শফিক হাসান সড়কপথ নাকি মরণ ফাঁদ-এমনই এক প্রশ্ন গুঞ্জরিত হচ্ছে এখন বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের মনে। সড়কপথে চলাচলকারী যানবাহনগুলো দিনদিন বেপরোয়া হয়ে মানুষকে ঠেলে দিচ্ছে অপঘাত মৃত্যুর দিকে। বাহনের তো আর কিছু করার ক্ষমতা নেই, সব কীর্তির একক দায়ভার বাহন চালনাকারীর। আরো বিশদভাবে বললে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের।
প্রতিটি মৃত্যুই সমান কষ্টের।
প্রতিটি মৃত্যুই দুমড়ে মুচড়ে দেয় মানুষের হৃদয়। মৃত্যুর মাধ্যমে যাপিত জীবনে তৈরি হয় ক্ষোভ, হতাশা এবং নিঃসীম বেদনা। শোকের পারদ যত তরতর করে উপরের দিকে ওঠে-নামার ক্ষেত্রে ততটা দ্রুতগতি পায় না। হালে অপমৃত্যুর মচ্ছবে মেতে উঠেছে দেশ। সারাদেশেই এখানে-ওখানে নানাভাবে সড়কপথে প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ।
সর্বশেষ গত ১৪ আগস্ট সড়ক দুর্ঘটনায় চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব তারেক মাসুদ ও সংবাদকর্মী মিশুক মুনীর এবং আরো পাঁচজন মর্মান্তিক মৃত্যুবরণ করলেন। ঢাকার সমীপে মানিকগঞ্জে ঘটে এ দুর্ঘটনা-‘কাগজের ফুল’ নামের ছবির শ্যুটিং করার জন্য স্পট দেখতে গিয়েছিলেন তারা। সঙ্গে সতীর্থ আরো মানুষ, বন্ধুস্বজন। অন্যদের মধ্যে কেউ কেউ আহত হলেও মৃত্যুবরণ করেন দেশের দুই সূর্যসন্তান। দুই আলোকবর্তিকার অকাল প্রয়াণে থমকে আছে দেশের বাতাস।
হাহাকারে ভারি হয়ে আছে চতুর্দিক, মন ও মননের গহীন কোষ।
এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না-বলেও কি সান্ত্বনা পাওয়ার উপায় আছে? যতই মানুষ কষ্ট পেয়ে এমন বাক্য উচ্চারণ করুক না কেন; শেষ পর্যন্ত এটাই সত্য-এই মৃত্যু উপত্যকাই আমার দেশ! বড় কোনো দুর্ঘটনা না ঘটলে (অঙ্কের হিসাবে) সাধারণের মৃত্যু সংবাদপত্রে সেভাবে আলোচিত হয় না। এগুলো আমাদের জন্য ‘ডালভাত’ হয়ে গেছে। পরিবারের একজন উপার্জনক্ষম মানুষের মৃত্যু মানেই পুরো পরিবারটি সমস্যার পাহাড়ের মুখে নিপতিত হওয়া। স্বাধীনতার পর থেকে এই পর্যন্ত নিহত ব্যক্তির পরিবারের পাশে সরকার বা অন্য কোনো সংস্থা দাঁড়িয়েছে এমন কোনো নজিরও নেই।
১৯৯৩ সালের ২২ অক্টোবর চট্টগ্রামে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের স্ত্রী জাহানারা। এর প্রেক্ষিতে তৎকালীন জনপ্রিয় সাপ্তাহিক যায়যায়দিন সম্পাদক, সাংবাদিক শফিক রেহমানের পরামর্শে ইলিয়াস কাঞ্চন তাঁর ভক্ত-অনুরাগীদের নিয়ে গড়ে তোলেন একটি সংগঠন। সংগঠনের শ্লোগান-নিরাপদ সড়ক চাই। সিনেমায় এবং নানা ধরনের প্রচারমাধ্যমে তিনি আন্দোলনটি চালিয়ে যান। কিন্তু খুব একটা সফল হয়েছেন বলা যাবে না।
যদিও তাঁদের চেষ্টা ছিলো শতভাগ। আন্দোলনটি ফলপ্রসূ হলে সড়কপথে এখন অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করা দুর্ঘটনা সংঘটিত হতো না। ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ শ্লোগানটি এখন আরো বেশি প্রাসঙ্গিক।
এদেশে মৃত্যুর কারবারী মানুষগুলো থেকে যায় সব রকমের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। তাদের কিছুতেই কিছু হয় না।
এমনকি তাদের লেলিয়ে দেয়া মানুষদেরও না। সড়ক দুর্ঘটনার নানাবিধ কারণে হয়ে থাকে। বিপজ্জনক রাস্তা, এবড়ো- থেবড়ো-ভঙ্গুর-বন্ধুর, ত্রুটিযুক্ত যান ছাড়াও সবচেয়ে বড় সমস্যা-চালকের অদক্ষতা। প্রায় প্রতিদিনই এদেশে গাড়ি চালকের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। অধিকাংশের ড্রাইভিং লাইসেন্সই ভুয়া।
টাকা দিলেই সহজে লাইসেন্স পাওয়া যায়। অবশ্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী-কর্তারা তো সব রকমের লাইসেন্স দিতে সদা উদগ্রীব! এই অরাজকতাময় পরিস্থিতিতে সত্যিকার অর্থে দক্ষ চালক সৃষ্টি হওয়া কি সম্ভব? যেনতেনভাবে স্টিয়ারিং ধরতে পারলেই তাকে আমরা বসিয়ে দিচ্ছি চালকের আসনে। যে চালক আমাদের নিয়ে যাবে কাঙিক্ষত গন্তব্যে। কিন্তু কাঙিক্ষত গন্তব্যে নেয়ার আগেই যে পাঠিয়ে দিচ্ছে মরণের ঠিকানায়! দিক, তাতেও খুব বড় কোনো সমস্যা হবে নাকি! দেশে অশ্লীল হারে জনসংখ্যা বেড়েই চলেছে। হাস্যকর আদমশুমারি এবং পরিসংখ্যান করেও এ জনসংখ্যা গণনার ফলাফল মানুষের বিশ্বাসযোগ্য করানো যাচ্ছে না।
অন্যদিকে জন সংখ্যা বৃদ্ধি মানেই দেশের সমস্যা বৃদ্ধি।
সরকারি হিসাবে প্রতিবছর গড়ে তিন হাজারের বেশী মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় (বেসরকারি হিসাবে ১২ থেকে ২০ হাজার)। কোনো দুধের শিশুকেও বলে দিতে হবে না, প্রকৃতপক্ষে এ হিসাব আরো অনেক বেশি। কারণ সরকারি হিসাব মানেই যে বড় সড় ধরনের ধাপ্পাবাজি, লুকোছাপার খেলা-বোঝে না এমন মানুষ আছে! এভাবে যদি (সড়ক পথে দুর্ঘটনার মাধ্যমে) কিছু জনসংখ্যা কমানো যায় ক্ষতি কী! সরাসরি না হলেও জনসংখ্যা কমানোর পরোক্ষ একটা প্রচেষ্টা থাকলো! ব্যর্থরা নানা আকাশকুসুম চিন্তা করতে কসুর করে না, বাংলাদেশ সরকার যদি এমন চিন্তা করেই থাকে তাকে খুব একটা দোষ দেয়া যাবে না! তাদের পক্ষে এমন অসুস্থ চিন্তা খুবই সম্ভব। নৈতিকভাবে নতজানু মানুষ সবরকম চিন্তাই করতে পারে।
বিবেকের কাছে বাধা পায় না। এ ‘জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ’কে কৃতিত্ব হিসেবে ধরলে কৃতিত্বটুকু দিতে হবে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়কেই। কারণ এর নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ছেন তো যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মহোদয়ই। দলীয় বিবেচনায় যিনি চালকের লাইসেন্স দিতে ইতস্তত বোধ করেন না। নৌমন্ত্রীর চাপে পরীক্ষা ছাড়াই ২০০৯ সালে ১০ হাজার লাইসেন্স দেয়া হয়েছিলো।
এবছর দেয়া হচ্ছে সাড়ে ২৪ হাজার। হয়তো আরো দেবেন। কেউ খালি হাতে ফিরবে না যোগাযোগ এবং নৌমন্ত্রীর দরবার থেকে!
এতো কিছুর পরও মন্ত্রী মহোদয়ের কথার তেজ এতোটুকু কমেনি। ব্যর্থতার দায়ে পদত্যাগ দূরে থাক, তিনি এখন থিয়োরি দিচ্ছেন প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে রাস্তার সংস্কার কাজ করতে পারেননি। অন্যদিকে অর্থমন্ত্রী বলছেন সম্পূর্ণ উল্টো কথা।
আগের বরাদ্দকৃত অর্থের ব্যবহারই এখনো হয়নি! যোগাযোগমন্ত্রীর ভাঁড়ামি এবং তামাশায় মানুষ বিনোদিত হয় না, উল্টো শোকের পাল্লা আরো বেড়ে চলে।
আর কিছুদিন পরই ঈদ। ঈদ মানে শুধু আনন্দই নয়, অপমৃত্যুও। স্বজনের মায়ায় এবং মাটির টানে সারাদেশ থেকে মানুষ ঘরমুখো হয়। প্রতিবছরই ঘরমুখো মানুষের ললাটলিখন অপঘাতে মৃত্যু।
জলপথ, সড়কপথ উভয় পথেই হয়ে থাকে। রাস্তার পাশে উল্টে থাকে পরিবহনকারী বাহন; পানির নিচে লঞ্চ, স্টিমার! ঈদের পর ক’দিন সংবাদপত্র বন্ধ থাকে। যেদিন চালু হয়, অবধারিতভাবে প্রথম পাতায় একটা খবর থাকবেই-পরিবহন দুর্ঘটনায় এতজনের মৃত্যু, এতজন আহত।
এখন অপেক্ষার পালা, এবারের ঈদ উপলক্ষে কতজন আদম সন্তানের মৃত্যু সংবাদ উপহার দেয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়; সংবাদপত্রের শিরোনামই বা কোন রঙের হয়, কত কলামের! ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।