বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ যশোরে বিষ দিয়ে মারা হচ্ছে সড়কের সরকারি গাছ । বিষয়টা সম্ভবত খুবই তুচ্ছ । তা না হলে এ নিয়ে থানায় অভিযোগ করা হলে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা হাসাহাসিই-বা করে কেন? রাজনৈতিক নেতারাই -বা এ বিষয়ে গা করে না কেন? তারাও নাকি হাসাহাসি করে।
খায়রুল তখন এহসানকে সেরকমই বলল । এ দেশে আজকাল হাসাহাসিটা যেন একটু বেশিই হচ্ছে । এ দেশের লোকে অনভিজ্ঞ মন্ত্রীর অর্বাচীন বক্তব্যে হাসে। আমোদ পায়। সাময়িক ভাবে দুঃখ-দুর্দশা ভুলে যায়।
এহসান ক্রোধ টের পায় ...
খায়রুল ও এহসান দেশের একটি শীর্ষ দৈনিকের তরুণ প্রতিবেদক। থানার এস.আই ওদের একেবারে উড়িয়ে দিল না। প্রশাসনের পক্ষ থেকে অপকর্মের হোতাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে বলে আশ্বাস দিল ।
শার্শা থানা থেকে বেরিয়ে সিগারেট ধরালো এহসান । বাইরে চরম রোদ।
সাদা রঙের টিশার্ট পরেছিল। ভিজে গেছে। এহসানের ঠিক পাশেই হাঁটছিল খায়রুল । ছেলেটা জুনিয়র। এহসানদের পত্রিকার স্থানীয় প্রতিনিধি।
আমার সামনে সিগারেট ধরাতে সঙ্কোচ বোধ করছে কি? কিন্তু খায়রুল সিগারেট খায় কি? শ্যামলা রঙের ছোটখাটো গড়ন খায়রুলের । পরনে সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট। কাঁধে বড়োসরো একটা ব্যাগ। ক্যামেরাটেমেরা ওই ব্যাগের ভিতরেই আছে। বেশ মেধাবী ও সাহসী সাংবাদিক খায়রুল।
যশোরের খুঁটিনাটি খোঁজখবর ভালোই রাখে। এর আগে ওর কয়েকটা সরেজমিন রিপোর্ট হইচই ফেলে দিয়েছিল।
এহসানদের পত্রিকার সম্পাদকের বাড়ি যশোরে । স্বভাবতই যশোরের ব্যাপারে স্পর্শকাতর। গতকাল এহসানকে ডেকে বললেন, প্রভাবশালীরা যশোরে সড়কের রাস্তার পাশের সরকারি গাছ বিষ প্রয়োগ করে মেরে ফেলছে।
তুমি খায়রুলের সঙ্গে যোগাযোগ করে একটা সরেজমিন প্রতিবেদন দাঁড় করাও। সেই খোঁজ নিতেই যশোরে এসেছে এহসান। আজ সকালে শার্শায় পৌঁছে খায়রুলের সঙ্গেই যোগাযোগ করেছে। তারপর দুজনে থানায় গিয়েছিল। তো থানার লোকজন অভিযোগ শুনে হাসল।
হাসারই কথা। এদেশে মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। বিষ দিয়ে গাছ মেরে ফেলা তো তুচ্ছ বিষয়।
ওরা একটা রেস্তঁরায় ঢুকল। রেস্তঁরাটি মহাসড়কের ঠিক পাশেই ।
মহাসড়কে বাস- ট্রাকের সারি। বেনাপোল বর্ডার কাছেই। শার্শার পশ্চিমে। সীমান্তের ওপারেই পশ্চিম বাংলা ।
সকাল এগারোটার মতো বাজে।
রেস্তঁরায় তেমন ভিড়টির নেই। অল্প কজন লোক বসে চা-সিঙাড়া খাচ্ছে। এহসান রাস্তার দিকে মুখ করে বসল। রোদের আলোয় স্পষ্ট দেখা যায় মহাসড়কের পাশে দীর্ঘ একটি রেনইনট্রি। কারা যেন গোড়া থেকে বাকল ছাড়িয়ে নিয়েছে।
খায়রুল দু’কাপ চায়ের অর্ডার দিল।
রিপোর্টটার খসড়া এহসান আজই লিখে ফেলতে চায়। খায়রুল নিজ উদ্যেগেই বিষয়টি নিয়ে কিছু খোঁজখবর নিয়ে রেখেছে। এহসান জিগ্যেস করল, গাছ যে বিষ দিয়ে মেরে ফেলছে তার কারণ কি বলে মনে হয় ?
খায়রুল দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল, এসব জায়গায় জমির দাম আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে।
সড়কের পাশের জমি নিষ্কন্টক রাখার জন্যই গাছগুলি মেরে ফেলা হচ্ছে।
কী ভাবে? এহসানের চোখ সরু হয়ে উঠছে।
তুঁতেসহ বিভিন্ন রাসায়নিক তরল ও কেরোসিন তেল দিয়ে।
এহসান দীর্ঘশ্বাস ফেলে। একমুখ ধোঁয়া ছাড়ে।
আজকাল মানুষ কত হিংস্র হয়ে উঠেছে। এরকম মর্মান্তিক উপায়ে গাছহত্যা করতে বিবেকে বাধে না ।
একটি অল্পবয়েসি ছেলে এসে চা দিয়ে যায়।
খায়রুল চায়ের কাপ টেনে নিয়ে বলল, যারা রাস্তায়-রাস্তায় শুকনো কাঠ পাতা কুড়ায়, প্রভাবশালী লোকজন তাদের দিয়েই কাজটা করায় । তারা আগে বাকল ছাড়িয়ে নেয় গাছের।
তারপর বিষ দেয়। মাস ছয়েকের মধ্যেই গাছটি শুকিয়ে পুরোপুরি মরে যায়।
এহসান বিষন্ন বোধ করে। অন্যমনস্ক হয়ে চায়ে চুমুক দেয়। এ কী রকম বীভৎসতা! আর এরকম বীভৎসতা সত্ত্বেও প্রশাসন এ ব্যাপারে একেবারেই তৎপর নয়।
এ কীরকম দেশ!
চায়ে চুমুক দেয় খায়রুল। তারপর বলল, গতকাল ঢাকা থেকে আপনার ফোন পাওয়ার পরপরই আমি জেলা পরিষদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। তারা বলল, ওদের নিয়ন্ত্রণাধীন ১৩৬টি সড়কের মধ্যে অন্তত ৩০টি সড়কের পাশে হাজার খানেক গাছে বিষ দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে প্রায় ২০০ গাছ শুকিয়ে মরে গেছে।
আশ্চর্য! এর পরও প্রশাসন কিছু করছে না!
এহসানের বিক্ষুব্দ মুখ দেখে খায়রুল হাসল।
বলল, তারা একেবারে বসে নেই। গত বছর জেলা পরিষদ ও বনবিভাগ প্রায় ৪৮ লাখ টাকা মূল্যের মৃত ও চোরাই কাঠ উদ্ধার করেছে।
হুমম। চায়ে চুমুক দেয় এহসান । অন্যমনস্ক হয়ে বলে, বেশ নাজুক অবস্থা দেখছি।
একদিকে প্রশাসন শিথিল, অন্যদিকে নেতারা হাস্য করেন: পরিবেশের জন্য এ রকম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রশাসনের তেমন তৎপরতা নেই।
খায়রুল বলল, যশোর জেলা পরিষদের বৃক্ষ সংরক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আশরাফ হোসেন গত বছরের নভেম্বর মাসে ঝিকরগাছা থানায় ‘বিষাক্ত রাসায়নিক প্রয়োগে বৃক্ষ নিধন’-সংক্রান্ত দুটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন। জেলা প্রশাসনের অভিযোগ, বিষয়টি পুলিশ আমলেই নেয়নি।
এহসান অস্থির বোধ করছিল। জীবন্ত গাছ বিষ ঢেলে মেরে ফেলতে কষ্ট লাগে না? যারা টাকার বিনিময়ে কাজটা করে, তারাও দরিদ্র।
কিন্তু ... কিন্তু গাছেরও যে জীবন আছে। এক সত্যটি এক বাঙালি বিজ্ঞানীরই আবিস্কার । এহসান বলে, তাই বলে চোখের সামনে এত বড় পুকুর চুরি?
খায়রুল হেসে বলল, প্রভাবশালীরা হরতালের সুযোগ নেয় এহসান ভাই। আজকাল দেশে ঘনঘন হরতাল হচ্ছে।
এহসান কী যেন ভাবে ।
শার্শার পশ্চিমের পশ্চিমবাংলার উত্তর চব্বিশ পরগনার বারাসাত। জিগ্যেস করে, ওদিকের কি খবর খায়রুল ? মানে বারাসাতের? ওপারেও কি ওরা গাছ মেরে ফেলে?
না। খায়রুল মাথা নাড়ে।
তাহলে? এহসান কৌতূহলী হয়ে ওঠে।
খায়রুল বলল, ওপারে অনেক মানুষ প্রাচীন বলেই আজও মহাসড়কের গাছগুলিকে পূজা করে।
যে কারণে ওপারের গাছগুলি আজও সতেজ সবুজ।
চায়ে শেষ চুমুক দেওয়ার জন্য কাপ তুলেছিল এহসান ।
কাপশুদ্ধ হাতটা থমকে রইল শূন্যে।
তথ্যসূত্র: এই গল্পের সূত্র গত ৩১ জুলাই ২০১১ প্রথম আলোয় প্রকাশিত মনিরুল ইসলাম- এর ‘যশোরে বিষ দিয়ে মারা হচ্ছে সড়কের সরকারি গাছ’ নামে প্রতিবেদনটি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।