গাড়ি চালাতে ভালো লাগে না সুলাইমানের। কোনো ড্রাইভারই ব্যাকরণ মানে না। যার সাথেই কথা হয় সুলাইমান তাকেই বলে ভাই, তুমি এ্যামনে গাড়ি চালাও ক্যা? একটু ব্যাকারণ মানতে পারো না?
সুলাইমানের কথা শুনে অন্যরা হাসে। টিটকিরি করে, মিয়া তুমি তো অনেক পাকনা কথা শিখ্যা গেছো। মাত্র এই লাইনে আইছ।
একটু দেখো। শিখো। ক্যমনে কী? মাতব্বরি ফলানোর অনেক জায়গা আছে। ব্যাকরণ আবার কী জিনিস মিয়া? জাম ঠেলতেই দিন পার অয়। ব্যকারণ মানলে পেডে বাত দেওন লাগবো না।
সুলাইমান ভাবে তাদের কথাও ঠিক। কিন্তু তারপরেও ব্যাকরন বলেও একটা কথা আছে। ব্যাকরণ মানে হচ্ছে নিয়ম কানুন। সুলাইমান মাদ্রাসায় নানা ধরণের ব্যকরন পড়েছে। বাংলা।
ইংরেজি। আরবি। সব কিছুতেই ব্যকরণ ছিল। বড় হুজুর বলেছিলেন, আদব লেহাজেও ব্যাকরন আছে। বড় হুজুর এটাও বলেছেন, ব্যাকরণ আছে এই হইজগতের সব কিছুতেই।
সুলাইমান এই সব ব্যকরণগত ভাবণা যখন ভাবছিলেন তখন গাড়িতে বসা পেছনের এক যাত্রী ব্যকরন না মেনেই গালি দিয়ে দিয়ে বসলেন, ওই হালারপুত। খেয়াল কইরা গাড়ি চালা। ঘুমাস নি?
সুলাইমান কথা বলে না। গাড়ীর গিয়ার পাল্টে, সামনে পেছনে করে জোরে টান দেয়।
২.
গাড়ি চালাতে গিয়ে সুলাইমানের অনেক ঝামেলা হয়।
সুলাইমান হুজুর টাইপের লোক। কোরআণে হাফেজ। পাবলিক খুব খারাপ কথা বলে। আস্তে চালালে গালি দেয়। জোরে চালালেও ক্ষমা করেনা।
মহাবিপদ তার। কিন্তু সুলাইমান কখনোই এসবের জবাব দেয় না। তার হেলপার আর কন্ডাক্টররা প্রায়ই তেড়ে যায়। সে থামায়। তার রাগ হয় না।
কষ্ট পায়। সুলাইমান হুজুর টাইপের লোক হবার প্রথম অসুবিধা হচ্ছে, সবাই তার বেশভূষা নিয়ে কথা বলে। কোন কথার জবাব দিতে পারেনা। কঠিন কথা বলতে পারে না। বললেই শুনতে হয়, টুপি পইরা রইছেন মিয়া, আবার ত্যাড়া কথা কন!
সুলাইমান এসবের অর্থ বোঝেনা।
তবে এটা বোঝে মানুষ যা খুশি, তাই বলে দেয়। কোনো ব্যাকরন মানেনা।
সুলাইমান আগে এমন কথা শুনলে কষ্ট পেতনা। এখন পায়। খারাপ কোনও কথা শুনলে তার এখন মেয়েটার কথা মনে পড়ে।
মেয়েটা মানে ওই মেয়েটা। এক মাস হলো যে মেয়েটা তার সাথে থাকে। তার বউ হয়েছে। মেয়েটা জানলে কী কষ্টইনা পাবে! স্বামীকে মানুষ ধমকাচ্ছে।
নরম মনের মানুষ সুলাইমানের এই কথা ভেবে এখনই কষ্ট লাগা শুরু হয়ে যায়।
সুলাইমান তার ভাবণা এবং গাড়ীর দুইয়েরই হার্ড ব্রেক করে।
৩.
কাউন্টারে এসে গেছে সুলাইমান। কাউন্টার সার্ভিসের বাস চালায় সে। কাউন্টারে কাউন্টারে থামানো তার বাধ্যতামূলক কাজ।
সে থামিয়ে বসে আছে।
এই মুহুর্তে তার মনে অসম্ভব আনন্দ। এই কাউন্টার পার হলেই তার আনন্দের শুরু হয়। পরের কাউন্টারটা তার বাড়ির সামনে। এই ছোট মফস্বল শহরে সুলাইমান আগে দিনভর অনেকবার বাড়ির সামনে দিয়ে গেছে। কখনও এমন লাগেনি।
ইদানিং লাগছে। কেন লাগছে? সে জানে। ওই একই কারণে। ধমক খেলে যে মেয়েটার জন্য কষ্ট লাগে, সেই মেয়েটার জন্য এইখানে আবার আনন্দ। কারণ পরের কাউন্টারের আশেপাশে কোথাও এসে সেই মেয়েটা দাঁড়িয়ে থাকবে।
দিনের যে কোনো একটা সময় সে এসে দাঁড়ায়। সুলাইমানকে দেখার জন্য। সুলাইমানের দেখার জন্য। সুলাইমান এই পথটুকু খুবই লজ্জা নিয়ে গাড়ি চালায়। সুলাইমানের মধ্যে লজ্জা অনেক।
যেমন এই আনন্দের কারণটা সে কারো কাছে বলতে পারেনা লজ্জায়। অনেককে বলবে বলবে ঠিক করেও বলতে পারেনা। অনেকবার চেয়েছে তার হেলপার আর কণ্ডাক্টরতে বলবে। কিন্তু তার আগেই যেন তারা কিভাবে টের পেয়ে গেছে। একদিন হেলপার তো বলেই ফেলল হুজুর এই জায়গায় আইলে এতো খুশি খুশি হইয়া যান ক্যান?
এই কথা শুনে আর বলার সাহস হয়নি।
এমনিতেই বেশ লজ্জা পেয়েছে। বলে আবার নিজের লজ্জা বাড়াতে চায়নি।
আবার সুলাইমান গাড়ি চালাচ্ছে ধীরে। যত এগিয়ে যাচ্ছে ততই তার লজ্জা বাড়ছে। সুলাইমানের লজ্জা অনেক।
আরো অনেক বিষয়েও। বউয়ের সামনে বেশিক্ষণ থাকতেও তার লজ্জা করে।
সুলাইমানের বউ অবশ্য এত লজ্জা নিয়ে থাকেনা। তার কাছে সুলাইমানের লজ্জা দেখতেই ভালো লাগে। তবে গত কদিন আগে সুলাইমান তার সব লজ্জা জলাঞ্জলী দিয়ে একটা কথা বলে ফেলেছে তার বউকে।
কথা বলে সে ঘর থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। বসে থাকতে পারেনি। বউ দরজার দিকে, সুলাইমানের বেরিয়ে যাওয়ার পথের দিকে হা করে তাকিয়ে ছিল অনেকক্ষণ। এইটা কী খুব লজ্জার কথা? গাধা কোনানকার!
প্রত্যেকদিন কাউন্টারের সামনে গিয়ে দাঁড়াইতে হইবো এইডা বলাতে লজ্জার কি আছে? বলছ, যামু।
৪.
সুলাইমান বাড়ীর কাছে কাউন্টারে এসে ব্রেক চাপলো।
রাস্তায় সামনে এক গাছের আড়ালে তার বউ দাড়িয়ে আছে। সুলাইমান মন ভরে বউকে দেখছে। সামনাসামনি এমন করে দেখতে পারেনা। আহ! কী সুন্দর একটা মাইয়াই না বিয়ে করছি। সুলাইমান ভাবে।
তার বউয়ের কথা ভাবে। তার বউয়ের রুপের কথা ভাবে। আরো কত কী ভাবে। তবে সুলাইমান অবাক হয় সে তার এই ভাবণাতে কোনো ব্যাকরণ মানছে না।
সে লজ্জিত হয়।
কাউন্টারের সুপারভাইজারের চিৎকারে সুলাইমানের সম্বিত ফেরে। তবে বউয়ের দিক থেকে চোখ ফেরায় না। সে দিকে তাকিয়েই পা দিয়ে ব্রেকটা ছেড়ে দেয়। ক্লাষও ছাড়ে। চাপ দেয় এক্সসেলেটরে।
গাড়ি চলতে শুরু করে। ধীরে ধীরে বউয়ের সামনে দিয়ে চলে যায় সে। একটা সময় বউকে পেছনে ফেলে যায়। তবে তাও সুলাইমানের মন ভরেনা। সে লুকিং গ্লাস দিয়ে তাকিয়ে থাকে।
ধীরে ধীরে তার গাড়ির গতি বাড়ে। বউয়ের প্রতিবিম্বটা ক্রমশ ছোট ছোট হতে থাকে। তাও সে অনেক কিছু বুঝতে পারে। সে বুঝতে পারে তার বউয়ের সামনের চুল উড়ছে। চোখের পলক পড়ছে।
তার বউ রাস্তা পার হয়ে অন্য পার দিয়ে বাড়ির উদ্দেশে পা বাড়াচ্ছে।
৫.
প্রতিদিন খুব রাতে সুলাইমান বাড়ি ফেরে। গাড়ি সাইড করে আসতে হয়। তার আগে পরের দিনের জন্য গ্যাস ভরে রাখতে হয়। এগুলো করতে করতে রাত অনেক হয়ে যায়।
আগে এতটা রাত মনে হতোনা। এখন হয়। আগে পাম্পে বসে গল্প করতে ভাল্লাগতো। এখন লাগে না। উল্টো অসহ্য মনে হয়।
তার মনে শুধু একটাই চিন্তা। বাড়িতে যাব কখন?
বাড়িতে আসতেই কেমন জানি হয় তার মন। হরবর করে কত কথাও বলে ফেলে। সারাদিন কোথায় কী হল? কোথায় কী দেখল? সব।
তার বউও সব মনোযোগ দিয়ে শোনে।
শুনে তার চোখ চকচক করে। স্বামীর কর্মক্ষেত্র নিয়ে সে খুবই উচ্ছসিত হয়। সাফল্যের কথা শুনে আনন্দিত হয়। ব্যার্থতায় মন খারাপ করে।
গত এক মাস ধরে এটাই হয়।
এমনই হচ্ছিল।
৬.
সুলাইমানের বউ মৌসুমী। মেয়েটার এই এক মাসে অনেক বদলে গেছে। নতুন জীবন নিয়ে সে খুবই খুশি। তার স্বপ্ন একদিন স্বামীর বাসে সে একা একা চড়ে ঘুরবে।
অনেক জায়গায় যাবে। তারও সুলাইমানের মতো ভাবাভাবির রোগ পেয়ে গেছে এই এক মাসে। সে এসব ভাবতে ভাবতে কেমন যেন হয়ে যায়। তার চোখে মুখে আনন্দ আর ধরে না।
সে প্রতিদিন একটা সময় পাগল হয়ে ছুটে যায়।
বেশির ভাগ সময়ই দুপুরের দিকে যায় সে। তখন বেশিক্ষন দেখা যায়। মানুষের চাপ কম থাকে। গাড়ি অনেকণ কাউন্টারে দাঁড়িয়ে থাকে। সে ওই সুযোগে অনেকক্ষণ স্বামীকে দেখে।
৭.
তাদের এই দেখাদেখির পর্ব পুরোনো হয়না। যখন মাস ছয়েক হয়ে গেলো তখনও পরিবর্তন ছিলনা। বছরখানেকে এসেও কমেনি। বরং বেড়েছে। কারণ এখন সমস্যাও বেড়েছে অনেক।
আগের মত এখন বেশি সময় পায়না দুজন। রাস্তায় ভীড় বেড়েছে। বেড়েছে গাড়িও। বেড়েছে অনেক কাউন্টার। এক কাউন্টারে বেশিণ দাঁড়ানো গাড়ি থাকেনা।
অনেক অসুবিধা। অনেক অসুবিধা পার করে তাও মৌসুমি আসে। সুলাইমান দেখে। দুর থেকে দেখে। সামনে থেকে দেখে।
পেছন থেকে লুকিং গ্লাস দিয়েও দেখে। মন ভরেনা সুলাইমানের। মন ভরেনা মৌসুমীরও। কী করবে? কিছু করারও নেই। অনেক রাতে সুলাইমান আসে।
খুব ভোরে চলে যায়। এতটুকুতে কী আর চলে? মন ভরে?
যে কারণে সুলাইমান প্যাসেঞ্জারের গালি খেয়ে হলেও একটু বেশি সময় গাড়ি থামিয়ে মৌসুমিকে দেখে। মৌসুমিও এই কঠিন রাস্তা পার হয়ে প্রতিদিন আসে। ব্যাকরন না মেনে গাড়ী চালানো ড্রাইভারদের বিপদের সকল আশংকা উপেক্ষা করে।
৮.
প্রতিদিনের মত আজও এসে দাঁড়িয়েছে মৌসুমি।
অপেক্ষায় আছে সুলাইমানের। সুলাইমান আসবে। একটু দেরী হলেই বুকটা কেমন যেন করে উঠে মৌসুমির। কোনো বিপদ হয়নি তো! আজও দেরি হচ্ছে। মৌসুমিরও খারাপ লাগা বাড়ছে।
অন্য ড্রাইভারগুলি যেভাবে গাড়ি চালায়। মৌসুমি বহুবার সতর্ক করেছে। সাবধানে চালিও। সাবধানে থেকো। সুলাইমান হাসে।
আরে না কিছু হবে না। উল্টো সে মৌসুমিকে সতর্ক করে। তুমি সাবধানে থেকো। প্রতিদিন রাস্তা পার হও আমার ভয় করে। আমি ভয়ে ভয়ে তোমার রাস্তা পার হওয়া দেখি।
লুকিং গ্লাস দিয়ে তাকাইয়া থাকি।
হঠাৎ মৌসুমির সম্বিত ফিরে আসে। তার মন আনন্দে ভরে যায়। সুলাইমানের গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে কাউন্টারে। সুলাইমানকে দেখে মনটা ভরে যায়।
তার মায়া লাগে। আহারে। কী কষ্টই না করে লোকটা!
৯.
সুলাইমানের মেজাজ আজ চরম খারাপ। আরেকটু হলে অন্য এক ড্রইভারের সাথে তার মারামারি হত। শুধু মৌসুমির জন্য সে দ্রুত চলে এসেছে।
ব্যাটা বেঁচে গেছে। না হয় যে অপরাধ করেছে তার কোনো মা ছিলনা। ব্যাটা তার গাড়ি চাপাতে চাপাতে এনে সুলাইমানের লুকিং গ্লাস ভেঙ্গে দিয়েছে। সুলাইমান কোনো রকমে অর্ধেক বাঁচিয়ে এসেছে। অল্প দেখা যায়।
সুলাইমানের মন এখন কিছুটা ভালো। মৌসুমিকে কেন জানি অনেক সুন্দর লাগছে। সে তাকিয়েই আছে। বেশিক্ষণ পারলনা। পেছন থেকে যাত্রীরা চিৎকার চেচামেচি করছে।
সুলাইমান গাড়ি ষ্টার্ট দেয়। মৌসুমির দিকে তাকিয়ে গাড়ি চালায়। ঠিক মৌসুমির পাশ কেটে এগিয়ে যায়।
১০.
মৌসুমি খুব সামনে থেকে সুলাইমানকে দেখে আতকে ওঠে। তার চেহারা এমন হয়েছে কেন? কোথাও কী কোনও ঝামেলা হল নাকি? কে জানে? মৌসুমির মন কেমন বিষাদে ভরে যায়।
সে ভাবণায় পড়ে, কী হয়েছে। এমন লাগলো কেন? ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক মৌসুমি রাস্তা পার হয়। তার মনস্কতা আর দশ পনের সেকেণ্ডে ফেরেনা। ওদিক থেকে আবার প্রচণ্ড গতিতে ছুটে আসে ব্যাকরণ ছাড়া চালানো কোনও এক ড্রাইভারের গাড়ী। মৌসুমি কখনো গণিত পারেনি।
গণিতকে ভয় পেতো। সে জন্যই কিনা কে জানে জীবনের এই সময়ে ছোট্ট একটা গণিত তার করা হয়ে ওঠে না। গাড়ীর গতির সমানুপাতিক হার তার রাস্তা পেরুনোর গতিতে ছিলনা।
তার আর রাস্তা পেরুনো হয়না।
১১.
সুলাইমান লুকিং গ্লাস দিয়ে তাকিয়ে আছে।
ফ্রেমে অল্প পরিমান গ্লাস অবশিষ্ট আছে। সেই অল্পতেই সে মৌসুমিকে দেখার চেষ্টা করছে। মৌসুমির উড়ন্ত চুল দেখার চেষ্টা করছে। চেষ্টা করছে কখন মৌসুমির চোখের পলক পড়বে সেটা দেখার। দেখতে চেষ্টা করছে মৌসুমির নিরাপদে রাস্তা পেরুনো।
কিন্তু সুলাইমান মৌসুমির রাস্তা পার হওয়া দেখতে চেয়েও পারছেনা। কেন যেন অনেক মানুষের জটলা হয়ে গেলো রাস্তায়। ভেঙ্গে যাওয়া লুকিং গ্লাসের অবশিষ্ট অংশ দিয়ে তা স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছেনা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।