পরিবর্তনে বিশ্বাস করি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমগ্র বিশ্ব পরিস্থিতিকে আমূল পাল্টে দেয়। প্রত্যক্ষ উপনিবেশবাদ থেকে উন্মেষ ঘটে নয়া উপনিবেশবাদের। এই কৌশলের প্রধান শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এর অপর পিঠে আফ্রো-এশীয় ও লাতিন আমেরিকার তৃতীয় বিশ্বভুক্ত ঔপনিবেশিক দেশগুলোতে জাতীয় গণতান্ত্রিক আন্দোলন জোরদার হতে থাকে।
স্বাধীন আর্থ-রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার লক্ষ্যে জাতীয় মুক্তি ও স্বাধীনতা কায়েমের জন্য কর্পোরেট স্বার্থের ধ্বজাধারি ও সাম্রাজ্যবাদের প্রতিভূ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সিআইএ সহ তার নানা নিপীড়নযন্ত্রের দ্বারা সংশ্লিষ্ট দেশের সামরিক বাহিনীর সাহায্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যাপক হত্যাকান্ড ও গণহত্যার মাধ্যমে তৃতীয় বিশ্বের জনগণের জাতীয় মুক্তির সেই আকাঙ্ক্ষাকে নস্যাৎ করে যা এখনো জারি রয়েছে।
গত শতকের সত্তরের দশকের গোঁড়ায় মার্কিন সন্ত্রাসী সংস্থা সিআইএর প্রত্যক্ষ মদদ ও সহযোগিতায় পৃথিবীর দুই প্রান্তে এরকম দুই রক্তক্ষয়ী সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেছিল । যার একটি বাংলাদেশে এবং অন্যটি চিলিতে। চিলিতে অভ্যুত্থান ঘটানো হয় ১৯৭৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর । সেদিন ইতিহাসের অন্যতম বর্বর একনায়ক হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া জেনারেল পিনোচেটের নেতৃত্বে চিলিতে সামরিক অভ্যুত্থান হয়।
দেশটির নির্বাচিত জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট সালভাদর আলেন্দে নিহত হন। আবির্ভূত হয় বিশ্বের ইতিহাসে অন্যতম ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর অধ্যায়। সামরিক অভ্যুত্থান সংগঠিত হবার ঠিক কয়েক মুহূর্ত আগে এক বেতার ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমি নিশ্চিত আমার এই আত্মত্যাগ বিফলে যাবেনা” ।
বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যারা জড়িত তাঁদের কাছে এক অনন্য নাম সালভাদর আলেন্দে। তাঁর পুরো নাম সালভেদর ইসারেলিনো ডেল স্যাগরাডো করাজোন দি জেসাস আলেন্দে গোসেন।
তিনি ১৯০৮ সালের ২৬ জুন চিলির ভ্যালপারাইসো নামক স্থানে জন্মগ্রহন করেন। তিনি পেশায় ছিলেন একজন ডাক্তার। তিনি সালভেদর আলেন্দে ক্যাস্ট্রো এবং লরা গোসেন ইউরিবের সন্তান। আলেন্দে উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান এবং শৈশবকাল থেকেই পারিবারিক ভাবেই প্রগতিশীল ও মুক্তচিন্তার রাজনীতির সাথে পরিচয় ঘটে। আলেন্দে যখন উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হন তখন জোয়ান দি মার্চির সান্নিধ্যে আসেন এবং বুদ্ধিবৃত্তি ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত হন।
যুবক আলেন্দে একজন প্রতিভাধর এ্যাথলেট ছিলেন। চিলি বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা শাস্ত্রে অধ্যয়ণরত অবস্থায় তিনি র্যািডিক্যাল রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং কয়েকবার এর জন্যে গ্রেফতার হন। ১৯২৬ সালে তিনি চিকিৎসা শাস্ত্রে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৩৩ সালে তার ডক্টরাল থিসিস Crime and Mental Hygiene প্রকাশ করেন যেখানে সেসার লমব্রোসোর প্রস্তাব সমূহের সমালোচনা করেন।
তিনি লাতিন আমেরিকার ইতিহাসে চিলির প্রথম সমাজবাদী, মার্কসবাদী প্রেসিডেন্ট, যিনি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন ।
১৯৭০ সালে তিনি সমাজতন্ত্রী, সাম্যবাদী ও দলছুট খ্রিস্টান ডেমোক্র্যাটদের এক কোয়ালিশনের নেতা হিসেবে ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় খুব অল্প ব্যবধানে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন । তিনিই এ বিশ্বের প্রথম ব্যক্তি যিনি সাহস দেখিয়েছেন গণতান্ত্রিক ভাবে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা স্থাপনের মাধ্যমে ইতিহাস গড়তে এবং সমাজতন্ত্র কায়েম করার অভিনব পদ্ধতির সূচনা করতে।
বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে চিলিতে রাজনৈতিক জটিলতা চলতে থাকলেও চিলির রাজনৈতিক ইতিহাস, রাজনৈতিক সংস্কৃতিগত অবস্থা এবং জনগনের রাজনৈতিক সচেতনতা লাতিন আমেরিকার যে কোন দেশের তুলনায় অনেক উন্নত ছিল। যার ফলশ্রুতিতে আলেন্দের মত প্রতিভাবান রাজনৈতিক নেতৃত্ব সাহস পেয়েছিল গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সমাজতন্ত্রে প্রবেশের পথে চলতে। তিনি ১৯৭০ সালে চিলির রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর ১৯৬৪ সালে ফ্রেই সরকার কতৃক গৃহীত সংস্কার কর্মসূচীর পুনঃবাস্তবায়নের মাধ্যমে চিলিতে সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তোলার স্বপ্নযাত্রার সূচনা করেন এবং দেশী-বিদেশী শোষণ রোধে তিনি দ্রুত তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করেন যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি বড় ধরনের হুমকি হয়ে দেখা দেয়।
এবং তারা আলেন্দেকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য উঠেপড়ে লাগে। কেন আমেরিকা আলেন্দের পেছেন লেগেছিল ? এর উত্তর মূলত তিনটি ।
প্রথমত, নাকের ডগায় অবস্থিত তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মত আরেকটি কমিউনিস্ট দেশের আবির্ভাব ঠেকানো । উল্লেখ্য যে তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের শীতল যুদ্ধ চলছিল।
দ্বিতীয়ত, দশকের পর দশক ধরে চলতে থাকা কমিউনিস্টবিরোধী মার্কিন প্রচারণার রূপটি ছিল এই যে কমিউনিস্টরা কেবল শক্তি প্রয়োগ ও প্রতারণার সাহায্যেই ক্ষমতা দখল করতে পারে।
তাই ক্ষমতাসীন একজন মার্কসবাদীর চেয়েও ভয়ঙ্কর হচ্ছে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার মাধ্যমে একজন মার্কসবাদীর ক্ষমতা গ্রহণ আমেরিকার জন্য ছিল ত্রাস।
তৃতীয়ত, চিলিতে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোর স্বার্থ রক্ষা করা । কারণ আলেন্দে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর সব তামার খনি এবং বিদেশিদের (বিশেষ করে মার্কিন) মালিকানাধীন অনেক ব্যবসা ক্ষতিপূরণ ছাড়াই বাজেয়াপ্ত করে জাতীয়করণ করেন । উল্লেখ্য, এই তামা শিল্প হলো চিলির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত । আর এতে বিনিয়োগ ছিল মার্কিন দুটি কোম্পানির ।
যাদের হাতে ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় তামা খনির নিয়ন্ত্রণ । ফলে স্বাভাবিকভাবেই আলেন্দের সিদ্ধান্তে বড় ধরণের ক্ষতি হয়েছিল মার্কিন কোম্পানিগুলোর ।
সিআইএ’র প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, নির্বাচনে যেন আলেন্দে জিততে না পারে সেজন্য মার্কিন একটি কোম্পানি সিআইএ’র মাধ্যমে আলেন্দের বিরোধী পক্ষকে সাত লক্ষ ডলার দিয়েছিল। এছাড়া আলেন্দের পরাজয় নিশ্চিত করতে ঐ কোম্পানিটি সিআইএ’কে আরও ১০ লক্ষ ডলার দিতে চেয়েছিল।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে আলজেরিয়ায় অনুষ্ঠিতব্য জোটনিরপেক্ষ সন্মেলনে আমন্ত্রিত হয়ে যোগ দিয়েছিলেন আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ।
আমন্ত্রিত বিশ্ব নেতাদের মাঝে ছিলেন সালভাদর আলেন্দে, ফিদেল কাস্ট্রো প্রমূখেরা । সেখানে ফিদেল বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন ” মুজিব, সম্রাজ্যবাদবিরোধী নীতি অনুসরণের জন্য বুকে, পিঠে বুলেট বরাদ্দ হয়ে গেল । তাই সাবধানে থাকবেন ” । ঐ সময়কালে আলেন্দে ও বঙ্গবন্ধুর সাম্রাজ্যবাদবিরোধী নীতির সাদৃশ্যতার কারণে উভয়ই তাঁদের সাক্ষাৎ আশা করেছিলেন । কিন্তু ঐ সময়ে পিনোচেটের উস্কানিতে চিলিতে ডানপন্থীদের বিশৃঙ্খলা চলছিল ।
নিজের দেশকে এই দুরবস্থায় রেখে আলেন্দে সন্মেলনে যোগ দিতে পারেননি । আর তাই তাঁদের মধ্যে কুশল বিনিময় ও অসমাপ্ত রয়ে গেল । তবে তিনি বঙ্গবন্ধুকে চিঠি মারফত জানিয়ে ছিলেন ” পরবর্তীতে কোন এক সময়ে বাংলাদেশ সফরে আসবেন ” । কিন্তু না, তা আর হয়নি ।
(চলবে...)
বিশেষ উল্লেখ্যঃ লেখাটির কিছু অংশ আব্দুল গাফফার চৌধুরির কলাম থেকে নেয়া।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।