আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প- আগ্নেয়গিরির মৃত্যু

সীমা কিন্তু লেখিকা! রেজা স্যারের এই প্রশংসাসূচক উক্তি আমার কাছে বক্রোক্তির মতো ঠেকলো। কিছুক্ষণ আগে প্রোজেক্ট ডিফেন্সে প্রশ্নবাণে জর্জরিত আহত সৈনিক আমি, প্রথম তীড়েই যে কুপোকাত। প্রশ্নের জন্য মানসিকভাবে আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলামনা। আমাদের আগের গ্রুপগুলোর মুখে শুনেছি প্রজেক্ট ডিফেন্সে তাদের ঢালে একটাও তীড় এসে লাগেনি। আমি তাই ঢালবিহীন হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।

মনের আনন্দে প্রেসেন্টেশন শেষ, অকস্মাৎ রেজা স্যারের আক্রমণ। আমি তখন স্যারের দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছি আর নিশ্চিত পরাজয়ের কথা চিন্তা করে ঘামতে শুরু করেছি। প্রথমটা বাদে বাদ-বাকী সব প্রশ্নের ঠিকঠাক উত্তর দিতে পারলেও, স্যারের ভাষ্যমতে প্রথমটাই নাকি বেসিক নলেজ। ওটা জানা আমার একান্ত দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। ধরা যাক কোন দুর্ভাগা বা সুভাগার “আংগুর ফল টক” নিয়ে প্রেসেন্টসেশন পড়লো।

তাহলে সেসব বিষয়বস্তু বেসিক নলেজের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে সেগুলো হলো – ১। আংগুর ফল টক বলে কেন? ২। আংগুর দেখতে সবুজ হয় কেন? ৩। আংগুরের জন্ম কোন দেশে? ৪। আংগুর আর কিসমিসের মধ্যে পার্থক্য কি? ৫।

কিসমিস পানিতে রাখলে ফুলে যায় কেন? ৬। কখন কিসমিস চুপসে যেতে পারে? ৭। অভিস্রবণ কাকে বলে? ইত্যাদি ইত্যাদি। এইসব ইত্যাদি ইত্যাদি জেনে রাখার চাইতে “বেসিক নলেজের অভাব” এই অপবাদটুকু শোনা ঢের ঢের সহজ কাজ। কেননা, শিক্ষা জীবনের একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ে এই কথাটায় শ্রবণ-ইন্দ্রিয় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।

দ্বিতীয় রোজার দিন আজ। বাসে ভীড়, ভীড় রাস্তায় । নানান কারণে, ভার্সিটি থাকা অবস্থায় আমাকে সারাটা দিন উপোস করে থাকতে হয়। এতোগুলো অভুক্ত বন্ধু-বান্ধবের সামনে নিজের উদরপূর্তি করাটা ভীষণ লজ্জার কাজ বলে মনে হয় আমার। বিশেষত ক্যান্টিনে পুরুষশ্রেণী যারা আমার নাম কিংবা নামের টাইটেল জানেনা, তাদের কাছে নারীকূলের রোজা না রাখার এই ব্যাপারটা এক ভিন্ন মাত্রা পায়।

ফলে একরকম অস্বস্তি কাজ করে। ক্লাসে, ল্যাবে, ভীড় বাসে বসে থাকতে থাকতে পেটের ক্ষুধা মাঝে-মধ্যে জেগে উঠে, একসময় মরেও যায়। বাসায় ফিরে প্রতিদিনের রুটিনের মতো ফেসবুকে বসা। সাজ্জাদকে কথা দিয়েছি, ওকে আর কোনোদিন ফেসবুকে নক বা মেসেজ দিবনা। ভীষণ ভীষণ রাগ করেছি ওর উপর।

রাগের কারণ এবং অস্তিত্ব সাজ্জাদের অজানা। অজানাই থাকুক। জানলেও পাত্তা দেওয়ার মানুষ সে নয়। হয়তো বলবে- “তুমি কষ্ট পাইলে পাওগা, আমার কি” ? মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি খেলে যায়। ওকে ট্যাগ করে পোস্ট দিতে ইচ্ছা করে, “তোমারে আমি নক করুমনা কইছি, কিন্তু পোক করুমনা কইনাই”।

ইচ্ছা ইচ্ছাই থেকে যায়, বাস্তবায়ন করার সাহস হয়না। প্রিয় সাজ্জাদ, এই প্রথম তোমাকে একটা চিঠি লিখছি, যে চিঠি তোমার পড়া হবেনা কোনোদিন। কেমন আছো তুমি? আমি ভালো আছি। আমার প্রেজেন্টেশন ভালোই হয়েছে। অন্য কোনোদিন হলে, তোমায় আজকের কত্তো কত্তো গল্প শোনাতাম।

তুমি তো আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারতে। পারতেনা? তোমাকে অনেক অনেক কথা বলার ছিল। কিন্তু বলবোনা। তুমি জোড় করলেও না। আমি চলে যাচ্ছি।

কোথায় যাচ্ছি বলবোনা। তবে যেখানে যাচ্ছি, সেখানে ফোন দিতে তোমার মিনিটে ১৭ টাকা খরচ হবে। অনেক ন্যাকি ন্যাকি করে লিখলাম। ভালা থাইক্কো। ইতি -তোমার অভিমানী বন্ধু প্রাপক যদি থাকতো, আমার এই চিঠির সাইজ হয়ে যেতো বিশাল বড়।

যে চিঠির কোন প্রাপক নেই সে চিঠি দীর্ঘায়িত করার কোন মানেই হয়না। দশম রোজার দিন। সাজ্জাদের মেসেজ- “অই ভালা আসোনি?”। আমার উত্তর – “ হ আসি, তুমি কেমন? ”। - আমিও ভালা।

ঈদের চার-পাঁচদিন পরে ঢাকা আসতেছি। - ভালোতো। দেখা করবা? - হুম। পারবানা? - পারুম। সব ঠিকঠাক।

আগস্ট মাসের ১৫ তারিখ তার সাথে আমার রীতিমত একটা ডেটপ্ল্যান হলো। উনত্রিশতম রোজা, আগামীকাল ঈদ। আমি যে একজন বিধর্মী, মফস্বল এলাকায় থাকাকালীন এই উপলদ্ধিটুকু কখনো হয়নি। আমরা থাকতাম চট্টগ্রামে। ক্লাস সিক্স-সেভেন পর্যন্ত আর সবার মতোই আমিও ঈদের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম।

দাওয়াত খেতে যাওয়ার আগে মা শিখিয়ে দিতো- “গরু দেওয়া কিছু খাবিনা কিন্তু”। এই কথাটা বলতেও আমার কেন জানি ভালো লাগতো- “আন্টি, আন্টি এইটা কিসের মাংস”? একটু বড় হওয়ার পর, মফস্বল থেকে শহরের দিকে চলে আসা। দাওয়াতের সংখ্যা কমে আসলো। বাসায় অনুমতি মিলতোনা যাওয়ার। আর ঢাকা আসায় পরতো ঈদ আমার কাছে দুঃখের দিন বলেই ঠেকে।

ব্যস্ততম এই শহরটি ভীষণ ফাঁকা হয়ে যায় এইসব দিনগুলোতে। বন্ধুরা চলে যায় যার যার বাড়ীতে। যারা থাকে তাদের কাছে দাওয়ার পাওয়ার আশা করাটাই দুরাশা। খাবারের প্রতি আমার লোভ সবসময়। তাই চারদিক সুস্বাদু খাবারের গন্ধে, টিভিতে চলতে থাকা – “ ঈদ মানে কি? খুশি খুশি খুশি।

ঈদ মানে কি? হাসি রাশি রাশি” গানে নিজেকে বড় অসহায় মনে হয়। প্রিয় সাজ্জাদ, ঈদ মুবারক! ঈদ কেমন কাটছে তোমার? আমার একটুকুও ভালোনা। সারাদিন বাসায় বসা। টিভিতে এডের জ্বালায় কিছু দেখাও দুস্কর। কারো সাথে ঘুরবো, এমন কেউ নেই।

তুমি আমাকে ঈদ মুবারক জানালেনা কেন? জানাতে তো পারতে। পারতেনা? ভালো থাকো। ইতি -তোমার দুঃখী বন্ধু একটু পর প্রাপকবিহীন চিঠিটা নিজেকে ছিন্ন-ভিন্ন অবস্থায় ময়লার ঝুড়িতে আবিস্কার করলো। ঈদের তৃতীয় দিন। আমার মোবাইলে সাজ্জাদের কল।

কেমন আছি জানতে চাইলো। আমাকে ১৫ তারিখের কথা মনে করিয়ে দিলো। মনে করিয়ে দিলো চোখে কাজলের বাধ্য-বাধকতা সম্পর্কে। আমি সব কিছুতেই আমার স্বতঃস্ফুর্ত সম্মতি জানালাম। বুঝতেও দিলামনা ও এখন একটা আগ্নেয়গিরির সাথে কথা বলছে।

ঈদের পঞ্চম দিন। টিভি চ্যানেলগুলোতে এখনো ঈদের বিশেষ অনুষ্ঠানের বিজ্ঞাপন বিশেষ অনুষ্ঠানের চাইতেও বেশি সাড়ম্বরপূর্ণ। আজ সাজ্জাদের সাথে আমার দেখা করার দিন। ওকে সকাল ৯ টায় শ্যামলীর ওভারব্রীজে থাকতে বলেছি। সেদিন আমার ঘুম ভাংগলো ভোর ৬ টায়।

ভীষণ অস্থির লাগছিলো। আমার প্রতি করা সকল অন্যায়ের শাস্তি আজ আমি ওকে দিতে যাচ্ছি। প্রিয় সাজ্জাদ, তোমার সাথে আজ আমার দেখা হবেনা। সকাল ৯ টার পর থেকেই তুমি আমার ফোন সুইচড অফ পাবে। তুমি আমায় অনেক অনেক কষ্ট দিয়েছ।

সুযোগ-সন্ধানী আমি এমন একটা দিনের প্রতীক্ষায় ছিলাম, যেদিন তোমায় আমি আমার যন্ত্রণাটা বুঝতে পারবে। তুমি কখনোই সময় সচেতন নও। ৯ টা না, হয়তো ৯ টা ১৫ তে তুমি আসবে। আমার জন্য অপেক্ষা করবে। ফোন করবে।

আমায় পাবেনা। কি অসহ্য কষ্ট হবে তোমার তখন, তুমি দেখো। ভালো থেকো। ইতি -তোমার প্রতিশোধপরায়ণ বন্ধু সকাল ৭ টা। সময় যেন কাটতেই চাইনা।

কখন ৯ টা বাজবে, কখন তার শাস্তিক্ষণ শুরু হবে? কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে, গান শুনে, নাস্তা করে এমন আরো অনেক ছোট-খাটো কাজ করতে করতে সাড়ে ৮ টা। হঠাত নিজেকে ভীষণ দুর্বল মনে হতে লাগলো। সুপ্ত আগ্নেয়গিরির তখন মৃতপ্রায়। বারবার সাজ্জাদের বিষন্ন মুখটার কথা মনে হতে লাগলো। আমাকে না দেখলে ও অনেক কষ্ট পাবে, অনেক কষ্ট পাবে।

সকাল ৮ টা ৪৫। বাসা থেকে বের হয়েই রিকশা নিলাম। এইটুক রাস্তা আমি সাধারণত হেঁটেই যায়। কিন্তু আজ বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছে। কোন সাজগোজ না করলেও চোখে কাজল আঁকতে ভুলিনি আমি।

নাহ সাজ্জাদ ঠিকই বলে, আমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবেনা, I can’t do anything. আমি বোঝাই রিক্সা ছুটে চললো তার গন্তব্যের দিকে............ I just want to make you cry once! To let you know how much you hurt me! I make plans again and again But all my plans go to in vain! Whenever I tried my best, It floods in my eye’s nest! So, let me love you To let you know how to love someone! লেখা তো নয়, যা-তা। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.