শফিক হাসান রাষ্ট্রপতির দয়ার শরীর, তাইতো দয়া দেখিয়েই তিনি ক্ষমা করে দিয়েছেন একাধিক খুনের মামলার আসামিকে। অবশ্য খুনি আবার তাঁর নিজ দলীয়ই। একই পীরের মুরিদ দুজন লোকের পারস্পরিক সম্পর্কের নাম পীর-ভাই। সে হিসেবে খুনি রাষ্ট্রপতির দল-ভাই। তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে আসছেন দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে, খুনিও তার বাবার সহযোগী হিসেবে আওয়ামী লীগের নাম ব্যবহার করে কী সব অকাজ-কুকাজ করে আসছিলেন।
কিন্তু লক্ষ্মীপুর জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক, আইনজীবী নুরুল ইসলামের হত্যাকাণ্ড ঘটনায় মিডিয়ায় তোলপাড় হওয়ায় কাজে ব্যাঘাত ঘটে। তাদের ‘জনসেবামূলক কাজ’ স্থগিত রাখতে বাধ্য হন। খুনি বিপ্লবের বাবা আবু তাহের লক্ষ্মীপুরের মূর্তিমান আতঙ্ক। গডফাদার হিসেবে লক্ষ্মীপুরে অদ্বিতীয়। তার নামে এক সময় লক্ষ্মীপুর থরথর করে কাঁপতো।
হয়তো এখনো কাঁপে। কাঁপার সপক্ষে কিঞ্চিত আলামতও পাওয়া গেছে। যাচ্ছেও।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ এবারসহ মোট দুইবার ক্ষমতায় গেছে। বিশেষ করে গত শাসনামলে এ সরকার তাদের দলীয় সাঙ্গপাঙ্গদের সহায়তায় দেশজুড়ে গড়ে তুলেছিলো ত্রাসের রাজত্ব।
জেলায় জেলায় গঠিত হয়েছে বিকল্প সরকার। দেশে সরকার আছে, আইন আছে এমন ধারণাও যেন বিলোপ করে দেয়ার সযত্ন চেষ্টা ছিলো। তৎকালীন উল্লেখযোগ্য সন্ত্রাসী-নেতার মধ্যে অগ্রভাগে ছিলেন নারায়ণগঞ্জের শামীম ওসমান, ফেনীতে জয়নাল হাজারী, লক্ষ্মীপুরে আবু তাহের...। লক্ষ্মীপুর বৃহত্তর নোয়াখালীর একটি জেলা। আবু তাহের যে সন্ত্রাসী তৎপরতায় জয়নাল হাজারীকেও ছাড়িয়ে গেছেন, এটা দলের মানুষ তো বটেই খোদ জয়নাল হাজারীও জানতেন কিনা সন্দেহ।
অবশ্য এলাকার লোকেরা হাড়ে হাড়ে টের পেতো, কারণ সন্ত্রাসের শিকার হতো মূলত তারাই। দুর্ভাগ্যের ফেরে, আবু তাহেরের ত্রাসের রাজত্ব মিডিয়ার কল্যাণে ধসে পড়ে এক সময়। পচা শামুকে পা কাটার মতো কোনো কুক্ষণে আবু তাহের বিএনপি নেতা এ্যাডভোকেট নুরুল ইসলামকে হত্যা করেছিলেন। সহযোগী হিসেবে ছিলেন তার গুণধর ছেলেরা এবং স্ত্রী। হত্যার পর লাশ ভাসিয়ে দেয়া হয়েছিলো মেঘনা নদীতে।
অনেক খোঁজাখুঁজি করেও সে লাশ আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। এ-নিয়ে যখন মিডিয়া তোলপাড়, আবু তাহের একলাফে ‘হিরো’র সম্মান পেয়ে গেলেন। রাতারাতি বনে গেলেন ‘মিডিয়া ব্যক্তিত্ব’। সে সময় লক্ষ্মীপুরে সংবাদ কাভার করতে গিয়েছিলেন দৈনিক প্রথম আলোর চট্টগ্রামের সাংবাদিক একরামুল হক বুলবুল। তাহেরের সন্ত্রাসী বাহিনী চড়াও হয় তার ওপর।
শুধু এখানেই শেষ নয়, তাহের সাংবাদিকদের হাত-পা বেঁধে মেঘনায় ভাসিয়ে দিতে বলেছিলেন। অবশ্য একসময় আবু তাহের নিজেই ভেসে যেতে বাধ্য হলেন। তার প্রিয় দল আওয়ামী লীগ আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে রক্ষা করার হাজারো চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত মিডিয়ার ‘বাড়াবাড়ি’তে আর পারেনি। সপরিবারে আবু তাহেরের স্থান হয় শ্রীঘরে। আবু তাহেরের পথ ধরে তার দল আওয়ামী লীগও ভেসে গেছে।
জাতীয় নির্বাচনে গোহারাই শুধু নয়, অপমানজনকভাবে হেরেছে দলটি। হারার শোক ভুলতে না পেরে নানা রকম তাণ্ডব চালাতেও কসুর করেনি। এ দানবদের সাধারণ মানুষের তো কিছু করার নেই, পাঁচ বছরে শুধু একবার ভোটের মাধ্যমে প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ তৈরি হয়। সে সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছে ভোটাররা। তারপর দীর্ঘ বিরতি।
প্রায় সাত বছর ক্ষমতাহীন অবস্থায় থেকে আবার ক্ষমতায় এসেছে আওয়ামী লীগ। তাদের পুরোনো খাসলতটাও আবার ফিরে এসেছে। ইতিহাস থেকে নাকি কেউ শিক্ষা নেয় না। আওয়ামী লীগও নেবে না, এ আর এমন কী। তারা ক্ষমতায় বসার পরপরই কারাবন্দি নেতাকর্মীদের মুক্তি দেয়া শুরু করলেন।
এ তরিকায় মুক্তি পেলেন লক্ষ্মীপুরের লক্ষ্মী আবু তাহের। মুক্তি পেয়েই তার জনসেবার খায়েশ আবার জেগে উঠলো। প্রতিপক্ষ প্রার্থীকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ঠিকই তিনি হয়ে গেলেন পৌরসভার মেয়র। আর এদিকে প্রায় ১০ বছর পলাতক থেকে আবু তাহেরের ছেলে, কারাদণ্ড এবং ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামি এ এইচ এম বিপ্লব আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। ২০০৩ সালে বিপ্লবের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয় আদালত।
আরো দুটি হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডও হয়েছে তার। বিপ্লব এ বছরের ৪ এপ্রিল আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। এরপর বিপ্লবের বাবা, জাতির অন্যতম গডফাদার আবু তাহের বিপ্লবের প্রাণভিক্ষা চেয়ে আবেদন করেন। রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান দলের তথা দলীয় কর্মীর মুখ চেয়ে ঠিকই ক্ষমা ভিক্ষা করেন। এখানে আমরা একটা কল্পনা করতে পারি।
প্রকৃত ঘটনা আসলে কী। ধরে নিই আবু তাহের সরকারের সাথে দরকষাকষি করেছিলেন। ফাঁসির আদেশকে রাষ্ট্রপতি কলা দেখাবেন, এই মর্মে নিশ্চয়তা পাওয়ার পরই তাহের তার সুযোগ্য পুত্র বিপ্লবকে আত্মসমর্পণ করতে বলেছেন। যথারীতি বিপ্লব আত্মসমর্পণ করেছেন এবং রাষ্ট্রপতি কথা রেখেছেন। অবশ্য এমনটি করবেন না-ই বা কেন, রাষ্ট্রপতি তো প্রকৃতপক্ষে একটা আলঙ্কারিক পদ।
প্রধানমন্ত্রী শাসিত দেশে রাষ্ট্রপতির কোনো ক্ষমতা থাকে না। শীর্ষ পদে আসীন কিন্তু ক্ষমতাহীন। রাষ্ট্রপতির কাজই হচ্ছে বিভিন্ন জাতীয় দিবসে বাণী দেয়া, দলীয় নেতার মাজার জেয়ারত আর ক্ষমা খয়রাত করা। বিএনপি সরকারের আমলের রাষ্ট্রপতির মাঝেও একই প্রবণতা দেখা গিয়েছিলো। আমাদের রাষ্ট্রপতি মহোদয় যোগ্যতা বলেই এ পদ অলংকৃত করেছেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে যখন আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা কারাঅন্তরীণ ছিলেন, দলের হাল ধরেছিলেন জিল্লুর রহমানই। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে সে ঋণ শোধ করতে কার্পণ্য করেনি। তাছাড়া অতীতে জিল্লুর রহমান কখনোই নেত্রীবন্দনায় পিছিয়ে ছিলেন না। যে দল তাঁকে রাষ্ট্রপতির মতো সর্বোচ্চ পদে আসীন করেছে আর সেই তিনি ‘মামুলি’ একটা কেসে দলের ‘নিবেদিত প্রাণ’ কর্মীকে ক্ষমা ভিক্ষা দিতে পারবেন না, তা কী করে হয়! তাছাড়া জনপ্রতিনিধির ফাঁসি হলে জনসেবা করবে কে, এই বোধও তাঁর মাথায় ছিলো!
অপরাধীকে যখন রাষ্ট্রের শীর্ষ থেকে উৎসাহিত করা হয় আরো অপরাধ করার জন্য, সাধারণ মানুষের দেয়ালে মাথা ঠুকে মরা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। একজন ঘৃণ্য খুনি বিপ্লব ক্ষমা ভিক্ষা পাওয়ার পর কি আরো খুন করতে উৎসাহী হবেন না? কারণ তিনি এবং তারা তো জেনেই গেছেন খুন করলে কিছু হয় না, হবেও না।
দল পাশে থাকবে। নিহত নুরুল ইসলামের স্ত্রী-সন্তানরা এখনই ভয়ে কুঁকড়ে উঠছেন বিপ্লব ছাড়া পেলেই তাদেরও কিছু একটা করে ফেলতে পারে। লক্ষ্মীপুরে বিপ্লবের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের শিকার সাধারণ মানুষরা রাষ্ট্রপতিকে অভিসম্পাত আর আওয়ামী লীগ নামক দলটির প্রতি ঘৃণা পোষণ ছাড়া আর কীই বা করতে পারে? রাষ্ট্রপতির এ উদারতা মানুষকে মুগ্ধ করেনি, বিস্মিত করেছে। তাঁর নীতি-নৈতিকতা, বোধ নিয়ে প্রশ্ন জেগেছে জনমনে। আর রাষ্ট্রপতি পদটাকে করেছে কলঙ্কিত।
একুশ আগস্টের ভয়াল গ্রেনেড হামলায় নিহত হয়েছেন রাষ্ট্রপতির স্ত্রী, আওয়ামী লীগ কর্মী আইভি রহমান। আগামীতে যদি অন্য কোনো সরকার ক্ষমতায় আসে, আইভি রহমানের খুনিদের বিচার এবং সে বিচারে খুনিরা রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পেয়ে যায়; এমন হলে কী রকম লাগে, তখনই বুঝতে পারবেন বর্তমান মহামান্য রাষ্ট্রপতি। এছাড়া অন্য কোনো পন্থা নেই তার ঠুলি পড়া এবং দলপ্রেমে অন্ধ হওয়া চোখে আলো দেয়ার। সঠিক জিনিস সঠিকভাবে দেখবার।
আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর বদলা নিতে বছরের পর বছর খুনিদের পিছনে লেগে আছেন।
প্রায়ই প্রধানমন্ত্রী তর্জন গর্জন করেন। সেই তিনিই যখন অন্য সন্তানের বাবার হত্যার বিচারের পথ রুদ্ধ করে দেন, তখন সেই সন্তানদের অনুভূতি কেমন হতে পারে? এমনিতেই আওয়ামী লীগের পাণ্ডারা প্রতিনিয়ত মানুষ খুন করার উৎসবে মেতে আছে। সে সবেরও কোনো বিচার হয় না বললেই চলে। তার ওপর এবার রাষ্ট্রীয় শীর্ষ পদ থেকে খুনকে উৎসাহিত করা হলো। এতে সাধারণ মানুষ ‘ছি’ বলে যে থুথু ফেলবে, সেই জায়গাটাই বা কই!
আওয়ামী তাহলে কেন দ্বৈতনীতি বজায় রাখবে? একদিকে তারা বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার চাইবে অন্যদিকে ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত খুনিকে মাফ করে দেবে কেন! তাদের কি উচিৎ নয় কোনো একটি পন্থা বেছে নেয়া! নাকি ‘আইন সবার জন্য সমান’ এ উক্তিও পাল্টে দেয়ার তালে আছেন তারা! আইন কি তাহলে যারা আওয়ামী লীগের সরাসরি রাজনীতি করে এবং সন্ত্রাসী প্রকৃতির তাদের জন্য? ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।