আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প: রেবা ও রাফি

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ রাফি এই মুহূর্তে সায়েন্স ল্যাবরেটরির মোড়ে ফুটপাত ধরে হাঁটছিল। বেলা তিনটের মতো বাজে। ভ্যাপসা গরম।

রোদের আঁচে ওর শ্যামলা মুখটা ঘেমে গেছে। চারটের সময় রাফির একটা টিউশনি আছে। তার আগে ঘন্টাখানেক এদিক-সেদিক ঘুরে কাটাতে হবে। টিউশনি ঝিকাতলায়। একটা মেয়েকে নজরুল গীতি শেখায়।

নাম স্বর্ণা। চমৎকার গলা স্বর্ণার । হঠাৎ দূর থেকে জুলফিকারকে দেখে থমকে দাঁড়াল রাফি । জুলফিকার-এর হাতে একটা তানপুরা। একটা মিউজিক শপে ঢুকছে।

জুলফিকারকে দেখে রাফির চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। ও চট করে সরে দাঁড়ায়। অবশ্য জুলফিকার ওকে দেখতে পায়নি। দেখতে পেলে বিব্রতকর অবস্থা হত । তার কারণ আছে।

সম্পর্কে জুলফিকার রাফির গুরুভাই। অর্থাৎ ওরা দুজনেই ওস্তাদ সাফকাত খান-এর কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীত শিখত। অত্যন্ত গুণি শিল্পী ওস্তাদ সাফকাত খান। উয়ারি থাকেন। রেডিও-টিভির অনেক বড় বড় শিল্পীকে তৈরি করেছেন, তালিম দিয়েছেন।

ওস্তাদ সাফকাত খান-এর কাছে তালিম নেয়া ভাগ্যের ব্যাপার। তো সেই ভাগ্য রাফির সইল না। ওই জুলফিকারের জন্যই। রাফির গায়কির ঢংটি অসাধারণ বলেই জুলফিকার ওকে ঈর্ষা করত। জুলফিকারদের পরিবারটি বেশ প্রভাবশালী।

ওস্তাদ সাফকাত খান-এর শিষ্যরা ওর পিছন পিছন ঘুরত। ওরাই ওস্তাদের কানে রাফির নামে যা তা লাগাল। রাফি নাকি বলেছে ... ওস্তাদের গায়কিতে নাকি অজয় চক্রবর্তীর ছাপ আছে। অমন কথা শুনে ওস্তাদের মনক্ষুন্ন হওয়ারই কথা। বছর খানেক হল আর উয়ারি যায় না রাফি।

ওস্তাদের ওপরও রাফির অভিমান রয়েছে। উনিই-বা কথাটা বিশ্বাস করতে গেলেন কেন? চারটে বাজার কিছু আগেই ঝিকাতলার মনেশ্বর রোডে চলে এল রাফি। চারতলা বাড়ি। স্বর্ণারা চারতলায় থাকে। বাঁ পাশের ফ্ল্যাটে।

বেল বাজাতে স্বর্ণাই দরজা খুলল । সালাম দিয়ে মিষ্টি করে হাসল। এবার ক্লাস নাইনে উঠেছে মেয়েটি। একটা প্রাইভেট টিভি চ্যানেলে গানের প্রতিযোগিতায় প্রাথমিক পর্যায়ে টিকে গেছে। বসার ঘরের কার্পেটের ওপর হারমোনিয়াম রাখা ।

হারমোনিয়ামের সামনে বসে রাফি । রিডে আঙুল চালিয়ে ‘আমি পথ মঞ্জুরী / ফুটেছি আঁধার রাতে’ সুরটা তোলে। স্বর্ণা গলা মেলায়। একটু পর স্বর্ণার মা এলেন। ফরসা মতন।

পঁয়ত্রিশের মতন বয়স। ভদ্রমহিলার নাম শাহিনা হক। মাঝে মাঝে টিভিতে গান করেন । নজরুলগীতি। ওস্তাদ সাফকাত খান-এর গান শিখেছেন কিছুদিন।

সেই সূত্রেই রাফির সঙ্গে পরিচয়। শাহিনা হক- এর হাতে একটা গ্লাস। গ্লাসে শরবত। রাফির তেষ্টা পেয়েছিল। চুমুক দিয়ে বুঝল পেঁপের শরবত।

জুলফিকারকে দেখে রাফির মনে যে বিষাদ জমেছিল, সেটি দূর হতে থাকে। শাহিনা হক চমৎকার ভঙ্গিতে পা মুড়ে বসলেন কার্পেটের ওপর। তারপর বললেন, খবরটা কি তুমি শুনেছ রাফি ? কোন্ খবর ? রাফি খানিকটা অবাক। ওস্তাদ সাফকাত খান গুরুতর অসুস্থ। গতকাল ফৌজিয়া ফোন করেছিল।

ওই আমাকে বলল। ওহ্ । রাফির আঠাশ বছরের শরীরটি কেঁপে ওঠে। ওস্তাদজীর জন্য বিষাদ টের পায় শাহিনা হক আক্ষেপের সুরে বললেন, রেডিও-টিভির অনেক বড় বড় শিল্পীকে ওস্তাদজীর কাছে তালিম দিয়েছেন। এখন দেখার কেউ নেই।

পুরনো ঢাকার একটা হাসপাতালে বেডে একা পড়ে আছেন। কাল ফৌজিয়া গিয়েছিল দেখতে। রাফি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ওস্তাদ সাফকাত খান বিপতœীক। একটাই মেয়ে।

ডলি। সুন্দরী। বছর পাঁচেক আগে মডেলিং এ নেমেছিলন । তারপর মিডিয়ার মন্দ লোকদের পাল্লায় পড়ে উচ্ছন্নে গেছে। বাবার খোঁজখবর নেয় না।

এ নিয়ে ওস্তাদ সাফকাত খান-এর গোপন দুঃখ আছে। রাগ ইমন কিংবা ভৈরবীর ধূন গেয়ে দুঃখ ভোলেন ওস্তাদ। স্বর্ণাকে গান শিখিয়ে বেরুতে-বেরুতে সন্ধ্যা হল। তার আগে শাহিনা হক-এর কাছ থেকে হাসপাতালের ঠিকানা নিল রাফি। বড় অস্থির লাগছিল।

কত দিন ওস্তাদের উয়ারির বাড়ি যাওয়া হয় না। বিশাল ড্রইংরুমের মেঝেতে বসে গান -কথা- হাসি ... বুকটা হু হু করে। এখন হাসপাতালে দেখা হবে। হয়তো শেষ দেখা-কে বলতে পারে। নয়নার কথা মনে পড়ে।

নয়নাকে ভালো লাগত রাফির। নয়না সেটা জানত। অদ্ভূত উদাসীনতা দেখিয়েছিল মেয়েটি। ও জুলফিকারের দিকে ঝুঁকল । জুলফিকার নয়নাকে দিয়ে বলাল, ওস্তাদের গায়কিতে নাকি অজয় চক্রবর্তীর ছাপ আছে।

ওস্তাদজী রাফিকে সবার সামনে অপমান করলেন। মাথা নীচু করে বেড়িয়ে এসেছিল রাফি। এক বছর আগে ... ২ বড় চাচা নিস্তেজ ভঙ্গিতে বিছানায় শুয়ে আছেন। চাচার পান্ডুর মুখের দিকে তাকিয়ে রেবার শরীর হিম হয়ে আসে। বড় চাচার এখন কিছু হয়ে গেলে? তখন থেকে আজাদ ভাইকে ফোন করছে রেবা ।

আজাদ ভাই ফোন ধরছে না। আজাদ রেবার চাচাতো ভাই । এখন আর এ বাড়িতে থাকে না। মাঝে মাঝে আসে। কী ব্যবসা করে, সেটিও খুলেও বলে না।

উহঃ, আজাদ ভাই ফোন ধরছে না কেন? আজ যদি না আসে? চাচাকে হাসপাতালে নেওয়া দরকার। রেবার তেইশ বছরের শরীরটি কেঁপে ওঠে। । পাশের বাড়ির রওশন ভাবী আর ইকবাল ভাই অবশ্য খোঁজ খবর নেয়। দু পরিবারের সম্পর্ক খুব ভালো।

ওদের একটাই মেয়ে । মৌমিতা। এবার ক্লাস এইটে উঠল। বেল বাজল। রেবা দরজা খুলে দেখল রওশন ভাবী।

শ্যামলা মতন। পঁয়ত্রিশের মতন বয়স। ছাপা শাড়ি পরে আছে। ভিতরে ঢুকে বলল, চাচা এখন কেমন? দরজা বন্ধ করতে করতে রেবা বলল, ঘুমিয়ে আছে। ভালো মনে হল না।

অত ভাবিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি কী করব ভেবে পাচ্ছি না। আজাদ ভাই ফোন ধরছে না। রেবার গলায় কান্নার আঁচ।

আমরা আছি। অত ভেঙে পড়িস না। বলে রওশন রেবা জড়িয়ে ধরে। রওশন ভাবীর আলিঙ্গনে কেঁপে ওঠে রেবা। রেবার একবার বিয়ে হয়েছিল ।

সুখি হয়নি। শাশুড়ি আর বর মেরে ধরে তাড়িয়ে দিয়েছে ছ’ মাসের মাথায়। বোর ভিতরে আলিঙ্গনের তৃষ্ণা আছে। সে তৃষ্ণা বড় গভীর। বিকেলে দিকে বড় চাচার শরীর অবশ হয়ে এল।

ইকবাল ভাই অফিসে ছিলেন। রওশন ভাবী ইকবাল ভাইকে ফোন করে। ইকবাল ভাই এলে বড় চাচাকে হাসপাতালে নেওয়া হল। হাসপাতাল কাছেই। বড় চাচার মুখে অক্সিজেন মাক্স পরানোর পর নিশ্চিন্ত হল রেবা।

আজাদ ভাই তখনও আসেনি ... ৩ হাসপাতালে ওস্তাদ সাফকাত খান-এর ফ্যাকাশে মুখের দিকে তাকিয়ে রাফি তীব্র কষ্ঠ অনুভব করে। অসুখে বিসুখে বৃদ্ধ কে শীর্ণ দেখায়। একা হাসপাতালের বেডে পড়ে আছেন। অথচ ওস্তাদজী যাদের তৈরি করেছেন বাজারে তাদের অ্যালবামের ছড়াছড়ি। গত ঈদে নয়নার একটি অ্যালবাম বের হল।

প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও অনুষ্ঠান থাকে নয়নার । গত বছর জুলফিকার কে বিয়ে করেছিল। সেই জুলফিকারও বোধ হয় হাসপাতালে আসে নি। গতকালও একবার এসেছিল রাফি। রাতে।

ওস্তাদজীর পাশে তখনও কেউ ছিল না। ওকে চিনতে পেরে ওস্তাদজী চিৎকার করে উঠেছিলেন, যাঃ, তুই এসেছিস কেন! কন্ঠে গভীর অভিমান টের পেয়েছিল রাফি। ঠিক তখনই রাফিকে দেখে রেবা । লম্বা। শ্যামলা।

কোঁকড়া চুল। পাঞ্জাবি পরা। শ্যামল মিষ্টি মুখ। চোখে চশমা। রাফিকে দেখে রেবা কিছুটা অবাক।

যদিও বৃদ্ধের সঙ্গে সম্পর্ক আঁচ করতে পারছে না। তবে রাফিকে ভালো লাগছে। বৃদ্ধ গালমন্দ করার পরও ডাক্তার-নার্সদের সঙ্গে কথা বলছে। বৃদ্ধের গালমন্দ থামেনি। ছেলেটা তারপরও আজও এসেছে।

এই ভালো লাগার কারণ। হাসপাতালে আসার পর বড় চাচার শরীর বেশ চাঙা হয়ে উঠেছে। রেবা বোঝে, বড় চাচা আসলে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। রেবার বিয়েটা টিকল না। তার ওপর ছেলের রহস্যময় জীবন।

আজাদ ভাই ফোন করেছিল। তখন রেবা সব খুলে বলেছিল। আজাদ ভাই হাসপাতালের ঠিকানা চাইল। একজন বেঁটে মতন ফরসা কালো টি শার্ট আর জিন্সের প্যান্ট পরা টেকো লোক দশ হাজার টাকা দিয়ে গেল। লোকটাকে দেখে ঘেন্না ধরে গিয়েছিল রেবার।

শরীরে অদ্ভূত গন্ধ। মদ খায় বলে মনে হল। আজাদ ভাই মাঝে মাঝে বাড়ি আসে। তখন আজাদ ভাইয়ের ঘরেও রকম ঝাঁঝালো গন্ধ পায় রেবা। আজাদ ভাই ঘরে এলে রেবা আতঙ্কে থাকে।

ক্ষুধার্ত হায়নার মতো রেবার শরীর ঘাঁটে আজাদ ভাই। থাইল্যান্ডের হোটেলের নগ্ন মেয়েদের সঙ্গে তোলা ঘনিষ্ট ছবি দেখায়। এই কুৎসিত দিকটার কথা শুধু রওশন ভাবী জানে। রেবার প্রাক্তন স্বামীও রেবার শরীর নিয়ে কুৎসিত মাংশল উৎসবে মেতে উঠত। তবে আজাদ কিংবা রেবার প্রাক্তন স্বামী রেবার শরীর নিয়ে যাই করুক-পুরুষ নারীকে পুরোপুরি ভাঙতে পারে না বলেই রেবা আজও টিকে আছে ... গতকাল অনেক রাতে একবার রওশন ভাবী আর ইকবাল ভাই এলেন।

তারা একটা দুঃসংবাদ দিলেন। ইকবাল ভাই অস্ট্রেলিয়ায় ভিসার আবেদন করেছিলেন। ভিসা হয়ে গেছে। এ মাসেই চলে যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়ায়। রেবার পায়ের তলার মাটি পিছলে সরে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছিল ...চোখে মুখে অন্ধকার দেখে।

রাফি আজ হাসপাতাল থেকে চলে যাওয়ার সময় রেবা অনেকটা মরিয়া হয়ে বলল, প্লিজ। আমাকে একটু হেল্প করুন। রাফি থমকে দাঁড়ায়। রেবা বলে, আমার অষুধ লাগবে। দেখছেনই তো আমার সঙ্গে কেউ নেই ।

বলে ভাঁজ করা প্রেসক্রিপশনটা বাড়িয়ে দিয়েছিল। প্রেসক্রিপশনের ভিতরে একটা একহাজার টাকার নোট। রাফি খানিকটা বিস্মিত হলেও বলল, ঠিক আছে। এনে দিচ্ছি। রাফির মন আজ ফুরফুরে ছিল।

ওস্তাদজীর ব্যবহার ধীরে ধীরে সহজ হয়ে উঠেছে। ওস্তাদজীর মনের জোর অসাধারণ। এ যাত্রায় বেঁচে যেতেও পারেন। আজ ওস্তাদজীকে কমলার রস খাওয়ালো রাফি। অনেকটা জোর করেই।

ওস্তাদজী তখন জিগ্যেস করলেন, তুই নাকি বলেছিস আমার গায়কিতে নাকি অজয় চক্রবর্তীর ছাপ আছে। নাঃ। বলিনি। হুম। তালে বল আমি কেমন গাই? আপনার মতো গায়কির ঢং ভারতীয় উপমহাদেশে কারও নেই।

রাফি বলল। ওস্তাদজী রাফির মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন, তাহলে এখন বল, অজয় চক্রবর্তীর গান তোর কাছে কেমন লাগে? স্বর্গীয়। ওর মেয়ে, কৌশীকির? অসাধারণ। স্পেশালি কোনটা? খাম্বাজ।

বেশ। বলে হাসলেন। তারপর বললেন, কানাডার টরোন্টোতে টু থাউজেন্ড টেন এর এপ্রিলে কৌশীকি আমার ভূপালি শুনে ঠিক ওই কথাই বলেছিল। বলেছিল, ওস্তাদজী। আপনার মতো গায়কির ঢং ভারতীয় উপমহাদেশে কারও নেই।

রাফি হাসে। বলে, কৌশীকি সত্যি কথাই বলেছে। ওস্তাদজী বললেন, যাক। এ যাত্রায় আমি বেঁচে গেলে আমার বাড়িতে শুধু তুই আসবি। অন্যগুলোকে আসতে মানা করে দেব।

ফৌজিয়া এসেছিল শুনলাম। রাফি বলল। হ্যাঁ। আর ওকে আসতে দেব। এখন দে, আমার মোবাইল ফোন দে।

সবাইকে ফোন করে আমার বাড়ি আসতে নিষেদ করে দিই। অষুধ কিনে ওয়ার্ডে ফেরার পর রাফি থমকে গেল । রেবা ওস্তাদজীর বেডে বসে আছে। ওস্তাদজীর সঙ্গে দিব্যি আলাপ জমিয়ে ফেলেছে। ওস্তাদজীর মুখ কেমন জ্বলজ্বল করছে।

রেবাকে খাসির শাহী বিরিয়ানির রেসিপি নিয়ে কী সব বলছেন ওস্তাদজী । ৪ আজ সকাল থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি পড়ছিল। দুপুরেও ছাড়েনি। ঝিরঝির করে ঝরে যাচ্ছিল। স্বর্ণাকে নতুন একটা গান দেখিয়ে দিচ্ছিল রাফি।

ভরিয়া পরাণ শুনেতেছি গান/ আসিবে তুমি বন্ধু মোর। এক কাপ চা নিয়ে স্বর্ণার মা শাহিনা হক এলেন। ভদ্রমহিলার মুখটা বিমর্ষ মনে হল। বললেন, ওস্তাদজী ফোন করে ওনার বাড়ি যেতে নিষেধ করেছেন। আপনি হাসপাতালে যাননি কেন? রাফির কন্ঠস্বর সামান্য কর্কস ঠেকল।

কী ভাবে যাই বলেন। কানাডা থেকে স্বর্ণার ফুপুরা সব এল ...বলে শাহিনা হক নানা অজুহাত দেখাতে থাকে। তারপর মেয়েকে বললেন, যা তো। টেবিলের ওপর থেকে বিসকিটের প্লেটটা নিয়ে আয়। ভুলে ফেলে এসেছি।

স্বর্ণা উঠে ভিতরের ঘরে যায়। শাহিনা হক ফিসফিস করে বলেন, নয়না আর জুলফিকারের ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছে জান? রাফি চমকে ওঠে। বলে, কে বলল? ফৌজিয়া। মাত্র এক বছরের মাথায় । ভাবলে অবাক হতে হয়।

রাফির ভ্রুঁ কুঁচকে যায়। ঠিক তখনই রাফির মোবাইল ফোনটা বাজল। রেবা । বলল, বড় চাচা আপনাকে একবার দেখতে চায়। রাতে কিন্তু আমাদের এখানে খাবেন।

খাবেন তো? স্বর্ণা বিসকিটের প্লেট নিয়ে ফিরে এসেছে। রাফি ফিসফিস করে বলল, এখন টিউশনি তে আছি। বিকেলের দিকে আসছি। ঠিক আছে। আর আসার সময় মনে করে বড় চাচার জন্য আধা কেজি আঙুর নিয়ে আসবেন।

আর একটা সাবানও লাগবে। লাক্স সাবান। সাবান ফুড়িয়ে গেছে। বলে, রেবা ফোন অফ করে দেয়। ৫ রেবা রান্নাঘরে ছিল।

রাফির জন্য গুড়ের পায়েস রাঁধছিল। বড় চাচা ঘুমিয়ে আছেন। পাশে ফ্ল্যাটে রওশন ভাবীরা নেই। বিদেশ চলে যাচ্ছে। কবে ফেরে না -ফেরে।

দেশে গেছে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে । ইকবাল ভাইদের দেশের বাড়ি চট্টগ্রামের চান্দনাইশ। ফাঁকা ঘরে রেবার ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস পড়ছিল। আজাদ ভাইকে পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে। খবরটা দু-একটা পত্রিকায় ছেপেছেও।

পুলিশ বাড়িতেও এসেছিল। ইকবাল ভাই আর রওশন আপা ট্যাকেল করেছে। খবরটা বড় চাচাকে বলা হয়নি। হাসপাতাল থেকে ফেরার পর বড় চাচার শরীর আবার খারাপ হয়েছে। আজাদ ভাই স্মাগলিং।

রাতারাতি টাকা করতে চেয়েছিল ওই কুৎসিত মানুষটা। ৬ টিপু সুলতান রোডে রেবাদের বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা হল। ওরা খাওয়ার টেবিলেই বসল। গুড়ের পায়েস খেয়ে চমৎকৃত হল রাফি। রেবার ঠোঁটে মিহিন হাসি।

ওরা চা খাচ্ছিল। রেবা ওর জীবনের কথাগুলি চুপচাপ বলে যাচ্ছিল। মাবাবা মারা যাওয়ায় বড় চাচার কাছেই মানুষ। ওই অভিশপ্ত বিয়েটা আর আজাদ ভাই যে স্মাগলিং করত- সে কথাও লুকালো না। (কেবল ওর শরীরের প্রতি আজাদ ভাইয়ের লোলুপ আচরণের কথা লুকিয়ে রাখল।

সব কথা বলা যায় না বলে। ) ... রাফি চুপচাপ শুনছিল। খাওয়ার ঘরটা শুনশান করছিল। ওপাশে জানালায় বৃষ্টির ছাঁট। একবার কারেন্ট চলে গেল।

রেবা মোমবাতি আনার জন্য উঠবে ... কী মনে করে আবার বসে পড়ল। থাক। অন্ধকারই থাক। অন্ধকার তো আর সারা জীবন থাকে না ...ক্ষণিকের অন্ধকার উপভোগ্য হয়ে উঠতে পারে কখন-কখনও ... রাফির মোবাইলটা বেজে উঠল। ওস্তাদজী ফোন করেছে।

বললেন, টিভিটা অন হচ্ছে না । একজন ভালো ইলেকট্রিশিয়ান নিয়ে আয় তো। আসছি। বলে ফোন অফ করে রাফি। রেবাকে বলল, এখনই একবার উয়ারি যেতে হবে।

রেবা জানে ওস্তাদজী গতকালই বাড়ি ফিরেছেন। পুরনো শিষ্যদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছেন। রাফির সঙ্গে যেতে ইচ্ছে হল রেবার । বড় চাচাকে ফেলে যেতে ইচ্ছে হল না। রওশন ভাবীরা থাকলে না হয় একটা কথা ছিল।

আবার ফিরবেন তো? রাতে মুগের ডালের খিচুড়ি রাঁধব। রাফি মাথা নাড়ে। বলে, বড় জোর দশটা বাজবে। রাফি উঠে দরজার কাছে চলে আসে। জায়গাটা কেমন অন্ধকার-অন্ধকার।

স্বপ্নে অনেকবার দেখেছে রেবা এই অন্ধকার জায়গায় দাঁড়িয়ে কে যেন ওকে জড়িয়ে ধরে অনেক ক্ষণ ধরে চুমু খাচ্ছে। রাফিকে একবার ছুঁতে ইচ্ছে হল রেবার। ... নাঃ, রাফিকে ছোঁবে না রেবা । যাকে জীবনভর ছুঁয়ে থাকবে তাকে অত সহজে ছোঁবে না ... ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.