জহিরুল চৌধুরী হাডসন ভ্যালী'তে আমার প্রথম দিনগুলো- প্রথম পর্ব
নিউইয়র্কে আসার সাত মাসের মাথায় আমার বন্ধু শামীম জানালো আইবিএমে লোক নেয়া শুরু হয়েছে তুমি চলে এসো। নিউইয়র্কে এসেছিলাম ২১ সেপ্টেম্বর। এসেই আট দিনের মাথায় একটি ইয়েলো পেজের অফিসে কম্পোজিটর কাম ডিজাইনারের চাকরি নিয়েছিলাম কন্টাক্টে। তিন মাসের মাথায় সে চাকরিটির কন্টাক্ট ফুরিয়ে যায়। পত্রিকা অফিসে কাজ করবো না, এ প্রতিজ্ঞা করেই আমেরিকায় এসেছিলাম।
কিন্তু মাস খানেকের বেকারত্তে সে কাজেও বাধ্য হয়েছিলাম। ‘এখন সময়’ নামক এক সাপ্তাহিকে ঢাকার পত্রিকার কাটিং-পেস্টের কাজে হাপিয়ে উঠেছিলাম। পত্রিকার প্রথম পাতায় যা খুশি লেখে দিলেই হলো। কারন আমার নাম থাকাটাই যেখানে ছিল যথেষ্ট। তার উপর সপ্তাহান্তে পত্রিকা কর্তৃপক্ষের বেতন প্রদানে গড়িমসি ঢাকায় আমার সর্বশেষ পত্রিকা সংবাদের কথা মনে করিয়ে দিলো।
দৈনিক সংবাদে শেষের দিকে এমনটা ঘটতো। এরপর দুই মাসে অন্তত চার জায়গায় চাকরি বদল। এরমধ্যে এক ভারতীয়ের এডভেঞ্চারে শামিল হয়ে ‘পরিবর্তন’ নামক দৈনিক পত্রিকা শুরু করি ম্যানহ্যাটনের অফিস থেকে। সপ্তাহ দুয়েক পর সাপ্তাহিক নাম নিয়ে মাস খানেক গড়াগড়ি করে চলে পরিবর্তন। এরপর কলকাতার বাঙালী খ্রিস্টান, খ্রিস্টফার ঘোষ তার অভিযানের সমাপ্তি টানেন।
ম্যানহাটনের ওই ভবন থেকেই একটি স্প্যানিশ পত্রিকা বের হবে, নাম ‘সেম্ব্রান্দ মারাবিয়াস’। সম্ভবত এর অর্থ ছিলো ‘সুন্দরের প্রকাশ’।
পত্রিকাটির মাস্ট হেডের নীচে ছিলো ক্যারিবিয়ান দেশগুলোর পতাকা। ক্যারিবীয় মালিক আমাকে গ্রাফিক্স ডিজাইনারের অফার দিলে লুফে নিলাম। সপ্তাহে সাত’শ ডলার।
আমার জীবনে সবোচ্চ বেতন! কিন্তু চাকরিটি স্থায়ী ছিলো মাত্র এক সপ্তাহ। কারন আমি স্প্যানিশ জানি না। কাটিং পেস্টের কাজ ঠিক মতো করতে পারি না। পত্রিকাটির ফ্রন্ট ডেস্ক সেক্রেটারি মহিলাটির কাছ থেকে সেই প্রথম শিখেছিলাম- বুয়েনাস দিয়াস, অর্থাৎ শুভ সকাল এবং বুয়েনাস তারদেজ, অর্থাৎ গুড এভিনিং। এ সময় ফুটপাত থেকে একটি স্প্যানিশ-ইংলিশ ডিকশনারীও কিনেছিলাম, কিন্তু তাতেও চাকরির শেষ রক্ষা হলো না।
অবশেষে একটানা প্রায় তিন মাস বেকার। ভালো কাজের আশায় মন্দ কাজের ধার ধারিনি। অবশ্য এরমধ্যে আমার ইমিগ্রেশন পাকা করে ফেলেছি। আমেরিকায় স্থায়ীভাবে বসবাস আর চাকরির সুযোগ লাভে আর কোন বাধা নেই।
আমার ইমিগ্রেশনের কাগজ, আর শামীমের টেলিফোন এলো একই সময়ে।
মাহবুব-ই-এলাহী চৌধুরী শামীম আমার ঢাকার খুব ভালো বন্ধু। ১৯৯০ সালের মাঝামঝি থেকে ঢাকায় অবস্থানকালে বিকেলের সঙ্গী শামীম। উদিচী অফিসে আড্ডা, প্রেস ক্লাবের সামনের রেস্তোরাঁয় ফালুদা, গুলশানে বিয়ারের গ্লাসে রাত্রি পাড়, এসবই শামীমের সঙ্গে আমার মধুর দিনের স্মৃতি। জিগাতলায় আমার বাসায় শামীম-রুপার বিবাহ পূর্ব ডেটিং আমাদের বন্ধুত্বকে নিয়ে যায় পারিবারিক পরিমণ্ডলে।
২০০০ সালে আমি একা এসেছিলাম আমেরিকায় মাত্র কয়েক সপ্তাহের জন্য।
এসেছিলাম জাতিসংঘের মিলেনিয়াম সামিট কভার করতে। সেই সুবাদে একরাতে শামীম রুপা নিউইয়র্ক থেকে রাত একটায় আমাকে নিয়ে এসছিলো তাদের গাড়িতে করে। এস্টোরিয়ায় মিতালী মুখার্জীর গজলের আসর থেকে প্রায় আশি মাইল পথ পাড়ি দিয়ে। হাডসন ভ্যালী’র পুকেপ্সি’তে ভিলেজ ক্র্যাস্ট অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে থাকতো শামীম রুপা। কপোত-কপোতির সংসার।
দুজনেই বাঙালী সংস্কৃতি বিকাশে অন্তঃপ্রাণ। নিউইয়র্ক নগরীতে সপ্তাহে অন্তত একবার যাতায়াত করে বাঙালী শিশুদের গান-বাজনা শেখাতে। বউ সুখে সুখী শামীম। সামনা সামনি অন্তত তাই মনে হয়।
সকালে জানালায় দাঁড়িয়ে সামনের মেপল গাছের নীচে পাখির কিচির-মিচির আর কোন এক পাখী প্রান মানুষের ছিটানো খাবার খেতে তাদের জটলা আমাকে সম্মোহিত করে।
সেপ্টেম্বর মাসের সকালে সবুজ আঙ্গিনা জুড়ে বাহারি ফুল আর ঝাউ গাছের সারি ছবির জগতে এক মায়াবি মূর্ছনা ছড়িয়ে যায়। ইচ্ছে হয় বউ-বাচ্চা নিয়ে কিছুদিন এই মায়াবী পরিবেশে কাটিয়ে দিই। শামীম রুপাকে বললাম, আর কোন দিন আমেরিকায় এলে আমি এখানেই থাকবো। বলতে দ্বিধা নেই, আমার আমেরিকায় সপরিবারে পাড়ি জমানোর গোপন ইচ্ছা দানা বাধে এই শামীমের বাড়িতেই। জানতে চাইলাম, এখানে কাজের সুবিধা কেমন।
তারা দুজনেই কাজ করে আইবিএমে। আমি কিংবা আমার বউ একই কাজ করতে চাইলে সম্ভব হবে কি না। এসব প্রশ্নের উত্তরে ওরা বলল সম্ভব। মনে মনে ছক কষে নিলাম আমেরিকায় কখনো স্থায়ীভাবে বাস করতে চাইলে স্বর্গের কাছাকাছি সম্ভবত এটিই একমাত্র জায়গা।
দূপুর নাগাদ রুপা পৌঁছে দিলো পুকেপ্সি ট্রেন স্টেশনে।
ট্রেনের টিকিট কেটে দেয়ার সৌজন্যতাতেও কমতি রাখলো না। ডান পাশে বসেছিলাম। হাডসন নদীর কূল ঘেঁষে ট্রেনটি ছুটে চলল ম্যানহাটনের গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল স্টেশন অভিমুখে। কখনো মনে হলো আমি যেন নদীর উপর ভেসে ভেসে চলেছি। পাহাড়-জঙ্গল-নদীর এমন অপূর্ব সমাবেশ আমি আগে কখনো দেখিনি।
যাই হউক, শামীমের ফোন পেয়ে হাডসন ভ্যালীতে আসার জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠলো। কিন্তু এখানে বসবাসের পূর্বশর্ত যে ড্রাইভিং লাইসেন্স, তাতো আমার নেই। একদিন মটর ভিহাইকেল অফিসে গিয়ে লার্নার পারমিটের জন্য লিখিত পরীক্ষা দিলাম। প্রথমে ফেল করলাম, পরের বার পাশ। কয়েকটি রোড লেসনও নিলাম।
কিন্তু ড্রাইভিং লাইসেন্সের পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে তা মোটেও যথেষ্ট নয়। আমি নিয়েছি মোটে তিনটে লেসন, পরীক্ষার জন্য প্রয়োজন অন্তত ১২টি। এদিকে হাডসন ভ্যালীর আইবিএম আমাকে ডাকছে। মার্চের পনের তারিখে ইমিগ্র্যাসনের কাগজ হাতে পেয়েছি। ওয়ার্ক অথোরাইজেশনের জন্য আবেদন করেছি, কিন্তু তখনো হাতে এসে পৌঁছেনি।
তথাপি শামীমকে বললাম, আমি আসতে চাই। কিন্তু ড্রাইভিং লাইসেন্সের কি হবে? শামীম অভয় দিল- একটা কিছু ব্যবস্থা হবে।
পুকেপ্সি আইবিএম-এর প্রধান ভবন, তুষারে ঢাকা পাকিং লট
২৩ এপ্রিল ২০০২, আইবিএমে ইন্টারভিউ’র দিন। শামীমের বাড়ি থেকেই রুপা ড্রাইভ করে নিয়ে গেল। ইন্টারভিউতে আমার হলো, কিন্তু আমার বউয়ের হলো না।
কারন জানালো- ইংরেজী কমিউনিকেশনে আমার স্ত্রীর যথেষ্ট পারঙ্গমতার অভাব। কি আশ্চর্য, এক মাসের মাথায় আরেকটি জব কোম্পানীর বদৌলতে আমার স্ত্রীর ঠিকই চাকরি হলো। ঢাকায় আমাদের চার বছরের সংসারে স্ত্রীর চাকরির প্রয়োজন পড়েনি। আমিও কখনো ভাবিনি। তবে সে কুটির শিল্প ধরণের কিছুতে নিজেকে ব্যস্ত রাখুক তা চাইতাম মনে প্রানে।
এজন্য বিয়ের কয়েক মাসের মাথায় বঙ্গবন্ধু এভিন্যু’র সিঙ্গার দোকান থেকে একটি সেলাই মেশিনও কিনে নিয়ে গেছিলাম দুজনে মিলে। আমার স্ত্রীর ‘বুটিক’ এর স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। অথচ আইবিএমে হাইটেকের চাকরিতে সে দিব্যি নিজেকে মানিয়ে নিলো অল্প কয়েক দিনের মধ্যে। এবং আরো আশ্চর্য আমার স্ত্রী আইবিএমে কখনো লেইড অফ হয়নি। গত প্রায় নয় বছর ধরে একটানা চাকরি করে যাচ্ছে মেনফ্রেম কম্পিউটার ডিভিশনে।
হাডসন নদীর কূল ঘেঁষে পুকেপ্সি আইবিএম ফ্যাসিলিটি
***
২৬ জুন ২০১১, হাডসন ভ্যালী, নিউইয়র্ক ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।