আকাশটা ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে
নিয়োগ বাণিজ্যে সরগরম রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদ
মুক্তিযোদ্ধা কোটাও নাকি বেশ ভাল দামে বিক্রি হচ্ছে
রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের সর্বস্তরে এখন দারুণ ব্যস্ততা। পিয়ন-দারোয়ান থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পদেআসিন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, সবার ব্যস্ততাই চোখে পড়ার মত। তবে এই ব্যস্ততা শুধু জেলা পরিষদের লোকজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে সমগ্র জেলাতেই। কোন কোন ক্ষেত্রে জেলার বাইরে থেকেও এর উত্তাপ পাওয়া যাচ্ছে।
দিন-রাত চলছে শলা-পরামর্শ আর দৌঁড়যাপ। আর এসব কিছুই হচ্ছে একটি নিয়োগকে কেন্দ্র করে।
গত বছরের ২৯ নভেম্বর রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের নিয়ন্ত্রণাধীন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সমূহের জন্য সহকারী এবং প্রধান শিক্ষক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জারী করা হয়েছিল। রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ কর্তৃক (স্মারক নং- সংস্থা/৫৬৮/জেপ্রাশিঅ/২০১০/নিয়োগ/১৬৬৩) জারি করা ওই বিজ্ঞপ্তির তথ্য মতে জেলার ১০টি উপজেলায় ২০৬ জন সহকারী শিক্ষক এবং ৪টি উপজেলায় ১০ জন প্রধান শিক্ষক নিয়োগ পাওয়ার কথা। তবে শেষ পর্যন্ত সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পেতে পারেন তিনশতাধিক এবং প্রধান শিক্ষকের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাবে বলে অনেকে ধারণা করছেন।
আর ওই বিজ্ঞপ্তির আলোকে দরখাস্তকারীদের লিখিত(নিয়োগ) পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে গত ১৫ জুলাই, ২০১১ ইং তারিখে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে প্রধান শিক্ষক পদে দুইশতাধিক এবং সহকারী শিক্ষক পদে প্রায় আট হাজার পরীক্ষার্থী অংশ নিয়েছে। আজকালের মধ্যে এই লিখিত পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করে মৌখিক পরীক্ষার জন্য নির্বাচিতদের তালিকা প্রকাশ করার কথা শুনা যাচ্ছে।
বর্তমানে জেলা পরিষদের সকল ব্যস্ততা এই নিয়োগকে কেন্দ্র করেই। কেননা এই নিয়োগকে ঘিরে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা।
লাখ লাখ টাকা লেনদেনের হিসাব চলছে ঘরে-বাইরে। কে কার কাছ থেকে কত টাকা নিয়ে নিয়োগ দিতে পারে সর্বত্র চলছে তারই অসুস্থ প্রতিযোগিতা। নিয়োগ প্রার্থী এবং এই অসুস্থ প্রতিযোগীদের কানা-ঘুষা থেকে যা আভাস পাওয়া যাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে, জেলা পরিষদের এবারের নিয়োগ প্রক্রিয়া দুর্নীতিতে আগের সকল রেকর্ড ভাঙ্গার পণ করে নেমেছে নিয়োগকর্তারা। তাছাড়া এবার কেউ আর বিনা পয়সায় চাকরী পাওয়ার আশাও করছে না। আর তাই চাকরী প্রার্থীরাও বসে নেই।
যাদের যে লিংক আছে তারা তাদের সে লিংক ধরেই নিশ্চয়তা খুঁজছে চাকরীর। সহকারী শিক্ষক পদে দেড় লাখ থেকে তিন -সাড়ে তিন লাখ টাকা দিয়ে অনেকেই ১৫ জুলাই এর আগেই নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছে। যারা আগে নিশ্চিত করতে পারেনি তারা এখন দৌড় যাপ করছে। তবে মুক্তিযোদ্ধা কোটার পদগুলোও নাকি এবার বেশ ভাল দামে বিক্রি হচ্ছে। আর একারনেই বিভিন্ন উপজেলার অনেক পরীক্ষার্থী ১৫ তারিখ পরীক্ষা দেয়ার পরেও রাঙ্গামাটি অবস্থান করছে যাতে তাদের নিয়োগ নিশ্চিত করতে পারে।
প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ কর্তাদের ডিমান্ড নাকি একটু বেশিই। তাই ভাল পরীক্ষা দিয়েও আমার পরিচিত এক পরীক্ষার্থী কয়েকদিন ঘুরাঘুরি করে ক্ষান্ত দিয়েছে। কারণ তার বাড়ি-ঘর বেচলেও নিয়োগকর্তাদের চাহিদার এক চতুর্থাংশও হবে না। আবার অন্য একজন বলে বেড়াচ্ছে যে আশি নম্বরের লিখিত পরীক্ষায় চল্লিশ পেলেই প্রধান শিক্ষক পদে তার নিয়োগ নিশ্চিত!
নিয়োগকর্তাদের নির্ধারিত সব প্রার্থী যাতে পরীক্ষায় পাশ করে সে ব্যাপারেও পূর্ব প্রস্তুতি ছিল বলেই জানিয়েছে একাধিক পরীক্ষার্থী। যারা আগেই সিলেক্ট হয়েছিল তাদের নাকি একই সাথে বসে একে অপরকে যাতে পরীক্ষায় সহযোগিতা করতে পারে সে সুযোগও দেয়া হয়েছে।
তাছাড়া আরো একটি অভিযোগ শুনা যাচ্ছে যে, এক সাথে বসে পরীক্ষা দেয়ার পরেও যদি কেউ খারাপ করে তাকেও ভাল নম্বরের পাওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। কেন্দ্র ফেরত অনেকে বলেছে, খাতার সাথে পরিচিতির অংশটুকু যেভাবে পিনআপ করা ছিল তা খুব সহযেই পরিবর্তন করা যাবে। কোন কোন ক্ষেত্রে পরীক্ষার খাতা পরিবর্তনের প্রয়োজন হলে, পিন খুলে সেটাও করা যাবে অবলীলায়।
জেলা পরিষদের যেকোন নিয়োগের ক্ষেত্রে টাকা লেনদেনের বিষয়টি অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। আর এটা শুধু রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ বলে কথা নয়।
তিন পার্বত্য জেলার একই অবস্থা। দুই একটি ব্যতিক্রম ছাড়া প্রত্যেক ক্ষেত্রেই টাকা নিয়ে, স্বজন প্রীতির মাধ্যমে কিংবা দলীয় ক্যাডারদের নিয়োগের বিষয়টি এখানে রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া শুধু নিয়োগ বলে কথা নয়। যেকোন সরকারী সুবিধার ক্ষেত্রেই এখানে জনস্বার্থ বিবেচনার চেয়ে দলীয় কিংবা স্বজন প্রীতিই সবার আগে বিবেচিত হয়ে থাকে। তাই অত্র অঞ্চলের সাধারণ মানুষ এসব জেলা পরিষদকে দলীয় নেতাকর্মীদের পুনর্বাসন কেন্দ্র কিংবা দুর্নীতির আখড়া হিসেবেই চিহ্ণিত করে থাকে।
এর জন্য অবশ্য দায়ী এ অঞ্চলের অপরাজনীতি আর সরকারের গা বাঁচিয়ে চলার রীতি। বিশেষ করে দীর্ঘ দিন ধরে অনির্বাচিত দলীয় লোকদের দিয়ে জেলা পরিষদ গুলো চালানো হচ্ছে। আর যেহেতু এসব লোককে সরকার তাদের ইচ্ছে মত নিয়োগ দিয়ে থাকে তাই এভাবে নিয়োগ প্রাপ্তরা কখনোই নিজেদেরকে জনগণের কাছে দায় বদ্ধ মনে করে না। যার ফলে তারা তাদের নিয়োগকৃতদের আজ্ঞাবাহী হয়ে দুর্নীতি করে টাকা কামানোর দ্ধান্দাতেই ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করেন। কিন্তু নির্লজ্জ আর নীতিহীন এই ব্যবস্থাটা তো চিরস্থায়ী হতে পারে না।
এটা কোন সভ্য সমাজের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। তাই যত দ্রুত সম্ভব এই ব্যস্থার পরিবর্তন দরকার। দরকার এ জেলা পরিষদ গুলোতে নির্বাচনের সকল বাধা দূর করে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্থান্তর করা। আর নির্বাচন অনুষ্ঠানের পূর্বে যতটা সম্ভব এসব জেলা পরিষদ গুলোর দূর্নীতি কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে সবার আগে প্রয়োজন জেলা পরিষদ গুলোর অধীন শিক্ষা ব্যবস্থাকে দূর্নীতি মুক্ত করা।
কেননা শিক্ষকতার মত মহান পেশায় আসার আগেই যদি এসব শিক্ষকদেরকে ঘুষ বাণিজ্যের শিকার হতে হয় তাহলে তারা কতটা দায়িত্ববোধ নিয়ে তাদের ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াবেন তা সহজেই অনুমেয়। এসব শিক্ষকরা নিজেরা ঘুষ দিয়ে চাকুরী নিয়ে তাদের ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে কোন আদর্শকে তোলে ধরবেন? সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের এটা অবশ্যই ভাবতে হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।