হাডসন স্ট্রিট স্টেশনের আরেকটি নাম আছে,৮০ স্ট্রিট। স্টেশনটি এলিভেটেড। মোটা মোটা লোহার থামের উপর টন টন লোহা আর কাঠের বোঝা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে স্টেশনটি। নিচে প্রশস্ত রাজপথ। চব্বিশ ঘন্টা নানা ধরণের গাড়ি ছোটাছুটি করছে প্রায় নিঃশব্দে।
যা কিছু শব্দ তা শুধুই ইঞ্জিনের,হর্ণের বাড়তি অত্যাচার নেই। এই স্টেশনটি ক্রমশ ঢালু হয়ে নেমে গিয়েছে সূড়ঙ্গে অর্থাৎদীর্ঘ টানেলের ভেতর,গ্রান্ট স্ট্রিটে। আর এই গ্রান্ট স্ট্রিট থেকেই আন্ডারগ্রাউন্ড রেলওয়ের শুরু।
ম্যানহাটানগামী 'এ' ট্রেনটি ধরার জন্য যখন হাডসন স্ট্রিটে এসে দাঁড়ালাম তখন চারদিক আঁধার হয়ে এসেছে। আকাশে মেঘের ঘনঘটা ।
মাঝে মাঝে ঝিলকিয়ে উঠছে বিদ্যৎ। একেবারেই বাংলাদেশ স্টাইলে কড়াৎ কড়াৎ শব্দে ডাকছে মেঘ। ভেজা ঠান্ডা বাতাস বইছে হুম হুম করে। ভাসমান প্লাটফরমের ভিত কাঁপিয়ে এবং একরাশ ঠান্ডা হাওয়া ছড়িয়ে এ সময় বিপরীত দিক থেকে যে ট্রেনটি এলো তা উগড়ে দিল কিছু যাত্রী। যাত্রীদের দিকে তাকাতে গিয়ে চোখে পড়লো তাকে।
সেও আমারই মতো ম্যানহাটানগামী ট্রেনের প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। সে দীর্ঘাঙ্গী। শরীর কামড়ে ধরা ডেনিম আর লো-কাট গেঞ্জি পরে আছে। তাকাতেই হেসে উঠল সে। সাধারণত এরকম অপরূপ সুন্দরীদের দাঁত তেমন সুন্দর হয়না,কিন্তু এ মেয়েটির দাঁত ভারী সুন্দর।
শাদা,সুগঠিত দাঁতের হাসিটি মনে রাখার মতো। শ্বেতাঙ্গিনী বুঝাই যাচ্ছে,কিন্তু চুল তার সোনালী নয়,কালো। তাকাবনা তাকাবনা করে আবারো যখন তাকালাম তখন সেও চোখ তুলে তাকালো। চোখাচোখি হতেই আবারো সে হাসলো,তার অসাধারণ হাসি। এবং সৌজন্যবশত বললো,হাই!
প্রত্যুত্তরে আমিও বললাম,হ্যালো!
খানিকটা ইতস্তত করে সে বললো,'যদি কিছু মনে না করো তাহলে আমি কি তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারি?
আমি বললাম,'অবশ্যই পারো।
'
সে বললো,' তুমি কি ইন্ডিয়ান?'
-না,বাংলাদেশী।
-বাংলাদেশের কোথায়,ঢাকা?
-না,সিলেট,কিন্তু তুমি ঢাকা চেন?
-গল্প শুনেছি। আমার গ্রান্ড'পার বাড়িও সিলেট;কিন্তু তোমাদের রাজধানী শহর ঢাকার গল্প তিনি প্রায়শই করেন।
-আই সী,এ জন্যই।
-এ জন্যই কি! সে খানিকটা বিস্মিত।
-তোমার চুল কালো।
হাসতে বোধহয় সে ভালোবাসে তাই আবারো হাসলো। বাজ পড়ার আওয়াজের মতো কড়াৎ কড়াৎ শব্দে আবারো মেঘ ডেকে উঠলো,ঝিলকিয়ে উঠলো বিদ্যুৎ। বাতাসের বেগ তীব্র হয়ে উঠলো আর ঝমঝম শব্দে শুরু হলো বৃষ্টি। বৃষ্টির শব্দকে ছাপিয়ে এ সময় সশব্দে প্লাটফরমে এসে ঢুকলো আমাদের কাঙ্ক্ষিত 'এ" ট্রেন।
স্বয়ংক্রিয় দরজা খুলে গেলে আমি তাকে বললাম,'চলো ওঠা যাক। '
ভেতরে প্রবেশ করে আমরা দু'জন পাশাপাশি বসলাম। ট্রেন ছেড়ে দিল। ধীরে ধীরে ট্রেন প্রবেশ করছে টানেলে। সে বললো,'আমি অ্যানিটা,অ্যানিটা রোজমেরী।
'
-আমি রুদ্র,রুদ্র রাসেল।
-নাইস নেম।
-ধন্যবাদ! অ্যানিটা তুমি তোমার গ্রান্ডপার কথা বলো।
-আমার গ্রান্ডপা এসেছিলেন তোমাদের দেশ থেকে,তখন বোধহয় তোমাদের দেশের অন্য একটি নাম ছিল।
-ওটা আগে পাকিস্তানের একটি অংশ ছিল,পূর্ব পাকিস্তান।
-হ্যাঁ। পাকিস্তান। তো পাকিস্তানি একটি জাহাজ থেকেই নেমে পড়েছিলেন নিউইয়র্কে।
-বাহ! বেশ ইন্টারেস্টিং তো!
-ইন্টারেস্টিং এবং এডভেঞ্চারাস।
-এই গল্প নিশ্চয়ই একটি দীর্ঘ গল্প?
-তা বলতে পারো।
-তোমার সাথে আবারো দেখা হওয়া দরকার।
-সে ক্ষেত্রে আমার ঠিকাণা এবং সেল ফোন নম্বর রাখো। আমি এখানে কুইন্স লাইব্রেরীতে পার্ট টাইম কাজ করি। তোমার অফ ডে তে ওখানেও আসতে পারো।
আমি তারপরও তার ঠিকাণা ও সেল ফোন নম্বরটি নিয়ে নেই।
ভূগর্ভে ট্রেনটি ছুটে চলছে তার আপন গতিতে। উপরের পৃথিবীতে বৃষ্টি কি ঝড়ের দাপাদাপি কিছুই এখান থেকে বুঝার উপায় নেই। আমার সামনে আলোকিত ট্রেনের কামরা আর সুন্দরী মেয়েটি। তার শরীর থেকে ছুটে আসা সুগন্ধ,তার অসাধারণ প্রায় উন্মুক্ত দুটি স্তন আর তীব্র আকর্ষণীয় হাসির ঝলকে ঝলসে যাচ্ছে সকল সত্তা। মগজের কোষে কোষে তার তীব্র তীক্ষ্ন অনুরণন শুনতে পাচ্ছি আমি।
আমি বললাম, 'তোমার গ্রান্ডমা,তিনি কোথাকার?'
-তিনি ইটালিয়ান,ইটালিয়ান-আমেরিকান।
-তোমার বাবা তাহলে দুই মিশ্রণে তৈরি হয়েছেন?
সে রিন রিন শব্দে হেসে উঠলো। আমার মনে হলো চারপাশ আবারো যেন আলোকিত হয়ে উঠলো। সে হাসতে হাসতেই বললো,তুমি খুব মজার মানুষ রুড্র। তবে আমার পাপা খুব নাইস ম্যান,তুমি তার সাথে মিশলেই বুঝতে পারবে।
-আমার আগ্রহ বাড়ছে ।
-তুমি টেলিফোন করে চলে এসো।
-তোমার গ্রান্ডপা?
-তিনি এখনো জীবিত। তাকেও দেখতে পাবে তুমি।
-অবশ্যই আসবো।
বিশেষ করে তোমাকে দেখতে।
সে নিরবে হাসলো।
ট্রেন ম্যানহাটানের ৪২ স্ট্রিটে এসে থামলো। আমার গন্তবয় এসে যাওয়ায় আমি উঠে দাঁড়ালাম। সে বললো সে পরের স্টেশনে নামবে সুতরাং তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি নেমে পড়লাম।
অ্যানিটার সাথে কথা দিলেও তারপর কিভাবে যে দিন চলে যায়। কাজ আর কাজ। যান্ত্রিক এই জীবনের একমাত্র ধ্যান যেন এই কাজ নামক দানবের কাঁধে চড়ে তীব্র গতিতে ছুটে চলা। অসংখ্য স্কাইস্ক্যাপারের বিশাল ছায়ার নিচে নিজেকে হারিয়ে ফেলা। পরের সপ্তাহ নয় ,তার পরের সপ্তাহে আমি তার সেল ফোনে রিং দিলে ওপাশ থেকে তার সুরেলা কণ্ঠ ভেসে আসে,'হাই রুড্র! তুমি কোথায়? তোমাকে আমি কত যে খুঁজেছি।
তোমাকে আমার ফোন নম্বর দিয়েছি,অথচ তোমারটা নেইনি,কী বোকা আমি তাই না? এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে দম নিল অ্যনিটা।
আমি বললাম,'সত্যি দুঃখিত অ্যানিটা। আমারই যোগাযোগ করাটা উচিৎ ছিল। কিন্তু কাজের এই ঝামেলা----
-ঠিক আছে,এখন তুমি কোথায়?
-ম্যানহাটান।
-চলে এসো আমার লাইব্রেরীতে,এখান থেকেই তোমাকে নিয়ে বেরুবো।
অবশয় তোমার কোনো সমস্যা না হলে।
-ঠিক আছে,আমি রওয়ানা দিচ্ছি।
-অল দ্য বেস্ট!
-অল দ্য বেস্ট!টেক কেয়ার।
ম্যানহাটানের বিশাল বিশাল আকাশচুম্বি দালানগুলোর নিচে প্রশস্ত ফুটপাতে এখন রোদ ও ছায়ার খেলা। আমার কেন জানি খুব হাঁটতে ইচ্ছে করে।
হাঁটতে হাঁটতে সেই সুরম্য দালানটির কাছে এসে দাঁড়াই। যেটির বিশাল লনে নানা জাতের ফুলের সমারোহ। ছোট ছোট পাতার ঘনিষ্ঠতায় প্রগাঢ় গাছগুলো ছেটে দিয়ে বিভিন্ন জন্তুর আকৃতি দেয়া হয়েছে আর ফুলের অফুরন্ত সমারোহের ভেতর একটি উড়ন্ত শাদা ঘোড়ার ভাস্কর্য অপরূপ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। এই দৃশ্যটি দেখতে দেখতে কেন জানি আমার মনটা ভালো হয়ে যায়। ওপাশে অনেকগুলো বার্চ,ওক আর ম্যাপল গাছ জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে।
আমার মনটা কেন জানি হঠাৎ হঠাৎ-ই ছুটে যায় ফেলে আসা সেই শিউলি গাছটির পাশে। আমার ঘরের জানালা খুললেই সেই গাছটা চোখে পড়তো। চোখে পড়তো প্রত্যুষে হালকা কুয়াশার চাদরে ঢাকা পৃথিবীতে ভোরের স্নিগ্ধ বাতাস গায়ে মাখতে মাখতে শিউলি তলায় বসা কিশোরী তনিমাকে। একদা যে আমাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল আপাদমস্তক।
লনটা পেরুলেই আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনের সিঁড়ি।
সিঁড়ি ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে যতই পাতালে নামছি ততই বিস্ময় আর স্মৃতি একাকার হয়ে একটি জলরং বিমূর্ত চিত্রের মতো আমাকে ক্রমশই এক দুর্বোধ্য বোধের মধ্যে টেনে নেয়। মনে মনে প্রার্থনা করি খুব দ্রুত যেন আমি অ্যানিটার কাছে পৌঁছে যাই। প্রায় এক ঘন্টা পর যখন আমি কুইন্স লাইব্রেরীতে পৌঁছই তখন বিকেল চারটা। অ্যানিটা যে আমারই অপেক্ষায় ছিল,আমাকে দেখে তার মুখ উদ্ভাসিত হওয়া দেখেই বুঝা যায়। তাপানুকূলস্নিগ্ধ পরিবেশে থরে থরে সাজানো বইয়ের রাজ্যে অ্যানিটাকে অনেকটা নানদের মতো পবিত্র লাগে।
অ্যানিটা তার সামনের চেয়ারটি আমাকে দেখিয়ে বলে,বসো। আমি নির্ভেজাল এই সৌন্দর্যের সামনে অভিভূত হয়ে বসে থাকি। আমার মনে পড়ে যায় বত্তিচেল্লির আঁকা কিছু চিত্রের কথা। তিনি নিশ্চয়ই এরকম কাউকে সামনে বসিয়ে তার অসাধারণ চিত্রকর্মগুলো সম্পন্ন করেছিলেন। অ্যানিটা বোধহয় টের পায়।
বোধহয় কেন,যদ্দুর জানি এইসব ক্ষেত্রে নারীর তৃতীয় চক্ষু অধিক সচেতনই থাকে। সে বলে,কি ভাবছো?
আমি বলি,'কই কিছু নাতো! নাথিং ইমপোর্টেন্ট। '
(চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।