আমি অপার হয়ে বসে আছি ওহে দয়াময়, পাড়ে লয়ে যাও আমায় (১)
হিমু একা দাঁড়িয়ে আছে। সামনে বিশাল মাঠ। ওপাশে নুহাশ পল্লীর বড় গেইট। রোযা রমজানের দিন একা এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার মধ্যে এক ধরনের মজা আছে, রাস্তায় বা মাঠে ঘাটে মানুষজন থাকে না। সবাই চটজলদি শুয়ে পড়ে, সেহেরীর সময় উঠতে হবে না? কাজেই, কে কেন এইসব অবান্তর প্রশ্ন শুনে বিরক্তও হতে হয় না।
বাবা বলতেন, মানবজাতির নীরবশত্রু কৌতূহল, মহাপুরুষের কৌতূহল থাকতে নেই। এদিক দিয়ে মেসের দারোয়ান ভাই অনেক ভালো। এতো রাতেও হিমুকে বের হতে দেখে কিছু বলে নি। বরং গদগদ কণ্ঠে বলে,
-হিমু ভাই, ও হিমু ভাই ?
- কি ? পাঞ্জাবীর হাতা গোঁটাতে গোঁটাতে জিজ্ঞেস করে হিমু।
- খালি পায়ে বাইরে যাইতাছেন, এক জোড়া স্যান্ডেল আইনা দেই ?
- দেন।
দারোয়ানের আগ্রহ দেখে আর না বলতে পারে না হিমু। স্যান্ডেল জোড়া পায়ে দিয়ে দারোয়ানের সামনে কিছুক্ষণ হাঁটাহাটি করে সে। মানুষটা তা দেখে দাঁত কেলিয়ে হাসে। মানুষকে হাসাতে পারাও একটা বড় গুন, সবার থাকে না। অবশ্য কিছুদূর হাঁটার পর জুতো জোড়া ম্যানহোলে ফেলে দেয় হিমু।
কারন, হুমায়ূন স্যার তাকে খালি পায়ে হাঁটতে শিখিয়েছেন আর স্যারের শিক্ষা ভোলার প্রশ্নই আসে না।
যদিও হিমু ভেবেছিলো ঝামেলা ছাড়াই গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে,পরে দেখা গেলো হিমুর এজামশন আসলে ভুল। ঝামেলা একটা হলোই। চৌরাস্তার সামনের ভুরিমোটা গার্ডটা ভালো সমস্যা করল। একা এতো দূর আসার পর গার্ডের জেরার মুখে পড়াটা অনেক বিরক্তিকর।
হিমুকে দেখেই হুইস হুইস হুইস করে বাঁশি বাজালো গার্ড।
-কই যাওয়া হয় ? সন্দেহের চোখে হিমুকে প্রশ্ন করে সে।
-মাঠে যাই। চটজলদি হিমু উত্তর দেয়।
-কই থেইকা আসছেন ? গার্ডের সন্দেহ আরও বাড়ে।
- বইয়ের পাতা থেকে আসছি। মুচকি হাসে হিমু। গার্ড কিছুটা অবাক চোখে তাকায়। ভড়কে গেছে হয়তো। ভূতের ভয় টয় দেখাবে নাকি ?
গার্ডের নাম আরজ আলি।
আলি এদিকে ৩ বছর ধরে ডিউটি দেয়। মাঝে মাঝেই নানা কিসিমের অদ্ভুত মানুষকে দেখে সে। দক্ষিণ দিকে মাদক কেনাবেচা হয়। আড্ডা-টাড্ডা আছে। টাল হয়ে রাস্তায় হাঁটা মানুষকে বেশ কয়েকবার সামাল দিয়েছে সে।
সেদিন তো এক বুড়ো মাতাল আরজ আলির গায়ের উপর উঠে কান দুটো মলে দিয়ে বলল, "চলো আমার গাড়ি চলো চলো। " চিন্তা করা যায়?
থাক, ঝামেলায় গিয়ে লাভ কি ?কোন মাতাল হবে হয়তোবা। হিমুকে আর ঘাঁটায় না আরজ আলি। সেহেরীর সময়ও হয়ে এলো প্রায়। এই কলিযুগে মানুষ আল্লাহ বিল্লাহ ভুলে গেছে, কমবয়সী ছেলেমেয়েরা তো গেছে আরও গোল্লায়।
সময়ে সময়ে যে আরও কত কিছু দেখতে হবে কে জানে ? আপন মনে মাথা নাড়ে আরজ আলি।
(২)
হিমু অনেকক্ষণ ধরে জোছনা গলাধঃকরণ করার চেষ্টা করছে। হা হয়ে থাকা মুখটাতে মশা মাছি এসে একাকার। খিদে লেগেছে বেশ। মাঝখানে একবার মাজেদা খালার বাসায় যাবে নাকি চিন্তা করেছিলো সে।
গেলে খাওয়া যেত, সাথে ভুলিয়ে ভালিয়ে বাদলটাকে সাথে নিয়ে আসা যেতো। হঠাৎ মনে পড়ে, খালা নতুন এক কুকুর পোষা শুরু করেছেন। বিকট চেহারা। সারা রাত ঘেউ ঘেউ করে। খালার বাসায় যাওয়ার চিন্তাটা বাদ দেয় হিমু।
অবশ্য এখন সে যেটা খাচ্ছে বা খাওয়ার চেষ্টা করছে, সেটিও মন্দ নয়। জোছনা খাওয়ার অভ্যাস তার অনেক দিনের। পেটের খিদে না মিটলেও মনের খিদে তো মিটে। হঠাৎ পিছনে খসখস পায়ের শব্দ হয়।
- মিসির আলি সাহেব আপনি এসেছেন ? হিমু মাথা না ঘুরিয়েই জিজ্ঞেস করে।
-হু, আসবো না আবার ? আমার সাথে শুভ্র আর রুপাও এসেছে।
-বেশ ভালো। আবার হা করে হিমু।
মিসির আলি ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন। এই হিমু করছেটা কি ? একদৃষ্টিতে কয়েকমিনিট পর্যবেক্ষণ করার পরও মর্মোদ্ধার করতে পারলেন না তিনি।
পাশ থেকে অনেক মিষ্টি একটা গন্ধ আসছে, রুপা মেয়েটার গা থেকে। মানুষের নাকে মিষ্টি কোন গন্ধ আসলে কি একটা হরমোন জানি সিক্রেশন হয়, নামটা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না মিসির আলির। এই যে ভুলে যাওয়া, বয়স বাড়ার কুফল। মিসির আলির দীর্ঘশ্বাস আরও দীর্ঘতর হয়। আচ্ছা, শুভ্র ছেলেটা আজকে এতো চুপচাপ কেন ? বড়লোক বাবার সাথে ঝগড়া হয়েছে নাকি আবার, কে জানে।
চোখ বুজেন মিসির আলি, আজকাল মাথাব্যাথাটা বেড়েছে। সময় নিয়ে কিছু ভাবা যায় না। ডাক্তার এজাজের সাথে কালকে দেখা করতেই হবে।
শুভ্র আজ বেশ চুপচাপ। পিরুজালি গ্রামের এদিকটায় অন্ধকার যেন আরও বেশী।
দূর থেকে নুহাশপল্লীর বাতিগুলোও কেমন ম্নান দেখাচ্ছে। চোখ থেকে নামিয়ে চশমার কাঁচটা আবার পরিষ্কার করে শুভ্র। পিটপিট চোখে হিমু আর রুপার দিকে তাকায়। মিসির আলি সাহেবের প্ল্যানটা কি আজকে ? ভোর হলেই এদিকটা লোকে লোকারণ্য হয়ে যাবে। পাঠকরা ওদের চারজনকে দেখলে যে হুমড়ি খেয়ে পড়বে, তা শুভ্র ভালো করেই জানে।
হিমু শুভ্রের দিকে এগিয়ে আসে, কাঁধে হাত রেখে বলে, “চলো সামনে যাই”।
হেঁটে হেঁটে লীলাবতি দীঘির পাড়ে চলে আসে চারজন। আজান হয়েছে একটু আগেই। সকালের বিশুদ্ধ বাতাস ইতিমধ্যেই বইতে শুরু করেছে। চাদরটা আরেকটু ভালো করে জড়িয়ে নেয় রুপা।
ঠান্ডা লাগছে। আড়চোখে হিমুর দিকে তাকায় সে। পাগলটা পাতলা একটা পাঞ্জাবী পড়ে আছে মাত্র, ঠাণ্ডায় ঠকঠক করে কাঁপছে।
বেডরুমের সামনের জানালায় হুমায়ূন পুত্র নিষাদকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেলো। শাওন ছেলের পাশে এসে দাঁড়ান।
-বাবা কি দেখো ? মাথায় হাত রেখে প্রশ্ন করেন শাওন।
- হিমুকে দেখি, শুভ্রকে দেখি। আর মিসির আঙ্কেলকেও।
- কোথায় তারা ?ছেলের দিকে ঝুঁকেন শাওন।
-ঐ তো শুভ্র।
আঙুল দিয়ে ইশারা করে নিষাদ।
নিষাদের আঙুল বরাবর সামনে তাকিয়ে কিছুই দেখতে পান না তার মা। কোলে তুলে নেন নিষাদকে, “বাবা, চলো। ঘুমোতে হবে। ” এদিকে শুভ্র নিষাদকে উদ্দেশ্য করে হাত নাড়ায়।
জবাবে মায়ের কোলে নিষাদ ফিক করে হেসে দেয়।
পরের দৃশ্যপটে, বিশাল বাঁধানো কবরের পাশে চারজন হাতে হাত ধরে গোল হয়ে দাঁড়ায়। কবরটা কারা যেন রাতেই ফুলে ফুলে সাজিয়ে দিয়েছে,মিসির আলি খেয়াল করেন। এদিকে চশমাটা ঠিকমতো নাকে বসিয়ে নিচ থেকে একটা কদমফুল তুলে নেয় শুভ্র। এখন তো বর্ষা মাস না।
কোথা থেকে কদমফুল আসলো কে জানে। নেড়েচেড়ে রুপাকে ফুলটা দেখায় সে।
কিন্তু রুপার মন অন্যখানে। অঝোরে কাঁদছে সে। মিসির আলি কিছুটা বিব্রত।
হিমুকে ইশারা করেন তিনি।
-রুপা, কবরের সামনে কাঁদতে নেই। স্যারের আত্মা কষ্ট পাবে। গম্ভীর গলায় বলে উঠে হিমু। জবাবে আরও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে রুপা।
মিসির আলি রুপার মাথায় একটা হাত রাখেন। পাশ থেকে শুভ্র বলে উঠে -
মরিলে কান্দিস না আমার দায়
যাদুধন,
মরিলে কান্দিস না আমার দায়...............
নিজের অজান্তেই হিমুর চোখে এক ফোঁটা পানি চলে আসে। চটজলদি চোখ মুছে নেয় হিমু। আজ নিজের স্বভাববিরুদ্ধ অনেক কাজ করেছে, ভেবে অবাক হয় সে। মহাপুরুষদের তো আবেগ থাকতে নেই, থাকতে পারে না।
হিমুকে যে একথা বলে গেছেন স্বয়ং হুমায়ূন আহমেদ! ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।