তখন পড়ি ক্লাস নাইনে , ২০০০ সালের কথা । রংপুর জিলা স্কুলে পড়তাম । বয়ঃসন্ধিকালে সবে পা রেখেছি, চোখে রঙিন চশমা । ওরকম একটা সময় বুঝি সবারই যায়-মাথায় অলীক আর আকাশকুসুম কল্পনা গিজগিজ করে । সমবয়সী কোন মেয়ে একবারের বেশি দুবার ঘুরে তাকালে ভেতরটা উথাল পাথাল করে ওঠে ।
ভালৈ চলছিল । বন্ধুদের সাথে আড্ডাবাজি, সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়ানো সবৈ ।
১ম সাময়িক পরীক্ষার পরে গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেলাম । ২০-২২ দিনের মত । রবিন ছিল আমার খুবৈ কাছের একজন বন্ধু ।
জিলা স্কুলে তিন টাইপের স্টুডেন্ট ছিলঃ একদল শহরের স্থানীয়-যেমন আমি,একদল রংপুরের আশপাশ যেমন সৈয়দপুর, তারাগঞ্জ, মিঠাপুকুর এইসব থেকে প্রতিদিন বাসে করে আসত । আর আরেকদল একটু দূরের হওয়ায় মেসে থেকে পড়ত । এদের সংখ্যা খুব বেশি নয় । রবিন ছিল দুই আর তিন নং ক্যাটাগরির ক্রস । সে মেসে থাকত ঠিকৈ,কিন্তু সপ্তাহে অন্তত তিনদিন বাড়ি থেকে এসে ক্লাস করত ।
প্রচণ্ড হোমসিক ছিল । ওর বাড়ি ছিল পার্বতীপুরে ।
সেই রবিন আমাকে ধরে বসল , গরমের ছুটিতে ওর বড় বোন সায়মার বিয়ে,আমাকে যেতে হবে । আমি পড়লাম ফ্যাসাদে । কারণ বাড়ি থেকে যাবার অনুমতি মেলা প্রায় অসম্ভব ।
আমার মা ছিলেন প্রচণ্ড কড়া (এখনো বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি ) । রবিনকে হ্যাঁ না কিছু বললাম না । এখন মনে হচ্ছে সরাসরি না বলে দিলেই ভাল করতাম সেদিন । তাহলে এমন একটা গ্লানি আমাকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হত না ।
কিভাবে বাড়ি থেকে অনুমতি পেলাম সে এক সাতকাহন ।
শুধু এটুকুই বলি , অনুমতিটুকু পেতে একগাদা মিথ্যে বলতে হয়েছিল ।
সম্ভবতঃ জুনের তিন তারিখ সকালে আমর দুজন রংপুর থেকে ট্রেনে উঠেছিলাম । বিয়েটা পাঁচ তারিখে । আমরা যাচ্ছি দুদিন আগেই ।
ট্রেন থেকে নেমে রিকশায় সোজা গেলাম রবিনের বাড়িতে ।
এলাকাটার নাম আমার মনে নেই ,তবে ওটা শহরের ভিতরেই একটা আবাসিক এলাকা ।
বিয়েবাড়িতে যতটা সমাগম থাকে সচরাচর , তার চেয়ে একটু বেশিই দেখলাম । বেশ আলিশান বাড়ি । কথায় কথায় জানলাম ,পাত্র বুয়েটের আর্কিটেক্ট । পাউবোতে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে জয়েন করেছে মাসতিনেক হল ।
রবিন সায়মাপুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিল । উনি আবার এমবিবিএস পড়ছেন ডিএমসিতে । প্রেমের বিয়ে ।
রবিনের কাছে কথায় কথায় জেনেছিলাম ওর একটা ছোটবোনও আছে,ক্লাস এইটে পড়ুয়া । নারী-পুরুষের রসায়নের ব্যাপারটা অতি প্রাচীন ।
স্বভাবতই ওর বোনটাকে দেখবার একধরণের তীব্র ইচ্ছে তৈরি হল । কিন্তু জনাকীর্ণ বিয়েবাড়িতে তো আলাদা করে বোঝা সম্ভব নয় যে কোনটা মুমু । ভাল কথা ,মেয়েটার নাম মুমু । এদিকে বন্ধুকেও তো লাজলজ্জার মাথা খেয়ে বলতে পারি না ,তোর বোনটাকে দেখতাম ! কাজেই একটা প্ল্যান করলাম । সায়মাপু যে ঘরে বসেছিলেন সেখানে তার বান্ধবীর ভিড় একটু পাতলা হতেই ঢুকে পড়লাম ,তার সাথে আলাপ জমাতে ।
মতলব ,মুমু তো কোন না কোন সময় বোনের কাছে আসবেই । খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না । তখন বোধহয় রাত আটটা হবে । দৌড়ে এসে যে ঘরে ঢুকল সে যে মুমু সেটা কারো বলে দেবার প্রয়োজনই ছিল না। আমি একইসাথে স্তম্ভিত,হতবাক এবং কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়লাম ।
একটা মেয়ে এতটা সুন্দর হয় কি করে ! মুমু আমার মুগ্ধতাটা বোধহয় খেয়াল করেছিল , আমার দিকে চেয়ে সে আলতো একটা হাসি দিল । আমি ততক্ষণে বেশ বুঝতে পারছিলাম যে আমি মেয়েটার প্রেমে পড়ে যাচ্ছি । বিপত্তি ঘটল হঠাত্ই,লোডশেডিং হল । ঘরে শুধু আমরা তিনজন । সায়মাপু বললেন ,"মুমু , যা তো মোমটা ধরিয়ে আন ।
"আমি একটু দায়িত্ববোধ দেখানোর চেষ্টা করলাম । বললাম ,"থাক না ,আমিই নিয়ে আসছি । " একথা বলে দরজার দিকে এগোলাম । দরজাটা কোনদিকে সেটা তো আর ভালভাবে দেখিনি , সামনের দিকে চলতে গিয়ে আচমকা মুমুর বুকে আমার কনুই লেগে গেল । আলতো এবং অনিচ্ছাকৃত একটা ছোঁয়া ,আমার মনে বিন্দুমাত্র দুরভিসন্ধি ছিল না ।
কিন্তু মেয়েরা বোধকরি একটু বেশীই সেনসিটিভ হয় ,এ আচরণটাকে সে ভাবল ইচ্ছাকৃত ,এবং আমার গালে সশব্দে একটা চড় বসিয়ে দিল । সায়মাপু চেঁচিয়ে উঠলেন,"কী হল ?"আমি বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম , আর মুমু কেঁদে তার বোনের কাছে গেল ।
এরপর যা হল তা বিস্তারিত বলবার কিছু নেই । রবিন আমাকে শুধু বলেছিল ,"তোকে বন্ধু ভেবেছিলাম আমি । "একথার পর আর সেখানে থাকা চলে না ।
থাকিওনি । বছরের মাঝখানে স্কুল চেঞ্জের অনেক হ্যাপা । তারপরও পরিবারের সাথে জোরাজুরি করে আমি জিলা স্কুল থেকে ক্যান্ট. পাবলিকে চলে এলাম । কারণ আমি আর রবিনের মুখোমুখি হতে চাইনি । অনেকদিন কেটে গেছে এ ঘটনার ।
কিন্তু ঘটনাটা ভুলতে পারিনি । পাখি উড়ে যায় , পড়ে থাকে পালক । তবে যদি সত্যি কথা বলতে হয়,মুমুর সাথে আমার Love at first sight হয়েছিল । শুধু যাকে একমূহুর্তেই ভালবাসলাম ,সেই আমাকে চরমভাবে ভুল বুঝল । এটা তো একটা ট্রাজেডিই,তাই না ?
মুমুকে এখনো অনেক ভালবাসি আমি ,ঐ থাপ্পরটার পরেও ।
রবিনের সাথে আর কখনো দেখা হয়নি আমার। শুনেছি,ও নাকি রুয়েটে ইইই পড়ে এখন একটা বেশ ভালো চাকরি করছে।
আর শাহরিয়ার ভাই এখনো বিয়ে করেননি। ভবিষ্যতেও করবেন কিনা জানি না। তার সাথে মাঝে মাঝে দেখা হয়।
তিনি প্রায়ই বলেন,মুমুর সাথে শুধু একবার দেখা করতে চান। সে বিয়ে করে থাকুক,নাই থাকুক,তিনি শুধু মুমুকে বলতে চান - এগারটি বছর ধরে কী যন্ত্রণা তিনি বয়ে বেড়াচ্ছেন ।
নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে এটা আমার ব্যক্তিগত ঘটনা নয় । কাজিন শাহরিয়ার ভাইয়ের মুখের কথাগুলো আমি আমার মত করে লিখেছি । তবে এটা ১০০ ভাগ সত্যি।
মুমু আপুকে আমি নিজেও একবার দেখেছিলাম । এখন খালি একটাই চাওয়া ,শাহরিয়ার ভাইয়ের চোখে যেন এই ব্লগ না পড়ে!তার ভেতরের দগ্ধ অনুভূতি ব্লগে প্রকাশ করে পাছে না আমাকেই কোপানলে দগ্ধ হতে হয় ! ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।