বললঃ
" কে বলছেন? কথা বলছেন না কেন? ফোন করতে পারেন- কথা বলতে পারেন না?"
এবার কেমন যেন খর খর আওয়াজ শুরু হল মোবাইল থেকে। কেমন যেন অদ্ভুত রকম একটা আওয়াজ। আস্তে আস্তে আওয়াজ এর উচ্চতা বেড়েই চলেছে। অদ্ভুত রকম সাঁ সাঁ আওয়াজ করেতে শুরু করল ওর মোবাইল থেকে। শেষে বিরক্ত হয়ে যখন রেখে দিতে যাবে তখন যেন অনেক দূর থেকে একটা কন্ঠ বলে ঊঠল-
“হ্যালো”।
কন্ঠ টা শুনে হটাত করে শোয়া থেকে সটান বসে পড়ল সে। বুকের ভেতর ধড়ফড় শুরু হয়ে গেল তার। এই কণ্ঠ আর কারো না- ওর মৃত বাবার। এই কন্ঠ কোন ভাবেই অন্য কারো হতে পারেনা। সে কণ্ঠ টা আবার শোনার জন্য অপেক্ষা করতে শুরু করল।
এবার মিনিট খানেক পরে আবার বলে ঊঠল-
-‘হ্যালো’
এবার আর দেরী করল না সে- কাঁপা কাঁপা গলায় বলে ঊঠল-
-কে? বাবা?
বলেই কেঁদে ফেলল সে- বুক থেকে যেন বের হতে যাইছে এক বছরের জমে থাকা দুঃখ গুলো। কোনভাবেই নিজেকে থামাতে পারছেনা। মোবাইলেই কাঁদতে কাঁদতে বলল-
“বাবা সত্যিই কি তুমি বলছ বাবা? সত্যিই তুমি?”
বলেই উত্তরের অপেক্ষা শুরু করল-ওপাশ থেকে বলল-
-“হ্যাঁ রে- তুই ভাল আছিস তো? বাবু সোনা?”
বাম হাতে চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল-
-“এইত বাবা আছি- কিন্তু তোমাকে অনেক অনেক মনে পড়ে বাবা।
অনেক... তুমি নেই- যেন আমার আসলেই কেউ নেই- তুমি ছাড়া কেউ আমার খেয়াল রাখেনা বাবা”- বলেই হাউমাঊ করে কেঁদে ফেলল আবার নাহিদ।
-“ হ্যাঁ রে কাদিস না- শোন আমি যে তোকে ফোন করেছি সেটা কাউকে বলিস না- আর আমি এখন যা যা বলব তুই সেটাই করবি- তাহলে তোর লেখা পড়া থেমে যাবেনা- তুই আবার পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারবি”
-ওপাশ থেকে বলল নাহিদের বাবা।
-“ বাবা তুমি যা যা বলবে আমি তা তা করব বাবা শুধু তুমি একবার বল- কি করতে হবে আমাকে ? -কেঁদে কেদেই বলে চলল নাহিদ।
“শোন – তুই যেখানে লেখা দিয়েছিস- সেটার পেছনে একটা দোকান আছে- সেখানে এক বৃদ্ধ লোক বসে- উনাকে তোর লেখা টা কালকেই দেখাবি। উনি তোর লেখা ছাপিয়ে দেবেন। তোকে উনি কালকেই দশ হাজার টাকা ও দেবেন । সেই টাকা দিয়ে তুই তোর সেমিষ্টার ফি দিবি- কি পারবিনা?” অপাশ থেকে জিজ্ঞাসু ভঙ্গিমা।
“ কিন্তু উনি কি আমার লেখা ছাপাবেন?” নাহিদের কন্ঠে বিস্ময়।
“উনি তোর মত একজন কে খুঁজছে। কাল ঠিক বেলা ১১টায় উনার কাছে একজন লোক আসার কথা। কালকে খিলগাঁও এলাকায় ফ্লাইওভার এ ফাটল দেখা দেবে। সেই জন্য বিশাল জ্যামে পড়বে সেই লোক।
তুই এই ফাঁকে আগে থেকে চলে যাবি বাংলাবাজার। ঠিক এগারোটায় সেখানে গিয়ে দেখা করবি বৃদ্ধের সাথে। এরপর তোকে আর টাকা নিয়ে ভাবতে হবেনা। আমি এখন রাখি রে- ভাল থাকিস- সব সময় তোর মায়ের দিকে খেয়াল রাখবি। রানু কে ভালমত মানুষ করবি।
রাখি” – বলেই খট করে ফোন রেখে দিল ওপাশ থেকে।
কিছু ক্ষন জেগে জেগে ভাবল নাহিদ। তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়ল সে।
পরদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে ই প্রথমে ফটোকপি র দোকান এ গিয়ে দোকানদার কে ঘুম থেকে জাগিয়ে লেখা গুলোর কপি করে নিল। তারপর পান্ডুলিপি বানিয়ে রওনা দিল বাংলা বাজারের দিকে।
সেখানে প্রভৃতি প্রকাশনের আশে পাশে ঘোরাঘুরি করল কিছুক্ষন। তারপর সময় কাটেনা দেখে রাস্তায় এসে কিছু ক্ষন হাটাহাটি করল। একে একে দশটায় সব দোকন খুলে গেল। সে প্রভৃতি প্রকাশনের বাইরে অপেক্ষা করছিল- এমন সময় প্রভৃতি প্রকাশনের পাশের দোকান খুলে ঢুকল এক আশি ছুই ছুই বৃদ্ধ। উনার প্রকাশনীর নাম “আদিত্য প্রকাশন”।
এগারোটা বাজতেই আস্তে করে দরজা দিয়ে ঢুকে বৃদ্ধের দিকে পান্ডুলিপি এগিয়ে দিল নাহিদ। বৃদ্ধ যেন আগে থেকে ই জানত সে আসবে। কিছুক্ষন কিছু পৃষ্টা উলটে পালটে দেখে বৃদ্ধ ওকে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিল। তারপর কাগজ কলম এগিয়ে দিল। সে পড়ে দেখল একটা ২০০ টাকার স্টাম্প।
সেখানে অনেক অনেক কথা লেখা। সে আস্তে আস্তে পড়ে তারপর সাক্ষর দিয়ে বের হয়ে আসল সেখান থেকে। সে বের হয়ে আসতেই একজন লোক দৌড়াতে দৌড়াতে এসে বৃদ্ধের কাছে আসল। ঐ লোক কে দেখেই নাহিদ ঐ খান থেকে চলে আসল তাড়াহুড়া করে।
এই ব্যাপার টা নিয়ে সেই আদিত্য প্রকাশনী থেকে খানিকটা সমস্যা হলেও শেষ পর্যন্ত নাহিদের বই বই মেলায় বের হল এবং চারদিকে ওর সুনাম ছড়িয়ে পড়ল।
যেন এক ঝটকায় ভাগ্য লক্ষ্মী ওকে খুলে দিল এক অবারিত সম্ভাবনার দ্বার।
.........................................................
ঠিক ৩৫ বছর পর
প্রখ্যাত লেখক নাহিদ হাসান উনার পঞ্চম সিনেমার পরিচালনা থেকে ফিরে মাত্র বাসায় এসে বসেছেন। রাত বাজে দুইটা। উনি ইদানিন অনেক বেশী ব্যাস্ত। ডিজিটাল মিডিয়াতে উনার বর্তমান সিনেমা “জীবনের গল্প” যেটা উনার নিজের জীবন নিয়েই বানাচ্ছেন সেটা নিয়ে ব্যাপক প্রচারনা হয়েছে।
ফলে উনি কাটাচ্ছেন অনেক কর্ম ব্যাস্ত দিন। আশা করছেন এই সিনেমা অস্কারে মনোনিত হবে। গতবছর একটুর জন্য অস্কার হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল একটা মালেশিয়ান সিনেমার জন্য। এবার উনাকে কেউ হারাতে পারবেনা- চিন্তা করতে করতে খানিকটা ঘুমিয়েছেন- এমন সময় উনার মোবাইলে একটা ফোন আসল। উনি ফোন ধরেই বললেন-
“ নাহিদ হাসান বলছি- কে বলছেন?”
ওপাশ থেকে কিছুক্ষন খস খস আওয়াজ করার পর কে যেন বলে ঊঠল-
“ কেমন আছো নাহিদ?”
গলাটা শুনেই ৩৫ বছর পর আবার চমকে ঊঠলেন তিনি।
মনে পড়ে গেল ঊনার বাবার কথা। সেই ৩৫ বছর আগে তিনি ফোন করেছিলেন। তারপর এতদিন পর তিনি আবার ফোন করলেন। আস্তে আস্তে অপাশ থেকে বলে ঊঠলেন-
“নাহিদ- কেমন আছো? আশা করি- ভাল আছ- শুনো- একটু পর আমি তোমাকে একটা লাইন দেব- সেখানে কে আছে জানার দরকার নেই- শুধু তুমি কথা বলবে”- বলেই থামলেন কেউ ওপাশ থেকে।
“কার সাথে কথা বলব আমি বাবা?” নাহিদ সাহেবের কন্ঠে সেই বিস্ময়।
“ তোমার জানার দরকার নেই। শুধু তুমি জেনে রাখ তূমি যা যা বলবে সব তোমার স্মৃটি থেকে। আজ থেকে ৩৫ বছর আগে রাতে তুমি ফোনে যা যা শুনেছিলে তাই তাই বলবে- একটা কথা ও বেশী বলবে না। একটা অক্ষর ও বেশী বা কম বলবে না। আমি এখন তোমাকে লাইনে দিচ্ছি”—বলেই খুট করে শব্দ হল একটা।
নাহিদ সাহেব হাঁ করে তাকিয়ে আছেন- এ রকম কিছু একটা হবে তিনি জীবনে ও ভাবতে পারেন নি। কেউ একজন উনাকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন কোথায় কিভাবে গিয়ে লেখা জমা দিতে হবে। এখন উনাকে এই কথা টা আরেক জনকে বলতে হবে- ভেবেই গলাটা শুকিয়ে গেল। ফোন কানে রেখেই এক গ্লাস পানি ঢক ঢক করে খেলেন তিনি। তারপর আবার ফোনে মনযোগ দিলেন তিনি।
অপাশ থেকে শুধু খর খর শব্দ হচ্ছে। কিছুক্ষন খর খর শব্দের পর চিনচিনে একটা শব্দ শুরু হল। তিনি বিরক্ত হয়ে ফোন রেখে দেবেন এমন সময় ওপাশ থেকে কেউ একজন বলে ঊঠল –
“হ্যালো”
কণ্ঠটা শুনেই বুকটা ধরাস করে ঊঠল উনার। গলাটা শুকিয়ে গেল এক নিমিশেই। কারন এই কন্ঠ তিনি খুব ভাল করে চিনেন।
উনার কোন রকম ভুল হচ্ছেনা। ভুল হবার কথা ও না। ওপাশ থেকে যে ফোন ধরেছে সে আর কেউ নয়- ৩৫ বছর আগের সেই নাহিদ হাসান- এখন কার বিখ্যাত নাহিদ হাসান নিজে ...
(সমাপ্ত)
উৎসর্গ ব্লগার দিপ জুবায়ের ও রিয়েল ডেমন ভাইকে ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।