আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দিগবিদিক @বালিয়াতি জমিদারবাড়ী ও ধানকোড়া জমিদারবাড়ী

আমি কথন কানা বাবা অনেকক্ষন তার চোখের ভাষা বোঝার চেষ্টা করছি। কিন্তু দ্রুত সে বাইরে দৃষ্টি নিয়ে যায়। এই অল্প সময়ে কি কারো চোখের ভাষা বোঝা যায়? কেউ কেউ বলে চোখে চোখ রাখা অপরাধ, আবার কারো মতে চোখে চোখ রাখতে না পারাটা দুর্বলতা। যাই হোক, বাসের ভিতর বাবার কোলে বসে থাকা দেড় বছরের শিশুটির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে না পারার জন্য আশেপাশের দৃশ্যগুলোই দায়ী। হঠাৎ একচিলতে খালি সময় পাওয়ায় পরিকল্পনা শুরু হল ঘুরতে বের হব।

কয়েকটা নামের মধ্যে মানিকগঞ্জের বালিহাটি জমিদারবাড়ীও ছিল। সবার জন্য প্রথমবার হিসেবে ভ্রমণের আগের দিনই ঠিক হলো আমরা মানিকগঞ্জেই যাব। আর গত কয়েক দিন ধরে পরীক্ষার ফাঁকে ফাঁকে বেশকিছু ছবি দেখার মাঝে “যেখানে ভুতের ভয়” দেখেছি। তাই পুরোন রাজবাড়ী বা জমিদারবাড়ী গুলোর প্রতিও একরকমের টান অনুভব করছিলাম। তাই ১৭ মার্চ ছুটিতে বন্ধু রিজুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

পুরোন ঢাকার বন্ধু সাসিস চলে এলো ফার্মগেট, সেখান থেকেই তিনজন একসাথে গাবতলী। আরো বেশ কিছু নাম থাকার সম্ভাবনা ছিলো। কিন্তু সকালের মিষ্টি ঘুম কে তুচ্ছ করতে পারাটাও ভালো সাহসের ব্যাপার। আমরা তিনজন সাহসী ১৮+ গাবতলী থেকে সাটুরিয়ার টিকেট কাটলাম S.B link এ। আশ্চর্যজনকভাবে সঠিক সময়ে বাসও চলতে শুরু করলো।

৯;৪৫ এ গাবতলী ছাড়লাম। আর এসময়েই বাবার কোলে চড়ে বাসে উঠলো শিশুটা। অদ্ভুত চোখদুটো। ভালোই দৃষ্টিবিনিময় হচ্ছিল। কিন্তু নবীনগর, ধামরাই পার হয়ে কালামপুরে যেই বাস ডানে মোড় নিলো, অমনি তার দৃষ্টি হারিয়ে গেলো দিগন্তবিস্তৃত ধান আর ভুট্টোক্ষেতের মাঝে।

আমিও তার দৃষ্টি অনুসরণ করলাম। মহিশাষী বাজারের আগের এলোমেলো সরু রাস্তাটা আমার গ্রামের বাড়ী যাওয়ার কথা মনে করে দিলো। আমরা সাটুরিয়া বাজার পৌঁছালাম ১২টায়। ইতিমধ্যেই আমাদের আরেক ভ্রমণসঙ্গী আবির ভাই রওনা দিয়েছেন গাবতলী থেকে। আমরা হাল্কা নাস্তা করে ভ্যানে চড়লাম।

গন্তব্য বালিহাটি জমিদার বাড়ী। পৌঁছেই তিনটি দশ টাকার টিকেট কেটে ভিতরে ঢুকলাম। পুরাই থ। চার চারটা জমিদার বাড়ী, প্রায় ৫০ ফিট উঁচু এক একটা প্রাসাদ এতই কারুকার্জে পুর্ণ যে প্রতি মুহুর্তেই বিস্মিত হচ্ছি। আট ইঞ্চি করে সিঁড়ির উত্থান আর বিশাল বিশাল স্তম্ভগুলো চুন-সুরকি আর ইট দিয়ে কিভাবে কত পরিশ্রমের মাধ্যমে যে নির্মিত হয়েছিলো আমি হতবাক।

প্রতিটা স্তম্ভের পেডেস্টাল ছয় ফিটের উপর। আর স্তম্ভ থেকে স্তম্ভের দুরত্বও আশ্চর্যজনকভাবে মানুষের দৈহিক মাপ সমর্থন করছে। গ্রীক স্থাপত্যের মতই কারুকার্জমন্ডিত স্তম্ভের উপরের দিকটা (ক্যাপিটাল)। স্থাপত্যের ছাত্র হিসেবেই মনে প্রশ্ন এলো, আমাদের পাশের দেশগুলোতে কি হয়েছে, কি হচ্ছে এসব যতটুকু জোর দিয়ে আমাদের পড়ানো হয়, জানানো হয়, সে হিসেবে অন্তত দেশের পুরোনো স্থাপত্যের নামগুলোও আমাদের সাথে পরিচিত করা হয় না। ১নং প্রাসাদের মাঝের স্তম্ভের পিছনে থাকা গোলাকার লৌহ নির্মিত সিঁড়ি আর দেয়ালের উপরের নিঁখুত কাজগুলো যতই প্রাসাদের ভেতরে টানুক, তালাবন্ধ থাকার জন্য ভেতরে ঢুকতে পারলাম না।

২নং প্রাসাদের ভেতরেই বর্তমান জাদুঘর। নিচ তলায় প্রদর্শনীতে রাখা এক একটা বিশাল সিন্দুক যে কি ভারী আর কেমন নিরাপদ ছিলো তা ভাবছিলাম আর বিভিন্ন সময়ের রাজারানীর কাহিনী মনে পড়ছিলো। সবচেয়ে আকর্ষনীয় মনে হলো ল্যাম্প গুলো। বিভিন্ন রকমের ল্যাম্প আর হারিকেনগুলোতে আলো জ্বললে ঐ মুহুর্তেই উনিশ শতকে চলে যেতাম। ৩ নং প্রাসাদেরও দরোজা বন্ধ, আর বাইরে দেখতেও একই।

৪নং প্রাসাদ দেখতে ১নং এর মত হলেও এটা বেশী পুরোন। পলেস্তারা খসে পরা দেয়াল গুলো চামড়াবিহীন নরকংকাল এর মতন হাসছে। তবু এর আলাদা একধরনের আকর্ষনীয় ক্ষমতা আছে। এর সামনের গাছটিও হয়তো তার সাথে সখ্যতা করেছে। গাছটি এমনভাবে আছে যেনো একইসাথে সে অন্য দালান গুলো থেকে ৪নংকে আলাদা আর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আড়াল করে রেখেছে।

তাকাতেই ঠান্ডা শিহরণ খেলে যাওয়া এই দালানের সামনের সিঁড়িতে আমরা পানিপান বিরতিতে বসলাম। ততক্ষনে আমাদের চতুর্থ ভ্রমণ সঙ্গী আবির ভাই সাটুরিয়া এসে পৌঁছেছেন সংবাদ এলো। আমরা ধীরে ধীরে ৩নং ও ৪নং প্রাসাদের মাঝ দিয়ে অন্দরমহলের দিকে ঢুকলাম। প্রতিটা প্রাসাদের জন্য একটা করে অন্দরমহল। তার মানে ৪টা প্রাসাদের ৪টা অন্দরমহল থাকার কথা।

কিন্তু ৪ নং এর পেছনে চতুর্থ অন্দরমহল নেই। এব্যাপারে বিস্তৃত কিছু এখনো জানি না। পেছনে সংস্কার কাজ চলছে। অন্দরমহলের ভিতরকার কক্ষগুলোতে জনসাধারণের তথা দর্শনার্থীএর প্রবেশ নিষেধ। সেখানে মিস্ত্রিরা তাদের সাময়িক সংসার পাতিয়েছেন।

কিন্তু একতলা আর বাইরে ঘুরতে ঘুরতে তখন খানিকটা রাগই লাগছিলো। কিছু পেলেও পেতে পারি ভেবে ২ ও ৩নং অন্দরমহলের মাঝখানের ২ফিটের সরু গলিতে হাটা শুরু করলাম। যদি কোনো ভাবে ভিতরে ঢুকা যায়। কিন্তু সব জানলা আর দরোজা পেরেক কাঠ দিয়ে আটকানো। কিছু অবশ্য লোহার গ্রিল ছিলো।

কিছু কিছু ভাঙ্গা, তবে তার পেছনেই টিন দেয়া। না যায় কিছু দেখা, ঢুকতে পারা তো অনেক পরের ব্যাপার। তক্ষক আর চামচিকার শব্দ শুনতে শুনতে যখন অপরপ্রান্তে বেরিয়ে আসলাম, সামনে তখন জমিদারবাড়ির পুকুর। ৬টা সিঁড়ি পুকুরে নেমে গেছে। বেশিরভাগই ভাঙ্গা।

ভুমিকম্পে ঠিক যেমন দালান কোঠা ফেটে যায়, তেমন। পুকুর পারে বসে অপেক্ষা করতে করতে আবির ভাই পৌঁছে গেলেন। তিনি আসার পর আমাদের দল সম্পুর্ণ। কারণ আমাদের সাথে এতক্ষন কোনো ক্যামেরা ছিলো না। তাই ক্যামেরা পেয়ে এবার শুরু হলো বিচার বিশ্লেষন।

স্থাপত্যের নয়, কোন স্থানে কিভাবে ছবি তুললে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হবে। যাই হোক তারপরও স্বভাববশত আলোচনায় পুকুরের অপরপাশের সারিবদ্ধ দরোজা গুলো দেখে আমরা ধারণা করতে লাগলাম কি হতে পারে ঐগুলো। হয়তোবা পয়নিষ্কাশন কক্ষ কিংবা পোশাক পরিবর্তন কক্ষ। কাছে গিয়ে দেখি সারিবদ্ধ কক্ষ গুলো সব পয়নিষ্কাশন কক্ষ । আর গুটিকয়েক পোশাক পরিবর্তন কক্ষ।

অদ্ভুত হলেও যেখানে আমরা আধুনিক সমাজে প্রতিটা কক্ষের সাথে একটা করে পয়নিষ্কাশন কক্ষ দেখি, সেখানে এই প্রাসাদগুলোতে পয়নিষ্কাশন কক্ষ একদম পিছনে। আর বলতে গেলে আলাদাই। পুকুরের সিঁড়িও পুরুষ ও মহিলাদের জন্য আলাদা। পুর্ব পার্শ্বের একটি সিঁড়ি এখন আর নেই। তারমানে পুকুরে নামার জন্য সাতটা সিঁড়ি ছিলো।

সবমিলিয়ে ৫টা কুয়ো চোখে পড়লো। সবগুলোই ভরাট হয়ে গেছে। অন্দর মহলের বাইরের কারুকার্য দেখে ৪নং প্রাসাদের সামনে আসলাম। লক্ষ্য স্থাপত্যের সাথে স্থাপত্যের ছবি তোলা (মাঝে মাঝে কেউ কেউ বলে, পাস করে আর্কিটেকচার হবা, কতদিন বাকি... )। ছবি তুলতে তুলতে খেয়াল করলাম আমরা বেশ তরতরিয়ে স্তম্ভের পাদতল গুলোতে উঠতে পারছি।

এক্সময় আবিষ্কার করলাম ছবি তুলতে তুলতে আমরা দোতালার বারান্দার কাছাকাছি। টপকিয়ে রেলিং পার হয়ে গেলাম। ঐ মুহুর্তে ভ্রমণ সফল কথাটা ভাবতে শুরু করেছি। দোতালার বারান্দায় দাড়িয়ে আমি আর রিজু জমিদারী দর্শন ও প্রদর্শন করতে করতে আরেকটি ৬/৭ জনের দল আমাদের দেখে ফেললো। তারা জানতে চাইলো আমরা কিভাবে উপরে উঠেছি? ব্যস দুজন স্তম্ভ বেয়ে উঠা শুরু করলো।

এদের একজনকে উঠার সময় আমাদের ক্যামেরা দেয়া হলো। রিজু যে মাত্র তার হাত থেকে ক্যামেরা নিলো অমনি কর্তৃপক্ষদের কয়েকজন হইচই করে দৌড়ে এলো। আমি আর রিজু দ্রুত সটকে পড়লাম ভিতরে। বাইরের চেঁচামেচি শুনছি আর ভাবছি বেরোব কিনা? তখন রিজু বললো ধরা তো খাবই তো ক্যামেরা হাতে ছবি তুলেই ফেলি। ঝটপট ছবি তুলা শুরু করলাম।

সিঁড়ি দুটো, দুটোই ভাঙ্গা। আর মজার ব্যাপার হলো সিঁড়ির ছাদ খোলা। অর্থাৎ বাড়ির ভেতরের সিঁড়িতে আকাশআলোর ব্যবস্থা। তখনো ছিলো। দেয়ালেও রঙের ভিন্যতা।

নিচ থেকে সবুজ সিগন্যাল পেয়ে দ্রুত নেমে এলাম দুইজন। ভিতরকার অন্ধকারাচ্ছন্ন কক্ষগুলোতে দেয়াল আলমিরা আর দরোজার চারপাশের কাজ ছাড়া কিছুই দেখার ছিলোনা। তবুও মানুষের স্বভাবসুলভ নিষিদ্ধ বিষয়ের প্রতি যে আকর্ষন সেই কারনেই হয়তো ভ্রমনের চুম্বক অংশটি মাত্র অতিবাহিত হলো, এই আনন্দে ডুবে গেলাম। বালিহাটি থেকে বের হয়ে সাটুরিয়া যখন আসলাম তখন সময় সাড়ে তিনটার বেশী। হোটেলে খেলাম ডিমের সালুন আর ভাত।

ভাত শেষে একটা করে রসগোল্লা। এরপর গন্তব্য ধানকোড়া। টেম্পোতে জায়গা আছে দু’জনের। কিন্তু আমরা ৪ জন। দুজন বসলো আর আবির ভাইয়ের সাথে আমি দায়িত্ব নিলাম টেম্পোর হেল্পার হবো।

দুজন যখন আধাপাকা রাস্তায় উড়ন্ত টেম্পোর পেছনের স্ট্যান্ডে দাঁড়ানো মনে হচ্ছিলো দুজনে কম্পিউটারে গেমস খেলছি। ধুলা থেকে চোখ বাঁচানো আর হঠাৎ আসা ডালপালা থেকে মাথা বাঁচানোর দুরুহ প্রচেষ্টা। ২৫ মিনিটের মধ্যেই ধানকোড়া বাজার পৌছে গেলাম। ভ্যানে চেপে চলে গেলাম জমিদার বাড়ি। এখন এই জমিদারবাড়ী ভুমি অফিস।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ব্যবস্থাপনায় এই জমিদারবাড়ী এখনো আসে নাই। পেছনে বিশাল পুকুর। একটাই একতলা দালান টিকে আছে। আর প্রবেশপথের দুপাশে দুটো টাওয়ার। পেছনের বাকি দালানগুলো এখন আর নাই।

সেগুলো ভেঙ্গে মানুষ নুতন বাড়িঘর করেছে। ইতিহাস রেখে লাভটা কি যেখানে নিজের ইতিহাসের নিরাপত্তা নেই। কিন্তু নিজের দেশের চুনসুরকির কথা না জেনে আমরা শুরু করছি কনক্রীট এর গল্প। তখনো লোহার তৈরী কাঠামোই ছিলো। কিন্তু চুন-সুরকির সাথে লোহার মিলন কিভাবে হলো, কে এই দেশে আনলো তা হয়তো স্বল্পজ্ঞানের জন্য আমার অজানা।

স্থাপত্যের শিক্ষার্থী হিসেবে এতোটুকুতো জানা উচিত এই দালানগুলোর স্থপতি কে। কিন্তু প্রশ্নটা অনেক পৌরাণিক আর সস্তা মনে হচ্ছে। আর আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোতে পুরোন স্থাপত্য গুলোর যেমন প্রচার ও পরিচর্যা করা হয় তার কিয়দংশ কি আমাদের দেশে হচ্ছে? মনে হয় না। সন্ধ্যে বেলার নিভে যাওয়া সুর্য জমিদারবাড়ী থেকে নিজের কুটিরে ফিরে যাওয়ার গল্প বলে। তাই নন্দীগ্রাম দিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।

ইতি টানলাম দিগবিদিক ভ্রমণ-১ এর গল্প। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।