সাম্রাজ্যবাদি আঞ্চলিক শক্তি ভারতের সাথে বাংলাদেশের শাসক শ্রেণীর বন্ধুত্বের নাটক যখন তুঙ্গে, যখন তিস্তার পানি বন্টন নিয়ে নামতা জপার পরও “বন্ধু পানি দিলনা” বলে আফসোসের জিগির উঠেছে, যখন কাটাতারের ঘেরাওয়ের মধ্যে বসে ট্রানজিটের মাধ্যমে রাস্তা-বন্দর ভাড়া খাটিয়ে “বেশ্যা অর্থনীতি”র বেসাতি চলছে তখন “সুখবর” পাওয়া গেল বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের এক গুরুত্বপূর্ণ নদী সারী-গোয়াইনের উজানে বাধ বানানো শেষ করে এনেছে। গত কয়েকদিন ধরে এই বাধ নিয়ে সিলেট অঞ্চলে প্রতিবাদ বিক্ষোভ চলছে, কয়েকটি দৈনিক এবং অনলাইনে খরবও প্রকাশিত হয়েছে কিন্তু শাসক গোষ্ঠীর তাতে কিছু যায় আসে বলে মনে হয় না, তারা টিপাইমুখ বাধের মতোই “বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর কোন কিছু করা হবে না” জাতীয় ভারতের আশ্বাস বাণী শুনতেই আরাম বোধ করেন। আসলে এরা বিষয়টি জেনেও না জানার ভান করছে, ভারতের কাছে আশ্বাস বাণী পাওয়ার আগেই আশ্বস্ত হয়ে বসে আছে, কারণ এটাই এই শ্রেণীর জন্য লাভজনক।
সিলেটের জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, কোম্পানিগঞ্জ ও সদর উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চল দিয়ে বয়ে যাওয়া সারী-গোয়াইন বা হারি গাঙ নদীর উতপত্তি ভারতের মেঘালয় পর্বতে। জৈন্তাপুরের লালখাল এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের আগে মাইনথ্রু(MYNTDU) নদী নামে প্রবাহিত হয়েছে।
এই মাইনথ্রু নদীতেই মেঘালয়ের লেসকা অঞ্চলে “মাইনথ্রু লেসকা হাইড্রোইলেক্ট্রিক প্রেজক্ট” নামে ১২৬ মেগাওয়াটের(৪২*২ + ৪২*১) এ্কটি জলবিদ্যুত প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষ করে এনেছে ভারত।
সূত্র: Myntdu Leshka St-I H.E. Project
http://meseb.nic.in/leshka.htm
২০০২ সালে উদ্বোধন হওয়া এই প্রকল্পটি চলতি সেপ্টম্বর মাসেই চালু হওয়ার কথা।
সূত্র:http://www.banglanews24.com/detailsnews.php?nssl=db1f9216e9ca7015a7186f2ca72a94b0&nttl=2011090656470
ছবি: প্রজেক্টের কাজ প্রায় শেষ
সূত্র: Status of Works of Myntdu Leshka HE Project
http://meseb.nic.in/leshka/StatusofWorks.pdf
প্রকল্পের ওয়েবসাইটে এটাকে রান অফ রিভার(Run Off River) ড্যাম বলে চিহ্রিত করা হলেও বাস্তবে বাধের ঠিক আগে লামু(Lamu), উমসারিয়াঙ(Umshariang) এবং মাইনথ্রু(Myntdu) এই তিন নদীর মোহনায় একটি বড় আকারের জলাধার নির্মাণের ফলে এটি আর রান অফ রিভার ড্যামের মতো কাজ করবে না। কারণ সাধারণ ভাবে রান অফ রিভার বাধের ক্ষেত্রে নদীর বেশির ভাগ পানি পাইপ বা টানেলের মাধ্যমে বিদ্যুত উতপাদনকারী টারবাইনের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত করে তারপর আবার সেটাকে নীচের দিকে নদীর পুরোনো গতিপথে ফিরিয়ে দেয়া হয়, জলেধারে বিপুল পরিমাণ পানি ধরে রাখা ও সুবিধা মতো সময়ে পানি প্রবাহ বাড়ানো কমানোর তেমন কোন ব্যাপার থাকে না।
In general, projects divert some or most of a river’s flow (up to 95% of mean annual discharge)[4] through a pipe and/or tunnel leading to electricity-generating turbines, then return the water back to the river downstream.
সূত্র: Click This Link
কিন্তু এক্ষেত্রে জলাধার ব্যাবহার করে প্রয়োজনের অনুযায়ী পানি ধরে রাখা এবং প্রয়োজন মতো পানি ছেড়ে দেয়ার সুযোগ থাকায় আর দশটা জলবিদ্যুত প্রকল্পের মতোই নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহের উপর কৃত্রিম নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে বাধটি যার খেসারত দিতে হবে নদীর ভাটি অঞ্চলে অবস্থিত জনগণকে।
ছবি: মাইনথ্রু-লেসকা হাইড্রোইলেক্ট্রিক প্রজেক্টের লেআউট ম্যাপ
তাহলে জলাধারে পানি ধরে রাখার সুযোগ রাখার পরও কেন এটিকে রান অফ রিভার ড্যাম বলা হচ্ছে? উইকিপিডিয়ায় এ সম্পর্কে একটা ইন্টারেষ্টিং বক্তব্য পাওয়া গেল:
The use of the term "run-of-the-river" for power projects varies around the world and is dependent on different definitions. Some may consider a project ROR if power is produced with no storage while a limited storage is considered by others. Developers may mislabel a project ROR to sooth public image about its environmental or social effects.
সূত্র: Click This Link
তাহলে দেখা যাচ্ছে রান অফ রিভার নাম করণেরও একটা রাজনীতি আছে। বাধের পরিবেশগত এবং সামাজিক প্রভাবকে আড়াল করার জন্য অপেক্ষাকৃত “পরিবেশ সম্মত” বলে পরিচিত রান অফ রিভার ড্যাম বলে লেবেল দেয়া হচ্ছে। বাস্তবে এর সমস্ত আয়োজন ট্র্যাডিশনাল হাইড্রোইলেক্ট্রিক বাধের মতোই, ট্রাডিশনাল হাইড্রোইলেক্টিক প্রজেক্টের মতোই এতে পানি ধরে রাখা এবং সুযোগ মতো পানি ছাড়া অর্থাত পানির প্রাকৃতিক প্রবাহের পরিমাণ হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটানোর ব্যাবস্থা আছে।
ফলে আশংকা হলো, মাইনথ্রু-লেসকা বাধ নির্মাণের ফলে ভাটিতে অবস্থিত বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া সারী নদীর প্রাকৃতিক পানি প্রবাহের হ্রাস বৃদ্ধি, পলি প্রবাহ, নদীর পানির গতি-তাপমাত্রা, মতস সম্পদ, জলজ উদ্ভিদ ইত্যাদি অর্থাত নদী কেন্দ্রিক গোটা বাস্তু সংস্থানের উপরই বিরুপ প্রতিক্রিয়া পড়বে এই বাধ নির্মাণের ফলে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পানি সম্পদ বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম.ইনামুল হক বলেন:
“ড্যাম এর জলাধারের কারণে আশপাশের কৃষিজমি ভেসে যাবে, জনবসতি উচ্ছেদ হবে, পশুপাখির আবাস নষ্ট হবে আর বাধের কারণে মাছ নদীর উজানে যেতে না পেরে ব্রিডিং গ্রাউন্ড হারাবে।
আর বাংলাদেশে আসা মাছের পরিমাণ কমে যাবে, পানি প্রবাহ বিঘ্নিত হবে যা আবার শীতাকালিন ফসলের ক্ষতি করবে। আমাদের উচিত এই প্রকল্পের বিরোধীতাকারী ভারতীয় জনগণ ও পরিবেশবাদীদের সমর্থন করা। “
সিলেটের আঞ্চলিক পত্রিকা শ্যামল সিলেট এ বিষয়ে লিখেছে:
“সারী নদীর উজানে বাধ দেয়ার খবর পেয়ে এ নদী তীরবর্তী অঞ্চলের লোকজন ক্ষোভে ফুসছেন। বাধ অপসারণের দাবীতে গঠন করা হয়েছে “সারী নদী বাচাও আন্দোলন”। সংগঠনের সমন্বয়ক লিডিং ইউনিভার্সিটির সহকারী রেজিস্টার আব্দুল হাই জানান ব্যাবসা সংক্রান্তকারণে জৈন্তাপুরের লোকজন জৈন্তিয়া হিল ডিস্টিক্টে যাতায়াত করেন।
ভারতে যাতায়াত কারী ব্যাবসায়ীদের কাছ থেকেই আমরা প্রথম বাধ নির্মাণের খবর পাই। পরে মাইন্ডু লেসকা হাইড্রোইলেক্ট্রিক প্রজেক্টের ওয়েবসাইট থেকে আমরা বিষয়টি নিশ্চিত হই। তিনি বলেন বাধের কারণে সারী নদী মরে যাবে। নদী তীরবর্তী এলাকার লোকজনের জীবন জীবিকার উপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে। এ প্রসঙ্গে পরিবেশ বিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুগোল ও পরিবেশ বিভাগের সাবেক ড.মুহম্মদ আব্দুর রব বলেন, তিনি মাইন্ডু লেসকা হাইড্রোইলেক্ট্রিক প্রজেক্ট ও মেঘালয় এনার্জি কর্পোরেশান লিমিটেড এর ওয়েবসাইট থেকে বাধটি সম্পর্কে জানতে পেরেছেন।
তিনি বলেন উজানে বাধ দেয়ার ফলে সারী নদীর স্বাভাবিক গতি বিঘ্নিত হবে। পানির সঙ্গে পলি আসা বন্ধ হওয়ায় এ অঞ্চলের মাটির উর্বরতা কমে আসবে। শীতকালে নদীর পানি স্বল্পতার কারণে কৃষিকাজ বিঘ্নিত হতে পারে। সিলেট অঞ্চলের উদ্ভিদ ও জলজ সম্পদ ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার পাশাপাশি ইকোসিস্টেমের বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। তার মতে বাংলাদেশ সফরে আসা ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সামনে বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর এ বাধ ও বিদ্যুত প্রকল্প বাতিলের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ জানাতে হবে।
“
সূত্র: Click This Link
আমরা “সারী নদী বাচাও আন্দোলন” এর সাথে সংহতি প্রকাশ করছি এবং সেই সাথে বাংলাদেশকে না জানিয়ে, বাংলাদেশের সস্মতি-অসম্মতির তোয়াক্কা না করে ভারতের এই বাধ নির্মাণ ও চালু করে ফেলার সকল প্রক্রিয়া অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য ভারতের সাথে বন্ধু বন্ধু খেলা বাদ দিয়ে রাষ্ট্রীয় ভাবে দ্বিপাক্ষিক ও আন্তর্জাতিক ভাবে সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগের দাবী জানাচ্ছি।
কৃতজ্ঞতা: লেখায় ব্যাবহ্রত মানচিত্র এবং তথ্য দিয়ে সহোযোগিতা করেছেন প্রকৌশলী ম.ইনামুল হক। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।