-আইজু, আমার পলিথিনডা দে তো বাজান !
ছেলে আইজুদ্দিকে ডাকে রহিমুদ্দি। কাল থেকে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। থামার কোন লক্ষণই নাই। রাতে একটু ক্ষান্ত দিয়েছিল। রহিমুদ্দি ভেবেছিল, যাক- বাঁচা গেল।
নাহ, তার ভাবনাটা ভুল হয়ে গেল। আর বাঁচা বুঝি গেল না ! শেষরাত থেকেই আবার শুরু হয়েছে সেই ঝুম বৃষ্টি। ঢল নেমেছে বর্ষার।
পলিথিনটা মাথায় জড়িয়ে নিল সে। তারপরে রিক্সা নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল।
ঘরে একমুঠো চালও নেই যে চার চারটা মুখকে খাওয়াবে। নিজের কথা না হয় বাদ ই দিল ! আরও যে তিনটা মুখ- বউ হাজেরা, ছেলে আইজুদ্দি আর মেয়ে রহিমা চেয়ে আছে তার দিকে! ওদের কি হবে !
বেড়িবাঁধের ওপারে তার বস্তির ঘরের চালায় হাজারটা ফুটো। কাল সারাদিন ঘরে পানি পড়েছে। ভিজে গেছে বিছানা-বালিশ, কাপড়-চোপড়- এমনকি রান্নার চূলাও। লাকড়িগুলোও রেহাই পায় নি।
-ও আইজুর বাপ, একটা বিহিত কর। সব যে ভিইজে গ্যাল! রাধমু কিবা কইরে আর থাকমুই বা কিবা কইরে ?- সারাবেলা হাজেরা প্যান প্যান করেছে। কিন্তু সারাবে কি করে ? হাতে যে একটা পয়সাও নেই তার! দিন আনে দিন খায়। নুন আনতে তার পান্তা ফুরায়।
এসব ভাবতে ভাবতে রিক্সা ঠেলতে থাকে রহিমুদ্দি।
রাস্তায় হাঁটুখানেক পানি জমে গেছে। রিক্সা চালানোই দায়। কোনমতে ঠেলে ঠুলে মোড়ের উপরে এসে দাঁড়াল।
একটা ভাড়াও পায় না। শাওনের ঝুম বৃষ্টি।
মাথার উপরে থমথমে আকাশ। কে তার রিক্সায় উঠবে ! সবাই তো যাচ্ছে বাসে আর প্রাইভেট গাড়ি করে। তবু ঠায় দাড়িঁয়ে থাকে আশা নিয়ে, যদি একটা পাওয়া যায়!
-এই খালি, কলেজ মোড় যাবা ?
-হ বাইজান, যামু।
-চল।
রিক্সায় উঠে বসল এক যাত্রী।
হাঁটুখানেক পানি-কাদার মধ্যে দিয়ে কোনমতে ঠেলে ঠুলে নিয়ে গেল সে। কলেজ মোড়ে এসে রিক্সা থামল।
লোকটা কয়েকটা টাকা বের করে রহিমুদ্দির হাতে ধরিয়ে দেয়।
-বাইজান, আর পাঁচটা টেহা।
-যাও মিয়া, এই তো ভাড়া ! ফুটা রিক্সা. পানি পড়ে ! আর পাঁচটা টাকা চাও ক্যামনে?
রিক্সা থেকে নেমে হনহন করে চলে যায় লোকটা।
বৃষ্টিতে জবুথবু রহিমুদ্দি তার পানে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে।
হাতের মুঠোয় টাকাগুলো ধরে রাখে। মাথায় তার হাজারটা চিন্তা। ঘরে একমুঠো খাবার নেই। ঘর ভাঙ্গা, চালা ফুটা- কখন যেন ভেসে যায় যায় অবস্থা।
শাওন মাস। বৃষ্টির যে চেহারা তাতে যে কোন সময় বন্যায় সব তলিয়ে যাবে। তার উপর যদি এভাবে কামাই হয় তাহলে খাবেই বা কি আর থাকারই বা কি হবে?
সারদিন বৃষ্টিতে ভিজে আরো দু-চারটা ভাড়া পেল রহিমুদ্দি। রিক্সাটা রাস্তার মোড়ে দাঁড় করিয়ে খুঁটে রাখা টাকাগুলো গুনে দেখল। নাহ, আর কাকভেজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার দরকার নেই।
চাল কেনার মত টাকা হয়েছে। এবার যাওয়া যাক। চাল কিনে নিয়ে বাড়ির দিকে রিক্সা ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে গেল।
সন্ধ্যা হতে না হতেই রাস্তায় পানি আরো বেড়ে গেছে। -ঘরডার যে কি হইল?-চিন্তা ভীড় জমাল তার মাথায়।
ঠেলে ঠুলে রিক্সা নিয়ে এসে বস্তির সামনের রাস্তাটায় দাঁড়াল রহিমুদ্দি।
-হায় আল্লাহ, একি হইল !-
মাথায় হাত দিয়ে পানির মধ্যেই বসে পড়ল সে। ঘর তার তলিয়ে গেছে পানিতে। ছেলে-পুলে, বউ তার আর সবার সাথে বাঁধের উপরে বসে অসহায় চোখে তাকিয়ে। বৃষ্টির পানি আর নদীর পানিতে একাকার হয়ে গেছে পুরো বস্তি এলাকা।
চাল-চুলো সবই যে তার এখন বন্যার পানিতে !
- হায়রে শাওন, একি করলি আমার !- দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল রহিমুদ্দির বুক চিরে ।
(বি.দ্র: গল্পটি চট্টগ্রাম বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স থেকে প্রকাশিত মাসিক শিশু-কিশোর দ্বীন দুনিয়া জুলাই -'১১ সংখ্যায় প্রকাশিত । প্রিয় এক ব্লগার ছোট ভাইয়ের জন্যে আমার গল্পটা ব্লগে দিয়ে দিলাম ) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।