আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পুরুষবাদীর ভাবনাচিন্তাঃ প্রসঙ্গ ভিকারুন্নিসা

নিজেকে এই অধম বরাবরই একজন পুরুষবাদী হিসেবে দাবী করে এসেছে। নারী এবং পুরুষ মানবজাতির দু'টি আলাদা প্রজাতি, এবং প্রাকৃতিক প্রয়োজনেই তাদের সম্পূর্ণ আলাদা করে সৃষ্টি করা হয়েছে, আর যেখানে তাদের মাঝে তুলনা করার কোন সাধারণ মাপকাঠি নেই, সেখানে "সমতা"র প্রশ্নটা কিভাবে আসে সেটাও এই বান্দার মাথায় কখনো আসেনি। নারীবাদী নেতা-নেত্রীদের হাঁকডাক দেখলে বেশিরভাগ সময়েই বিরক্ত লাগতো, কারণ অতি পুরুষবাদীদের মত অতি নারীবাদীদেরও ভারসাম্যের প্রতিকূল শক্তি হিসেবেই মনে হয়। অত্যন্ত নিরীহ এবং ভীতু লোক বলেই কিনা, চরমপন্থাকে বরাবরই একটা অগ্রহণযোগ্য সমাধান বলে মনে হয়েছে সদাসর্বদা, কাজেই এই দুই অতি-মেরু'র লোকজনকে চেষ্টা করেছি সবসময় এড়িয়ে থাকতে, এবং সুবিধাবাদীর মতই, এসব অধিকারবিষয়ক তর্কেও গা বাঁচিয়ে গেছি। তো আজকে হঠাৎ করেই এমন বহুবিতর্কিত অনিচ্ছুক বিষয় নিয়ে প্যাঁচাল কেন? প্যাঁচালের হেতু, এবার সমস্যা নিজের ঘাড়ে এসে পড়েছে।

নিজের বলতে, মধ্যবিত্তের ঘাড়ে। এতদিন যখন গার্মেন্টসের মেয়ে পুলিশের হাতে ধর্ষিতা হতো, বা কোন এক পাড়াগাঁয়ে চেয়ারম্যানের ছেলে পরাজিত পক্ষের মেয়েকে পাটক্ষেতে তুলে নিয়ে যেত, তখন আমাদের খুব একটা গা না করলেও হতো। এমনকি উচ্চবিত্তের কন্যা শাজনীনকে যখন বাড়ির পুরুষ চাকরটা ধর্ষণ করে খুন করে, তখনো আমরা খানিক কৌতুহল নিয়ে খবরগুলো পড়তাম, মনে মনে ভাবতাম, বড়লোকের মেয়ে কিনা, সমস্যা আছে, হুঁ হুঁ বাবা! আর মিডিয়ার সেলিব্রিটি তিন্নির লাশ ব্রিজের গোড়ায় পাওয়া গেলে তো কথাই নেই, আরে, পর্নস্টার, মরলেই কি! প্রভার ভিডিও বের হলে আরো খুশি,এইবারে দেখা যাবে ঐ নিষ্পাপ মুখের আড়ালে কত বড় বড় শয়তান, দেখলেন, দেখে কি মনে হয়, আর শরীরে কি! চৈতীর ভিডিও বের হবার খবরে ব্লগে আর ফেসবুকে আকুতি, ভাই লিংকটা দিয়েন ইনবক্সে, মেইল আইডি দিয়া গেলাম, মাগীরে ভালমতন দেখবার চাই! ভাল, এরা নারী, এদেরকেই নিজের সবকিছু রক্ষা করে চলতে হবে, পুরুষ আছে শুধু দেখার জন্য আর ভোগ করার জন্য, বেশ। এদের একেকজনের সামাজিক মর্যাদা, প্রতিষ্ঠা একেকরকম, কেউ নিম্নবি্ত্ত, কেউ মধ্যবিত্ত, কেউ চাকুরিজীবি, কেউ তারকা, কিন্তু একটা জায়গায় সবাই সমান, এরা নারী, এরা "ভিক্টিম"। এরা আমাদের, পুরুষদের থাবার শিকার।

এখানে আমাদের বাছবিচার নেই, আমেরিকার স্পাই স্যাটেলাইটের চেয়েও সর্বগামী আমাদের দৃষ্টি। কোথায় কোন মেয়ের ওড়না সরে গেল, কোথায় কার জামা দিয়ে শরীর কতখানি ফুটে উঠলো, তা নিয়ে গবেষণার শেষ নেই। হোক না কোটিপতির মেয়ে, পুরুষ চাকরের কাছে সে শুধুই মাংসপিণ্ড। কাজের মেয়ে হলেই বা কি, তার শরীরে কি আর সামাজিক মর্যাদা লেখা থাকে? কালো-ধলা, ছোট-বড়, আত্মীয়া-বান্ধবীতে তফাৎ নেই, দেখো আর মজা নাও আর উপভোগ করো। প্রেমিকা? যতক্ষণ আছে ততক্ষণ, ছেড়ে গেলেই একান্ত বিশ্বাসে সমর্পণ করা মুহূর্তগুলোর ভিডিও ছেড়ে দাও সবার সামনে, তুমি একবার ভোগ করেছ, এবার সবাই মিলে চোখ দিয়ে আর মুখ দিয়ে ধর্ষণ করুক, একার মাল দিয়ে কাজ নেই, মালে গণিমতেই আসল সওয়াব।

এগুলো নিয়মিত ঘটনা, গা সওয়া হয়ে গেছে। যেসব পুরুষ প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে এসব কর্মকাণ্ডের সাক্ষী, বা হোতা, তাদেরও ঘরে মা আছে, নিজের বোনের নিরাপত্তা নিয়ে তারাও সময় সময় চিন্তিত হয়, তারপরেই ঘরে ফিরে খোঁজ করতে বসে, আজকে কোন বাংলাদেশী কলেজ গার্লের বয়ফ্রেন্ডের সাথে নতুন ভিডিও বের হলো, সেই কলেজ গার্লটা যে তার নিজের বোনও হতে পারে সেটা ভুলে গিয়েই। নিজেও যে এর খুব ব্যতিক্রম তা নয়, তবে পার্থক্য হয়তো এটাই যে নিজের ঘরের নিরাপত্তা নিয়ে এই অধম একটু বেশি চিন্তিত, তাই অন্যের মেয়ে যখন ভিডিওতে ধরা পড়ে বা ধর্ষিতা হয়ে বিচার চাইবার বদলে আত্মহত্যা করে বা ঘরের কোণে মুখ লুকায়, সেখানে নিজের ঘরের মেয়েটাকে চিন্তা করে ভয়ে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। আমার বোনটা তো কলেজে গেছে, কার সাথে ঘুরছে, কাকে বিশ্বাস করে নিজেকে তুলে দিচ্ছে, আমার মেয়েটাও তো একদিন স্কুলে যাবে, পিতৃতুল্য শিক্ষকের কাছে পড়া বুঝতে যাবে, সহপাঠী ছেলেটার সাথে সরল বিশ্বাসে কথা বলবে, তখন? তখন কি হবে, এটা সম্ভবত আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজের খানিকটা মাথায় ঢুকেছে, রাজধানীর সবচেয়ে খ্যাতনামা স্কুলগুলোর একটি, ভিকারুন্নিসা নুন কলেজের এক ছাত্রী তার শিক্ষকের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হবার পর। এই ছাত্রীকে এরপর এই শিক্ষকরূপী পশু ব্ল্যাকমেইল করে তার জঘন্য কাজ চালিয়ে যায়, এবং এক পর্যায়ে এই ছাত্রী তার অভিভাবকদের মাধ্যমে স্কুল কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ জানায়।

এর সাথে অন্য ছাত্রীরা আরো ৪ জন শিক্ষকের নামে একই ধরনের অভিযোগ করে। আতঙ্কজনক বিষয়টা ঘটে এরপর, কলেজ শাখার প্রধান বিষয়টা চেপে যান, কিন্তু ততক্ষনে ঘটনাটা প্রচার পেয়ে যাওয়াতে অন্য অভিভাবকরাও ক্ষোভে ফেটে পড়েন, এবং এই প্রেক্ষিতে তাকে অপসারণ করা হয়, এবং অভিযুক্ত শিক্ষককে সাময়িক অব্যাহতি দিয়ে বাকি ৪ জনকে অন্য শাখায় বদলি করা হয়। এতে ছাত্রীরা এবং অভিভাবকরা সন্তুষ্ট না হয়ে আন্দোলন চালিয়ে যান, এবং সেই অবস্থায় কলেজের অধ্যক্ষা হোসনে আরা নির্যাতিতা ছাত্রীকেই টিসি দেয়ার হুমকি দেন। এমনকি পরবর্তীতে যখন অভিযুক্ত শিক্ষক পরিমল গ্রেপ্তার হয়ে ধর্ষনের কথা স্বীকার করে, তখনো এই অধ্যক্ষা গদী আঁকড়ে রাখার জন্য এই ঘটনাকে "মিউচুয়াল সেক্স" বলে আখ্যা দেন, এবং ছাত্রীদের আন্দোলনকে "এক শ্রেণীর ক্ষমতালোভীর কলেজকে অস্থিতিশীল করার চক্রান্ত বলে ঘোষণা করেন। এই হলো ঘটনার সারসংক্ষেপ, কিন্তু এটাকে বলা যায় "টিপ অভ দ্য আইসবার্গ", শুধু বাইরেরটুকুই দেখা যাচ্ছে, এসবব ঘৃণ্য আচরণের নিচে জমে থাকা আরো অনেক পঙ্কিলতা, আমাদের মনের নীচতা চাপা-ই পড়ে আছে।

যেমন ধরুন, এর মাঝেই নানাভাবে ঘটনাকে দলীয় রূপ দেয়া হয়ে গেছে। এক পক্ষ বলে, অমুক দলের লোক সব ধর্ষক, আরেক পক্ষ বলে, অমুক দল আমাদের গায়ে কালি দিচ্ছে। মাঝ দিয়ে যে মেয়েটার এত দুর্দশা, তাকেই হুমকি দিয়ে বসলেন অধ্যক্ষা। একজন "আন্ডার এজড" বা অপরিণত মেয়ের সম্মতিতেও তার সাথে মিলিত হলেও সেটা ধর্ষণ, যে কোন দেশের আইনেই, কাজেই এটাকে যে বা যারা "মিউচুয়াল সেক্স" বলে চালাতে চান, তাদের সাথে সাথেই পদচ্যুতি এবং তাদের নামে মামলা করা সম্ভব। এখানে আবার আরেকদল বুদ্ধিজীবি "আইন ও বিচার এবং অধিকার" জাতীয় বুলি নিয়ে উদয় হলেন, তর্ক লেগে গেল আওয়ামী-বিএনপি-জামাত ইস্যুতে, কমিটি সরানো বৈধ নাকি অবৈধ এই নিয়ে শুরু হলো চুলাচুলি, এর মাঝে আবার আরেকদল উদয় হলো, তাদের কথা হলো, ভিকির মেয়েরা যেমনে চলে, ওদের দিকে তো নজর যাবেই, পুলিশের রিপোর্টে লেখা হলো, স্কার্ট আর টপস পরে গিয়েছিল বলেই পশুটা সেই মেয়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।

লে হালুয়া, এইবার সামলান ভাইয়েরা! মেয়েদের পোশাক দেখলেই আমাদের পুরুষত্ব জেগে ওঠে, খালি পরিমলের দোষ দেই কেন, ফেসবুকে দেখলাম একখানা গ্রুপ খোলা হয়েছে, তার নাম-- "ঐ ছেমড়ি, গলায় ওড়না না দিয়া বুকে দে, কামে দিবো। " কোন এক নৈতিকতার ধ্বজাধারী এই বান্দাকেও সেখানে যোগ করেছেন, গিয়ে দেখি সেখানে মডেল দের ওড়না ছাড়া ছবি, আর প্রতিটা ছবির নিচে যেসব মন্তব্য, সেগুলো পড়ে এইসব নীতিবাগীশদের সম্পর্কে একটা কথাই মনে আসে-"ধর্ষকামী"। তাদের কাম যাতে প্যান্টের ভেতরে থাকে, সেজন্য মেয়েদের ওড়না পরতে হবে, তাদের ধর্ম রক্ষার জন্য মেয়েদের সারা গা ঢেকে চলতে হবে, কিন্তু ধর্মে যে এইসব বীরপুঙ্গবদেরও দৃষ্টি সংযত ও নত রাখতে বলা হয়েছে, সেই অংশটুকু নীতির কারবারীরা বেমালুম ভুলে যান। ব্যক্তিগতভাবে রক্ষণশীল বলে এরকম ডিজুস ফ্যাশন পছন্দ নয়, ঘরের বৌ বা বোন এভাবে ঘুরবে সেটাও চাইনা, কিন্তু অন্যের মেয়ে বা বৌ কিভাবে ঘুরলো, সেদিকে চোখ দিয়ে তাকে চেটে খেয়ে জনসমক্ষে কথা দিয়ে তাকে ধর্ষণ করার মত নিচেও বোধহয় এখনো নামতে পারিনি। আরে ব্যাটা, আপনি ভাল তো জগৎ ভাল, কে কিভাবে ঘুরবে, কার সাথে ঘুরবে, এটা সম্পূর্ণই তার নিজের অধিকার, যতক্ষণ সে তোমার ক্ষতি না করবে।

পছন্দ না হয়, চোখ নামা, নিজের ঈমান আর নৈতিকতা এতই দুর্বল যে মেয়েদের পোশাক দেখলেই নোলা সামলাতে পারিস না, তুই আসিস উপদেশ দিতে ক্যামনে ঈমান রক্ষা করা যায়, ভণ্ড আর কাকে বলে! পরিমলের সাথে এদের একটাই তফাৎ, পরিমলের সাহস বেশি, এদের নেই, সুযোগ পেলে এরাও ছেড়ে দেবে, এই ভরসা তো পাই না! ভার্চুয়াল জগৎ ছেড়ে একটু বাস্তবে নামি। ধরুন পাবলিক বাসের কথা, গাদাগাদি ভিড়ের মাঝেও আজকাল মহিলাদের বাসে উঠতে হয়, আর বিশ্বাস করুন, সেটা সুখের কোন অভিজ্ঞতা না। আমরা এমনই ভদ্রলোক যে কারো গায়ে ধাক্কা না দিয়ে যেতে পারি না, সম্ভব হলে একটু গায়ে হাত দিয়ে সরতেও বলি। বাস কন্ডাকটর আরেকটু সরেস, মেয়েদের পিঠে হাত না দিয়ে বাস থেকে নামাতেই পারে না। কোন মেয়ে প্রতিবাদ করলেই সেই পুরানো যুক্তি, পাবলিক বাসে উঠেছেন, ধাক্কা তো লাগবেই, এত শখ থাকলে গাড়িতে যান।

কিছু চামার আছে, পেছনে জায়গা খালি থাকলেও বসে যাবে সামনের মহিলা সিটে, মহিলা উঠলেও মোষের মত বসেই থাকবে, উঠতে বললে বলবে, সমানাধিকার চান, খাড়ায়া যান। আরে ব্যাটা, ঐ কথা বলার আগে কোনদিন ভাবিস, তুই যেভাবে চলিস, মেয়েটা কি ঐভাবে চলতে পারে? রাত ১২টায় তো আপনি নিশ্চিন্তে রাস্তায় হেঁটে যেতে পারেন, পারবেন আপনার মেয়েটাকে হাঁটতে দিতে? যেদিন পারবেন সমান পরিবেশ নিশ্চিত করতে, সেদিন নিশ্চয়ই জোর গলায় বাসের মহিলা আসন তুলে দিতে বলবো, তার আগে পর্যন্ত পুরুষ হিসেবে লজ্জা থাকলে একটু চুপ করে থাকুন না! নিজেদের কীর্তিকাণ্ডের বয়ান কত দেব? অফিসে সহকর্মী আর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, পথে বখাটে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহপাঠী আর শিক্ষক, কোথায় নিরাপদ? একজনের কাছে শুনেছিলাম, বাসে ওঠার পরে ১২-১৪ জন কলেজ ছাত্র সারাটা পথ তাকে উদ্দেশ্য করে শিষ দিয়ে গেছে আর রসালো মন্তব্য করে গেছে সারাটা পথ, পুরো বাসে একটা লোকও কথা বলেনি। অন্যের কথা কি বলি, যখন কলেজে পড়ি, বড় বোনকে নিয়ে দোকান থেকে বের হচ্ছি, কয়েকটা ছেলে দাঁড়িয়ে ছিল, হঠাৎ পা বাড়িয়ে বোনের পায়ে বাঁধিয়ে দিল। বোন ঘুরে গালাগালি শুরু করলো, বদমাশগুলো দাঁত বের করে হাসতে লাগলো, কাপুরুষের মত দাঁড়িয়ে রইলাম। প্রতিবাদ করবেন? সাথে সাথেই মন্তব্য আসা শুরু হবে, ভাই আপনার এত দরদ কেন? কিছু আছে নাকি? এইরকম বেলেল্লার মত দেখায়া বেড়াইলে তো ঠোকর দিবেই, ঢাইকা রাখবার পারে না? খুব সহজ রাস্তা, এই কলংক লেপে দেয়া।

পুবদেশীয় সংস্কৃতিতে মেয়েদের "পবিত্রতা" নামক একটা বস্তুকে দাম দেয়া হয় খুব বেশি, এবং যত আধুনিকা-ই হোক, এই সংস্কারটা থেকে বের হয়ে আসা খুব কঠিন। এজন্য মোটামুটি থোড়াই কেয়ার টাইপ কোন মেয়েও সহজে কোথাও স্বীকার করবে না কার সাথে তার সম্পর্ক কতটা গভীর, এজন্যই আমাদের দেশে ধর্ষিতাকেই বহন করতে হয় সব দায়ভার, যেখানে ধর্ষক বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায় সবার সামনে। প্রমাণ চান? গতকালকের পত্রিকাটা খুলে দেখুন, "ধুমধাম করে বিয়ে করলেন অপূর্ব। " বাহ মর্দ, দেখালে বটে! প্রভা কেমন মেয়ে, সে বিবেচনায় না যাই, কিন্তু নিশ্চিতভাবেই তার ক্যারিয়ার শেষ, কারণ সে মেয়ে, কিন্তু অপূর্ব বা রাজীবের জীবনে কোন পরিবর্তন হয়নি, হবেও না। ঠিক একারণেই, নির্যাতন করুন, ধর্ষণ করুন, একবার যদি প্রমাণ করা যায় যে "মেয়েটা খারাপ", আপনাকে আর পায় কে, অপরাধ থেকে রেহাই, সমাজের সহানুভূতি, সব হাতের মুঠোয়।

রুমানা মনজুরের উদাহরণ চোখের সামনে, পশুরূপী স্বামী বেচারার চোখ খুবলে নিল, তারপর তার চরিত্রে কালি দিয়ে বোঝাতে চাইলো, যা করেছে ঠিকই করেছে, আর কি আশ্চর্য দেখুন, সেইসব নীতিবাগীশরা সাথে সাথে মাঠে নেমে গেলেন, যে তাই তো, পরকীয়া করবে কেন, চোখ তুলে নাও এর, মেরে ফেলো। এদের মাঝে অনেকে আছেন যারা দোররা মারার পর মোল্লাদের জাত উদ্ধার করেন, ওদের সাথে আপনাদের পার্থক্য কোথায়, ভণ্ডামি আরেকটু বেশি করছেন আপনারা, তাই তো? যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেই যে একটা মেয়ে তথাকথিত "ভালো না", তাহলেই কি সে "মালে গণিমত" হয়ে গেল? তাকে যা খুশি তাই করার অধিকার পেয়ে গেলেন আপনারা? আদিম যুগের গুহামানবদের সাথে তবে আমাদের তফাৎটা কি রইলো? এবার মূল ঘটনায় ফেরা যাক। পরিমল গ্রেপ্তার হয়েছে, অপরাধ স্বীকার করেছে, শুনে স্বস্তি পেয়েছিলাম। আরো স্বস্তি পেয়েছি যখন হোসনে আরা কে সরিয়ে দেয়া হলো, ভাবলাম যাক দেরিতে হলেও এখনো ভাল সিদ্ধান্ত আসে, দলীয় লোকজনকেও জনগণের কথা চিন্তা করে মাঝে মাঝে গারদে পোরা যায়। এরপরেই চমক, মন্ঞ্চে হাজির আমাদের প্রাণপ্রিয় রাজনীতিবিদরা।

ভেঙে দেয়া হলো কমিটি, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষাকে প্রচার করা হলো জামাতি হিসেবে, আন্দোলনকারী বর্তমান ও প্রাক্তন ছাত্রীদের পুলিশি বাধার মুখে পড়তে হলো, হুমকি দেয়া হলো তাদের। প্রচারণা শুরু হলো, এটা কলেজের ক্ষমতা দখলের জন্য বিএনপি-জামাত জোটের ষড়যন্ত্র। উপরমহল থেকে আদেশ হলো, পরিমলকে নাকি বিশেষ যত্নে রাখতে হবে। আর সবচেয়ে ঘৃণ্য ভূমিকা নিল আমাদের "বিবেক" মিডিয়া-- পত্রিকা আর টিভি চ্যানেল গুলো। সবার রিপোর্টিংয়ে নানা রকম ভণিতা করে প্রমাণের চেষ্টা করা হলো, "কতিপয়" ছাত্রী ও অভিভাবকের ষড়যন্ত্রেই এই অস্থিতিশীলতা।

প্রথম আলোতে মতি ভাই যুক্তিপূর্ণ সম্পাদকীয় লিখে সুশীল ভাষায় সবাইকে আহ্বান জানালেন পরিস্থিতি "স্থিতিশীল" করে ফেলতে। টিভি চ্যানেল আর পত্রিকার সাংবাদিকরা ক্রমাগত বাচ্চা মেয়েগুলোকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে বুঝাতে চাইলেন, তোমরা ভুল করছো, এগুলো কোন বিষয় না, চেপে যাও, সমঝোতা করো। যখন কাজ হলো না, তারা হুমকি দিলেন, আমাদের বিবেক, মিডিয়া, হুমকি দেয়া শুরু করলো আমাদেরই মেয়েদের, আমাদের সন্তানদের। একজনকে যখন বলা হলো,আপনার বোনকে রেইপ করলে আপনি কি করতেন, সেই মানুষরূপী কুলাঙগার বলে বসলো, দিস ইজ নান অভ মাই বিজনেস, আমি ক্লাস করতাম। হ্যাঁ, টা হয়তো তিনি করতেন,নিজের মা-বোন-কন্যাকে বিক্রি করতে না পারলে কি আর এই দেশে উপরে ওঠা যায়? একজন হোসনে আরার কাছে যেমন তার সন্তানতুল্য মেয়েদের চেয়ে একজন দলীয় ধর্ষকের মূল্য বেশি, হারামখোর পা-চাটা সাংবাদিকের কাছ থেকে আমরা আর কি আশা করতে পারি? হায় সাংবাদিক ভাইয়েরা, হায় বুলবুল, মতি ভাই, হায় নারীনেত্রীর স্বামী, আপনাদের স্ত্রী-কন্যারা এখন কোথায়? নাকি নারী অধিকার শুধু আপনার ঘরে? ঐ মেয়েটি, যার পৃথিবীটা এক পলকে ঝলমলে রঙিন থেকে কুৎসিত কালো হয়ে গেছে, সে কি আপনাদের কাছে এতটাই অচ্ছ্যুৎ? ব্যবসা আর ক্ষমতার জন্য কি আপনারা ঐ পশুর অধম রাজাকারদের মতই নিজের ঘরের মেয়েকেও তুলে দেবেন? মতি ভাই, আপনার অন্নদাতার কন্যাও তো এই ঘৃণ্য অপরাধের স্বীকার, একটিবারও কি সেই স্মৃতি আপনাদের বুকটা কাঁপিয়ে দেয় না? নাকি পশু হতে হতে আমরা আদতে পশুকেও লজ্জায় ফেলে দিতে যাচ্ছি? একটা জাতির সভ্যতার মাপকাঠি সম্ভবত তার সম্পদে বা ক্ষমতায় নয়, বরং সমতায়।

একটা ছোট্ট উদাহরণ দেয়া যাক। একটা সুইডেনের, একটা পাকিস্তানের। সুইডেনে নাকি, একটা মেয়ের সম্মতি নিয়ে তার সাথে মিলিত হলেও মেয়েটি অভিযোগ করলে সেটা আমলে নেয়া হবে, জুলিয়ান অ্যাসান্ঞ্জ সেটার উদাহরণ। এমনকি, কোন মেয়ে অভিযোগ করলে সেখানে পুরুষটির জামিন পাওয়ার সম্ভাবনা শূন্যের কাছাকাছি। উল্টোদিকে পাকিস্তানে, ধর্ষিতাকে দু'জন পুরুষ সাক্ষী রেখে প্রমাণ করতে হবে যে সে ধর্ষিতা, যেন ব্যাপারটা এমন যে ধর্ষণের আগে দু'জন পুরুষকে ডেকে মেয়েটা বলবে, এসো, দেখো, তারপর সাক্ষ্য দাও।

কোন জাতিকে আপনি সভ্য বলবেন, আর কোনটাকে বর্বর, আপনার বিবেচনা। এবার আমাদের দেশে আসুন, যেখানে ধর্ষিতাকে দোররা মারা হয়, নয়তো বিয়ে দেয়া হয় ধর্ষকের সাথে, এটাই সমাজের বিচার, আবার থানায় গেলে পুলিশি হয়রানি, ওদিকে প্রমাণ করার চেষ্টা চলবে, মেয়েটা "খারাপ", কাজেই সম্মান বাঁচাতে মেয়েটা চুপ থাকবে,, চুপ থাকবে তার পরিবারও। ভিকারুননিসার ঘটনায় দৃষ্টি ফেরাই, বাচ্চাটা চুপ ছিল প্রথমে, কারণ তাকে ব্ল্যাকমেইল করা হলো, ভিডিও ছেড়ে দেয়া হবে, এভাবে হুমকি দিয়ে একই কাজ করা হলো বারবার। না পেরে মেয়েটা অভিযোগ করলো, এবার কলেজের অধ্যক্ষা আর শিক্ষক-শিক্ষিকারা বললেন, চেপে যাও। যখন পারলেন না, হুমকি দিলেন, মেয়েটাকেই টিসি দেয়া হবে,ওদিকে আসামীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে।

সব যখন চলে গেল নিয়ন্ত্রণের বাইরে, এবার স্বয়ং ক্ষমতার ডাণ্ডা নিয়ে এগিয়ে এল তাদের আশ্রয়দাতারা, রাষ্ট্রযন্ত্র তার সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো আমাদের সন্তানদের উপর, তাদের মুখ বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা চললো, আর তাতে সরব বা নীরব সমর্থন যোগান দিয়ে চললো আমাদেরই তথাকথিত সভ্য লোকেরা। কি, নিজেদেরকে কি এখন পাকিস্তানী বর্বরদের চেয়ে খুব ভাল কিছু মনে হচ্ছে? মাননীয় ভদ্রলোকরা, ভদ্রমহিলারা, জাতির বিবেকরা, একটু নিজেদের সমস্যা পাশে সরিয়ে এই মেয়েগুলোর সমস্যার দিকে তাকান। এরা আপনাদের সন্তান, আমাদের সন্তান, এরা ভিনদেশ থেকে আসেনি, ভিনগ্রহ থেকে নামেনি, এরা আপনার আমার অতি আদরের, অনেক স্নেহে গড়ে তোলা কন্যাসন্তান। এরা আমাদের ভবিষ্যৎকে গড়ে তুলবে, আমাদেরই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্মদাত্রী হবে, এদের সমান অধিকার দেয়ার মত সভ্য আমরা যদি না হতে পারি, অন্তত এদেরকে আমাদের সমান নিরাপত্তা দেয়ার মত বিবেক তো আমাদের আছে, এইটুকু আশা কি আমরা করতে পারি না? আমাদের ২ লক্ষ নারী বর্বর পাকিস্তানিদের হাতে সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন, আমরা কি এই স্বাধীন দেশে আমাদের শিশুদের কাছে নিজেদের সেরকম বর্বর হিসেবেই প্রমাণ করতে চাই? আজ আপনার মেয়ে সেখানে নেই, কিন্তু নিশ্চিত থাকুন, আমাদের মেয়েরা কোথাও নিরাপদ নয়, ঘরে না, বাইরেও না, কারণ আমরা এখনো পশু, এখনো কাপুরুষ, আমরা এখনো পুরুষ নামের যোগ্য হতে পারিনি, সম্ভবত, মানুষ বলে নিজেকে দাবী করারও যোগ্য হয়ে উঠিনি। আমরা যদি জেগে না উঠি, কোন একদিন, কোন এক নিকষ অন্ধকার মুহূর্তে, আপনার, আমার রক্তে-মাংসে গড়ে ওঠা মেয়েটার দিকেও কোন এক কুৎসিত জানোয়ার তার থাবা বাড়াবে, সেদিন যদি আপনার মেয়েটা প্রশ্ন তোলে, আমি এখন কোথায় যাবো, আমরা কি জবাব দেব তাদের কাছে? কাকে আপনারা কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চান হে ভদ্র-সভ্য নামধারী ভণ্ড বিবেকহীন মানুষেরা, ঐ জানোয়ারকে, নাকি নিজেদেরকে? ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।