আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফিঙ্গারপ্রিন্ট, একজন আজিজুল হক এবং বাংলাদেশ

শহীদের খুন লেগে, কিশোর তোমার দুই হাতে দুই, সূর্য উঠেছে জেগে। -------হাসান হাফিজ ফিঙ্গারপ্রিন্ট মহান আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত একটি অতি আশ্চর্যজনক নমুনা বা নক্সা, যা সনাক্তকরন চিহ্ন হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ফিঙ্গারপ্রিন্ট প্রযুক্তি হচ্ছে বায়োমেট্রিকসের (Biometrics) একটি শাখা। মানুষের ভৌতিক গুণাবলির (physical properties) ওপর ভিত্তি করে মানুষকে শনাক্ত করাকে বায়োমেট্রিকস বলে। ফিঙ্গারপ্রিন্ট প্রযুক্তিতে আঙুলের ছাপের ওপর ভিত্তি করে অপরাধীকে শনাক্ত করা হয়।

কারণ প্রত্যেক মানুষের ফিঙ্গারপ্রিন্ট সম্পূর্ণ ইউনিক এবং সারা জীবন ধরে অপরিবর্তিত থাকার কারণে অন্য যেকোনো প্রযুক্তির চেয়ে ফিঙ্গারপ্রিন্ট-ভিত্তিক প্রযুক্তি তুলনামূলকভাবে নির্ভুল ও কার্যকরি ভূমিকা পালনে সক্ষম। প্রতিটি ব্যক্তির ফিঙ্গারপ্রিন্ট এতটাই স্বাতন্ত্র্য যে, দেখা গেছে দু’টি জমজ শিশু একই ডিএনএ প্রোফাইল নিয়ে জন্মালেও ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে তাদের আলাদা করা যায়। এবার দেখা যাক, এই ফিঙ্গারপ্রিন্টের উৎপত্তি কোথায়, কীভাবে এটা প্রতিটি ব্যক্তিকে শনাক্ত করে। ফিঙ্গারপ্রিন্টের উৎপত্তিঃ ফিঙ্গারপ্রিন্টের উৎপত্তি নিয়ে বিভিন্ন মতভেদ আছে যেমন, কোথাও বলা হয়ে থাকে প্রাগৈতিহাসিক যুগে প্রাচীন ব্যাবিলনে ব্যবসায়িক লেনদেনে ক্লে ট্যাবলেট (clay tablet) এর উপর ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যবহৃত হত, আবার কোথাও বলা হয়ে থাকে প্রায় ৪০০০ বছর আগে মিশরে পিরামিড যুগে মানুষের হাত ও পায়ের ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া যায়। Jeffrey Barnes-এর মতে প্রায় ৬০০০ বছর পূর্বে উত্তর-পশ্চিম চীনে আর্থেনওয়্যার (earthenware) আবিষ্কৃত হয় যা সবচেয়ে প্রাচীনতম চামড়ার ছাপ হিসেবে বিবেচিত।

এখানে বলে রাখা দরকার যে আর্থেনওয়্যার হল একধরনের সিরামিক পদার্থ যা মৃৎশিল্পে নক্সা তৈরীর কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তবে প্রমাণ পাওয়া যায় যে প্রায় খৃস্টপূর্ব ৩০০ বছর আগে চীনে কোন ব্যক্তিকে শনাক্ত করার জন্য ফিঙ্গারপ্রিন্টের ব্যবহার হোত। ১৬৮৪ সালে ইংলিশ চিকিৎসক নেহেমিয়া গ্রু (Nehemiah Grew) এবং ১৬৮৫ সালে ইতালিয়ান মার্শেলো মালপিগি (Marcello Malpighi) প্রথমে ফিঙ্গারপ্রিন্টের গঠন নিয়ে তাদের গবেষণা প্রকাশ করলেও (সমসাময়িক সময়ে বা পরে আরো অনেকে) ফিঙ্গারপ্রিন্টের প্রথম ব্যবহারিক প্রয়োগ শুরু করেন স্যার উইলিয়াম হার্শেল ১৮৫৮ সালে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল হার্শেল এটি শুরু করেন আমাদেরই ভারত উপমহাদশে। হার্শেল একটি চুক্তিতে রাযোধর কনাই (Rajyadhar Konai) নামে এক লোকাল ব্যাবসায়ীর প্রথম হাতের ছাপ নেন ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর পক্ষে।

আরো যা মজার তা হলো, হার্শেল প্রকৃতপক্ষে হাতের ছাপটি নিয়েছিলেন কনাইকে ভয় দেখানোর জন্য যাতে পরে সে তার স্বাক্ষর হিসেবে হাতের ছাপকে ভবিষ্যতে অস্বীকার করতে না পারে। হার্শেলের এই উদ্যেগ ফলপ্রসু হয় এবং পরে ব্যাপক হারে তিনি বিভিন্ন ব্যক্তিগত চুক্তি বা অন্যান্য চুক্তিতে, জেল কয়েদীদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেওয়া শুরু করেন। অবশ্য ভারতে ব্যাপক হারে শিক্ষার অভাবও একটি কারণ ছিল। পরবর্তীতে ১৮৯৭ সালে কলকাতায় ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যুরো প্রতিষ্ঠিত হয় যেখানে খান বাহাদুর আজিজুল হক এবং হেমচন্দ্র বোস নামে দুজন ভারতীয় ‘ফিঙ্গারপ্রিন্ট বিশেষজ্ঞ’ হিসেবে হেনরী ক্লাসিফিকেশন সিস্টেম (Henry classification system) তৈরীতে অবদান রাখেন যা নাকি পরবর্তীতে ইংল্যান্ডে প্রতিষ্ঠিত ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যুরোতে গৃহীত হয় এবং ফ্রেঞ্চ ক্লার্ক Alphonese Bertillon কর্তৃক সৃষ্ট বার্টিলন সিস্টেমের (Bertillon system) চেয়ে বেশী জনপ্রিয়তা লাভ করে। আমারিকাতে ফিঙ্গারপ্রিন্টের সর্বপ্রথম প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবহার শুরু হয় নিউইয়র্ক সিভিল সার্ভিস কমিশন কর্তৃক ১৯০২ সালে।

পরবর্তীতে আমারিকাতে ফিঙ্গারপ্রিন্ট সিস্টেম অনেক সমৃদ্ধ হয়েছে এবং ফিঙ্গারপ্রিন্টের শুধুমাত্র কম্পিউটারাইজড ডাটাবেজই তৈরী হয়নি, এখন ফিঙ্গারপ্রিন্ট সরাসরি কম্পিউটারে নেওয়া হয় এবং এনালিসিসও করা হয় কম্পিউটারের মাধ্যমে করা হয়। বর্তমানে শুধুমাত্র ফিঙ্গারপ্রিন্টই নয়, ডিএনএ যোগ করা হচ্ছে সনাক্তকরনকে সম্পুর্ণভাবে নির্ভুল করার জন্য। ফিঙ্গারপ্রিন্ট গবেষণা এবং উন্নয়নে আরো অনেকেই জড়িত আছেন, আমি এখানে শুধুমাত্র গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজনের সম্পর্কে বললাম। আজিজুল হকের মৌলিকত্ব যেখানে ২০০১ সালে প্রকাশিত কলিন বিভান তাঁর ফিঙ্গারপ্রিন্টস গ্রন্থে আজিজুল হকের গবেষণার মৌলিকত্ব সম্পর্কে লিখতে গিয়ে জানাচ্ছেন, অ্যানথ্রোপমেট্রিক পদ্ধতি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আজিজুল হক ভয়ানক অসুবিধার সম্মুখীন হন। ফলে নিজেই হাতের ছাপ তথা ফিঙ্গারপ্রিন্টের শ্রেণীবিন্যাসকরণের একটা পদ্ধতি উদ্ভাবন করে সে অনুযায়ী কাজ করতে থাকেন।

তিনি উদ্ভাবন করেন একটা গাণিতিক ফর্মুলা। ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা আঙুলের ছাপের ধরনের ওপর ভিত্তি করে ৩২টি থাক বানান। সেই থাকের ৩২টি সারিতে সৃষ্টি করেন এক হাজার ২৪টি খোপ। বিভান আরও জানাচ্ছেন, ১৮৯৭ সাল নাগাদ হক তাঁর কর্মস্থলে সাত হাজার ফিঙ্গারপ্রিন্টের বিশাল এক সংগ্রহ গড়ে তোলেন। তাঁর সহজ-সরল এই পদ্ধতি ফিঙ্গারপ্রিন্টের সংখ্যায় তা লাখ লাখ হলেও শ্রেণীবিন্যাস করার কাজ সহজ করে দেয়।

এর আগে বিশিষ্ট নৃবিজ্ঞানী ফ্রান্সিস গ্যালটন, যে একইসঙ্গে বিখ্যাত জীববিজ্ঞানী চার্লস ডারউনের চাচাত ভাই, তাঁর উদ্ভাবিত অ্যানথ্রোপমেট্রিক পদ্ধতি অপরাধী শণাক্তকরণের কাজে ব্যবহার হয়ে আসছিল, কিন্তু এই পদ্ধতিতে ফিঙ্গারপ্রিন্টের শ্রেণীবিন্যাসকরণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় লেগে যেত, অথচ হকের সাব-ক্ল্যাসিফিকেশন পদ্ধতি বা শ্রেণীবিন্যাসকরণ পদ্ধতির দৌলতে তা হয়ে দাঁড়ায় বেশি হলে মাত্র এক ঘণ্টার কাজ। অথচ আজিজুল হকের এই পুরো কৃতিত্ব অ্যাডওয়ার্ড হেনরি নিজের বলে চালিয়ে দেন। তাঁর এই পদ্ধতির নাম দেন ‘হেনরি সিস্টেম’। এমনকি তিনি ক্ল্যাসিফিকেশন অ্যান্ড ইউজেস অব ফিঙ্গারপ্রিন্টস নামে যে বই লেখেন, তাতেও বেমালুম চেপে যান আজিজুল হকের নাম। এবং ব্রিটিশ সরকারও যথারীতি স্বীকৃতি দিলেন এই পদ্ধতিকে।

এর অল্প দিনের মধ্যেই কলকাতায় স্থাপন করা হলো বিশ্বের প্রথম ‘ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যুরো’। এই সংস্থা গড়ে তোলার বেশ পরে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে একই ধরনের আরও একটি ব্যুরো গড়ে তোলা হয়। আমেরিকাতেও গড়ে ওঠে একই ধরনের প্রতিষ্ঠান। তবে বেশ পরে। আর আজ বিশ্বের এমন কোনো দেশ নেই, যেখানে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যুরো বা সংস্থা গড়ে ওঠেনি, যেখানে অনুসৃত হয় না আজিজুল হক উদ্ভাবিত ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা আঙুলের ছাপের শ্রেণীবিন্যাসকরণ পদ্ধতি।

ফিঙ্গারপ্রিন্ট কীভাবে প্রতিটি ব্যক্তিকে শনাক্ত করে? আমাদের প্রত্যেকের হাতের তালু , হাতের আঙ্গুলের পৃষ্ঠভাগ, পায়ের তলা, পায়ের আংগুলের পৃষ্ঠভাগে রেখাগুলি টালি বা পর্বতশীর্ষ এলাকায় দীর্ঘ সরু উচ্চভূমিরেখার মত নক্সা তৈরী করে আছে। এদেরকে বলা হয় ফ্রিকশন রিজ (friction ridge) বা সংক্ষেপে রিজ (Ridge)। এই রেখাগুলি মূলতঃ কোনকিছু শক্তভাবে আঁকড়ে ধরার জন্য প্রকৃতিগতভাবে তৈরি হয়েছে যা অনেকটা গাড়ীর চাকার টায়ারের বহির্ভাগের সাথে তুলনা করা যায়। শুনে অবাক হতে হয়, এটিই আমাদের সমস্ত শরীরের একমাত্র চর্মভাগ যা নাকি লোমহীন এবং আমাদের এই ফ্রিকশন রিজ স্কিন তৈরী হয় মাতৃগর্ভে থাকাকালীন তৃতীয় এবং চতুর্থ মাসে। এই রেখার নক্সাগুলিকে প্রধানতঃ তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে, আর্চ (Arch), লুপ (Loop), হুয়ার্ল (whorl)।

একটা রিজের উপর আরেকটা শায়িত হয়ে তৈরী হয় আর্চ প্যাটার্ন। প্রায় ৫ ভাগ ফিঙ্গারপ্রিন্ট প্যাটার্নে এই ধরনের নক্সা দেখা যায়। আর্চও দুইরকমের আছে -- প্লেইন আর্চ (plain arch) ও টেন্টেড আর্চ (tented arch). এছাড়া আরো সাবগ্রুপ আছে, জটিলতার জন্য আর বেশী আলোচনা না করাই উচিৎ। এবার আসা যাক লুপ প্যাটার্ণে। প্রায় ৬০ থেকে ৭০ ভাগ ফিঙ্গারপ্রিন্ট প্যাটার্ণে এই ধরনের লুপ প্যা্টার্ণ দেখা যায়।

এক্ষেত্রে এক বা একাধিক রিজ দুই পার্শ্ব থেকে উঠে গিয়ে বেঁকে, একটি আরেকটিকে স্পর্শ করে বা অতিক্রম করে একটি কার্ভ প্যাটার্ণ তৈরী করে। এখানে একটি ডেল্টা অবশ্যই থাকবে। লুপ প্যাটার্ণে রিজের সংখ্যাও গণনা করা হয়। দুই ধরনের লুপ প্যাটার্ণ আছে - আলনার লুপ (Ulnar loop) ও রেডিয়াল লুপ (Radial loop). আমাদের শেষ আলোচনা হল হুয়ার্ল প্যাটার্ণ। এই ধরনের প্যাটার্ণ প্রায় ২৫ থেলে ৩০ ভাগ ফিঙ্গারপ্রিন্ট প্যাটার্ণে দেখা যায়।

এটা অনেকটা বৃত্তাকার। টেকনিক্যাল ভাষায়, লুপের মতই কিন্তু দুটি ডেল্টা অবশ্যই থাকতে হবে। একটি ডেল্টা থাকলে হবে লুপ আরে দুটি ডেল্টা থাকলে হবে হুয়ার্ল। হুয়ার্ল হতে পারে প্লেইন (plain), ডাবল (double), সেন্ট্রাল পকেট (central pocket) টাইপ। এই তিন ধরনের প্যাটার্ণ ছাড়াও ফিঙ্গারপ্রিন্টে থাকতে পারে ডট, লেক, শর্ট রিজ, এন্ডিং রিজ, ক্রসওভার, কিংবা বাইফারকেশন রিজ বৈশিষ্ট্য যা দিয়ে ফিঙ্গারপ্রিন্ট প্যাটার্ণ সনাক্ত করা যায়।

লেটেন্ট ফিঙ্গারপ্রিন্ট (latent fingerprint) অপরাধ যেখানে ঘটে সেখান থেকে নেওয়া হয়। অপরাধী কোন না কোন কিছুর (সাধারণত মেটাল, গ্লাস বা প্লাস্টিক এর তৈরী কিছু) উপর তার হাত রাখবেই আর সেখান থেকেই ফিঙ্গারপ্রিন্ট যোগাড় করা যায়। এক্ষেত্রে কিছু কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় যা দিয়ে ফিঙ্গারপ্রিন্ট সংগ্রহ ও পরে নক্সা পরিস্ফুট করা হয়। গবেষণা ও অভিজ্ঞতা থেকে দেখে গেছে যে, একজন ব্যক্তির তার জীবিত সময়কালে কখনোই তার ফিঙ্গারপ্রিন্ট প্যাটার্ণ পরিবর্তন হয় না, কোনপ্রকার দূর্ঘটনা, চর্মরোগ, পোড়া, এমনকি মৃত্যুর পরেও যতদিন পর্যন্ত দেহ পঁচে-গলে ক্ষয় না হয়ে যায়, ততদিন পর্যন্ত ফিঙ্গারপ্রিন্ট প্যাটার্ণ অক্ষত থাকে। এটা প্রতিটি ব্যক্তির ক্ষেত্রে এতটাই স্বাতন্ত্র্য যে, দেখা গেছে দুটি যমজ শিশু একই ডিএনএ প্রোফাইল নিয়ে জন্মালেও ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে তাদের আলাদা করা যায়।

বাংলাদেশে ফিঙ্গারপ্রিন্টঃ আমাদের ভারতবর্ষেই ফিঙ্গারপ্রিন্টের প্রথম সফল প্রায়োগিক ব্যবহার, আমাদের ভারতবর্ষেরই দুজন বিশেষজ্ঞ হেনরী ক্লাসিফিকেশন সিস্টেম তৈরীতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন আর আমাদের বাংলাদেশে ফিঙ্গারপ্রিন্টের প্রায়োগিক ব্যবহার নেই। আমাদের দেশে অক্ষরজ্ঞানহীন লোকের বৃদ্ধাগুলির ছাপ নেওয়া হয় কিন্তু সেটা কীভাবে তাকে সনাক্তকরে আমার মাথায় ঢুকে না। কারন ফিঙ্গারপ্রিন্ট দশ আঙ্গুলের নিতে হবে এবং কোন অঙ্গুলী না থাকলে সেটা মিসিং অঙ্গুলী হিসেবে লিপিবদ্ধ করতে হবে। আমাদের ফিঙ্গারপ্রিন্টের কম্পিউটারাইজড ব্যবস্থার কথা বাদই দিলাম, গতানুগতিক ফাইলিং সিস্টেমও নেই। আমার জানা মতে আমাদের দেশে ফিঙ্গারপ্রিন্ট বিশেষজ্ঞও নেই।

সঠিক অপরাধীকে ধরার জন্য এর চেয়ে ভালো ব্যবস্থা আর নেই। আমাদের দেশে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যবস্থা জরুরী ভিত্তিতে গড়ে তোলা দরকার যদি আমরা দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন বা প্রথম দশ/বিশে আর না থাকতে চাই। জাতীয় পরিচয়পত্র ও ফিঙ্গারপ্রিন্টঃ বাংলাদেশে পরিচয়পত্র নিরীক্ষার বর্তমান পদ্ধতি শুধুমাত্র ছবি মিলিয়ে দেখা। সরকারের কাছে একটি ছবি থাকে, আর ব্যবহারকারীর কাছে থাকে কার্ড। চোখের দেখায় ছবি মিলিয়ে হিমানীকে হিমানী বলে শনাক্ত করা হয়, রিমাকে রিমা বলে।

এক্ষেত্রে জালিয়াতি প্রধানত দু’রকম হতে পারে। যেখানে কেন্দ্রীয় ভাবে সংরক্ষিত ছবির সাথে মিলিয়ে দেখা হয় – যেমন নির্বাচন কমিশন – সেখানে রিমার মূল ছবিটি বদলে হিমানীর একটি ছবি রেখে দেওয়া দুষ্কর কিছু নয়। এরপর রিমার অজান্তেই তার পরিচয়ে জীবন চালাতে পারে হিমানী। দ্বিতীয় পদ্ধতিটি হলো নিজের ছবি তুলে একটি পরিচয়পত্র তৈরি করে ফেলা। এটি ব্যবহার হতে পারে এমন স্থানে যেখানে ছবি ব্যবহার হলেও কেন্দ্রীয় ভাবে সংরক্ষিত ছবির সাথে মিলিয়ে দেখা হয় না – যেমন, বাজার-ঘাটে পরিচয় দেওয়া, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের সময় পরিচয়পত্র দেখানো, ইত্যাদি।

এই দুর্বলতা নিরসনে ভবিষ্যতে এমন কার্ড দরকার যা তার চুম্বক-স্মৃতিতে কিছু মৌলিক তথ্য সংরক্ষণ করবে। এটি হতে হবে এমন তথ্য যা শুধু সেই পরিচয়পত্রের প্রকৃত মালিক জানবেন। ধরা যাক রহিম ও করিমের একজনের গুপ্ত সংকেত ১২৩, অন্য জনের ৪৫৬। শুধু এটুকু তথ্য থাকলে তা খুব সহজেই জেনে যাওয়া সম্ভব। প্রয়োজন তাই আরেকটু কঠিন কিছু।

একটি পদ্ধতি হলো কেন্দ্রীয় সার্ভারে সংরক্ষিত ছবির সাথে স্বয়ংক্রিয় ভাবে মিলিয়ে নেওয়া। একটি স্ট্যাম্প-সাইজ ছবিতে প্রায় ৮০৪ পিক্সেল পরিমাণ তথ্য থাকে। এই পরিমাণ তথ্য ও আনুষাঙ্গিক প্রক্রিয়াকরণ দেশের যেকোন প্রান্ত থেকে কেন্দ্রীয় ভাবে যাচাই করার প্রয়াস সুতার উপর ট্রাক চালানোর মতো ব্যাপার। তুলনায় অনেক কার্যকর পদ্ধতি হলো আঙ্গুলের ছাপ মিলিয়ে নেওয়া। এটি বর্তমানে বহুল-ব্যবহৃত পদ্ধতিগুলোর একটি।

প্রতিটি মানুষের হাতের ছাপ ভিন্ন। এমনকি যমজ ভাই-বোনের হাতের ছাপও ভিন্ন হয়। এটি প্রতিটি মানুষেরই আছে, এবং এটি কোন পাসওয়ার্ডের মতো কষ্ট করে মুখস্তও রাখতে হবে না। কম্পিউটারে এই ভিন্নতাকে ধারণ করা হয় কো-অর্ডিনেট সিস্টেমের মাধ্যমে। পাঠক নিজের ডান হাতের তর্জনীর দিকে তাকালে দেখবেন, কোনো কোনো স্থানে হাতের দাগগুলো ভাগ হয়ে গেছে কাটা চামচের মতো (ফর্ক), কোথাও কোথাও দাগের সমাপ্তি ঘটেছে (টারমিনেশন), আর কোথাও কোথাও তৈরি হয়েছে পাহাড়চূড়া (মিনুশা পয়েন্ট)।

মূলত এই তিনটি বিশেষত্বের অবস্থান দিয়েই গঠিত হয় একজন মানুষের ‘পরিচয়’। এই তথ্য সংরক্ষণের জন্য একটি সাধারণ মেট্রিক্স যথেষ্ট। প্রান্তিক ভাবে বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই পদ্ধতিকে আরও শক্তিশালী করা সম্ভব। কেন্দ্রীয় সার্ভারেও নামের বিপরীতে একটি হাতের ছাপ সংরক্ষণ করা সহজতর। কেন্দ্র ও প্রান্ত উভয় ক্ষেত্রেই উচ্চতর প্রযুক্তি ব্যবহার করে পদ্ধতিটি শক্তিশালী করা সম্ভব।

এই সামগ্রিক পরিবর্তন কোন ভাবেই তথ্য আদান-প্রদানের প্রক্রিয়াটি প্রভাবিত করবে না। পক্ষান্তরে, একটি ছবি কেন্দ্রীয় ভাবে যাচাই করার জন্য অনেক বেশি পরিমাণ তথ্য আদান-প্রদান করতে হয়। সাথে রয়েছে চেহারার বিভিন্ন অংশ খুঁজে বের করা, সেগুলোর আইগেন ভ্যালু নেওয়া, ইত্যাদি জটিলতা। পরীক্ষায় দেখা গেছে, যান্ত্রিক ভাবে যাচাইকৃত ছবির ব্যর্থতার হার ২০ থেকে ৪০ ভাগ। তুলনায় ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যবহার করলে ব্যর্থতার হার কমে ২.৫% -এ নেমে আসে।

এখন পর্যন্ত জানা পদ্ধতির মধ্যে শুধুমাত্র ডিএনএ পরীক্ষা করেই এর চেয়ে সফল ভাবে পরিচয় যাচাই করা সম্ভব। খুব সহসা না হলেও ২০২১ নাগাদ এই পদ্ধতি খুব সহজেই বাস্তবায়ন করা সম্ভব বাংলাদেশে। জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির প্রাথমিক ধাপেই এ-ধরনের দিক-নির্দেশনা দেওয়া থাকলে সকল নাগরিকের হাতের ছাপ সংরক্ষিত থাকবে, যা ভবিষ্যতে অপরাধ দমনেও সাহায্য করবে ব্যাপক ভাবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এ-ধরনের বায়োমেট্রিক তথ্যসমৃদ্ধ চিপ ব্যবহার করেই ইলেক্ট্রনিক পাসপোর্ট তৈরি হয়। এই আধুনিক পাসপোর্টে একটি ডিজিটাল ছবি জুড়ে দেওয়া হয়।

আগামী কিছু বছরের মধ্যে উন্নত বিশ্বে যাতায়াতের জন্য ইলেক্ট্রনিক পাসপোর্ট আবশ্যক হতে যাচ্ছে। অতএব, কোনো না কোনো পর্যায়ে বাংলাদেশের অনেক মানুষকেই নতুন করে পাসপোর্ট গ্রহণ করতে হবে। দেশব্যাপী কোনো প্রকল্প হাতে না নিলেও অন্তত এই নতুন পাসপোর্ট ইস্যুর সময় নিজস্ব একটি বায়োমেট্রিক ডেটাবেজ তৈরির দিকে নজর দেওয়া উচিত। অতঃপর সীমিত পরিসরে হলেও এর ব্যবহার ছড়িয়ে দেওয়া উচিত। এভাবেই হাঁটি হাঁটি পা পা করে কিছু বছরের মধ্যে একটি ব্যাপক তথ্যভাণ্ডার গড়ে উঠবে।

সহায়ক সাইটসঃ ১। আধুনিক ফিঙ্গারপ্রিন্টের আবিষ্কারক ২। . http://blog.priyo.com/2011/jan/16/827.html ৩। http://batayon.blogspot.com/ ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৩ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.