দ্বিপাক্ষিক স্বার্থ সংরক্ষণে ভারত ও বাংলাদেশ
ফকির ইলিয়াস
================================
ড. মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফর করে গেলেন। না, তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হয়নি। বিগড়ে গেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী। তিনি আসেননি। বলা দরকার, তার একটা বিশেষ রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে।
বাংলাদেশ তার প্রটোকল বজায় রেখেই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালিয়েছে। সেক্ষেত্রে মমতার সঙ্গে বাড়তি যোগাযোগ রাখতে পারলে ভালো হতো। যে কারণেই হোক, মমতা তার আপত্তি জানিয়েছেন বলেই এই চুক্তি হয়নি, তা আপাতত ধরে নেয়াই যায়। এদিকে বাংলাদেশও ট্রানজিট চুক্তির পাতা নতুন করে খোলেনি। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত গেল ৫ সেপ্টেম্বর সোমবার পর্যন্ত বলেছিলেন, ট্রানজিট চুক্তি হবে।
এবং তা ২০১২ সাল থেকে কার্যকর হবে। অথচ মঙ্গলবার তার সুর পাল্টে যেতে দেখলো দেশবাসী। তিনি বললেন, নতুন করে ট্টানজিট চুক্তির কোনো দরকার নেই। আসলে কোথাও কোনো শূন্যতা আছে বলেই মনে করার নানা রকম যৌক্তিকতা থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। কারণ, মমতা না আসলে এই সফর ফ্যাকাশে হয়ে যেতে পারে তা বাংলাদেশের আগেই জানা উচিত ছিল।
মনমোহন সিংয়ের এই সফরে যা অর্জন হয়েছে তার মাঝে রয়েছে, আঞ্চলিক সহযোগিতা নিয়ে একটি রূপরেখা চুক্তিতে সই। এরপর একটি প্রটোকল ও কয়েকটি সমঝোতা স্মারকে সই করে দুই পক্ষ। চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠান শেষে যৌথ বিবৃতিতে দুই প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেন, ভারতে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাবে বাংলাদেশের ৪৬টি গার্মেন্ট পণ্য। এছাড়া তিনবিঘা করিডোর ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকবে।
বহু আলোচিত তিস্তা ও ফেনী নদীর পানিবণ্টন নিয়ে কোনো চুক্তি হয়নি।
ট্রানজিট বাস্তবায়নে দুই দেশের মধ্যে বিনিময় হয়নি সম্মতিপত্রও। আমরা পত্রপত্রিকায় দেখেছি, তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে আপত্তির কারণে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় শেষ মুহূর্তে এই সফর থেকে নাম প্রত্যাহার করে নেন। মনমোহন সিং ঢাকা আসার আগে সোমবার রাতে টেলিফোন করে মমতাকে আশ্বস্ত করেন, পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থহানি হবে এমন কোনো চুক্তি সরকার করবে না। ফলে বাংলাদেশ সরকারের দৃঢ় আশাবাদ সত্ত্বেও এ চুক্তি স্থগিত হয়ে যায়। কলকাতার ‘বর্তমান’ পত্রিকা একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম করে- ‘গুরুত্ব হারালো প্রধানমন্ত্রীর সফর’।
ঢাকা সফরে মনমোহন আর যে স্মারকগুলোতে সই করেছেন সেগুলো হলো - সুন্দরবনের সুরক্ষা, বাঘ রক্ষা, মৎস্য উৎপাদন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে শিক্ষা বিনিময়, কলকাতার দূরদর্শন ও বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং বিজিএমইএ ইনস্টিটিউট অব ফ্যাশন টেকনোলজি ও ভারতের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ফ্যাশন টেকনলজির (নয়াদিল্লি) মধ্যে সহযোগিতা বিষয়ে আরো ছয়টি সমঝোতা।
মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে চারটি অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ঢাকা এসেছিলেন। এরা হলেন- আসামের তরুণ গগৈ, মেঘালয়ের মুকুল সাংমা, ত্রিপুরার মানিক সরকার এবং মিজোরামের পু লালথানহাওলা। আমরা জানি এই চারটি অঙ্গরাজ্যই বাংলাদেশের খুব ঘনিষ্ঠ সীমান্ত প্রতিবেশী। তাই তাদের এই সফর গুরুত্বপূর্ণ ছিল অবশ্যই।
এই সফরকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশাবাদ দেশবাসীকে কিছুটা হলেও প্রাণিত করবে। তিনি বলেছেন, ‘মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফর এবং দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে দুই দেশের সম্পর্ক আরো এক ধাপ এগোলো। ’
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে দেয়া বক্তব্যে শেখ হাসিনা আরও বলেন- ‘বিশেষ করে দুই দেশের স্থলসীমা নির্ধারণ, যোগাযোগ, জ্বালানি, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া, শিক্ষা ও সুন্দরবনের ঐতিহ্য সুরক্ষার মতো বিষয়ে আমরা সমঝোতায় পৌঁছেছি। জাতীয় উন্নয়ন ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে সহযোগিতার নতুন ক্ষেত্র চিহ্নিত করেছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আজকের এই আলোচনা দুই দেশ ও এর জনগণের পাশাপাশি এ অঞ্চলের উন্নয়নে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
’
এদিকে মনমোহন সিংও বলেছেন- তিস্তা ও ফেনী নদীর হিস্যা বিষয়ে আরো আলোচনা হবে। তিনি বলেছেন- ভারত-বাংলাদেশ যৌথ স্বার্থকে আমরা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেবো।
এই চুক্তি না হওয়ায় দুঃখও প্রকাশ করেছেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী। তিস্তা চুক্তি না হওয়াকে ‘অনাকাক্সিক্ষত’ ও ‘দুর্ভাগ্যজনক’ বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। তবে তিনি এ চুক্তি না হওয়ার জটিলতা দূর করতে আলোচনা অব্যাহত রাখার কথাও বলেছেন।
বাংলাদেশ সফরের শেষ দিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে ‘ভারত বাংলাদেশ এবং দক্ষিণ এশিয়া’ শীর্ষক বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেছেন। উভয় দেশের জন্যই পানি একটি ‘স্পর্শকাতর’ বিষয় উল্লেখ করে মনমোহন সিং বলেছেন, এ সফরে আমরা তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সমাধানে পৌঁছতে দুই পক্ষই কঠোর পরিশ্রম কাজ করে আসছিলাম। একটি চুক্তিতে পৌঁছতে পারবো বলেও আমি আশাবাদী ছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এ উদ্যোগ সফল হয়নি। তবে যারা এ নদীটির পানির ওপর নির্ভরশীল তাদের কল্যাণের কথা বিবেচনায় রেখে আমি ভারত ও বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের একটি কল্যাণকর নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি বের করতে বলেছি।
তিনি বলেন, এক্ষেত্রে এমন কোনো পদক্ষেপ নেয়া হবে না, যা বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর হবে। তবে ’৯৬-এর গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তির উদাহরণ টেনে ‘সহযোহিতা ও সমতার ভিত্তিতে’ এটি সমাধান করা সম্ভব বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন তিনি। এই তিস্তা পানি চুক্তি কেন হয়নি, তার কারণ বাংলাদেরশকেও খুঁজতে হবে। মনে রাখতে হবে, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তাদের রাজ্য সরকারের স্বার্থ বাদ দিয়ে কিছুই করবে না। আর মমতা ব্যানার্জী তার প্রতিপক্ষ বাম দল, বিজেপি এদের চাপের মুখে কিছু করতে হলে তার নির্বাচনী মাঠ বাঁচিয়েই করবেন।
বাংলাদেশের উচিত হবে দিল্লির পাশাপাশি কলকাতার সঙ্গেও ডিপ্লোমেসি প্রক্রিয়া বজায় রেখে কাজ এগিয়ে নেয়া। আমরা দেখেছি, বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কের বিষয়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমরা সবসময়ের জন্য প্রতিবেশী ও বন্ধু হয়ে থাকবো। যদি আমরা ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি নতুন সমন্বিত মডেল গ্রহণ করতে সক্ষম হই, তাহলে এটা দক্ষিণ এশিয়ার ভাগ্যে প্রবল প্রভাব ফেলবে। এর তাৎপর্য হচ্ছে এইÑ ভারত এই উপমহাদেশে যে ‘রিজিওনাল পাওয়ার’ হবার মহড়া দিতে চাইছে তাতে বাংলাদেশের সমর্থন আদায় করা। কিন্তু কথা হলো এই, যারা ‘পাওয়ার’ হতে চাইবে- উদার তাদেরকেই হতে হবে।
উদারত্ব, মহত্ত্ব দেখাতে না পারলে অন্যরা এই শক্তিমান কে মানবে না। মানার রেওয়াজ ভারতকেই চালু করতে হবে। আর এজন্য ছাড় দিয়ে তিস্তার পানিবন্টন ভারতকেই করা উচিৎ।
অন্যদিকে মনমোহন সিং বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করেও বলেছেন, বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী কোনো কাজ ভারত করবে না। টিপাইমুখ বাঁধ বিষয়ে খালেদা জিয়া উভয় দেশ মিলে একটি কারিগরি দল গঠন করে পরিবেশ এবং অন্যান্য বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার প্রস্তাব দিয়েছেন।
তা শেষে তথ্য বিনিময়ের পর টিপাইমুখ বাঁধের বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখার প্রস্তাব করলে ড. মনমোহন সিং এ প্রস্তাবকে স্বাগত জানান। খালেদা জিয়া ড. মনমোহনকে আরো বলেন, এ বিষয়ে বিএনপি একটি কারিগরি টিম গঠন করে পরীক্ষার বিষয়টি ভারতকে জানাবে। ড. মনমোহন বলেন, তিনি দেশে ফিরে এ বিষয়ে তার সরকারকে নির্দেশ দেবেন। এতে দেখা যাচ্ছে, ভারত প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গেও যৌথ মতবিনিময়ের ভিত্তিতে কাজ করতে চাইছে। যা একটি ভালো লক্ষণও বলা যায়।
তারপরও যদি বিএনপি, মহাজোট সরকারের বিরুদ্ধে ভারত ইস্যু নিয়ে আন্দোলনের ডাক দেয়া শুরু করে তবে তা হাস্যকর বলেই বিবেচিত হবে।
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর দুদিনের সফর শেষে যে যৌথ বিবৃতি আমরা দেখেছি, তাতে ভারতকে পণ্য আনা-নেয়ায় চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের সব আনুষ্ঠানিকতা ‘যতো দ্রুত সম্ভব’ সম্পন্ন করা হবে বলে যৌথ বিবৃতিতে উল্লেখ করেছেন দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী। একই সঙ্গে তিস্তা ও ফেনী নদীর পানি ভাগাভাগির বিষয়ে যে ঐকমত্য হয়েছে তাকে স্বাগত জানিয়ে দুই প্রধানমন্ত্রী যতো দ্রুত সম্ভব এ দুটি চুক্তি সম্পাদনের কাজ শেষ করতেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন। দুটি বিষয়ই আশার কথা। আসামি প্রত্যর্পণসহ ৬৫টি দফা সংবলিত যে যৌথ বিবৃতি এসেছে তার আলোকে, তা মেনে দুই দেশকেই কাজ করা দরকার।
উভয় দেশেরই মনে রাখা দরকার, পৃথিবী ছোট হয়ে আসছে। স্বার্থরক্ষা এক পক্ষের দ্বারা হবে না। খোলা মন নিয়ে দুই পক্ষকেই এগিয়ে আসতে হবে। ভারত বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিবেশী দেশ। ভারতকে বাংলাদেশ কখনোই প্রভু মনে করে না।
করার কোনো কারণও নেই। বিশ্বে অনেক দেশ আছে, যারা পরাক্রমশালী প্রতিবেশীর পাশে শির উন্নত করেই বেঁচে আছে। বাংলাদেশের মানুষরা এর চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। তাই ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে যতোটা উদার-বন্ধুসুলভ আচরণ করবে, উপমহাদেশে শান্তির পথ ততোটাই অবারিত হবে।
৮ সেপ্টেম্বর ২০১১
---------------------------------------------------------------------------
দৈনিক ভোরের কাগজ/ ঢাকা/ ১০ সেপ্টেম্বর ২০১১ শনিবার
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।